সালাম : ভালোবাসার নির্মল সেতুবন্ধন
মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টি এবং পারস্পরিক ঝগড়া বিবাদ নিরসনে সালামের গুরুত্ব অপরিসীম। ঝগড়া ফাসাদ ও পারস্পরিক অমিল মানুষের জীবনকে বিষময় করে তোলে। জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ গতিকে চরমভাবে ব্যাহত করে। অপরদিকে পারস্পরিক মিল মুহব্বত ও প্রীতি ভালোবাসা মানুষের জীবনকে সুখ ও আনন্দে ভরে দেয়। জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলোতেও হৃদয় মনে শান্তি ও প্রশান্তির শীতল স্পর্শ দান করে।
পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ তার জীবনকে একটি সু্ন্দর ও স্বচ্ছন্দ নিয়মে পরিচালিত করতে চায়। জীবনের কষ্টের দিক গুলোকে এড়িয়ে চলতে চায়, আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যের দিকগুলোকে আপন করে নিতে চায়। এককথায় মানুষ আরাম চায় এবং শান্তি চায়। তবু তাকে জীবন বাঁচাতে একটি যুদ্ধে নামতে হয়, যাকে বলা হয় জীবন-যুদ্ধ। জীবনকে ধরে রাখার জন্য সংগ্রাম। জীবনের এ অধ্যায়টিতে বিভিন্ন মেজাজের মানুষের সঙ্গে তার চলাফেরা ও উঠাবসা করতে হয়। এভাবে মানুষের সঙ্গে তার নিত্যদিনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে সম্পর্কের মাঝে সুখ থাকে, দুঃখ থাকে, হাসি থাকে, কান্নাও থাকে। এসময়ে তার মনের গভীরে লুকায়িত থাকে একটি সুপ্ত আকাঙ্খা-সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, নিশ্চয়তা, পরিতৃপ্তি এবং হৃদয় ও আত্মার পরম প্রশান্তি। পৃথিবীর যত জ্ঞানী-গুণী, সবার সর্বসম্মত বক্তব্য, সেই সুখ-স্বাচ্ছন্দ লাভের একমাত্র উপায় হল পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসা।
প্রশ্ন হল, এই সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি কীভাবে সৃষ্টি হবে? সৃষ্টি হওয়ার পর একে ধরে রাখার মাধ্যমটি কী হবে? ইসলামের নবী এবং মানবতার নবী বিশ্বশান্তির অগ্রদূত সায়্যিদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কণ্ঠে শুনুন এর সহজ সমধান-
أولا أدلكم على عمل إذا عملتموه تحاببتم، أفشوا السلام بينكم
আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি আমল শিক্ষা দিব না যা করলে তোমরা একে অপরকে ভালোবাসতে শিখবে? শোন, তোমরা সালামের প্রসার ঘটাবে।
নবীজী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ হাদীসের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানুষ লাভ করল বিশ্ব শান্তির এক অনন্য সাধারণ অমোঘ ব্যবস্থা। কেননা সালাম মানুষকে মানুষের সঙ্গে প্রগাঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে। সালাম মানুষের হৃদয় ও আত্মার গভীরে শান্তির শীতল স্পর্শ দান করে। সমাজবদ্ধ জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধির মূল শক্তিই তো হল এই বন্ধন, আত্মার সাথে আত্মার প্রগাঢ় সম্মিলন।
ইতিহাসের যে সময়টিতে একজন মহান মানবের কণ্ঠে ঘোষিত হয়েছিল সালামের এমন বিস্ময়কর যাদুকরী প্রভাবের কথা, সে সময় সে মহামানবের সান্নিধ্যধন্য মানুষগুলো বিপুল আবেগ ও উদ্যমের সঙ্গে সে আহবানে সাড়া দিয়েছিলেন। নবীজী ঘোষণা দিলেন, ‘তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও ’ অমনি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে শুরু হয়ে গেল চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা, কে কার আগে সালাম দিতে পারে। সালামের প্রসারে কে কার চেয়ে এগিয়ে থাকতে পারে। নবীজীর এই বাণী সাহাবায়ে কেরামের জীবনে আপন মহিমায় মূর্ত হয়ে উঠেছিল। তাই তাঁদের জীবন ছিল এমন সুন্দর সুশোভিত। এমন প্রোজ্জ্বল, আলোকিত, প্রস্ফুটিত। তাই তাঁদের জীবনে ঘটেছিল সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বিস্ময়কর অনেক ঘটনা। তাই তারা মানুষকে ভালোবাসতে পেরেছিলেন হৃদয় ও মনের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে। তাই তাঁরা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন ভাইয়ের জন্য ভাইয়ের স্বার্থত্যাগ ও আত্মত্যাগের বিরল ও বিস্ময়কর ইতিহাস। তাঁরা পরস্পরকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসার নিবিড় উৎস থেকে উৎসারিত হত তাঁদের সালাম। কিংবা বলা যায়, তাঁরা পরস্পরকে সালাম দিতেন, সালামের শব্দ ও মর্মের গভীর উৎস থেকে জন্ম নেওয়া তাদের সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি তাঁদের সমাজকে এমন স্বর্ণসমাজে পরিণত করেছিল। তাঁদের সে নির্মল নিষ্কলুষ ভালোবাসাই তাঁদের জীবনকে এমন বিস্ময়কর আদর্শিক উচ্চতায় মহিয়ান করেছিল।
তাঁরা একে অপরকে সালাম দিতেন, সবাই সবাইকে। তাঁদের সালাম কোনো গণ্ডির ভিতর সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁদের সালাম সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসের অদৃশ্য আইনের আওতাভুক্ত ছিল না । তাঁদের সালাম স্রেফ পরিচিত মহলের মাঝেই আবদ্ধ ছিল না। তাঁরা সালাম দিতেন সকলকে। ছোট বড় উভয়কে। পরিচিত অপরিচিত সবাইকে। তাঁরা সালাম দিতেন আমীরকে। তাঁরা সালাম দিতেন গরীবকে। কেননা তাঁরা শুনেছিলেন তাঁদের নবীর কণ্ঠে—
تقرأ السلام على من عرفت ومن لم تعرف.
‘সালাম দাও যাকে চেন তাকে, যাকে চেন না তাকেও।’ তাঁরা শুনেছিলেন নবীজীর কণ্ঠে—
يسلم الراكب على الماشي والماشي على القاعد والقليل على الكثير.
‘আরোহী সালাম দিবে পথচারীকে, পথচারী সালাম দিবে বসা ব্যক্তিকে, স্বল্প সংখ্যক সালাম দিবে অধিক সংখ্যককে’।
প্রিয় পাঠক, নবীজী যখন একথাগুলো বলেছিলেন, সাহাবায়ে কেরাম তখন নিজেদের জীবনে এর প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। আজ নবীজী চলে যাওয়ার অনেক অনেক বছর পর বর্তমান দুনিয়ায় বিচরণকারী এই আমাদের মাঝেও নবীজীর সেসব বাণীর শব্দগুলো বিরাজমান। তবু সাহাবীদের সমাজ আর আমাদের সমাজের মাঝে এমন বিস্তর ফারাক। তবু তাঁদের জীবন ও আমাদের জীবনের মাঝে এমন দুর্লঙ্ঘ নৈতিক ব্যবধান। এর কারণ একটাই। তাঁরা নবীজীর আদর্শকে নিজস্ব সংজ্ঞা দান করেননি। আমরা তাঁর আদর্শের নতুন সংজ্ঞা খুঁজে বের করেছি। তাঁরা সালাম দিতেন বড়কে এবং ছোটকে, আমরা সালাম দেই বড়কে, ছোটকে নয়। তাঁরা সালাম দিতেন ধনীকে, গরীবকে। আমরা সালাম দেই ধনীকে, পথের ভিখারীকে নয়। তাঁরা সালাম দিতেন শিক্ষককে এবং ছাত্রকে। আমরা সালাম দেই শিক্ষককে, ছাত্রকে নয়। তাঁরা সালাম দিতেন, সালামের অপেক্ষায় থাকতেন না। আমরা সালামের অপেক্ষায় থাকি, সালাম দেই না। তাঁদের নিকট নববী পরিচয় ছাড়া সালামের অন্য কোন পরিচয় ছিল না। আমাদের নিকট সালামের ভূরি ভূরি পরিচয় আবিস্কৃত হয়েছে। তারা সালাম দিতেন নবীর আদর্শ হিসেবে, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার নির্মল উৎস হিসেবে। আমাদের সালামের মধ্যে থাকে স্বার্থের গন্ধ কিংবা প্রাপ্তির আশা কিংবা হারানোর ভয়।
আমাদের দেশে এবং পৃথিবীর আরও অনেক দেশে সম্পূর্ণ দ্বি-মুখী দুটি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে। প্রত্যেক শিক্ষায় শিক্ষিতদের ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। একজন মাওলানা অন্যজন মিষ্টার। সাধারণভাবে সমাজের মধ্যে এদেরকে পরস্পর বিরোধী দু’টি শ্রেণী মনে করা হয়। একশ্রেণী অপর শ্রেণীকে ভিন্ন চোখে দেখে। শ্রদ্ধা বা সমীহের কারণে এমনটি ঘটে তা বলা যায় না। এর পিছনে ভিন্ন কারণও রয়েছে। সে কারণটি যাই হোক, ফলাফল অবশেষে এই দাঁড়িয়েছে যে, দিন দিন দুই শ্রেণীর মাঝে দূরত্ব বাড়ছে বৈ কমছে না। পারস্পরিক উদারতার স্থলে তিক্ততার জন্ম হচ্ছে। যার ফলে পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে সর্বত্র যেখানে যে শ্রেণীর আধিপত্য, অপর শ্রেণীর লোকদের সঙ্গে সেখানে অনুদার ও অসুন্দর আচরণ পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় এ আচরণের পিছনে বিশেষ কোনো কারণ থাকে না; বরং অন্তরের গভীরে আজন্ম লালিত পারস্পরিক দূরত্ববোধ থেকেই এমন আচরণ প্রকাশ পেয়ে থাকে। এতে উভয় শ্রেণীই অপর শ্রেণীর অঙ্গনে গিয়ে দারুণভাবে বিব্রত বোধ করে। এ সমস্যা যেদিন থেকে শুরু বিশেষ করে আমাদের এদেশে, সম্ভবত সেদিন থেকেই সমাজের বিজ্ঞজনেরা চিন্তা শুরু করেছেন এ সমস্যার কীভাবে সমাধান করা যায়। এ দূরত্ব কীভাবে দূর করা যায়, বহুজন বহু পরিকল্পনা পেশ করেছেন, বিস্তর গবেষণাও চলেছে। কিছু কিছু গবেষণার কিছু ফলাফলও যে পাওয়া যায়নি তা নয়, পাওয়া গেছে। তবে সমস্যার ভয়াবহতার তুলনায় তা অতি নগণ্য।
পৃথিবীর মানুষ একদিন এমন এক সমস্যায়ও পড়বে, এ বিষয়টি হয়তবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম টের পেয়েছিলেন। তাই তাঁর কণ্ঠে আজ থেকে বহু বছর আগেই উচ্চারিত হয়েছে সেই অমোঘ বাণী, সেই অসাধারণ নির্দেশনা যার বাস্তবায়নে পাল্টে যেতে পারে আমাদের এ সমাজ, সমাজের এই দূরত্বে বাঁধা অবয়ব।
أولا أدلكم على عمل إذا عملتموه تحاببتم، أفشوا السلام بينكم.
রাসূল দিয়েছিলেন আমাদেরকে অসাধারণ একটি ফমূর্লা, পারস্পরিক দূরত্ব ঘোচানোর বিস্ময়কর ফর্মূলা, যার মূলকথা হল, একে অপরকে সালাম দাও। কারো সঙ্গে দেখা হলেই মনের গভীর থেকে বল, السلام عليكم তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, যার সাথে তোমার দূরত্ব আছে, এই একটি সালামের কল্যাণেই তোমার আর তার মধ্যকার দূরত্ব দূর হয়ে যাবে। তুমি তার জন্য শান্তি ও রহমতের দুআ করলে, উত্তরে সে-ও তোমার জন্য একই দুআ করল। এরপর কি করে তোমাদের দু’জনের মাঝে দূরত্ব থাকতে পারে? এরপর কি করে তোমরা একে অপরকে ভিন্ন নজরে দেখতে পার? পরস্পরকে পরস্পরের প্রতি অনূদার কিংবা অসহিষ্ণু ভাবতে পার?
নবীজীর এ হাদীসের ভাব ও মর্মের বিশালতা ও গভীরতা প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই। তবে নির্ভয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, রাসূলের এ শিক্ষাকে বাদ দিয়ে, সালামের এ মহান আদর্শকে অবহেলা করে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য সৃষ্টির পিছনে যত কৌশলই প্রয়োগ করা হোক, চূড়ান্ত ফলাফল কিছুতেই অর্জিত হবে না।
আমাদের সমাজে সালামের প্রচলন নেই, এমন নয়। আছে। ভালোই আছে। এটা বড়ই তৃপ্তির কথা এবং আনন্দের বিষয়। ইসলামী আদর্শের অনেক কিছু আমাদের কর্মের অঙ্গন থেকে হারিয়ে গেছে। এর মাঝে সালামের আদর্শটি যে টিকে আছে এটা অবশ্যই সুখের বিষয়। তবে যে বিষয়টা দুঃখ দেয় এবং মনকে দারুণভাবে আহত করে তা এই যে, সালামকে আমরা সুন্নতে নববীর অবস্থান থেকে সরিয়ে এনে অনেকটা ‘ফ্যাশনের’ পর্যায়ে কিংবা স্রেফ সামাজিক সাধারণ আচরণের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছি। যার ফলে যেখানে সালামকে সামাজিক শিষ্টাচার মনে করি সেখানে সালাম দেই। (সেই সালামের উচ্চারণ ও ভাবভঙ্গি যেমনই হোক) আর যেখানে মনে করি সালাম নয় হ্যান্ডশেকটাই শিষ্টাচার সেখানে সালামের কথা ভুলে যাই। এটাই প্রমাণ করে সালাম যখন দেই, নবীজীর সুন্নত হিসেবে দেই না। সালাম না দিলে কেমন দেখায় কিংবা সালাম দিতে হয় তাই দেওয়া—এ ধরনের মনোভাব তখন অনেকটা কার্যকর থাকে।
এধরনের আচরণ নিঃসন্দেহে নবীজীর সুন্নতের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল নয়। সালামকে কোনো ব্যক্তির অনুগামী না করে ব্যক্তিকেই বরং সালামের অনুগামী করা উচিত।
পরিশেষে আল্লাহর কাছে দুআ করি, আল্লাহ যেন আমাদেরকে রাসূলের প্রতিটি সুন্নত চূড়ান্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পালন করার তাওফীক দান করেন। আমীন।