ফিকহে হানাফীর সনদ
ভূমিকা
আল্লাহ তাআলা কুরআনী শরীয়ত তথা ইসলামী শরীয়তের হিফাযতের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেছেন। এই শরীয়ত হল সর্বশেষ শরীয়ত। আল্লাহ সে শরীয়তের হিফাযতের দায়িত্বই নিজে গ্রহণ করেছেন যা কিয়ামত পর্যর্ন্ত বিদ্যমান থাকা মহান আল্লাহর অভিপ্রায়।
বিজ্ঞ লোকেরা জানেন, শুধু কুরআন-সুন্নাহই নয়, কুরআন-সুন্নাহকে বোঝা যে বিষয়গুলোর উপর নির্ভরশীল সেগুলোকেও আল্লাহ তাআলা পূর্ণরূপে হিফাযত করেছেন। তদ্রূপ কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা ও নির্দেশনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং তার বিন্যাস ও সংকলনের জন্য যে শাস্ত্রগুলোর সূচনা, সেগুলোকে এবং সেগুলোর বুনিয়াদী গ্রন্থগুলোকেও আল্লাহ হিফাযত করেছেন।
আজ শত শত বছর পরও ইলমে হাদীস, ইলমে তাফসীর, ইলমে ফিকহ ইত্যাদি শাস্ত্রের মৌলিক গ্রন্থগুলো আমাদের কাছে ঠিক সেভাবেই সংরক্ষিত আছে যেভাবে এ গ্রন্থগুলো রচিত ও সংকলিত হয়েছিল। কপিকার ও মুদ্রাকরের বেখেয়ালীতে কোনো ভুলক্রটি হয়ে গেলে তা চিহৃিতকরণ ও সংশোধনের জন্যও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে, যার ভিত্তিতে ভুল-ত্রুটি চিহ্নিত ও সংশোধিত হওয়ার ধারাবাহিকতা প্রতি যুগেই অব্যাহত ছিল এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।
প্রত্যেক শাস্ত্রের বুনিয়াদী গ্রন্থগুলো সে শাস্ত্রের ধারক বাহক ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে পঠন-পাঠন-আলোচনা এবং এ গ্রন্থকেন্দ্রিক বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে সমাদৃত ছিল এবং রচিত হওয়ার সময় থেকে আজ পর্যন্ত ‘তাওয়াতুর’ ও ‘ইস্তিফাযাহ’র মাধ্যমে চলে এসেছে। গ্রন্থগুলোর বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য মাখতূতাহ (হস্তলিখিত কপি) বিশেষজ্ঞদের সামনে রয়েছে। মুদ্রনযন্ত্রের প্রচলনের পর থেকে গ্রন্থগুলো মুদ্রিত হয়ে পাঠকের সামনে আসছে। আজও যদি কোনো প্রকাশক এ জাতীয় গ্রন্থাদির প্রকাশনার ক্ষেত্রে নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিতে না পারেন এবং কোনো বুনিয়াদী গ্রন্থকে একাধিক বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য মাখতূতাহ (হস্তলিখিত কপি) থেকে কিংবা অন্তত এমন একটি মাখতূতাহ থেকে যা বিশেষজ্ঞদের কাছে নির্ভরযোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ, না ছেপে থাকেন তবে এর প্রতিবাদ করার মতো এবং পূর্ণ নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে এ গ্রন্থ পুনরায় প্রকাশ করার মতো আত্মমর্যাদাশালী আলিম ও প্রকাশক এখনও বিদ্যমান রয়েছেন।
মোটকথা, শুধু কুরআন-সুন্নাহ নয়; বরং কুরআনী শরীয়তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রসমূহের বুনিয়াদী গ্রন্থগুলোকেও আল্লাহ তাআলা হিফাযত করেছেন। আর ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, যে যুগে যে কেউ এগুলোর যথাযথরূপে সংরক্ষিত থাকার বিষয়টিকে সন্দেহযুক্ত করতে চেয়েছে আল্লাহ তাদেরকে জনসমক্ষে লাঞ্ছিত করেছেন।
বেশ কিছুদিন থেকে দেখা যাচ্ছে, ইসলামের দুশমনদের বিভিন্ন প্রচারণায় অবচেতনভাবে প্রভাবিত হয়ে কিছু গায়রে মুকাল্লিদ বন্ধু একটি প্রশ্নের অবতারণা করছেন। প্রশ্নটি এই যে, ফিকহে হানাফীর সনদ কী এবং ফিকহে হানাফীর বুনিয়াদী কিতাবগুলো যাদের রচনা বলে প্রসিদ্ধ, এগুলো যে তাদেরই রচনা তার প্রমাণ কী?
এই প্রশ্ন শুনে আমার সারা শরীর শিহরিত হয়ে উঠেছে। কেননা, এই একই প্রশ্ন আগামীকাল কেউ ফিকহে মালেকী সম্পর্কে করবে না, ফিকহে শাফেয়ী বা ফিকহে হাম্বলী সম্পর্কে করবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? শুধু তাই নয়, এই প্রশ্ন ইলমে হাদীস, ইলমে তাফসীর এবং অন্য সকল ইসলামী শাস্ত্র সম্পর্কেও কেউ করবে না তার নিশ্চয়তা কী? বরং ইসলামের দুশমনরা তো এ জাতীয় প্রশ্ন অনেক আগে থেকেই করে আসছে।
একটু চিন্তা করলেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কোনো ইসলামী শাস্ত্রের যেকোনো গ্রন্থ, যা বিশেষজ্ঞদের মাঝে সমাদৃত এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের নির্ভরযোগ্য উৎসরূপে বরিত, তার বিষয়ে এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করা কত বড় মূর্খতা ও গোমরাহীর পরিচায়ক।
যাহোক, প্রশ্ন যখন উঠেছে, তখন সেটা ভিত্তিহীন হলেও সাধারণ মুসলিম জনগণকে এর বিভ্রান্তি থেকে নিরাপদ রাখার জন্য প্রশ্নটির প্রকৃত অবস্থা উদঘাটন করে দেওয়া অপরিহার্য হয়ে দাড়িয়েছে। এজন্য আমার কিছু বন্ধুর অনুরোধে আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করে নিম্নোক্ত আলোচনা পত্রস্থ করা হল। প্রসঙ্গটি নিয়ে আমার কিছু সুহৃদ আমাকে আগেও প্রশ্ন করেছিলেন। তাদের প্রশ্নের উত্তরে মৌখিকভাবে যে কথাগুলো তখন পেশ করেছিলাম সে কথাগুলো দিয়েই প্রবন্ধটি শুরু করেছি।
একটি আলোচনা
আমার সেই বন্ধুগণ বিভিন্ন সময় আমাকে বলেছেন যে, গাইরে মুকাল্লিদ ভাইদেরকে আমাদের উপর প্রায়ই একটি প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়। প্রশ্নটি এই যে, আপনারা ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর তাকলীদ করে থাকেন, কিন্তু আপনারা কি কখনো যাচাই করে দেখেছেন, আপনাদের কিতাবের মাসআলাগুলো ইমাম আবু হানীফা বলেছেন কি না? আপনারা মাসআলা সংগ্রহ করেন ফতোয়া শামী থেকে। এ কিতাবের লেখক ইবনে আবেদীন শামী হলেন হিজরী ত্রয়োদশ শতাব্দীর ব্যক্তি, তার মৃত্যুসন ১২৫২ হিজরী। আপনাদের মাদরাসায় ফিকহের কিতাব ‘কানযুদ দাকাইক’ পড়ানো হয়। এর লেখক হলেন আবুল বারাকাত নাসাফী, যার মৃত্যুসন ৭১০ হিজরী। তাহলে তাকে অষ্টম শতাব্দীর লেখক বলা যায়। এরপর সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে প্রসিদ্ধ যে কিতাবটি আপনাদের মাদরাসায় পড়ানো হয় তা হল ‘হিদায়া’। এর রচয়িতা আবুল হাসান মারগীনানী; ইনি ৫৯২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেছেন। অন্যদিকে ইমাম আবু হানীফা রহ. ইন্তেকাল করেছেন ১৫০ হিজরীতে। তাহলে ষষ্ঠ, অষ্টম বা ত্রয়োদশ শতাব্দীর কোনো ব্যক্তি যদি সনদ ছাড়া “আবু হানীফা বলেছেন” বলে উদ্বৃতি দেন, তাহলে তার কথার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? যেখানে ইমাম আবু হানীফা ও উপরোক্ত গ্রন্থকারদের মাঝে শত শত বছরের ব্যবধান, সেখানে তাদের সনদবিহীন উদ্ধৃতির ভিত্তিতে কোনো কথাকে কীভাবে আবু হানীফার কথা বলা যেতে পারে?
দ্বিতীয় কথা এই যে, আপনারা ‘রদ্দুল মুহতার’কে ইবনে আবেদীন শামীর কিতাব বলে থাকেন, ‘কানযুদ দাকাইক’কে আবুল বারাকাত নাসাফীর কিতাব এবং ‘হিদায়া’কে আবুল হাসান মারগীনানীর কিতাব বলে থাকেন এবং ওই কিতাবগুলোর মাসায়েল উপরোক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে এবং তাদের সূত্রে ইমাম আবু হানীফার সঙ্গে যুক্ত করে থাকেন। প্রশ্ন হল আবু হানীফা তো দূরের কথা ওই রচয়িতাদের পর্যন্ত কোনো সনদও কি আপনাদের কাছে রয়েছে?
আমার সেই বন্ধুরা বলেছেন, যেহেতু অনেক গায়রে মুকাল্লিদের পক্ষ থেকে এই প্রশ্ন আজকাল খুব প্রচারিত হচ্ছে এবং বিভিন্ন লিফলেট ও পুস্তক-পুস্তিকার মাধ্যমে এ প্রশ্ন ছড়ানো হচ্ছে, তাই এ বিষয়ে একটি বিশদ প্রবন্ধ আলকাউসারে আসা উচিত।
আমি তাদেরকে মৌখিকভাবে এটুকু বলেছি যে, আপনারা গায়রে মুকাল্লিদ ভাইদেরকে আদবের সঙ্গে জিজ্ঞেস করবেন, আপনাদের মতে ফিকহে হানাফীর তাকলীদ অনুচিত হওয়ার কারণ কি এই যে, এখানে উল্লেখিত মাসায়েল ইমাম আবু হানীফা থেকে সনদের সঙ্গে প্রমাণিত হওয়ার বিষয়ে আপনাদের সন্দেহ রয়েছে? যদি এই সন্দেহ দূর হয়ে যায় তাহলে আপনারা ফিকহে হানাফীর তাকলীদ সঠিক বলবেন? যদি বিষয়টি এমন হয়, তাহলে আপনাদের উপরোক্ত প্রশ্নের জওয়াব দেওয়া ফলদায়ক হতে পারে। যদিও আমাদের ধারণা হল, উপরোক্ত প্রশ্ন ভুল হওয়ার বিষয়টি আপনাদেরও ভালোভাবেই জানা আছে। তবুও আমরা এই প্রশ্নের জওয়াব পেশ করতে প্রস্তুত রয়েছি। আর যদি বিষয়টি এমন না হয়; বরং প্রশ্নের উদ্দেশ্যই হল একটি অর্থহীন তর্ক-বিতর্ক ও বিবাদ-বিসংবাদের সূচনা করা, তাহলে এ জাতীয় প্রশ্নগুলো হাদীসের ভাষায় ‘উগলূতাত’-এর অন্তভুর্ক্ত হবে, যা থেকে বিরত থাকতে হাদীস শরীফে তাকীদ করা হয়েছে। এ জন্য অন্তত আপনাদের পক্ষে এ জাতীয় প্রশ্ন উত্থাপন করা এবং তা সমাজে ছড়ানো কখনো শোভা পায় না।
আমি তাদেরকে একথাও বলেছি যে, আপনারা গায়রে মুকাল্লিদ ভাইদের কেন জিজ্ঞেস করেন না, ভাই, আমরা এবং আপনারা সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, জামে তিরমিযী, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসায়ী, মুসনাদে আহমাদ এবং আরও বহু হাদীসগ্রন্থ থেকে হাদীস বর্ণনা করে থাকি। তদ্রƒপ তাফসীরে ইবনে কাছীর, তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে তাবারী এবং আরও অনেক তাফসীরগ্রন্থ থেকে তাফসীর সংক্রান্ত উক্তি উদ্ধৃত করে থাকি। কিন্তু আপনারা কি কখনো এসব ক্ষেত্রে এই প্রশ্ন তুলেছেন যে, শত শত বছরের প্রাচীন এই গ্রন্থগুলোর গ্রন্থকারদের পর্যন্ত আমাদের সনদটি কী এবং তা কোন মানের?
তাছাড়া দেখুন, লোকেরা ‘মিশকাতুল মাসাবীহ’ কিতাব থেকে হাদীস উল্লেখ করে থাকে এবং সে কিতাবে উল্লেখিত উদ্ধৃতি মোতাবেক লিখে থাকে-বুখারী, আবু দাউদ, বায়হাকী ইত্যাদি, কিংবা আপনারা শায়খ আলবানীর কিতাব পড়ে বিভিন্ন হাদীস সম্পর্কে তার উল্লেখিত উদ্ধৃতি মোতাবেক লিখে থাকেন-বুখারী (২৫৬ হি.), মুসলিম (২৬১ হি.), আবু দাউদ (২৭৫ হি.), তিরমিযী (২৭৯ হি.), দারাকুতনী (৩৮৫ হি.), বায়হাকী (৪৫৮ হি.), ইবনে হাযম (৪৫৬ হি.), ইবনে আবদুল বার (৪৬৩ হি.) ইত্যাদি। কিন্তু আপনারা কি কখনো ভেবেছেন যে, মিশকাত গ্রন্থকার যিনি অষ্টম শতাব্দীর একজন ব্যক্তি, ইমাম বুখারী (২৫৬ হি.) প্রমুখ তৃতীয় শতাব্দীর মুহাদ্দিসদের পর্যন্ত তার সনদ কী? আলবানী সাহেব যিনি পঞ্চদশ শতাব্দীর মানুষ, তৃতীয় শতাব্দী, চতুর্থ শতাব্দী এবং পঞ্চম শতাব্দীর উপরোক্ত মুহাদ্দিসদের পর্যন্ত তাঁর সনদ কী? এরপর বলুন, মিশকাতের কোনো হাদীসের উপর আমল করার জন্য কিংবা আলবানী সাহেবের কোনো উদ্ধৃতিকে স্বীকার করার জন্য কি তাদের উদ্বৃত কিতাবসমূহ খুলে উদ্বৃতির বিশুদ্ধতা যাচাই করা এবং নিজে সনদের মান পরীক্ষা করা অপরিহার্য? আপনারা কি মনে করেন যে, উপরোক্ত কাজ ছাড়া কোনো আলেম তো দূরের কথা কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষেও তাদের উদ্ধৃতির উপর নির্ভর করা যাবে না?
‘মিশকাতুল মাসাবীহ’-তে সনদ উল্লেখ না থাকলেও সনদযুক্ত কিতাবসমূহের উদ্ধৃতি রয়েছে, কিন্তু মাসাবীহুস্ সুন্নাহ কিতাবে তো সনদও নেই এবং সনদওয়ালা কিতাবের উদ্ধৃতিও নেই। অথচ শত শত বছর ধরে গ্রন্থটি উম্মাহর মাঝে পঠিত হচ্ছে এবং এ গ্রন্থের উল্লেখিত হাদীস মুতাবেক আমলও করা হচ্ছে। সবাই আস্থাশীলতার সাথেই কিতাবটির হাদীস বর্ণনা করছেন। চিন্তা করে দেখুন, এই কিতাবের উপর নির্ভর করে হাদীস বয়ান করার অর্থ কি এই যে, বাস্তবেও এই হাদীসগুলোর কোনো সনদ নেই?
আমি আমার বন্ধুদের বলেছি, আপনারা তাদের বিবেকের কাছে এই প্রশ্নও রাখবেন যে, আজ আপনারা বিভিন্ন ভিত্তিহীন প্রশ্নের অবতারণা করে সাধারণ মুসলিম জনগণকে কিতাব-সুন্নতের ব্যবহারিক পদ্ধতি ‘ফিকহে মুতাওয়ারাস’ (খায়রুল কুরুন থেকে ধারাবাহিকভাবে উম্মাহর মাঝে সমাদৃত ফিকহ) সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করার চেষ্টা করছেন এবং নিজেদেরকে যেন ফিকহ অস্বীকারকারীদের কাতারে শামিল করছেন।
আপনারা কি ভেবে দেখেছেন, আমাদের সমাজে আরেকটি দল আছে যারা নিজেদেরকে ‘আহলে কুরআন’ বা এ জাতীয় কোনো চটকদার নামে পরিচিত করে থাকে, তারাও ঠিক এই ধরনের প্রশ্ন, যা আপনারা ফিকহ সম্পর্কে করেছেন, হাদীস সম্পর্কে তুলে থাকে, এবং মানুষকে হাদীস ও সুন্নত সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করার অপপ্রয়াসের মাধ্যমে নিজেদেরকে ‘হাদীস অস্বীকারকারীদের’ অন্তভুর্ক্ত করে। আল্লাহর ওয়াস্তে ভাবুন, কুরআনের নাম নিয়ে হাদীস অস্বীকার করা আর হাদীসের নাম নিয়ে ফিকহ অস্বীকার করার মধ্যে নীতিগত কিংবা কৌশলগত কোনো পার্থক্য আছে কি না?
এই কথাগুলো আরজ করার পরও আমার বন্ধুরা আমাকে বলেছেন যে, এ বিষয়ের মূল কথাগুলো কিছুটা বিশদ আকারে লিখুন, যাতে এ ধরনের ভিত্তিহীন প্রশ্নের মাধ্যমে কেউ হাদীস-তাফসীরের নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি সম্পর্কেও বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে এবং ফিকহ-ফাতাওয়া বা কোনো দ্বীনী ইলম ও ফনের স্বীকৃত কিতাবাদি সম্পর্কে মানুষের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করতে না পারে। তাদের অনুরোধে আল্লাহর উপর ভরসা করে ইচ্ছা করেছি যে, এ বিষয়ের কিছু জরুরি ও মৌলিক কথা পাঠকদের সামনে পেশ করব।
সকল শাস্ত্রের স্বীকৃত নীতি
কোনো গ্রন্থ সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ কি না এবং গ্রন্থটি যার লিখিত বলে পরিচিত বাস্তবিকই তার লিখিত কি না তা জানার দু’টি পদ্ধতি রয়েছে।
প্রথম পদ্ধতি এই যে, সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রের ধারক-বাহক ও পারদর্শীগণ যদি সেটিকে তাদের শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসাবে গণ্য করেন, গ্রন্থটিকে ওই লেখকের গ্রন্থ বলে স্বীকৃতি দেন এবং উক্ত গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন তাহলে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হবে যে, গ্রন্থটি (সার্বিক বিচারে) নির্ভরযোগ্য এবং সেটির গ্রন্থকার-পরিচয় নির্ভুল।
পারিভাষিক শব্দে এভাবে বলা যায় যে, আলোচ্য গ্রন্থটি ওই লেখকের হওয়ার বিষয়টি ‘তাওয়াতুর’ কিংবা অন্তত ‘শুহরত’ ও ‘ইস্তেফাজাহ’র পর্যায়ে উন্নীত হলে এবং গ্রন্থটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ‘মুতালাক্কা বিল কাবূল’ গ্রন্থ হিসেবে গণ্য হলে তার নির্ভরযোগ্যতা এবং গ্রন্থকার-পরিচয় অকাট্যভাবে প্রমাণিত হবে।
এ পদ্ধতিতে গ্রন্থ ও গ্রন্থকারের যোগসূত্র প্রমাণিত হলে এ প্রশ্নের কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকে না যে, আমাদের থেকে গ্রন্থকার পর্যন্ত কোনো ‘সনদ’ আছে কি না, কিংবা সে ‘সনদে’র মান কী?
তবে একথার অর্থ এই নয় যে, দ্বীনী ইলম ও ফনের প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ কিতাবসমূহের সনদ সংরক্ষিত নেই। আলহামদুলিল্লাহ এ ধরনের কিতাবসমূহের সনদ এখনো সংরক্ষিত আছে এবং ইনশাআল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে।
এখানে মনে রাখার বিষয় এই যে, এ ধরনের কিতাবগুলোর ক্ষেত্রে ‘সনদে’র চেয়েও শক্তিশালী দলীল বিদ্যমান রয়েছে, যার পারিভাষিক নাম হল ‘তাওয়াতুর’ ও ‘তালাক্কী বিল কাবূল’।
সুতরাং এই অকাট্য দলীল বিদ্যমান থাকা অবস্থায় সনদ খোঁজার প্রয়োজন থাকে না। এজন্য হাদীস বিশারদগণ এবং অন্যান্য শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন যে, এধরনের গ্রন্থাদির ক্ষেত্রে সনদ তালাশ করা মূল কাজ নয়, এখানে মূল কাজ হল গ্রন্থটির যে কপি আমাদের ব্যবহারে রয়েছে তা বিশুদ্ধ কি না যাচাই করা।
কপির বিশুদ্ধতা কীভাবে প্রমাণিত হয় তার স্বতন্ত্র নিয়ম-পদ্ধতি রয়েছে এবং তা আহলে ইলমদের জানা আছে। এ বিষয়ের জ্ঞান লাভের সহজ পদ্ধতি এই যে, কপিটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের কাছে সমাদৃত কি না এবং তারা সার্বিক বিচারে একে নির্ভরযোগ্য গণ্য করেন কি না তা জেনে নেওয়া।
দ্বিতীয় পদ্ধতি এই যে, আমাদের যুগ পর্যন্ত কিতাবটির ‘সনদে মুত্তাসিল’ অর্থাৎ অবিচ্ছিন্ন সূত্র বিদ্যমান থাকা। অর্থাৎ স্বয়ং গ্রন্থকার থেকে তার শীষ্যগণ সরাসরি পড়ে, শুনে কিংবা ইজাযত নিয়ে কিতাবটি সংগ্রহ করেছেন। এরপর এই ধারাবাহিকতা এভাবেই অবিচ্ছিন্নভাবে আমাদের যুগ পর্যন্ত অব্যাহত থেকেছে। এ ক্ষেত্রেও কপির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চয়তা লাভ করা অপরিহার্য।
এই দুই পদ্ধতির মধ্যে প্রথমোক্ত পদ্ধতিটিই অধিক শক্তিশালী এবং অধিকতর নির্ভরযোগ্য। এ জন্য হাদীস, ফিকহ, উসূলে ফিকহ ইত্যাদি বিষয়ের ইমামগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, প্রথমোক্ত পদ্ধতিতে কোনো গ্রন্থের গ্রন্থকার সম্পর্কে নিশ্চয়তা লাভের পর কিংবা ওই গ্রন্থটি নির্ভরযোগ্য প্রমাণিত হওয়ার পর গ্রন্থকার পর্যন্ত সনদ বা ‘সূত্র’ সন্ধান করা কিংবা সেই কিতাব থেকে কোনো হাদীস, কোনো মাসআলা বা কোনো তথ্য বর্ণনার জন্য এ সূত্র অপরিহার্য মনে করা একেবারেই ভুল। এ কথা আহলে ইলমের কাছে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। কেননা, সকল ইলম ও ফনের প্রাচীন গ্রন্থাদির ক্ষেত্রেই এই নীতি প্রযোজ্য। তবুও আমি পাঠকবৃন্দের মনের প্রশান্তির জন্য চারজন ইমামের উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি।
১. ইমাম আবু ইসহাক ইসফিরাঈনী (৪১৮হি.)
জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ. লিখেছেন, ইমাম আবু ইসহাক ইসফিরাঈনী এ বিষয়ে সকল ইমামের ইজমা উল্লেখ করেছেন যে, যে গ্রন্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের আস্থা অর্জন করেছে, তা থেকে তথ্যাদি উদ্ধৃত করা বৈধ। এর জন্য গ্রন্থকার পর্যন্ত সনদভিত্তিক সংযুক্তি জরুরি নয়। হাদীস ও ফিকহ উভয় বিষয়ের গ্রন্থাদির ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। —তাদরীবুর রাবী ১/১৫১
২. ইমাম ইবনে হাজার আসক্বালানী (৮৫২ হি.)
ইনি সহীহ বুখারীর সর্বোত্তম ও বিশ্বস্ততম ভাষ্যগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারী’র বিখ্যাত রচয়িতা। তিনি লিখেছেন-‘যে গ্রন্থগুলো (শাস্ত্রজ্ঞদের মাঝে) প্রসিদ্ধ ও সমাদৃত (যেমন, সুনানে নাসায়ী) তা গ্রন্থকার থেকে প্রমাণিত হওয়ার জন্য পাঠক থেকে গ্রন্থকার পর্যন্ত সনদ যাচাই-এর প্রয়োজনীয়তা নেই। -আননুকাত আলা কিতাবি ইবনিস সালাহ ১/২৭১
৩. ইমাম ইযযুদ্দীন ইবনে আব্দিস সালাম (৬৬০ হি.)
ইনি ফিকহ, হাদীস ও তাফসীর ছাড়াও অন্য অনেক বিষয়েও ইমাম পর্যায়ের মনীষী। তিনি লিখেছেন, “ফিকহের যে প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহের বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কপি বিদ্যমান রয়েছে সেগুলোর উপর নির্ভর করা বৈধ হওয়ার বিষয়ে আলিমগণ একমত। কেননা, বর্ণনাসূত্র (সনদ) দ্বারা যে নিশ্চয়তা লাভ হয় তা এই পদ্ধতিতেও লাভ হয়ে থাকে (বরং তার চেয়ে দৃঢ়ভাবে)। এ জন্যই মানুষ নাহব লুগাত এবং অন্যান্য ইলম ও ফনের প্রসিদ্ধ গ্রন্থাদির উপর নির্ভর করে থাকেন (এবং গ্রন্থকার পর্যন্ত বর্ণনাসূত্রের সন্ধান প্রয়োজন মনে করেন না) এখন যে মনে করে যে, সকল মানুষ বিভ্রান্তিতে রয়েছে তিনি বিভ্রান্তিতে থাকা অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
‘মোটকথা, যে বলে, কোনো বিশুদ্ধ কপি বিশিষ্ট প্রসিদ্ধ গ্রন্থ থেকে বর্ণনা করতে হলে গ্রন্থকার পর্যন্ত সনদ বা সূত্র বিদ্যমান থাকতে হবে সে ইজমা-বিরোধী।” —তাদরীবুর রাবী ১/১৫২, আল আজবিবাতুল ফাযিলাহ, আব্দুলহাই লাখনোভী ৬০-৬৪; তাওজীহুন নযর, তাহির জাযাইরী ২/৭৬৫-৭৭২
৪. ইমাম ইবনুল হুমাম (৭৯০—৮৬১ হি.)
ইনি হাদীস, ফিকহ ও উসূলের প্রসিদ্ধ ইমাম ছিলেন। তিনি তার কিতাব ফাতহুল কাদীরে (১/৩৬০) লিখেছেন, ‘ইমামে মাযহাব থেকে কোনো মাসআলা বর্ণনা করতে হলে তার দুটি পদ্ধতি রয়েছে। এক. ইমাম থেকে মাসআলাটি সনদসহ বর্ণনা করা। দুই. মাসআলাটি ফিকহের কোনো প্রসিদ্ধ ও ব্যাপক পঠিত গ্রন্থ (অর্থাৎ যা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ব্যক্তিবর্গের কাছে সমাদৃত) তা থেকে গ্রহণ করা। যেমন ইমাম মুহাম্মদ রহ.-এর রচনাবলি এবং অন্যান্য মুজতাহিদের প্রসিদ্ধ রচনাবলি। কেননা এই গ্রন্থগুলো প্রসিদ্ধির কারণে এবং ব্যাপক ব্যবহারের কারণে ‘খবরে মুতাওয়াতির’ বা ‘খবরে মশহুর’-এর পর্যায়ে উন্নীত। ইমাম আবু বকর রাযী আল জাসসাস রহ.ও আলফুসূল ফিল উসূল (৩/১৯২)-এ এ বিষয়টি ব্যক্ত করেছেন। এরপর ইবনুল হুমাম (রহ.) লেখেন যে, “মারগীনানী (৫৯২ হি.) কৃত ‘হিদায়া’ এবং সারাখসী (৪৮২ হি.) কৃত ‘আলমাবসূত’ উপরোক্ত ধরনের প্রসিদ্ধ ও সমাদৃত গ্রন্থাদির অন্তর্ভুক্ত।”
উপরোক্ত স্বীকৃত নীতির আলোকে পাঠকবৃন্দের কাছে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ, মুয়াত্তা মালিক, ত্বহাবী শরীফ, দারাকুতনী, ইবনে আব্দিল বার-এর তামহীদ, ইস্তেযকার, মিশকাত শরীফ, মাসাবীহুস সুন্নাহ বাগাভী, বায়হাকী এবং অন্যান্য হাদীসের কিতাব, তাফসীরে কুরতুরী, তাফসীরে ইবনে কাছীর, রূহুল মাআনী, তাফসীরে তাবারী এবং অন্যান্য তাফসীরের কিতাব, তাহযীবুত তাহযীব, মীযানুল ইতিদাল, তাহযীবুল কামাল এবং অন্যান্য আসমাউর রিজালের কিতাব, বাদায়েউস সানায়ে, শরহে বিকায়া, কানযুদ দাকাইক, আদদুররুল মুখতার, রদ্দুল মুহতার, (ফাতাওয়ায়ে শামী) ফাতাওয়া আলমগীরী এবং অন্যান্য ফিকহ ও ফতোয়ার কিতাব যা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের কাছে সমাদৃত এগুলো থেকে হাদীস, তাফসীর কিংবা কোনো ফিকহী মাসআলা বর্ণনা করার জন্য এগুলোর রচয়িতাদের পর্যন্ত সনদ ও সনদের মান বিষয়ে খেঁাজাখুঁজিতে লিপ্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। কেননা, বিশেষজ্ঞদের কাছে এই কিতাবগুলো সমাদৃত হওয়াই সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা এবং গ্রন্থকারের পরিচয় বিশুদ্ধ হওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে। ‘তাওয়াতুর’ ও ‘ইজমা’র মতো দলীল দ্বারা কোনো বিষয় প্রমাণিত হওয়ার পর ভিন্ন কোনো দলীল তালাশ করার কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে? উপরন্তু এমন দলীল বা সনদ যা ‘সহীহ’ ও ‘মুত্তাসিল’ হলেও সর্বোচ্চ ‘খবরে ওয়াহিদ’-এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
আমি এ কথাটি আগেও বলেছি যে, এই প্রসিদ্ধ গ্রন্থাদির রচয়িতাদের পর্যন্ত ‘সনদ’ও আলহামদুলিল্লাহ আমাদের কাছে বিদ্যমান রয়েছে এবং নমুনা হিসেবে একটি সনদ এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় কিস্তিতে উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ।
সনদের দ্বিতীয় পর্যায়
এবার শুধু এ আলোচনাটুকু রইল যে, হিদায়া, কানয ইত্যাদি গ্রন্থের রচয়িতাদের কাছে আইম্মায়ে মাযহাব-ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হাসান শাইবানী প্রমুখের বয়ানকৃত মাসায়েল কোন সূত্রে পৌঁছেছে? উপরের আলোচনা থেকেও এ বিষয়টি অনুমান করে নেওয়া সম্ভব তবুও এখানে কিছু কথা উল্লেখ করছি।
১. যাদের মধ্যে তাহকীকের যোগ্যতা নেই তাদের জন্য তো এটুকুই যথেষ্ট যে, যেহেতু এগুলো নির্ভরযোগ্য কিতাব তাই এতে যে কথাগুলো আইম্মায়ে ফিকহের উদ্বৃতিতে বলা হয়েছে তা নিশ্চিত হয়েই বলা হয়েছে। অতএব এই উদ্বৃতি সঠিক।
কোথাও দুই এক মাসআলায় ইমামগণের মাসলাক বর্ণনা করতে কোনো ভুল হয়ে গেলেও তা ব্যাখ্যাকার ও টীকাকারগণ যত্নের সাথে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। ফিকহের শিক্ষক ও ফতোয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীলদের এ বিষয়ে সম্যক অবগতি রয়েছে। এজন্য এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত হওয়া বা তাদেরকে বিভ্রান্ত করার প্রশ্নই আসতে পারে না।
২. এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি বিষয় রয়েছে। একটি হল কোনো কথার সনদ না থাকা আর অপরটি হল সনদ উল্লেখিত না হওয়া। এই দুই বিষয়ের পার্থক্য সুস্পষ্ট। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, গাইরে মুকাল্লিদ ভাইরা এই পার্থক্যের দিকেও ভ্রূক্ষেপ করেন না। তারা যখন কুদুরী, শরহে বিক্বায়া, কানয ইত্যাদি কিতাবে মাসায়েলের সঙ্গে ‘সনদে’র উল্লেখ দেখতে পান না তখন বলতে শুরু করেন যে, দেখ, দেখ, এই মাসআলাগুলোর কোনো সনদ নেই। এ বিষয়টি এমনই হল যেন কেউ মুহিউস সুন্নাহ বাগাভীর প্রসিদ্ধ হাদীসের কিতাব ‘মাসাবীহুস সুন্নাহ’-তে উল্লেখিত হাদীসগুলোকে শুধু এ জন্য সনদহীন বলে দিল যে, মাসাবীহ কিতাবে হাদীসগুলোর সনদ উল্লেখিত হয়নি। অথচ যদিও মাসাবীহ কিতাবে হাদীসের সনদ উল্লেখিত হয়নি কিন্তু বাগাভী রহ. যে উৎস গ্রন্থগুলো থেকে মাসাবীহ কিতাবের জন্য হাদীস সংগ্রহ করেছেন, সেখানে প্রত্যেক হাদীসের সঙ্গে সনদ উল্লেখিত হয়েছে। তাহলে কোনো কিতাবে যদি সাধারণ পাঠকের সুবিধার্থে এবং সংক্ষিপ্ততার স্বার্থে সনদ উল্লেখ করা না হয় তবে কি তা থেকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় যে, কথাটির আদৌ কোনো সনদ নেই? বাস্তবে সনদ না থাকা আর কোনো কারণে সনদ উল্লেখিত না হওয়া এ দুয়ের পার্থক্য তো অবশ্যই বোঝা উচিত।
মুখতাসারুল কুদুরী, কানযুদ দাকাইক, আলবিকায়াহ এবং ফিকহে হানাফীর অন্যান্য ‘মুতূন’ ও ‘মুখতাসারাত’, যা সংক্ষিপ্ততার কারণে এবং পঠন-পাঠনের সুবিধার কারণে দ্বীনী মাদরাসাগুলোতে পাঠ্যসূচীর অন্তভুর্ক্ত ছিল এবং এখনও আছে এগুলোতে প্রত্যেক মাসআলার সঙ্গে সনদ উল্লেখ করা হয়নি সংক্ষিপ্ততার উদ্দেশ্যে। অন্যথায় হানাফী ইমামগণ পর্যন্ত, বিশেষত ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হাসান আশশাইবানী পর্যন্ত প্রত্যেক মাসআলার সনদ ফিকহের উৎস গ্রন্থগুলোতে বিদ্যমান রয়েছে এবং ওইসব গ্রন্থেও রয়েছে যা ‘মুতূন’ শ্রেণীর গ্রন্থাদির ‘শুরূহ’ আকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
কুদূরী, ‘কানয’ ইত্যাদি ‘মুতূন’ বা ‘মুখতাসারাত’ শ্রেণীর গ্রন্থগুলো এ জন্যই তৈরি হয়েছে যে, এতে মৌলিকভাবে ওই সকল মাসআলা সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখিত হবে যা ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হাসান আশশাইবানী (১৩২ হি.—১৮৯ হি.)-এর প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে। এই কিতাবগুলো প্রতি যুগের ফিকহ ও ফতোয়া বিশেষজ্ঞদের কাছে, এমনকি অন্যান্য মাযহাবের ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের কাছেও ফিকহে হানাফীর ‘মুতালাক্কা বিল কাবূল’ বা স্বীকৃত উৎসগ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত। সেই ছয় কিতাবের নাম এখানে উল্লেখ করা হল।
১. কিতাবুল আসল।
এর অপর নাম আলমাবসূত। কিতাবটির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মুদ্রিত অবস্থায়ও রয়েছে।
২. আলজামিউস সাগীর
৩. আলজামিউল কাবীর
এই দু’টি কিতাব পূর্ণাঙ্গভাবে মুদ্রিত রয়েছে।
৪. আসসিয়ারুল কাবীর।
এ কিতাবটি এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘শরহুস সিয়ারিল কাবীর সারাখসী (৪৮২ হি.)-এর সঙ্গে একীভূতভাবে মুদ্রিত হয়েছে।
৫. আসসিয়ারুস সাগীর।
এ কিতাবটি আমাদের জানামতে এখনও অমুদ্রিত।
৬. আযযিয়াদাত।
এ কিতাবটিও ভাষ্যগ্রন্থ ‘শরহুয যিয়াদাত কাযী খান (৫৯৩ হি.)-এর সঙ্গে একীভূতভাবে মুদ্রিত রয়েছে।
ইমাম মুহাম্মাদ রহ. ফিকহে হানাফীর শীর্ষস্থানীয় তিন ইমামের অন্যতম। অপর দুই ইমাম-ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম আবু ইউসুফ ছিলেন তাঁর উস্তাদ। তাঁদের ফিকহী মাযহাব তিনি সরাসরি তাঁদের কাছ থেকেই গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম আবু ইউসুফের ফিকহ ও হাদীস বিষয়ক সংকলন ও গ্রন্থসম্ভারও তাঁর কাছে ছিল। তাহলে যে মাসআলাগুলো ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর গ্রন্থাবলি থেকে গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে এই প্রশ্নের কী অর্থ থাকে যে, ইমাম মুহাম্মাদ ও তাঁর দুই উস্তাদ পর্যন্ত এগুলোর সনদ কী?
আমাদের গাইরে মুকাল্লিদ ভাইয়েরা ‘হিদায়া’ সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করে থাকেন যে, এ কিতাবের মাসায়েলের সনদ কোথায়? অথচ তারা যদি ‘হিদায়া’ পড়ে দেখতেন, তাহলে হয়তো এ প্রশ্ন করতেন না। হিদায়া হল হিদায়া গ্রন্থকার মারগীনানী রহ.-এর অন্য একটি রচনা ‘বিদায়াতুল মুবতাদী’র ব্যাখ্যাগ্রন্থ। ‘বিদায়াতুল মুবতাদী’তে শুধু ‘মুখতাসারুল কুদূরী’ ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসানের ‘আলজামিউস সাগীর’-এর মাসায়েল উল্লেখিত হয়েছে।
‘মুখতাসারুল কুদূরী’ কিতাবটি তো প্রত্যেক তালিবে ইলমের কাছেই রয়েছে, আলজামিউস সাগীরও আলহামদুলিল্লাহ অনেক মাদরাসায় এসে গেছে। আজ থেকে এক শতাব্দী আগেই এই কিতাব হিন্দুস্তানে মুদ্রিত হয়েছে।
আলজামিউস সাগীর খুললেই দেখা যাবে, প্রত্যেক মাসআলার শুরুতে ইমাম মুহাম্মাদ সনদ উল্লেখ করেছেন। এই কিতাবের সকল মাসআলা ইমাম মুহাম্মাদ রহ. ইমাম আবু ইউসুফ থেকে গ্রহণ করেছেন এবং তিনি ইমাম আবু হানীফা থেকে। এজন্য প্রত্যেক মাসআলার শুরুতে এ কথাটি রয়েছে-
محمد عن يعقوب عن أبي حنيفة.
ইয়াকুব হল ইমাম আবু ইউসুফের নাম। তবে তিনি ‘আবু ইউসুফ’ উপনামেই সমধিক প্রসিদ্ধ।
এবার কুদূরীর মাসআলাগুলোর প্রসঙ্গ। আলজামিউস সাগীরের বাইরের যে মাসায়েল এ কিতাবে রয়েছে তা ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর অপর পাঁচ কিতাব থেকেই গৃহীত। কোথাও কোনো মাসআলা অন্য কোনো কিতাব থেকে গৃহীত হলে তা হিদায়া বা তার ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোতে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হয়েছে।
৩. আজ আমাদের বন্ধুগণ এই প্রশ্ন তুলছেন যে, হানাফী মাযহাবের মাসআলাগুলোর সনদ আছে কি না? অথচ তারা যদি জানতেন যে, শুধু সনদ নয়, সনদ বিষয়ক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াও হানাফী ফকীহগণ যে কাজ সম্পন্ন করেছেন তা এই যে, ফিকহে হানাফীর মাসআলাগুলোর মধ্যে কোন মাসআলা আইম্মায়ে মাযহাব থেকে বর্ণিত এবং কোনগুলো তাঁদের নির্ধারণকৃত নীতিমালার ভিত্তিতে উৎসারিত, অর্থাৎ পরবর্তী যুগের ফকীহগণ (যাদেরকে পরিভাষায় ‘মুজতাহিদীন ফিল মাযহাব’ ‘আসহাবুত তাখরীজ’ ও ‘আসহাবুত তারজীহ’ বলা হয়) গবেষণা করে বের করেছেন তা নির্ণয় করা। এরপর যে মাসআলাগুলো আইম্মায়ে মাযহাব থেকে বর্ণিত হয়েছে তা কি হুবহু এভাবেই বর্ণিত হয়েছে, না মূল কথাটি সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণিত হয়েছিল এবং পরবর্তী যুগের ফকীহগণ তা ব্যাখ্যা করেছেন, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ব্যাখ্যাকারী কে ইত্যাদিও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এরপর ইমামদের থেকে বর্ণিত মাসআলাগুলোর বর্ণনাসূত্র কোন পর্যায়ের-কোন মাসআলাগুলো ‘মুতাওয়াতির’ বা ‘মাশহুর’-এর সূত্রে বর্ণিত এবং কোনগুলো ‘খবরে ওয়াহিদ’-এর সূত্রে, এ বিষয়টিও নির্ণিত হয়েছে।
মুসতাখরাজ মাসায়েল অর্থাৎ ইমামগণের পরবর্তী ফকীহগণের গবেষণাকৃত মাসআলাগুলোর মধ্যে কোন মাসআলা কোন ফকীহর ইস্তেখরাজ বা গবেষণা এবং কোন গবেষণাগুলো গৃহীত ও সমাদৃত হয়েছে আর কোনগুলোতে আপত্তি হয়েছে এই সকল বিষয়েও ফকীহগণ আলোচনা করেছেন। এজন্য মাসায়েলের বিভিন্ন শ্রেণীবিন্যাস এবং সেগুলোর বিভিন্ন পারিভাষিক নাম সৃষ্টি হয়েছে। যথা-‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’, ‘নাদিরুর রিওয়ায়াহ’, ফাতাওয়াল মাশাইখ ইত্যাদি। ফকীহদের এই পরিশ্রম আলহামদুলিল্লাহ বিনষ্ট হয়নি। এখনো পর্যন্ত ‘শুরূহ’ শ্রেণীর বিশদ গ্রন্থগুলোতে এ ধরনের পর্যাপ্ত আলোচনা বিদ্যমান রয়েছে। এ শ্রেণীর গ্রন্থগুলোর মধ্যে আলমাবসূত, শামসুল আইম্মা সারাখসী (৪৮২ হি.) বাদায়েউস সানায়ে আলকাসানী (৫৮৭হি.) ফাতহুল কাদীর শরহুল হিদায়া, ইবনুল হুমাম (৮৬১ হি.) শরহু মুখতাসারিত ত্বহাবী, লিল জাসসাস, শরহু মুখতাসারিল কারখী, লিল কুদূরী (৪২৮ হি.), আলবাহরুর রায়েক ইবনে নুজাইম (৯৭০ হি.), রদ্দুল মুহতার ইবনে আবেদীন শামী (১২৫২ হি.), শরহুল জামিইস সাগীর, লিল জাসাস (৩৭০ হি.), শরহুল জামিইল কাবীর, লিল জাসসাসসহ আরও অনেক গ্রন্থ রয়েছে।
প্রথমোক্ত তিনটি কিতাব মুদ্রিত হয়েছে এবং শেষোক্ত চারটি কিতাব ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন কুতুবখানায় ‘মাখতূত’ (হস্তলিখিত) আকারে রয়েছে। সর্বশেষ গ্রন্থের একটি হস্তলিখিত কপির ফটোকপি আলহামদুলিল্লাহ মারকাযুদ দাওয়া আল ইসলামিয়া ঢাকা-এর গ্রন্থাগারেও বিদ্যমান রয়েছে। মূল গ্রন্থটি রয়েছে দারুল কুতুবিল মিসরিয়্যা, কায়রোতে।
ফিকহে হানাফীর এমন কিছু রচনাও আছে, যেখানে পাঠকের সুবিধার্থে প্রত্যেক শ্রেণীর মাসায়েল আলাদা আলাদভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে। ইমাম রযীউদ্দীন আসসারাখসী (৫৪৪ হি.)-এর আলমুহীতুর রাযাভী হল এ ধরনের একটি গ্রন্থ। এ গ্রন্থে প্রতি অধ্যায়ে ধারাবাহিকভাবে প্রথমে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ শ্রেণীর মাসায়েল, এরপর ‘নাদিরুর রিওয়ায়াহ’ শ্রেণীর এবং সবশেষে ‘ফাতাওয়াল মাশাইখ’ শ্রেণীর মাসায়েল উল্লেখিত হয়েছে। এই বিষয়গুলো সামনে রেখে চিন্তা করলে গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুদের পক্ষ থেকে ফিকহে হানাফীর সনদ সম্পর্কে উত্থাপিত প্রশ্নের মূল্য কতটুকু তা স্পষ্ট হয়ে যায়। এ ধরনের খামখেয়ালির মূল কারণ হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নোক্ত নির্দেশনা অনুসরণ না করা, যা হাদীস শরীফে এভাবে এসেছে—
‘যখন তারা জানে না তখন কেন জিজ্ঞেস করল না? না জানার সমাধান হল প্রশ্ন করা।’
তৃতীয় ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়
ফিকহে হানাফীর সনদ বিষয়ে সর্বশেষ প্রসঙ্গ হল মাসআলার সনদ প্রসঙ্গ। অর্থাৎ হানাফী ইমামগণ যদি এই মাসআলাগুলো তাঁদের পূর্ববর্তী ফুকাহায়ে সাহাবা ও ফুকাহায়ে তাবেয়ীন থেকে গ্রহণ করে থাকেন তবে সেই সনদ এবং তা কোথায় উল্লেখ আছে তা আলোচনা করা। যে মাসায়েল তারা পূর্ববর্তী ফকীহদের থেকে গ্রহণ করেছেন আর যে মাসায়েল নিজেরা বের করেছেন—এই উভয় ধরনের মাসায়েলের উৎস কী এবং শরীয়তের দলীল বিশেষত, কুরআনে কারীম, সুন্নাতে নববী ও হাদীস শরীফের সঙ্গে এই মাসায়েলের সামঞ্জস্য কতটুকু এ বিষয়ে আলোকপাত করাই হল এ পর্যায়ের আলোচনার উদ্দেশ্য।
আলহামদুলিল্লাহ আমরা গবেষণা ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতেই পূর্ণ আশ্বস্তির সঙ্গে বলতে পারি যে, ইসলামী ফিকহের অন্য সকল স্বীকৃত সংকলনের ন্যায় ফিকহে হানাফী শীর্ষক সংকলনটিও কুরআন, সুন্নাহ ও অন্যান্য শরয়ী দলীল থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়; বরং এ সংকলনটিও কুরআন-সুন্নাহরই ব্যাখ্যাতা। কুরআন-সুন্নাহর বিধি-বিধান এবং কুরআন সুন্নাহর মূলনীতিসমূহের আলোকে প্রদত্ত সিদ্ধান্তসমূহেরই বিন্যস্ত রূপ এবং আলহামদুল্লিাহ সার্বিক বিবেচনায় ফিকহের অন্যান্য সংকলনের তুলনায় এ সংকলনটিই শরীয়তের দলীল বিষয়ক স্বীকৃত মূলনীতি—
عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين
এর সঙ্গে সর্বাধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। সম্ভবত এজন্যই অন্যান্য সংকলনের তুলনায় এ সংকলনটি অধিক সমাদৃত এবং সর্বযুগে সর্বাধিক অনুসৃত। গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুদের এত প্রচেষ্টা ও অপপ্রচারের পরও এ যুগেও এ সংকলনের গ্রহণযোগ্যতাই সবচেয়ে বেশি।
সংক্ষিপ্ততার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আলোচনা কিছুটা দীর্ঘ হয়ে গেল । তাই এ মৌলিক কথাটি বলেই এ সংখ্যার আলোচনা শেষ করছি। আগামী সংখ্যায় ফিকহে হানাফীর সনদের এই পর্যায়টি সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ও প্রমাণ ভিত্তিক আলোচনা পেশ করব ইনশাআল্লাহ। সে আলোচনায় আমাদের থেকে নিয়ে ফিকহ-গ্রন্থাদির রচয়িতাদের পর্যন্ত এবং তাদের থেকে ইমাম আবু হানীফা রহ. পর্যন্ত একটি ‘মুত্তাসিল সনদ’ উদাহরণস্বরূপ পেশ করারও ইচ্ছা রইল।