দাওয়াত ও তাবলীগের জন্য মাদরাসার অস্তিত্ব জরুরি
ফেনী শহরের ধমীর্য় অঙ্গনে সুফী আব্দুল গনী সাহেব একটি উল্লেখযোগ্য নাম। আলেম-ওলামা ইংরেজি শিক্ষিত ও ব্যবসায়ী মহলে তার বেশ সুনাম রয়েছে। ফেনী বাজারে ছোট একটি কাপড়ের দোকান ছিল। যেকোনো নামাজের আজান হওয়ামাত্র প্রস্তুতির জন্য তার দোকানটি বন্ধ হয়ে যেত। মালিক-কর্মচারী সবাই একসাথে বড় মসজিদে গিয়ে জামাতে নামায আদায় করতেন। ক্রেতার ভিড় যতই থাকুক না কেন তার দোকান অবশ্যই বন্ধ হয়ে যেত। ক্রেতাদেরকে বলা হত, আজান হয়ে গেছে, এখন বেচা-বিক্রি হবে না। আপনাদের ইচ্ছা হলে নামাজের পর আসতে পারেন। আর নামায তো আপনাদেরও পড়তে হবে, তাই চলুন না, একসঙ্গে নামাযটা পড়েই আসি।
সম্ভবত সুফী সাহেবের মুখেই শুনেছি, তিনি একসময় কুলি ছিলেন। শহরের উত্তর পার্শ্বে নির্মিত বিমান বন্দরের পাশেই তাঁর পৈত্রিক বাড়ি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ সেনাদের অস্ত্রশস্ত্র ও মালামাল এই বিমানবন্দর দিয়েই আনা-নেওয়া হত। সেই সুবাদে সুফী সাহেব সেখানে কুলিগিরি করে কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে হালাল জীবিকা উপার্জন করতেন। কোনো এক আল্লাহর বান্দা তাঁকে দাওয়াত দিয়ে মসজিদে নিয়ে তাবলীগের কিছু বয়ান শুনালেন। এ থেকেই তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন শুরু হল।
বছরের অধিকাংশ সময় তিনি তাবলীগের উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে সফরে থাকতেন। দোকানের ম্যানেজার সাহেব দোকান ও তাঁর সংসারের যাবতীয় প্রয়োজন মিটিয়ে তাঁর জন্য টাকা জমিয়ে রাখতেন, যা দ্বারা তিনি বর্তমান কোর্ট বিল্ডিং-এর পার্শ্বে অনেক জায়গা খরিদ করে রেখেছিলেন। এখন সেখানে কোর্ট ভবন হওয়ার কারণে এ সকল জমি কোটি টাকার সম্পদে পরিণত হয়েছে। তিনি সেখানে একটি মসজিদও বানিয়েছেন। মেয়েদেরকেও আলিমের কাছে বিয়ে দিয়েছেন। এক সুন্দর দ্বীনী পরিবেশ তাঁর জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। বর্তমানে বার্ধক্যের কারণে চলাফেরায় খুব কষ্ট হয়। তারপরও ফেনী জেলা তাবলীগ জামাতের আমীর হিসাবে তিনি দাওয়াতের কাজেই নিয়োজিত রয়েছেন।
সূফী সাহেবের মুখেই শুনেছি, পাকিস্তান আমলে তিনি একবার তাবলীগ সফরে আরব রাষ্ট্র জর্ডান গিয়েছিলেন। জর্ডানের রাজধানী আম্মান শহরের প্রধান মসজিদে দেখলেন, খুব সুন্দর মধুর স্বরে আজান হচ্ছে। মুয়াজ্জিন কে এবং কোথা থেকে আজান দিচ্ছে জানতে গিয়ে তিনি দেখলেন, মুয়াজ্জিন সাহেব রেকর্ডকৃত আজান মাইকে লাগিয়ে দিয়ে আজানের ব্যবস্থা করেছেন। এতে সূফী সাহেব আশ্চর্যান্বিত হয়ে মুয়াজ্জিন সাহেবকে বললেন, এত ফযীলতের কাজ আপনি মুখে না দিয়ে টেপ দিয়ে দিচ্ছেন কেন? মুয়াজ্জিন সাহেব বললেন, রাখুন তো আপনার ফযীলত। পঁচিশ বছর পর্যন্ত আজান দিচ্ছি আর কত দেওয়া যায়? তাই এখন রেকর্ডকৃত আজানই মাইকে লাগিয়ে দেই।
সূফী সাহেব আরেকটি ঘটনাও বললেন, মসজিদেই অনেক সময় মৃত ব্যক্তির জানাযার নামায হত। দেখা যেত, মৃতের সঙ্গে আসা আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই জানাযায় শরীক না হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সূফী সাহেব তাদেরকে নামাজে শরীক না হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলত, শরীর ও কাপড় পাক নেই, তাই নামাজে শরীক হইনি।
জর্ডানের পাশের রাষ্ট্র হচ্ছে লেবানন। লেবাননের রাজধানী বৈরুতে তখন আমেরিকান সিআইএ-র এশিয়ান হেড্ কোয়ার্টার ছিল। ফলে সিআইএ-র ষড়যন্ত্রে আরবের এই দু-টি দেশ উলঙ্গতা ও অনৈসলামিক কাজের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। সূফী সাহেব বললেন, একজন খ্রিষ্টান পাদ্রীকে আমি প্রশ্ন করলাম, কত বছর থেকে আপনি এখানে আছেন? পাদ্রী বলল, পঁচিশ বছর। সূফী সাহেব আবার প্রশ্ন করলেন, কতজনকে খ্রিষ্টান বানিয়েছেন? পাদ্রী উত্তরে বলল, একজনকেও না। সূফী সাহেব বললেন, তাহলে আপনাকে এত ঘি-মাখন খাইয়ে এখানে রাখার উদ্দেশ্য কী? পাদ্রী বলল, যদিও আমি একজন মুসলমানকেও খ্রিষ্টান বানাইনি, তবে কাউকে মুসলমানও থাকতে দেইনি। তারা শুধু নামে আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমান আছে। কর্মে তাদের মধ্যে ইসলামের কিছুই বাকী থাকেনি। আর এটাই আমার পঁচিশ বছরের সাধনার ফল।
সূফী সাহেব বললেন, গোটা জর্ডানে একটি মাদরাসারও অস্তিত্ব ছিল না, যেখানে তরুণদেরকে ইসলামের শিক্ষা দেওয়া হবে। আমার কাছে তখন মাদরাসার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে গেল। অথচ আমরা অনেক সময় বলে ফেলি, এ সকল মাদরাসার কী প্রয়োজন? তাবলীগ করলেই তো হয়। জর্ডানের অবস্থা দেখে আমার বুঝে আসল যে, আজ যদি সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে মাদরাসা থাকত, তাহলে যুবসমাজ আর কাপড় নাপাক হওয়ার কারণে তাদের স্বজনদের জানাযার নামায পড়া থেকে বিরত থাকতে পারত না এবং মুয়াজ্জিন সাহেবও টেপের মাধ্যমে আজান দিতেন না।
আমার উস্তাদ বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুজুর্গ পটিয়ার হযরত মাওলানা আলী আহমদ (বোয়ালবী সাহেব হুজুর রহ.) আমাকে একবার বলেছিলেন, মাদরাসা হচ্ছে দ্বীনের কারখানা। এখানে দ্বীন উৎপন্ন হবে। তাবলীগওয়ালারা হচ্ছেন ফেরিওয়ালা। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে তারা দ্বীনকে ফেরি করে বিতরণ করবে। কারখানার অস্তিত্ব না থাকলে দ্বীনের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে ফেরিওয়ালারা ফেরি করার জন্য পণ্য পাবে কোথায়? মাছের জন্য পানি যেমন জরুরি, দাওয়াতের জন্য মাদরাসার অস্তিত্বও তেমনি জরুরি। মাদরাসা থাকলে দাওয়াত থাকবে, মাদরাসা না থাকলে দাওয়াতও থাকবে না, বন্ধ হয়ে যাবে।