মুহাররাম ১৪৩২   ||   ডিসেম্বর ২০১০

তালিবানে ইলমের উদ্দেশে : তোমরা কে, তোমরা কী, তোমাদের গন্তব্য কোথায় - ৪

মাওলানা মানযূর নো‘মানী রাহ.

 

অনুবাদ : মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

 

ইলমের প্রতি প্রেমনিমগ্নতা ও আত্মনিবেদন

আমার পেয়ারে ভাই! আমার নূরে নযর! আমার কালবো জিগার! তোমাদের প্রতি আমার দ্বিতীয় নছীহত এই যে, ইলমে দ্বীন সেই হাছিল করতে পারে এবং  কোরআন্তসুন্নাহর জ্ঞান সেই অর্জন করতে পারে যার অন্তরে রয়েছে ইলমের মুহব্বত এবং জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা; যার দিলে রয়েছে ইলমের পিপাসা এবং জ্ঞানের তৃষ্ণা। ইলম তার ভিতরেই ঘর করবে যে ইলমের জন্য সবরকমের মেহনত মোজাহাদা করতে তৈয়ার থাকবে। জ্ঞান তাকেই সান্নিধ্য দান করবে যে জ্ঞানের জন্য সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকবে।

দেখুন ভাই! মাদরাসার উছূল-কানুন মেলে চলা, উস্‌তাযের সঙ্গে নিয়ম ও যাবেতার সম্পর্ক রক্ষা করা, সবক পড়া, পরীক্ষা দেয়া, পাশ করে সনদ নেয়া- এগুলো আসল কাজ নয়। এভাবে গড়পড়তা মাওলানা হয়ত হওয়া যায়, সত্যিকারের আলিমে দ্বীন ও ওয়ারিছে নবী হওয়ার জন্য লাগে অন্য কিছু। সে জন্য লাগে মাজনুর দিল এবং ফারহাদের ইশক।

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ইলম দুনিয়াতে এনেছেন এবং যে দ্বীন ও শরীআত রেখে গেছেন তার বিরাছাত ও উত্তরাধিকার লাভ করা এবং তার নিয়াবাত ও প্রতিনিধিত্ব-গৌরব অর্জন করা, এটা তো এমনই বিরাট নিয়ামত এবং এমনই অমূল্য সম্পদ যে, এজন্য চাই অনন্যসাধারণ এক প্রেমনিমগ্নতা। এজন্য চাই এমন ত্যাগ ও আত্মত্যাগ যার উদাহরণ আমাদের পূর্ববর্তীগণ আমাদের জন্য রেখে গেছেন। এই প্রেম ও ভালোবাসা, এই নিমগ্নতা ও তন্ময়তা এবং এই ত্যাগ ও আত্মত্যাগ যখন আপনার মধ্যে কিছু পরিমাণে হলেও আসবে তখনই আপনার উপলব্ধি হবে যে, কত বড় নিয়ামত এবং কত বিরাট সম্পদ আপনি অর্জন করতে যাচ্ছেন, কোন মহাধনে আপনি ধনী হতে চলেছেন। তখন আপনার ভিতরের হালাতে ইনশাআল্লাহ অনেক পরিবর্তন হবে, আপনি তখন অন্য মানুষ হয়ে যাবেন। আপনাকে যে দেখবে সেই বলবে, ঐ যে ইলমের আশিক, ইলমের সাচ্চা মাজনু!

এখন তো ইলমের জন্য সেই রকম মেহনত-মোজাহাদার যামানাই বাকি থাকেনি। সময়ের পবির্তনে, দ্বীনী মাদারিসের উপস্থিতি ও সংখ্যা-প্রাচুর্যের কারণে ইলম হাছিল করা এখন তো খুব সহজ হয়ে গেছে। যামানা তো এমন ছিলো যে, আল্লাহর বান্দাগণ ইলমের সন্ধানে দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে যেতেন; এমনকি একটি মাত্র হাদীছের খোঁজে হাজার হাজার মাইল সফর করতেন। তখন তো রেলগাড়ী ছিলো না, মোটরগাড়ী ছিলো না, জাহায ছিলো না, বিমান ছিলো না, আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার কথা কারো কল্পনায়ও ছিলো না। ইলমের আশিক ইলমের তালাশে বের হতেন উটের পিঠে সওয়ার হয়ে, কিংবা শুধু পায়ে হেঁটে। ইলমের প্রতি মুহব্বত পথের সমস্ত  কষ্ট তাদের জন্য সহজ করে দিতো। দূর অতীতের কথা না হয় থাক। ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আবুহানীফা (রাহ,)-এর কথা, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রাহ.)-এর কথা, ইমাম গায্‌যালী, আল্লামা ইবনুল জাওযী, আল্লামা শাওকানী (রাহ.)-এর কথা, সে-সব যুগের  সে-সকল আলোকপ্রদীপের কথা না হয় থাক। নিকট অতীতের কথাই শুনুন। এখানেও ইলমের প্রতি ফানাইয়্যাত ও আত্মনিবেদনের এমন সব বিস্ময়কর কাহিনী রয়েছে যে আকল হায়রান হয়ে যায়! সুবহানাল্লাহ, কেমন আশিক ছিলেন তাঁরা ইলমের! কেমন আত্মনিবেদন ছিলো ইলমের প্রতি তাঁদের!

একজনের কথা শুনেছি; তিনি দিল্লীতে হাদীছ পড়তেন। দিল্লী ছিলো ইলমে হাদীছের মারকায। কিন্তু তখন সেখানে এখনকার মত মাদরাসা ছিলো না, যেখানে প্রায় সবরকম  চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা থাকে, তবু অভিযোগ ও শিকায়াতের কোন হদ থাকে না। তখনকার তালিবে ইলমরা তো তেলের চেরাগও পেতো না। নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হতো। যাদের তেল কেনার পয়সা ছিলো না তারা কখনো পূর্ণিমার আলোতে কিতাব পড়তো, বিশ্বাস করুন, আমি গল্প বলছি না, আমি যার কথা শুনেছি, তিনি কখনো পূর্ণিমার আলোতে কিতাব পড়তেন, কখনো পড়তেন রাস্তার সরকারী লণ্ঠনের আলোতে। তবু তিনি পড়তেন, ইলমের প্রতি ইশকের তাগিদে, জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসার টানে। প্রেম ও ভালোবাসা ছাড়া এটা কখনো হয় না, হতে পারে না। এই ইশক ও মুহব্বতেরই তো ফসল হলেন হযরত নানতুবী (রাহ.), হযরত গাঙ্গোহী (রাহ.), হযরত শায়খুল হিন্দ (রাহ.), হযরত শায়খুল ইসলাম হোসায়ন আহমদ মাদানী (রাহ.) হযরত হাকীমুল উম্মত থানবী (রাহ.), হযরত মাওলানা মুহম্মদ ইলয়াস (রাহ.) ও অন্যান্য। আল্লাহ তাঁদের সবার তুরবত ঠাণ্ডা রাখুন, আমীন।

তো আমার পেয়ারে ভাই! তোমাদের প্রতি আমার দ্বিতীয় নছীহত এটাই যে, ইলমে নববীর যে মহান উত্তরাধিকার তোমরা হাছিল করতে চাও সে পথে নিজেকে ফানা করে দাও, একজন আশিক ও প্রেমিক যেভাবে তার মাহবূবের জন্য সবকিছু ফানা করে দেয়। এমনিতে নিয়মের যে লেখা-পড়া ও পরীক্ষা এবং মাওলানা হওয়ার  যে সনদ, তো তুমি নিজেও জানো যে, দুনিয়ার নযরে এর কোন মূল্য নেই। সুতরাং সেই ইলম হাছিল করো যার মাধ্যমে দুনিয়ার সামনে তুমি নিজেই হয়ে যাবে দ্বীনের সনদ, ইলমের সনদ।

ইলমের রূহ তাকওয়া

আমার পেয়ারে ভাই! এর পর আমার তৃতীয় নছীহত বা আবেদন এই যে, একথা তো বারবার বলা হয়েছে এবং আশা করি, আপনারাও হৃদয়ঙ্গম করেছেন যে, কোরআন ও সুন্নাহর ইলম হচ্ছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মীরাছ বা উত্তরাধিকার সম্পদ, আর উম্মতকে দ্বীনের উপর পরিচালিত করার যে নবুয়তি দায়িত্ব, সেই দায়িত্বের নিয়াবত বা প্রতিনিধিত্ব করা, এটা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার অতি খাছ নিয়ামত। তো এই রূহানী সম্পদ ও নিয়ামত শুধু মেধা ও প্রতিভা দ্বারা এবং শুধু মেহনত ও পরিশ্রম দ্বারা অর্জন করা কিছুতেই সম্ভব নয়। দুনিয়ার অন্যান্য জ্ঞান্তবিজ্ঞান শিক্ষা করা এং তাতে কামাল ও পূর্ণতা অর্জন করা মেধা ও মেহনত দ্বারা সম্ভব হলে হতেও পারে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেখে যাওয়া ইলম হচ্ছে এক আসমানি নূর, আর নবীর বিরাছাত ও নিয়াবাত হচ্ছে এক আসমানি মর্যাদা। সুতরাং এটা অর্জন করার জন্য মেধা ও মেহনত ছাড়াও আরেকটি জিনিস হচ্ছে অপরিহার্য শর্ত। সেটা হচ্ছে কলবের তাকওয়া। তাকওয়া ছাড়া ইলমের নূর এবং বিরাছাতে নবীর মর্যাদা হাছিল হওয়া অসম্ভব।

তাকওয়ার খোলাছা মতলব হচ্ছে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করা এবং আল্লাহকে মুহব্বত করা। আল্লাহকে ভয় করে এবং আল্লাহকে মুহব্বত করে তাঁর আদেশ-নিষেধ পূর্ণরূপে মেনে চলার চেষ্টা করা। এটাই হলো তাকওয়া, যার কথা কোরআনে হাদীছে বারবার বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে। এমন জীবন গড়ে তোলার চেষ্টা করুন যাতে রয়েছে তাকওয়ার পাকিযিগি ও পবিত্রতা, যাতে রয়েছে আল্লাহর সঙ্গে তাআল্লুকের তাজাল্লি ও জ্যোতির্ময়তা।

আল্লাহ তাআলা যে আমাদের

জন্য বিভিন্ন ইবাদত নির্ধারণ করেছেন, যেমন নামায, রোযা, তিলাওয়াত, যিকির ইত্যাদি, এগুলো হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে তাআল্লুক বা সম্পর্ক স্থাপনের বিশেষ মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা যেহেতু বান্দাকে মুহব্বত করেন সেহেতু তিনি বান্দাকে তার সঙ্গে তাআল্লুক পয়দা করার মাধ্যম দান করেছেন। তবে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, আমার নামায-রোযা, আমার যিকির ও তিলাওয়াত এবং আমার অন্যান্য ইবাদত তখনই আল্লাহর সঙ্গে আমার খাছ তাআল্লুক পয়দা করতে সক্ষম হবে যখন সেগুলো জানদার হবে; আমাদের ইবাদত যখন ছূরত না হয়ে হাকীকত হবে। ছুরত এক জিনিস, হাকীকত অন্য জিনিস। রন্ধন্ত প্রণালী শিক্ষার বই দেখেছি, সেখানে বিভিন্ন খাবারের সাজানো ডিসের ছবি আছে, কিন্তু তাতে কি স্বাদ আছে? তাতে কি ক্ষুধা দূর হয়? হয় না, কারণ এগুলো খাদ্য নয়, খাদ্যের ছবি মাত্র। আসল খাদ্য যখন তোমার সামনে রাখা হবে তখন তার ঘ্রাণেও স্বাদ, মুখে দিলেও স্বাদ, আবার তা ক্ষুধাও দূর করবে। ছবি ও হাকীকতের এই হলো পার্থক্য। তো আমাদের ইবাদত যেন রসমের ইবাদত না হয়, শুধু বাহ্যিক আকার-আকৃতির ইবাদত না হয়। তাতে যেন রূহ ও হাকীকত থাকে। তাহলেই ইবাদত দ্বারা আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক ও ভালোবাসা সৃষ্টি হবে, খালিকের সঙ্গে মাখলূকের তাআল্লুক ও মুহব্বত পয়দা হবে।

এই সফরে কয়েক দিন ধরে আমি গুজরাটেরই বিভিন্ন মাদরাসায় ঘুরছি। আমি দেখেছি, দেখে খুশী হয়েছি, ফজরের জামাতে তালিবানে ইলমের হাযিরিতে মসজিদ ভরে যায়। দিল-কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ফজরের পর সবাই কোরআন তিলাওয়াতে মশগুল হয়ে যায়। তিলাওয়াতের দৃশ্য যেমন সুখকর তেমনি তার আওয়ায ও ধ্বনি-গুঞ্জনও শ্রুতিমধুর। আলহামদু লিল্লাহ অবশ্যই এটি শোকরের বিষয়। কিন্তু আল্লাহর ওয়াস্তে একবার ভেবে দেখুন, আমাদের নামায ও তিলাওয়াত কি তেমন হয় যেমন হওয়ার কথা তালিবানে ইলমের। আমাদের নামায-তিলাওয়াতে কি সেই রূহ ও হাকীকত রয়েছে যেমন থাকার কথা ওয়ারিছীনে নবীর নামাযে, তিলাওয়াতে? যদি তাই হয় তাহলে তো বড় আনন্দ ও সৌভাগ্যের কথা। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা এই যে, আমাদের দ্বীনী মাদারিসের তালিবানে ইলমের নামায ও তিলাওয়াত সাধারণ মুসলমানদের নামায-তিলাওয়াত থেকে কিছুমাত্র উন্নত নয়, যারা সূরা-ক্কিরাতের অর্থ জানে না, ছানা-তাছবীহ ও তাকবীরের মর্ম বোঝে না। আমাদের নামায ও তাদের নামায একেবারে এক- রকম, কোন পার্থক্য নেই, বরং হয়ত তাদের নামায-তিলাওয়াত আমাদের চেয়ে উত্তম।

কেমন হবে আমাদের নামায-তিলওয়াত?

আমার পেয়ারে ভাই! হয়ত আপনারা মিশকাত শরীফে এই হাদীছটি পড়েছেন

إذا قام أحدكم يصلي فإنه يناجي ربه

 

 

তোমাদের কেউ যখন ছালাত আদায় করে তখন আসলে সে তার প্রতিপালকের সঙ্গে আলাপকরে (এবং তার মনের কথা বলে।)

হয়ত সেই হাদীছটিও পড়েছেন যাতে বলা হয়েছে-

নামাযে বান্দা যখন সূরা ফাতিহা পড়ে তখন প্রতিটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা সাড়া দেন। যখন বান্দা বলে-

الحمد لله رب العلمين

 

তখন আল্লাহ তাআলা বলেন

حمدني عبدي

 

(আমার বান্দা আমার হামদকরেছে।)

বান্দা যখন বলে-

الرحمن الرحيم

 

তখন আল্লাহ বলেন

أثنى علي عبدي

 

(আমার বান্দা আমার গুণ বর্ণনা করেছে।)

বান্দা যখন বলে-

مالك يوم الدين

 

তখন আল্লাহ বলেন

مجدني عبدي

 

(আমার বান্দা আমার গৌরব বর্ণনা করেছে।)

সুতরাং আল্লাহর ওয়াস্তে ভেবে দেখুন, যারা এই হাদীছ পড়েছেন এবং ইলমে দ্বীনের এই স্তরে পৌঁছেছেন যে, নামাযে পঠিত বিষয়ের অর্থ ও মর্ম হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন, তাদের নামায যদি ঐ লোকদের মত হয় যারা হাদীছ জানে না, আয়াতের অর্থ বোঝে না তাহলে তা কতটা মর্মানি-ক! তাদের জন্য তা কত বড় ক্ষতি ও খাসারার কারণ! নামায পড়েও আসলে তারা নিজেদের উপর কত বড় যুলুম ও অবিচার করছেন। এমন নামাযের মিছাল তো ঐ লোকের মত যার কাছে তার প্রিয়তমের পত্র আছে কিন্তু সে পত্রটির কথা ভুলেই গেলো। কখনো পড়ে দেখলো না যে, প্রিয়তম তাকে সম্বোধন করে কী লিখেছে!

আমার পেয়ারে ভাই! আল্লাহ তাআলা তো আপনাদেরকে এমন নামায পড়ার সৌভাগ্য দান করেছেন যে, আপনারা নামায পড়বেন, আর আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কথা বলার স্বাদ গ্রহণ করবেন। আপনারাই বলুন, আল্লাহর সঙ্গে আলাপওয়ালা নামায কেমন স্বাদের নামায হতে পারে! ষ

 

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement