নবীজীর স্নিগ্ধ হাসি
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আনন্দিত হতেন তখন তাঁর চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের মতো ঝলমল করে উঠত। দৈননিদন জীবনের বিভিন্ন কৌতুক ঘটনা, আশপাশের মানুষের সরলতাপূর্ণ কথাবার্তা ইত্যাদি নবী সা.কে আনন্দিত করত। তবে তিনি বেশি আনন্দিত হতেন তাঁর উম্মতের কোনো কল্যাণ হলে। আল্লাহ তাআলার রহমত ও মেহেরবানীর কথা বলার সময়ও নবীজীর অপূর্ব হাসি দেখা দিত। তাতে সাহাবায়ে কেরাম অত্যান্ত আনন্দিত হতেন। আবার কিয়ামত ও আখেরাতের বিভিন্ন আনন্দের বিবরণ দেওয়ার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনন্দিত হতেন। আমাদের সৌভাগ্য যে, নবী প্রেমিক সাহাবায়ে কেরাম সেসব বিবরণ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। হাদীসের কিতাবে তা যতেœর সঙ্গে সংরক্ষিত রয়েছে। এই ঘটনাগুলি পড়ার সময় আমাদের মন চলে যায় চৌদ্দশ বছর আগের সেই পুণ্য যুগে। নিজের অজান্তেই আমরা যেন হাজির হই পুণ্যভূমি সোনার মদীনায় এবং শরীক হয়ে যাই নবী সা.-এর মোবারক মাহফিলে। এরকম কিছু ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।
সে নিশ্চয়ই কুরাইশী কিংবা আনসারী হবে!
একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে এক বেহেশতী মানুষের গল্প শুনাচ্ছিলেন। সে বেহেশতে গিয়ে আল্লাহর কাছে আবদার করবে, ইয়া আল্লাহ! আমাকে চাষবাসের অনুমতি দিন। আল্লাহ বলবেন, এখানে কি কোনো কিছুর অভাব আছে যে, তুমি চাষবাস করতে চাচ্ছ? বেহেশতী বলবে, আল্লাহ! অভাব নেই, তবে আমার চাষাবাদের ইচ্ছে হয়েছে। আল্লাহ তাকে অনুমতি দিবেন। সে বীজ বপন করবে এবং মুহূর্তের মধ্যে চারা গজাবে। সেই চারা বড় হবে, তাতে শস্য হবে এবং কাটাই মাড়াই হয়ে তার সামনে উপস্থিত হবে। আল্লাহ বলবেন, নাও, কোনো কিছুতেই তোমার মন ভরে না! এই মজলিসে একজন বেদুইন সাহাবী ছিলেন। পশুপালন জীবিকার মাধ্যম। তিনি বলে উঠলেন, হুজুর এ লোক নিশ্চয়ই কুরাইশী কিংবা আনসারী হবে! কেননা তারাই তো চাষবাস করে থাকে। বেদুইন সাহাবীর কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে দিলেন।-সহীহ বুখারী হা. ২৩৪৮
আমার চেয়ে দরিদ্র আর কে আছে?
এক দরিদ্র ব্যক্তি রমযান মাসে রোযা ভেঙ্গে ফেললেন। এরপর অনুতপ্ত হয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি ধ্বংস হয়ে গেছি! নবীজী ঘটনা শুনে বললেন, তোমার কাছে কি কোনো ক্রীতদাস আছে, যাকে তুমি আযাদ করতে পার ? সে বলল, জ্বী না। নবীজী বললেন, তাহলে কি অবিরাম দুই মাস রোযা রাখতে পারবে? লোকটি বলল, জ্বী না, এই শক্তিও আমার নেই। এরপর নবীজী ষাট মিসকীনকে আহার করানোর কথা জিজ্ঞেস করলে এবারও সে তার অপারগতার কথা বলল। লোকটিকে কাফফারা আদায়ে অপারগ দেখে নবী সা. চুপ করে রইলেন। এমন সময় নবী সা.-এর দরবারে এক থলে খেজুর এল। নবীজী সেই খেজুর তাকে দিয়ে বললেন, এগুলো দান করে দাও। লোকটি বলল, হুজুর, এই মদীনায় আমার চেয়ে দরিদ্র কি আর কেউ আছে যে, আমি তাকে দান করব? লোকটির একথা শুনে নবী সা. হেসে ফেললেন এবং বললেন, ঠিক আছে, এগুলো তাহলে তোমার পরিবারের লোকদের জন্যই নিয়ে যাও। (অর্থাৎ পরে সামর্থ্য হলে কাফফারা আদায় করবে) -সহীহ বুখারী হা. ১৯৩৬
দৌড় প্রতিযোগিতা
এক সফরে আয়েশা রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলেন। নবীজী সবাইকে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলেন এবং আয়েশা রা.-এর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করলেন। সে সময় উম্মুল মুমিনীনের বয়স কম ছিল এবং তিনি হাল্কা ছিলেন। তাই প্রতিযোগিতায় তিনি জয়ী হলেন। ক’বছর পর আরেক সফরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সফরসঙ্গীদের এগিয়ে যেতে আদেশ দিলেন এবং আবার তাঁরা দৌড় প্রতিযোগিতা করলেন। এবার উম্মুল মুমিনীন দৌড়ে পিছিয়ে পড়লেন। কেননা তখন তাঁরও বয়স বেড়েছে এবং দেহ ভারি হয়েছে। নবীজী হেসে হেসে বললেন, ‘হাযিহী বিতিলকা’ অর্থাৎ এটা আগের দৌড়ের শোধ। -মুসনাদে আহমদ হা. ২৫৭৪৫
সে তো তোমাকে ভালো কথাই বলেছে !
আবু রাফি নামে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন আযাদকৃত গোলাম ছিলেন। একদিন তার স্ত্রী সালমা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে অভিযোগ করল যে, আবু রাফি তাকে মেরেছে! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু রাফিকে জিজ্ঞেস করলেন, আবু রাফি, তোমার ও সালমার মধ্যে কী হয়েছে? আবু রাফি বললেন, সে আমাকে কষ্ট দেয়। নবীজী সালমাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলল, জ্বী না, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি তাকে কষ্ট দেই না, তবে সে নামায পড়ছিল, নামাযের মধ্যে তার অযু ভেঙ্গে গেল। আমি বললাম, হে আবু রাফি, (নামাযের মাঝে) অযু ভঙ্গ হলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে (নতুন) অজু করতে বলেছেন। অমনি সে আমাকে মারতে লাগল। নবীজী একথা শুনে হেসে বললেন, আবু রাফি, সে তো তোমাকে ভালো কথাই বলেছে। -মুসনাদে আহমদ, হা. ২৫৮০৯৭
দৈনন্দিন জীবনের এরূপ নানা টুকরো ঘটনায় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধরে ফুটে উঠত স্নিগ্ধ হাসির রেখা। তবে নবীজী বেশি আনন্দিত হতেন উম্মতের কল্যাণে ও সফলতায়। আখিরাতের মুক্তি ও সৌভাগ্যের পথে তাদের অগ্রসরতা দেখলে নবীজীর চেহারা মোবারক আনন্দে ঝলমল করে উঠত। তদ্রূপ তাদের পার্থিব দুঃখ কষ্ট দূর হলেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনন্দিত হতেন।
মুমিনের সকল অবস্থাই ভালো
একদিন সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে বসে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন চিন্তামগ্ন। হঠাৎ তিনি কী ভেবে হেসে উঠলেন। সাহাবীগণ উৎসুক হয়ে হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি একথা ভেবে খুব আনন্দিত হলাম যে, মুমিনের সকল অবস্থাই তার জন্য কল্যাণকর। তার অবস্থা সুখময় হলে সে আল্লাহর শোকর করে তখন এটা তার কল্যাণের কারণ হয়, তদ্রূপ দুঃখ-কষ্টে পড়লে সে সবর করে তখন এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়। এভাবে সব অবস্থার কল্যাণ তো মুমিন ছাড়া আর কারো হয় না। -মুসনাদে আহমদ ২৩৪১২
নবীজী দুয়ায় খেজুরে বরকত হল
জাবির রা.-এর পিতা যখন মৃত্যুবরণ করলেন তখন তার অনেক ঋণ ছিল। পুত্র সেই ঋণ পরিশোধের উদ্যোগ নিলেন। খেজুর পাকার মওসুমে জাবির রা. পাওনাদারদের বললেন, আব্বাজানের ঋণের পরিবর্তে আপনারা আমার বাগানের খেজুরগুলো নিন। কিন্তু পাওনাদাররা ঋণের তুলনায় খেজুরের পরিমান কম মনে করে তাতে রাজি হল না। জাবির রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার নিরুপায় অবস্থার কথা জানালেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যখন তুমি বাগানের খেজুর কেটে একত্রিত করবে তখন আমাকে খবর দিও। জাবির রা. ঠিক সময়ে নবীজীকে খবর দিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দুই সাহাবী আবু বকর ও উমর রা. কে সঙ্গে নিয়ে সেখানে এলেন এবং খেজুরের স্তুপের নিকটে বসে বরকতের দুআ করলেন। এরপর বললেন, এবার তোমার পাওনারদের ডেকে প্রত্যেকের পুরা প্রাপ্য আদায় করে দাও। জাবির রা. একে একে সকল পাওনাদারের প্রাপ্য আদায় করতে লাগলেন। সবার পাওনা আদায়ের পরও তেরো ‘ওসক’ খেজুর থেকে গেল। পরবর্তী নামাযের সময় জাবির রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার ঋণমুক্তির কথা জানালেন। সাহাবীর আনন্দ দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনন্দিত হলেন এবং মুচকি হাসলেন। -সহীহ বুখারী হা. ২৭০৯
উম্মতের সমুদ্রাভিযান তাঁকে দেখানো হল
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কুবা পল্লীতে যেতেন তখন উম্মে হারাম বিনতে মিলহান রা.-এর মেহমান হতেন। তিনি ছিলেন উবাদা ইবনে ছামিত রা.-এর স্ত্রী। একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই গৃহে আহার করে কাইলুলা করছিলেন, হঠাৎ হাসতে হাসতে ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন। উম্মে হারাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি কেন হাসছেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি আমার উম্মতের এক দল মুজাহিদকে দেখলাম, সিংহাসনে বসা রাজা-বাদশাহর মতো গভীর সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে। উম্মে হারাম বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, দুআ করুন, আমি যেন সেই দলে থাকি। নবীজী দুআ করলেন এবং আবার ঘুমিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার হাসতে হাসতে জাগ্রত হলেন। উম্মে হারাম তার হাসির কারণ জানতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। নবীজী এবারও বললেন, আমি আমার উম্মতের একদল মুজাহিদকে দেখলাম তারা রাজকীয় অবস্থায় সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে। উম্মে হারাম এবারও এই দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দুআ প্রার্থনা করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি প্রথম দলের মধ্যে থাকবে। মুয়াবিয়া রা.-এর যুগে এই স্বপ্ন সত্য হয়েছিল। সে সময় উম্মে হারাম তার স্বামী উবাদা ইবনে ছামিত রা.-এর সঙ্গে সমুদ্র-অভিযানে অংশ নেন কিন্তু ফিরে আসার সময় বাড়ি পৌঁছার আগেই ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে শাহাদাত বরণ করেন। (অর্থাৎ পরবর্তী দলের মধ্যে তিনি আর শামিল হতে পারেননি।) -সহীহ বুখারী হা. ৬২৮৩
আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বড় নি’আমত দান করেছেন। যে নিয়ামতের সুফল তার উম্মতও ভোগ করবে। সেসব নিয়ামত স্মরন করেও নবীজী আনন্দিত হতেন।
হাউজে কাউসারের সুসংবাদ দেওয়া হল
এক মজলিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কিছুটা তন্দ্রার মতো হলো। কিছুক্ষণ পর হাসিমুখে মাথা তুললেন। সাহাবীগণ তার আনন্দের কারণ জানতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। নবীজী বললেন, এই মাত্র আমার প্রতি একটি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। সূরাটি ছিল সূরাতুল কাউসার। নবীজী তা সাহাবীদের সামনে পাঠ করলেন এবং বললেন, তোমরা জান, কাউসার কী? সাহাবীরা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সবচেয়ে ভালো জানেন। নবীজী বললেন, কাউসার হল জান্নাতের একটি নহর, যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। এতে অনেক কল্যাণ রয়েছে আর রয়েছে একটি হাউজ, যে হাউজ থেকে আমার উম্মত কিয়ামতের দিন সুপেয় পানি পান করবে। এই হাউজের চারদিকে এত পানপাত্র থাকবে যার সংখ্যা আকাশের তারকারাজির সমান। -সুনানে আবু দাউদ
বান্দার ক্ষমা প্রার্থনায় আল্লাহ সন্তুষ্ট হন
আলী রা. কোথাও সফরে যাচ্ছিলেন। তার আরোহনের জন্য সওয়ারী উপস্থিত করা হল। তিনি পাদানিতে পা রাখার সময় বললেন, বিসমিল্লাহ। সওয়ার হওয়ার পর বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। এরপর
سبحانك إني ظلمت نفسي، فاغفرلي إنه لا يغفر الذنوب إلا أنت.
এরপর তিনবার আলহামদুলিল্লাহ ও তিনবার আল্লাহু আকবর বললেন। এরপর বললেন
سبحان الذي سخر لنا هذا وما كنا له مقرنين، وإنا إلى ربنا لمنقلبون.
এই দুআ পড়ার পর মুচকি হাসলেন। জিজ্ঞেস করা হল, আমীরুল মু‘মিনীন আপনি কেন হাসলেন? আলী রা. বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি সওয়ারীতে আরোহনের সময় এভাবে দুআ পড়লেন এবং মুচকি হাসলেন। আমি তাঁকে হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বান্দা যখন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় এবং এই বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ক্ষমাকারী নেই তখন তিনি খুব সন্তুষ্ট হন। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা স্মরণ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্তর আনন্দে ভরে উঠেছিল। -সুনানে আবু দাউদ হা. ২৫৯৯
সদ্যজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়
একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অজু করলেন এবং অজু শেষ হওয়ার পর মুচকি হাসলেন। সাহাবীগণ তাঁর হাসির কারণ জানতে আগ্রহী ছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বান্দা যখন উত্তমরূপে অজু করে তারপর সঠিকভাবে নামায আদায় করে তখন সে সদ্যজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়। -মুসনাদে আহমদ হা. ৪৩২
কিয়ামত ও আখিরাতের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করার সময়ও নবীজীর মুখমণ্ডল পবিত্র হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠত।
সর্বশেষে জান্নাতে প্রবেশকারী
একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন যে লোকটি সবার শেষে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে সে কীভাবে জান্নাতে যাবে তা আমি জানি।
সে অতিকষ্টে শরীর টেনে টেনে জাহান্নামের আগুন থেকে বের হয়ে আসবে। এরপর আল্লাহ তাকে বলবেন, যাও বেহেশতে প্রবেশ কর। কিন্তু বেহেশতের কাছে গিয়ে তার মনে হবে, কোনো বেহেশত খালি নেই, সবগুলো বেহেশতীদের দ্বারা আগেই পূর্ণ হয়ে গেছে। সে ফিরে এসে বলবে, ইয়া রব, বেহেশত তো লোকে পরিপূর্ণ! আল্লাহ তাআলা আবার বলবেন, বেহেশতে যাও। এবারও তার কাছে এমনই মনে হবে এবং সে আবার একই ফরিয়াদ করবে। এবার আল্লাহ বলবেন, বেহেশতে যাও তোমাকে দশ দুনিয়ার সমান একটি বেহেশত দেওয়া হল। সে বলবে, ইয়া রব আপনি কি আমার সঙ্গে কৌতুক করছেন?! গরীব বেহেশতীর একথা উল্লেখ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে ফেললেন। -সহীহ বুখারী ৬৫৭১
যার জন্য করি চুরি সে-ই বলে চোর
একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে তাঁর সাহাবীগণ বসে ছিলেন। নবীজী ছিলেন চিন্তায় বিভোর। হঠাৎ তিনি হেসে উঠলেন। এরপর বললেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহর সঙ্গে এক বান্দার-কথা মনে পড়ে আমার হাসি এসে গেল। কিয়ামতের দিন এক বান্দা বলবে, ইয়া আল্লাহ, আপনি তো নিশ্চয়ই আমার উপর জুলুম করবেন না? আল্লাহ বলবেন, না তোমার উপর কোনো জুলুম করা হবে না। বান্দা বলবে, ইয়া আল্লাহ, আমার কাজকর্ম সম্পর্কে আমার নিজের সাক্ষ্য ছাড়া আর কারও সাক্ষ্য আমি মানব না। আল্লাহ বলবেন তোমার সত্তাই তোমার সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে এবং কিরামান কাতেবীন সাক্ষ্য দেবে। এরপর তার যবান বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কথা বলার আদেশ দেওয়া হবে। তারা তার সব আমলের বিবরণ পেশ করবে। এরপর আবার তাকে বাকশক্তি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। সে তখন তার নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলিকে লক্ষ করে বলতে থাকবে, ধিক, তোদের প্রতি শতধিক, তোদের জন্য না আমি কত কষ্ট করেছি, কত লড়াই করেছি। (আর আজকে তোরাই আমার বিপক্ষে সাক্ষ্য দিলি?!) -সহীহ মুসলিম হা. ২৯৬৯
পায়ে শিকল দিয়ে জান্নাতে নেওয়া হবে
খন্দক যুদ্দের সময় সাহাবীদের সঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও পরিখা খনন করছিলেন। তারা সবাই ছিলেন উপবাসী। তার উপর ছিলো ভীষন ঠাণ্ডা। এই কষ্টের মধ্যেও দ্বীনের জন্য জিহাদে মশগুল থাকায় আল্লাহর রহমতের ফরিয়াদ জোয়ার এল। আল্লাহ তাঁর নবীকে ভবিষ্যতের বিভিন্ন আনন্দের দৃশ্য দেখালেন নবীজী সেসব দৃশ্য দেখে আনন্দিত হয়েছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে জানিয়েছেন। এই আনন্দের আয়োজনে সাহাবীগণ তাদের সকল কষ্ট-ক্লেশ ভুলে গিয়েছিলেন। একবার পরিখা খনন করত করতে নবীজী সা. হেসে উঠলেন। সাহাবায়ে কেরাম হাসির কারণ জানতে চাইলেন। নবীজী বললেন, কিছু মানুষের অবস্থা দেখে আমি হাসলাম। পূর্বের অঞ্চল থেকে পায়ে বেড়ি দিয়ে তাদেরকে নিয়ে আসা হবে এবং জান্নাতের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। মুসনাদে আহমদ হা. ২২৩৫৪
মৃত্যুশয্যায় পিতার নসীহত
যে দশজন সাহাবী পৃথিবীতেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন তাদেরকে বলা হয় আশারায়ে মুবাশশারাহ। আশারা মানে দশ আর মুবাশশারাহ মানে সুসংবাদপ্রাপ্ত। অর্থাৎ দশজন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ব্যক্তি। হযরত সাআদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. আশারা মুবাশশারার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি মৃত্যুশয্যায় তাঁর পুত্রকে যে নসীহত করেছিলেন তা এখানে উল্লেখ করছি। তিনি বলেছিলেন যে, ‘‘প্রিয় পুত্র! পৃথিবীতে আমার চেয়ে বড় হিতাকাঙ্খী তোমার আর কেউ নেই। তাই আমার অন্তিম উপদেশ মনোযোগ দিয়ে শোন। যখন নামাযের সময় হয় তখন উত্তমরূপে অযু করবে এবং এমনভাবে নামায পড়বে যে, এরপর তোমার আর নামাযের সুযোগ হবে না।
‘লোভ-লালসা থেকে মুক্ত থাকবে এবং আল্লাহ প্রদত্ত রিযিকে সন্তুষ্ট থাকবে। কেননা হৃদয়ের পরিতুষ্টিই হল প্রকৃত প্রাচুর্য। আর লোভ-লালসাই প্রকৃত দারিদ্র্য।
‘এমন কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে, যে কথা ও কাজে পরে তোমাকে দুঃখ প্রকাশ করতে হয়।’
প্রিয় পুত্র! এই হল তোমার প্রতি আমার অন্তিম উপদেশ। এগুলোই মেনে চল এর বেশি তোমাকে আর কিছু করতে বলব না।’-আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস : ৩১২
আল্লাহ বলবেন
বেহেশতীদের আল্লাহ তাআলা এমন নিয়ামত দান করবেন, যা কোনো কর্ণ কোনো দিন শ্রবণ করেনি, কোনো চক্ষু কোনো দিন দেখেনি। আর কোনো মস্তিষ্কও কোনোদিন কল্পনা করেনি। এত নিয়ামত দান করার পর আল্লাহ একদিন বেহেশতীদের ডাকবেন। সবাই ‘আমরা হাজির ইয়া রব’ বলে উপস্থিত হবে। আল্লাহ বলবেন, জান্নাতের নিয়ামতরাজি পেয়ে তোমরা কি সন্তুষ্ট? সবাই বলবে, ইয়া রব! অবশ্যই আমরা সন্তুষ্ট। আপনি আমাদের এত নিয়ামত দান করেছেন, যা কখনো কাউকে দান করেননি। আল্লাহ বলবেন, আমি তোমাদেরকে আরও উত্তম উপহার দিতে চাই। বেহেশতীরা বলবে, ইয়া রব! এই নিয়ামতসমূহ থেকেও উত্তম কি আর কিছু হতে পারে? আল্লাহ বলবেন, হ্যাঁ। তা এই যে, আমি আমার চির সন্তুষ্টি তোমাদের জন্য ঘোষণা করছি।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৫৪৯
একটি সৌভাগ্য
তিনি এখন নেই। কিছুদিন পূর্বেও ছিলেন। আমার সৌভাগ্য যে, আমি তাঁকে দেখতে পেরেছি। তিনি হলেন বি. বাড়িয়ার সম্মানিত বড় হুজুর।
গত বছর পরীক্ষার ছুটিতে যখন বাসায় এলাম। আব্বু বললেন, আগামীকাল আমরা একজন বুযুর্গের সাক্ষাতে যাব। তখনও ঠিক বুঝতে পারিনি যে, আব্বু কার কথা বলছেন।
পরদিন যখন রওনা হলাম তখন গাড়িতে আব্বুকে জিজ্ঞাসা করলাম, আব্বু আমরা কোথায় যাচ্ছি? আব্বু বললেন, আমরা বি. বাড়িয়ার সম্মানিত বড় হুজুরকে দেখতে যাচ্ছি। দীর্ঘ সফর শেষে গাড়ি যখন বড় হুজুরের বাড়ির সামনে থামল তখন আমার মনের পর্দায় একটি নূরানী চেহারা ভেসে উঠল এবং আনন্দে মনটা ভরে গেল। আমরা বড় হুজুরের খিদমতে হাজির হলাম। একটি ভাব এবং একটি চিন্তা আমাকে আচ্ছন্ন করল-বাংলাদেশের আলেমকুল শিরোমণি সকলের নয়নমণি। আমি তার সামনে উপস্থিত! হুজুর বেশ কমযোর হয়ে পড়েছিলেন। আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারলেন না। এমনকি তাকাতেও পারলেন না। তবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, আল্লাহর কিছু বান্দা তাঁকে দেখতে এসেছে। তারপর আমরা চলে এলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল, এ দেখাই প্রথম দেখা এবং শেষ দেখা। তা-ই হল।
বড় হুজুর আমাদের জন্য, এ দেশের আলেম সমাজের জন্য অনেক কিছু ছিলেন। তাঁকে হারিয়ে আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি। জানি না, এ ক্ষতি পূরণ হবে কি না।
হুসাইন মুহাম্মাদ নূরুল্লাহ
মাদরাসাতুল মদীনা (১ম বর্ষ)