আস্থার সম্পদ যেন না হারাই
মুসলিম উম্মাহর ঈর্ষণীয় সৌভাগ্য হল শিকড়ের সঙ্গে তাদের সংযুক্তি। এক মুহূর্তের জন্যও এই সম্পর্কে কোনোরূপ ছেদ ঘটেনি। রিজালুল্লাহর অবিচ্ছিন্ন সূত্রে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতু রাসূলিল্লাহর সঙ্গে এই উম্মাহ সদা সংযুক্ত ছিল। সাহাবা-তাবেয়ীন, ফুকাহা-মুহাদ্দিসীন এবং প্রতি যুগের বিশ্বস্ত উলামায়ে উম্মত কুরআন-সুন্নাহর পবিত্র আমানতকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁদের বিশ্বস্ততা ও আমানতদারী ছিল প্রশ্নাতীত। কেননা, তাঁদের মাধ্যমে মহান রাব্বুল আলামীনের অমোঘ ঘোষণা—আমি এই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই তা সংরক্ষণ করব, বাস্তবায়িত হয়েছে। সমগ্র মুসলিম উম্মাহ দ্বীনের বিষয়ে এই মহান কাফেলার প্রতিই আস্থাশীল ছিল এবং এই আস্থা ও বিশ্বাসের বদৌলতে তাঁরা সংযুক্ত ছিলেন তাদের সুমহান ঐতিহ্যের সঙ্গে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, মুসলিম উম্মাহর মাঝে আস্থার সংকট সৃষ্টির কোনো প্রচেষ্টা কেউ কখনও গ্রহণ করেনি; বরং বাস্তব কথা এই যে, কোনো যুগই এই অপপ্রয়াস থেকে মুক্ত ছিল না। প্রতি যুগেই যেমন দ্বীনের উৎসগুলোর বিষয়ে, তেমনি এই উৎসের ধারক-বাহক-সংরক্ষকদের সম্পর্কেও মুসলিম উম্মাহকে আস্থাহীন করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। যাদের নসীব মন্দ ছিল তারা এসবে বিভ্রান্ত হলেও গোটা মুসলিম উম্মাহ কখনো বিভ্রান্তির আঁধারে নিমজ্জিত হয়নি।
ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত কর্মকাণ্ডের ইতিহাস অতি প্রাচীন। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে, তাঁর পুণ্যাত্মা স্ত্রীগণ ও আহলে বাইত সম্পর্কে এবং তাঁর সাহাবীদের সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার কম হয়নি। এঁরাই যখন নিষ্কৃতি পাননি তো পরবর্তী যুগের ব্যক্তিগণ নিষ্কৃতি পাবেন তা আশা করাও বাতুলতা মাত্র। পরবর্তী যুগের ফকীহ-মুহাদ্দিস, আলিম-উলামা, দায়ী ইলাল্লাহ ও মুজাহিদ ফী সাবীলিল্লাহ সকলেই বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মিথ্যা প্রচারের নিশানা হয়েছেন। এসব গোষ্ঠীর সবার উদ্দেশ্য অভিন্ন ছিল এমন কথা আমরা বলব না, তবে ফলাফল বিচারে এদের কাজকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভিন্নতা ছিল একথাও বলা যায় না। ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠীর মিথ্যা প্রচারের উদ্দেশ্য যদি হয় মুসলিম মন-মানসকে তাদের দ্বীনী ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে আস্থাহীন করা তবে মুসলিম উম্মাহর নাদান দোস্তদের হঠকারিতার ফলাফলও ভিন্ন কিছু হয়নি। এই আস্থাহীনতা সৃষ্টি কেবল ইসলামী ব্যক্তিত্বদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বিভিন্ন ভিত্তিহীন প্রচারের মাধ্যমে ইসলামের উৎস ও শাস্ত্রাদি সম্পর্কেও গণমানসে অবিশ্বাস সৃষ্টির প্রচেষ্টা হয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় কুরআন, সুন্নাহ, ফিকহ, ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি সকল বিষয়ই ভিত্তিহীন সমালোচনার শিকার হয়েছে।
আমাদের এই উপমহাদেশে ইংরেজ রাজশক্তি তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে মিষ্টার-মৌলভীর যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল এই বিভেদকে চিরস্থায়ী করার জন্য ইসলামের ধারক-বাহকদের সম্পর্কে এবং দ্বীন ও দ্বীনের উৎস সম্পর্কে আস্থার সংকট সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা ছিল অপরিহার্য। এ উদ্দেশ্যে তারা তাদের কার্যক্রম খুব সুচারুরূপে সম্পাদন করেছে। দুঃখের বিষয় এই যে, মুসলিম উম্মাহর কিছু গোষ্ঠী সচেতনভাবে কিংবা অসচেতনতার কারণে তাদের লক্ষ্য পূরণে সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে। এ বিষয়ে তাদেরও সচেতন হওয়া উচিত এবং সাধারণ মুসলিম জনগণেরও সতর্ক হওয়া কর্তব্য। তবে আশার কথা এই যে, প্রতি যুগে যেমন ছিল, এ যুগেও এই প্রবল বিরুদ্ধ স্রোতের মুখে দাঁড়িয়ে একটি কাফেলা কাজ করে চলেছেন। তারা হয়তো বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত রয়েছেন এবং খুব শক্তিশালী পার্থিব উপকরণে সমৃদ্ধ নন, কিন্তু মহান আল্লাহর নুসরতের প্রতি আস্থা রেখে তারা কাজ করে চলেছেন। দ্বীনের প্রতি মুসলিম উম্মাহর আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহালকরণে তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা উম্মাহর জন্য শুভফল বয়ে আনবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা এই মহান কাফেলার সকলের অবদানকে কবুল করুন এবং আমাদেরকেও ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে এই কাফেলার সঙ্গে সংযুক্ত থাকার তাওফীক দান করুন।
এবার বর্তমান সংখ্যা সম্পর্কে কিছু কথা। প্রতি সংখ্যার মতো এবারও বিভিন্ন আয়োজন নিয়ে আমরা পাঠকদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। এবারের গবেষণা-প্রবন্ধটির শিরোনাম হচ্ছে ‘ফিকহে হানাফীর সনদ’। পাঠকদের জন্য একটি তথ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ নতুন পরিবেশনা এ প্রবন্ধে বিদ্যমান। লিখেছেন মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেক ছাহেব। এ ছাড়া বিভিন্ন স্বাদের অনেকগুলো প্রবন্ধ-নিবন্ধের সঙ্গে রয়েছে নিয়মিত সকল বিভাগ। এবার আরও একটি নতুন বিভাগের সংযোজন ঘটল। সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে একগুচ্ছ নাতিদীর্ঘ নিবন্ধ নিয়ে বিভাগটির শিরোনাম রাখা হয়েছে- ফিলহাল। আশা করি বিভাগটি আপনাদের ভালো লাগবে। আপনাদের মতামত ও সহযোগিতা আমাদের আরও সমৃদ্ধ করবে ইনশাআল্লাহ। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।