জীবন দিয়ে
একজন মুসলমান আপন ধর্মে যে কত অবিচল থাকতে পারেন, পার্থিব জীবনের ভোগ-বিলাস যে তাদের কাছে কত তুচ্ছ হতে পারে তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন লাখো সাহাবী। দুনিয়ার সুখকে তারা ভেবেছিলেন এক মুঠো ধূলো। মৃত্যুকে ভেবেছিলেন বিধাতার দেওয়া শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তবে সে মৃত্যু কাফেরী মৃত্যু নয়, ভীতুর মৃত্যু নয়, মৃত্যু বলতে ইসলামের পতাকাকে শক্ত হাতে তুলে ধরতে শরীরের শেষ রক্তবিন্দুকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করা অর্থাৎ শহীদী মৃত্যু। শাহাদাত হল মহান পুণ্য যা অর্জন করেছিলেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনেক সাহাবী। তার মধ্যে একজন ছিলেন হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের রা.। যিনি মক্কার এক সম্পদশালী ব্যক্তির আদরের দুলাল ছিলেন। তার পিতা তাকে এত ভালোবাসতেন যে, তাকে দুইশ দেরহাম মূল্যের কাপড় কিনে পরাতেন। দুইশ দেরহামের তৎকালীন আরবে অনেক দাম ছিল। মুসআব রা. খুব শান-শওকতের ভিতর লালিত পালিত হয়েছিলেন। ইসলামের প্রথম পর্যায়ে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণ করার কিছুদিন পর পরিবারের লোকজন একমত হয়ে তাকে ঘরে বন্দী করে রাখলেন। কিন্তু মুসআব রা. একদিন সুযোগ পেয়ে পালিয়ে গেলেন। প্রথমে হিজরতকারী দলের সঙ্গে মিলিত হয়ে হাবশায় হিজরত করেন এবং অনেক দুর্দশার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করতে থাকলেন। এরপর তিনি মদীনায় একদিন তার সাথে নবী করীমের সাক্ষাৎ হল। তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখেলেন তার পরনে বহু তালিযুক্ত একটি মাত্র চাদর। আর ওই চাদরের কোনো জায়গায় চামড়ারও তালি ছিল। তা দেখে মসআব রা.-এর আগের অবস্থা তার স্মরণ হয়ে গেলএবং দয়ার নবীর দু'চোখ অশ্রুতে ভরে গেল।
হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের মুলমানদের ঐতিহাসিক উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং উহুদ যুদ্ধে মুহাজিরদের পতাকা তার হাতেই ছিল। যুদ্ধে যখন মুসলমানদের বিপর্যয় দেখা দিল তখনও তিনি পতাকা হাতে অটল ছিলেন। জনৈক কাফের তরবারী দিয়ে মুসআব রা.-এর ডান হাতে আঘাত করলে তার ডান হাত কেটে মাটিতে পড়ে গেল। তখন তিনি মুহূর্তের মধ্যে বাম হাত দ্বারা পতাকা সামলে নিলেন। তবুও পতাকা নিচে পড়তে দিলেন না। নিষ্ঠুর কাফের তার বাম হাতেও আঘাত করল এবং তার বাম হাতও কেটে মাটিতে পড়ে গেল। তখন মুসআব রা. তার উভয় বাহু দ্বারা বুকে চেপে লাঠির সাথে জড়িত ইসলামের পতাকাকে উঁচু করে রাখলেন। কিন্তু পাষণ্ড কাফের তার দুই হাত কেটেই ক্ষান্ত হয়নি, সে এবার মুছআব রা.-কে লক্ষ করে তীর মারলো আর ঐ তীরটি মুসআব - জড়িত লাঠিকে তিনি মাটিতে পড়তে দিলেন না। সঙ্গে সঙ্গে অন্য মুজাহিদ এসে পতাকা সামলে নিলেন। হযরত মুসআব রা. কে দাফন করার সময় একটি মাত্র চাদর ছাড়া আর কিছু ছিল না। ওই চাদর এত ছোট ছিল যে, তা সারা শরীর ঢাকার জন্য যথেষ্ট ছিল না। মাথা ঢাকলে পা ঢাকা হয় না আবার পা ঢাকলে মাথা ঢাকা হয় না। তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে মাথার দিক চাদর দ্বারা আবৃত করা হল আর পায়ের দিকে ঘাস ছড়িয়ে। সেই দুইশত দিরহামের মহামূল্য কাপড়ের জোড়া পরিধানকারী ধনাঢ্য ব্যক্তির আদরের দুলালের এই হল কাফনের অবস্থা। প্রকৃতপক্ষে তাঁদের অন্তরে ঈমান এমনিভাবে দানা বেঁধেছিল যে, পার্থিব যে কোনো প্রকার আরাম-আয়েশকে ইসলামের পথে তারা তুচ্ছ মনে করতেন।