জুমাদাল উলা ১৪২৮   ||   জুন ২০০৭

কলম-বন্ধুদের কাছে সমাজের প্রত্যাশা

মুহাম্মাদ যাইনুল আবিদীন

আক্রান্ত কিংবা নিহত কাকের শিয়রে দাঁড়িয়ে আহত কাকের বুকভাঙ্গা বিলাপ যারা শুনেছেন, দেখেছেন, কাক পক্ষীর গগনবিদারী শোক-উৎসব কিংবা ডাহুকের মর্মস্পর্শী শোকগাথা ভারাক্রান্ত করেছে যাদের কোমল প্রাণ তারা অন্তত স্বীকার করবেন মানুষের ভাষা শুধুই মনের ভাব, কাম কিংবা বেদনা প্রকাশের জন্যে নয়। নয় কক্ষচ্যুত নক্ষত্রের হঠাৎ ঝলসে ওঠার মত হৃদয়-আকাশে চমকিত ক্ষুদ্র আনন্দের শিহরিত উচ্চারণমাত্র। কারণ, আনন্দ-বেদনার এই শব্দ উচ্চারণে তো পাখিও পারঙ্গম। ফররুখের ভাষায়

তাই তুমি মুক্তপক্ষ নিভৃত ডাহুক

পূর্ণ করি বুক

রিক্ত করি বুক

অমন ডাকিতে পারো। আমরা পারি না

তাই ভাষাকে যদি বলি শুধুই মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম, আনন্দ-বেদনার কিংবা রাগ-অনুরাগ আর তুচ্ছ ডাল-ভাতের বিশ্বস্ত বাহন তাহলে সেটা হবে ভাষার প্রতি অবিচার। ছোট করা হবে মানুষের ভাষাকে। সৃষ্টির মাঝে মানুষের উপস্থিতি যেমন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর, স্বাভাবিক কথা, তার চিন্তা তার বিশ্বাস তার চেতনা, তার সভ্যতা, তার সংস্কৃতিও হবে স্বতন্ত্র বিভায় উজ্জ্বল। স্বাতন্ত্রের মহিমায় উদ্ভাসিত হবে তার উচ্চারণ- হৃদয়ের কথিত আবেদন। তার মুখের ভাষার বর্ণে বর্ণে দীপ্তি ছড়াবে তার ভাব চিন্তা বিশ্বাস সভ্যতা রুচি ও আকাঙ্খার নন্দিত স্বাতন্ত্রের। তবেই তো সে ভাষা হবে মানুষের। আজ চার দিকে যে চাপা দুর্ভিক্ষের হাহাকার এ হাহাকার শুধু চাল ডাল আর তেলের বাজারে নয়। এ

হাহাকার সভ্যতার বেদিতে আরো প্রকট। বর্ণমালার জলসায় বন্য বরাহের যে বন্য-তাণ্ডব চলছে, যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে আগামীরা অন্তত বর্ণমালার পাতা থেকে বিগতদের মানব-রূপ আবিস্কার করতে পারবে না। এ হল চলতি সময়ের জন্য এক ভয়ানক দুঃসংবাদ। আমি ভাবি, অন্তত এই দুঃসংবাদ থেকে উত্তরণের জন্যে এই সমাজের মানুষদের সাহিত্যমুখি হওয়া দরকার! এই দরকার মানুষের ভাষার জাত রক্ষা করার জন্যেও।

বাড়ির তরুণ মোরগটা সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠে শির উঁচু করে তার যৌবনের বাণীটা পাড়ার সবকটা মুরগির কানে পৌছে দেয়। অতঃপর তার সদম্ভ তাড়ায় ক্লান্ত করে তোলে পুরো পাড়ার মোরগ-মহল। তার ঝাপটায় উড়ন্ত বালুর তাড়া খেয়ে ঘরের দিকে চোখ বুজে ছুটে পালায় বাড়ির গেরস্ত, গেরস্তের ছোট নন্দিনীর নতুন বর। গেরস্ত লালায়িত দৃষ্টিতে দেখে তরুণ মোরগের গাও-গতর। বউকে শোধায়-কিগো, জামাই আছে। মোরগটা ধরব? চুলোর পাড়ে দাঁড়িয়ে অপরদিকে পাঁচ সন্তানের পরিণতি দেখেছে বৃদ্ধা জননী মুরগিটা। বেদনার বিষয় হলো, সেই গল্প সে শোনাতে পারেনি তার তরুণ সন্তানদের। রোধ করতে পারেনি অন্তত বর-অতিথির সামনে নর্তনের ঔদ্ধত্য। তাই তো সে অবলা প্রাণী। মানুষ আর অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে প্রধান পার্থক্য ছিল এটাই। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে কি মনে হচ্ছে সেই পার্থক্য আমরা ধরে রাখতে পারছি।

সৃষ্টিকর্তা মহানুভব প্রভু আমাদেরকে ভাষার মন্ত্র দিয়েছিলেন আমরা যেন দেখা সত্যকে জানা বাস্তবতাকে ভাষার মন্ত্রে অন্যের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে পারি। রাতের গভীরে দুধের সাথে পানি মেশাবার প্রস্তাব করেছিলেন দারিদ্র পীড়িত এক আরব জননী। নন্দিনী তাঁর বলেছিল, মা! আমীরুল মমিনীন তো দুধে পানি মেশাতে নিষেধ করেছেন। অবলা মা বলেছিলেন, এখন কি আমীরুল মুমিনীন দেখছেন? সাহসী কন্যা বলেছিল, আল্লাহ তো দেখছেন। এ মন্ত্রে চমকে ওঠেছিলেন গর্ভধারিনী জননী! চকিত হয়েছিলেন

অর্ধজাহানের বাদশাহ, শাসককুলের অহংকার নন্দিত মানবরূপ আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু। ঘরে তুলেছিলেন তাকে পুত্রবধু করে।

এই মন্ত্রের আরেকটি গল্প বলি। তখন রাজত্ব চলছিল বনূ উমাইয়ার। ওলীদ ইবনে আবদুল মালিকের পর শাসক হয়েছিলেন সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিক। জীবন সায়াহ্নে উপনীত খলীফা সুলাইমান! ডাকলেন প্রাইভেট সেক্রেটারী রাজা ইব্ন হাইওয়াকে। বললেন, আমি আমার পুত্রকে পরবর্তী খলীফা হিসাবে ঘোষণা করে যেতে চাই। রাজা সবিনয়ে নিবেদন করলেন, তিনি তো এখানে উপস্থিত নেই। সুলাইমান অন্য পুত্রের প্রতি ইঙ্গিত করে মতামত জানতে চাইলেন রাজা ইবনে হাইওয়ার কাছে। রাজা বিনয়ের সাথে বললেন, এ তো নাবালক। তাছাড়া হুযুর যদি কবরের কথা ভেবে থাকেন তাহলে কোনো সৎ আল্লাহভীরু ব্যক্তিকে এ আসনে রেখে যাবেন বলে আশা করছি। খলীফা বললেন, তুমি কাকে এ আসনের উপযুক্ত মনে কর? রাজা বললেন, আপনার চাচাতো ভাই উমর ইবনে আবদুল আযীযকে । সুলাইমান পছন্দ করলেন পরামর্শ। উমর ইবনে আবদুল আযীযকে খলীফা ঘোষণা করে একটি ফরমান লেখালেন। দস্তখত করে তা যথাসময়ে প্রকাশ করার জন্যে তুলে দিলেন সেক্রেটারী রাজা ইবন হাইওয়ার হাতে।

এই তো ভাষার মন্ত্র! এ মন্ত্র কী দিয়েছিল পৃথিবীকে, সেকথা সুবিদিত। উমর ইবনে আবদুল আযীয বিশাল পৃথিবীকে নুইয়ে দিয়েছিলেন ইনসাফের ভারে। বাঘ-বকরী একই ঘাটে পানি পান করেছিল! ইতিহাসের সে এক বিস্ময়কর বাতিঘর! আমরা ঘুরে ফিরে আত্মার তৃপ্তির জন্য হলেও এই বাতিঘরের কাছে যাই। কেবল ঘুণাক্ষরেও স্মরণ করি না রাজা ইবনে হাইওয়া ও তার হিরকতুল্য সুপরামর্শের মহত্ত্বকে। অথচ ইতিহাস উমর ইবনে আবদুল আযীযের সান্নিধ্য পেতে পারে না রাজা ইবনে হাইওয়ার সুপরামর্শ ছাড়া। আমি বলি, মানুষকে আল্লাহ ভাষার মন্ত্র দিয়েছেন জাতির ক্রান্তিকালে উমর ইবনে আবদুল আযীযের সন্ধান দেওয়ার জন্যই। আর আমরা যুগে যুগে সন্ধান দিয়েছি রাজার নাবালক পুত্রের কিংবা বিলাসী বিবির অথবা হৃদয়হীন কন্যার। পরামর্শক, সাংবাদিক, কবি সাহিত্যিক কেউ-ই ভুলমন্ত্র চালাতে কসুর করিনি। ইতিহাসও কসুর করেনি আমাদেরকে তার উপযুক্ত বদলা দিতে।

তবুও আমরা হাঁটছি সেই একই পথে। পরীক্ষিত ভুল পথে। ভুল হলেও পরিচিত বন্ধু। সেই বন্ধুর মতোই আকঁছি ছবি। ফলে ভাষা পাচ্ছে না মানুষের স্বাতন্ত্র। ভাষার ছবিতে মানুষ পাচ্ছে না তাদের কাঙ্খিত রূপ। অথচ এখন আমরা যে ক্রান্তিকাল অতিক্রান্ত করছি তখন প্রয়োজন ছিল এমন কিছু সুস্থ কলম-বন্ধুর যাদের রচনায় মূর্ত হয়ে ওঠবে হৃদয়ের আকুতি; দগদগে হয়ে ওঠবে সকল দুষ্ট ঘা। মানুষ কালকে বুঝতে পারবে। চিনতে পারবে কালের দুষ্ট ঘাগুলো।

রোম যখন জ্বলছে নিরু তখন বাঁশি বাজাচ্ছে নির্মর্মতার ভেতর থেকে আমাদের ভাষাশিল্পীদের বেরিয়ে আসা দরকার ভাষার দাবীতেই। কারণ ভাষাটা তো মানুষের। মানুষ জ্বলবে, মরবে, ত্রাহি ত্রাহি করবে দুর্ভিক্ষ আর দুঃশাসনের যাতাকলে পড়ে আর কবি ছবি আঁকবেন সুডৌল নারী-উরসের, গল্পকার চিত্র আঁকবেন তরুণীর দ্বিখণ্ডিত বদনের, ঔপন্যাসিক তাকে রক্তে মাংশে বানাবেন দীঘল কাহিনী। আর এসব পড়ে পথে নামা মানুষের অসহায় সংবাদ লিখে সমাজকে ঘাবড়ে দেবেন সাংবাদিকএ কেমন দুঃসহ রজনী! আমরা এখন এই কালরজনীর বিদায় চাই! চাই গল্প-সল্প নয়; রমণ-মন্থন নয়; আমাদের ভাষা হোক দিন বদলের মন্ত্র। সমাজের সাদা কালো যথার্থ রূপে চিত্রিত হোক আমাদের ভাষায়। কলঙ্কিত চেহারার পরশে অঙ্কিত হোক আমাদের দূর অতীতের গর্বিত মুখ। কলঙ্কের মূল উৎস চিহ্নিত হোক আমাদের ভাষায়। চিহ্নিত হোক আমাদের লয় ও পতনের ফাঁদগুলো। দল ও স্বার্থের বলয়মুক্ত হয়ে মানুষ দৃষ্টিতে নিবেদিত হোক মুক্তির বাণী! সমাজ এখন এমন কিছুই প্রত্যাশা করছে আমাদের কলম-বন্ধুদের কাছে।

 

 

advertisement