ইয়েমেনে একশত বিশ দিন - ৪
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পরবর্তী মসজিদ ‘দারে যাইন’ যাবার আগেই আমরা ঠিক করেছিলাম যে, এবার কোনোভাবেই স্থানীয় সাথীদের খেদমত নেব না। এজন্য মসজিদে এসেই খেদমতের সাথীরা বাজারে যাবেন বলে ঠিক হল। এখান থেকে বাজার মাত্র দুই কি.মি.। খেদমতের দুই সাথী চুপচাপ বাজারে চলে গেলেন। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। বাজারে যেয়ে তারা যখন তরিতরকারির দাম শুনছেন তখন এলাকার সাথীদের সঙ্গে দেখা। তারা হা হা করে উঠলেন। ইতোমধ্যেই তাদের বাজার হয়েছে, রান্নার কাজও চলছে। সুতরাং কোন কিছুই কেনা যাবে না। শেষ পর্যন্ত কিছু খেজুর, তরমুজ ও খিরা কিনে নিয়ে তারা মসজিদে ফিরে এলেন। ‘হাত পা যার বাঁধা তার পড়ে পড়ে মার খাওয়া ছাড়া আর কি উপায় আছে গোলাম হোসেন।’
এখানে অবস্থানকালীন তিনদিন তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু হল না। তবে লোকজন আগ্রহের সাথে দ্বীনী কথা শুনেছে। একটা খেলার মাঠে প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন ছেলে ফুটবল খেলছিল। সম্ভবত দু দলের মধ্যে ম্যাচ খেলা চলছিল। মাঠের বাইরে থেকে দলিল (রাহবার) সালাম দিতেই রেফারী খেলা বন্ধ করে দলবল নিয়ে আমাদের কাছে চলে এলেন। পুরা সময় সবাই চুপচাপ দাওয়াতের কথা শুনলেন। তারপর আমরা মসজিদে চলে এলাম, খেলা আবার শুরু হল।
এবার একটি সোজা ধাঁধাঁ। তালগাছের মাথা কয়টা হয়? সোজা উত্তর একটা। হয়ত কোন স্থানে ব্যতিক্রম দুইটাও হতে পারে। এখানে এমন গাছ খুবই কম আছে যার মাথা একটা। দুই, তিন, চারটা মাথা তো প্রায় প্রত্যেকটা গাছেরই। আমাদের মসজিদের কাছের একটি বাগানে মনে হল বেশী মাথাওয়ালা গাছ দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যার আগে আমি ও আটঘরিয়ার মিজান ভাই যেয়ে দেখি একটি গাছের আটটি মাথা। জমি থেকে একটা গাছ হাত খানিক উপরে যেয়ে চারটা ডাল হয়েছে এবং উপরে প্রত্যেক অংশে দুইটা করে ডাল হয়ে মোট আটটা মাথা। ওখান থেকে একটু দূরে অন্য এক বাগানে যেয়ে আমরা অবাক হতেও ভুলে গেলাম। মাটির উপরে উঠে গাছটি চার ভাগ হয়েছে এবং প্রত্যেক ভাগ উপরে উঠে আরও চার ভাগ হয়েছে। সর্বমোট ষোলটি মাথা।
এরপরের মসজিদ দারে খালাইয়া। বেশ বড় ও পুরাতন মসজিদ। পরে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। মসজিদে পানির ট্যাঙ্কি নষ্ট। আমরা চিন্তায় পড়ে গেলাম, কিন্তু সমাধান হতে বেশী সময় লাগল না। এক সাথী মোটর সাইকেল চালিয়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে গাধার পিঠের দুই পাশে দুইটি করে মোট চল্লিশ গ্যালন পানি নিয়ে ছোট ছোট মেয়েরা এসে হাজির। বড় ড্রামে পানি ঢেলে রেখে বাচ্চাগুলো আবার গাধার পিঠে রওয়ানা হল। এর মধ্যে মোটর সাইকেলে খাওয়ার পানি ভরা ট্যাঙ্কি নিয়ে আমাদের সাথীও ফিরে এলেন। সব মসজিদের এলাকাতেই দশটা থেকে বারটার মধ্যেই বরফ নিয়ে ট্রাক আসে। যার যা প্রয়োজন বরফের চাঁই নিয়ে খাওয়ার পানির ট্যাংকিতে ছেড়ে দেয়। সারাদিন রাত বরফ গলানো ঠান্ডা পানি খেতে বড় আরাম লাগে।
হঠাৎ একটি ফুটফুটে মেয়ে পলিথিনের প্যাকেটে আমাদের জন্য তুলসি পাতার মতো কয়েকটি গুল্ম গাছের পাতাসহ ছোট ছোট ডাল নিয়ে এল। জিজ্ঞেস করে জানলাম এটা রাইয়ান গাছের ডাল ও ফুল। বেশ সুগন্ধি। খুব যত্ন করে রেখে দিলাম।
দুপুরে বিয়েবাড়িতে দাওয়াত। এই সুযোগে এ দেশের বিয়ের কিছু খণ্ড চিত্র দেখার সুযোগ হল।। মেয়েরা এখানে পিতামাতার গলগ্রহ নয়। মেয়ের বিয়েতে বাপ মায়ের দুশ্চিন্তা নেই। মেয়েরা প্রচুর নগদ মোহরানা পায়। কনের কাপড়-চোপড় সহ অলঙ্কারাদি, প্রসাধনি এবং ওলিমার যাবতীয় খরচ বরকেই দিতে হয়। বিয়ে বাড়িতে কোন সাজসজ্জা নেই। যেখানে মেহমানদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে তার পাশেই একটা টং-এর মতো ঘর। দেয়ালের জংলা গাছ-গাছরার মধ্যে তিলের গাছও দেখলাম। অন্যসব বাড়িতে দেখা ঘরের মতোই গোল করে গাছ-গাছড়া দিয়ে ছাওয়া। সম্মুখে ঢোকার একটি জায়গা-একে দরজাও বলা যেতে পারে। এটাই হল বরবধূর বাসর ঘর। রাত্রে একটি পর্দা অথবা চাদর দরজায় টাংগানো হবে। আর কোন কিছুই নেই। বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত নতুন দম্পতি এই ঘরে থাকবে। বাচ্চা হলে পাশেই নিজের পাকা ঘরে স্বামী স্ত্রী পার হবে। জানতে চাইলাম, এই পুরাতন ঘরের রহস্য কী? সে জানাল, ঘরটা তার দাদার। তাই এটা পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে। এটা শুধু ওর একার ক্ষেত্রে নয়; বরং সামাজিকভাবেই ওরা প্রায় সবাই এটা মেনে চলার চেষ্টা করে থাকে।
বরের বাড়িতেই দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছোট বড় সব ধরনের পুরুষ মানুষ দাওয়াতের খানা খেল। কিন্তু একটা ছোট্ট মেয়েকেও সেখানে দেখলাম না। গান বাজনা বা হৈ চৈ নেই। পোলাও-এর উপরে রাংতায় মোড়া গোশত ও বাটিতে সুপ। সবার জন্য একই রকম খাবারের ব্যবস্থা। শুনলাম, বর বিয়ে করতে যাবে রাত দশটায়। মনে মনে বরের বিয়ের সাজ দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। এশার নামাযের পর বিয়েবাড়িতে যেয়ে দেখি ওখানেই একটা খাটে বর বসে আছে। খাটের উপর একটা নতুন কম্বল বিছানো, তার উপর দুই ধারে চারটা করে আটটা বালিস। এসব খাটিয়ার প্রত্যেকটিতে একজন করে বসতে হয়। দেখলাম একদিকের বালিশে হেলান দিয়ে বর বসে আছে, অপর দিকের বালিশের সঙ্গে একটা ক্লাসিনকভ (এ,কে-৪৭)-রাইফেল হেলান দিয়ে রাখা। এখানে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই এ অস্ত্রটা আছে। বাড়িতে একটা বন্দুক থাকলে তা নিয়ে আমাদের যত সতর্কতা এদের তাও নেই। একটা লাঠি পড়ে থাকা আর রাইফেল পড়ে থাকা মনে হল একই রকম। ছোট ছোট ছেলেরা ঘুরাঘুরি করছে। তারাও ওদিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।
বর উঠে এসে আমাদের সঙ্গে বসে গল্প করল। দুপুরের পোশাকের সঙ্গে পার্থক্য যা দেখলাম তা হল, মেহেদী দিয়ে সারা শরীর ডলে নিয়ে গোসল করেছে। হালকা মেহেদীর রং টের পাওয়া যাচ্ছে। দুপুরের মতই একটা পুরাতন শার্ট ও লুঙ্গি পরা। মাথায় টুপির উপর সাধারণ একটা রুমাল পাগড়ির মতো পেঁচানো। নতুনের মধ্যে শুধু একটি মস্ত বড় বেলী ফুলের মালা। প্রায় হাঁটু পর্যন্ত লম্বা। বিয়ের পর বর কনেকে এই মালাটাই পরিয়ে দিবে। মেয়ের বাড়িতে বরযাত্রীদের জন্য খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা নেই। বর যাবে,বিয়ে পড়ানো হবে, তারপর বরকনেসহ সবাই বাড়ি চলে আসবে। শুনেছি অধিকাংশ বিয়ের ক্ষেত্রেই একই রকম চিত্র।
শরীয়ত মোতাবেক একসঙ্গে সর্বোচ্চ চারটা বিয়ে করার জন্য এদেশে কোনো বিধি-নিষেধ নেই। বিশেষত মেয়েদের পক্ষ থেকে তো একদমই নেই। স্বামীর সংসার এদেশের মেয়েদের জীবনের সব কিছু।
একটা জিনিস আমার কাছে খুব সুন্দর লাগল। হায়াতুস সাহাবাতে সাহাবীদের যে রকম সহজ সরল জীবনের ছবি দেখেছি, ইয়েমেনের জীবন্তযাত্রায় যেন তার বাস্তব প্রতিচ্ছবি ইতিহাস যেন বাস্তব হয়ে ধরা দিচ্ছে। চৌদ্দশত বছর পরও সাহাবীওয়ালা যিন্দেগী নিয়ে চলা যে সম্ভব তার বাস্তব নমুনা এখানে দেখতে পেয়েছি নাই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, নাই উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ, নাই ধনী-দরিদ্রের সামাজিকতার মধ্যে তৈরি করা কোনো কৃত্রিম দেয়াল। পোশাকের বাহুল্য নেই, কৃত্রিমতার চোখ ধাঁধানো জৌলুস নেই, মিথ্যাকে সত্য দিয়ে ঢাকার অপপ্রয়াস নাই, এমনকি ছলনা দিয়ে শান্ত্বনা দেওয়া বা মন ভুলানোর প্রবণতাও অনুপসি'ত। আল্লাহর দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া জানালাম যে, তিনি মেহেরবানী করে ইয়েমেনের এই পল্লী গাঁয়ে আমার মতো একজন অতি সাধারণ মানুষকে এনেছেন। তাই ইসলামের সেই মন মাতানো চিরসুন্দর, চিরসবুজ জীবনের কিছু আলো মনের মনিকোঠায় জমা করতে পারলাম আলহামদুলিল্লাহ।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য জাহারে মদীনা। প্রথম বিশ দিনের রোখ ছিল মরুভূমিতে। বালিয়াড়ির সমুদ্র অতিক্রম করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাওয়াতের মেহনত করেছি। হাঁটতে যেয়ে বালুতে পা বসে গেলে মনে হয়েছে, আল্লাহর হাবীব এরকম মরুভূমিতেই মেষ চরিয়েছেন। নবুওয়ত লাভের পর কুফরের অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন তবুও ক্লান্ত হননি। কাফেরদের দ্বারা নিপীড়িত হয়েছেন তবুও মুখ ফিরিয়ে নেননি। দিবসের মেহনতের পর রাত জেগে আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করেছেন। যারা তাঁকে অবহেলা করেছে, ঘৃণা ও অপমান করেছে তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চেয়েছেন।
দুপুরের প্রখর রোদে মরুভূমির বালু যখন উত্তপ্ত হয়ে উঠত এবং সে বালু পায়ে লাগলে মাথা পর্যন্ত তার তেজ অনুভূত হত তখন মনে পড়ত, এর চেয়েও অনেক বেশি উত্তপ্ত বালুকারাশিতে হযরত বেলাল রা. ও হযরত খাব্বাব রা.কে শুইয়ে রাখা হত। আর বুকের উপর চাপিয়ে দেওয়া হত ভারি পাথর। তবুও তাঁরা ঈমান ও তাওহীদ পরিত্যাগ করেননি। মৃত্যুর পূর্বেই তাঁরা কেন ‘রাযিয়াল্লাহু আনহু’ উপাধি লাভ করেছেন তা একটু হলেও বুঝতে পেরেছি। ষ
(চলবে ইনশাআল্লাহ)