মানুষের গল্প
সাহাবিয়াগণের জীবনযাত্রায় আড়ম্বর ছিল না কিন্তু সহজতা ও স্বাভাবিকতা ছিল। বিত্তের ঝলকানি ছিল না, কিন্তু চিত্তশালিতার স্নিগ্ধ আলো ছিল। জীবনযাত্রার টুকরো টুকরো ঘটনায় সেই উজ্জ্বল্য প্রকাশ পেত। দয়া, পরোপকার, ধৈর্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি গুণ তাদের কাজকর্মকে ভিন্ন মাত্রা দান করেছিল। এখানে তাদের একটি গুণ- সবর ও আত্মনিয়ন্ত্রনের কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করছি।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ জগতের অন্য সব নারীর মতোই স্বভাবগত মমতা ও কোমলতার অধিকারী ছিলেন। তাই তাঁরাও ছিলেন মমতাময়ী মা, স্নেহময়ী বোন এবং প্রেমময়ী স্ত্রী। কিন্তু এর পাশাপাশি নবী আলাইহিস সালামের শিক্ষা তাদেরকে সবর ও আত্মনিয়ন্ত্রনেরও অধিকারী করেছিল।
হামনা রা. একজন সাহাবিয়া। উহুদ যুদ্ধের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় ফিরে এলেন তখন সাহাবিয়াগণ তাঁদের আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর জানতে উপস্থিত হন। হামনা রা.-এর ভাই ও অন্যান্য আত্মীয়ও উহুদ যুদ্ধে শরীক হয়েছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে লক্ষ করে বললেন, হামনা,তোমার ভাইয়ের ব্যাপারে সবর কর। হামনা ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়লেন এবং ভাইয়ের জন্য মাগফিরাত কামনা করলেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমার মামার ব্যাপারেও সবর কর।’ এবারও তিনি ইন্নালিল্লাহ পড়লেন এবং সবর ও আত্মনিয়ন্ত্রণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
আবু ত্বালহা রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন বিশিষ্ট সাহাবী। তাঁর স্ত্রী উম্মে সুলাইম রা.ও একজন বিশিষ্ট সাহাবিয়া ছিলেন। হাদীস ও ইতিহাসের কিতাবসমূহে তাঁর প্রাজ্ঞতা ও সাহসিকতার চমৎকার ঘটনাবলি উল্লেখিত হয়েছে। তবে তাঁর সবর ও বুদ্ধিমত্তার যে অনন্য দৃষ্টান্ত নিম্নোক্ত ঘটনায় পাওয়া যায় তার নজীর সত্যিই দুর্লভ। ঘটনাটি ছিল তাদের সন্তানের মৃত্যুর ঘটনা। তাদের শিশু পুত্র অসুস্থ ছিল। আবু তালহা রা. বাইরে কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসার আগেই শিশুটি মৃত্যুবরণ করে। জননী উম্মে সুলাইম রা. সুন্দর ভাবে শিশুটিকে ‘ঘুম পাড়িয়ে’ রাখলেন এবং স্বামীর আগমনের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। সন্ধ্যাবেলা আবু তালহা ঘরে ফিরে সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করলে উম্মে সুলাইম রা. বললেন, ‘সে আগের চেয়ে শান্ত হয়েছে’। ক্লান্ত স্বামীকে তৎক্ষণাৎ পুত্রের মৃত্যুসংবাদ দিলেন না। ঘরের লোকদেরকে নিষেধ করে রেখেছিলেন, তিনি ছাড়া অন্য কেউ যেন এ সংবাদ তাকে না জানায়। আবু তালহা ভাবলেন, পুত্র ভালো হয়ে উঠছে। তিনি শান্ত মনে রাতের খাবার খেলেন এবং বিশ্রাম নিলেন। সে রাতে উম্মে সুলাইম রা. অন্য দিনের তুলনায় বেশি সাজগোজ করলেন। স্বামীর সকল প্রয়োজন পূরণ হওয়ার পর তিনি তাকে বললেন, বলুন তো কেউ যদি কারো কাছে কোনো কিছু গচ্ছিত রাখে অতঃপর তা ফেরৎ নিতে চায় তবে কি তা আটকে রাখার অধিকার থাকে? আবু তালহা বললেন, না এ অধিকার থাকে, না। উম্মে সুলাইম রা. এবার অত্যন্ত স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, আপনার পুত্রের ব্যাপারে সবর করুন। আবু তালহা বিষয়টি বুঝতে পেরে মর্মাহত হলেন এবং রাতের আচরণে লজ্জিত হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে স্ত্রীর নামে অভিযোগ দায়ের করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ঘটনা শুনে চমৎকৃত হলেন এবং দুআ করলেন, আল্লাহ তোমাদের এ রাতে বরকত দান করুন।
আল্লাহ তাআলা তাদেরকে একটি পুত্র সন্তান দান করেন যার নাম রাখা হয় আব্দুল্লাহ। আব্দুল্লা ইবনে আবু ত্বালহাকে সাতপুত্র দান করেন। যাদের সকলেই কুরআনের আলিম হয়েছেন। -সহীহ ফেতহুল বারী ৩/২০১-২০৪
আরেকজন মহিয়সী জননী হলেন হযরত আসমা রা.। পুত্র আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর ও হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ এর মধ্যে লড়াই হচ্ছিল। এক ফাঁকে আব্দুল্লাহ মাকে দেখতে এলেন। জননী আসমা অসুস্থ ছিলেন। এ অবস্থায়ই পুত্রকে লক্ষ করে বললেন, বেটা দু’বিষয়ের কোনো একটি না হওয়া পর্যন্ত আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই না। হয় তুমি শহীদ হবে এবং আমি তোমার শাহাদাতের উপর ছবর করব কিংবা তুমি বিজয়ী হবে এবং আমি তা দেখে আমার চক্ষুকে শীতল করব।
আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা. শহীদ হলেন। জালেম হাজ্জাজ এই সাহাবীকে শূলীতে চড়াল। বৃদ্ধা জননী ঘর ছেড়ে এসে এ দৃশ্য দেখলেন এবং সম্পূর্ণ শান্ত কণ্ঠে হাজ্জাজকে বললেন, ‘এই ঘোড়-সওয়ারের কি এখনো ঘোড়া থেকে নেমে আসার সময় হয়নি?’
মোটকথা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার আশ্চর্য পরশে তাঁর মহিলা সাহাবীদের মধ্যেও এরূপ চারিত্রিক দৃঢ়তা সৃষ্টি হয়েছিল। আরব দেশের সাধারণ রীতি এই ছিল যে, আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুতে বিলাপের আসর বসানো হত। ভাড়াটে বিলাপকারিনীদের নিয়ে ঘরের মহিলারা বিলাপে রত হত। মাথার চুল ছেড়া, শরীরের কাপড় ছেড়া ইত্যাদি ছিল শোক প্রকাশের বিভিন্ন পদ্ধতি। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার বদৌলতে এই অস্থিরতা ও আত্মবিস্মৃতির পরিবর্তে সবর ও আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্টি ও সওয়াবের আশা তাদের চরিত্রের অংশ হয়ে গিয়েছিল। তাদের হৃদয় ব্যথিত হত, চক্ষু অশ্রুসজল হত, কিন্তু তারা আত্মহারা হতেন না এবং মুখ দিয়ে এমন কথাও বের করতেন না, যে কথায় মহান আল্লাহ অসুন্তুষ্ট হন।
জীবন ও কুরআন
ইমাম মালিক রহ. এর একজন ছাত্র ছিলেন বুহলুল ইবনে রাশিদ। মুসলিম-অমুসলিম সবার কাছেই তিনি শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। একদিন তিনি এক লোককে দু’টি দীনার দিয়ে কিছু তেল কিনতে পাঠালেন। সে যখন ভালো তেল তালাশ করছিল তখন লোকেরা তাকে বলল, অমুক খৃস্টানের দোকানে খুব ভালো তেল পাওয়া যায়। লোকটি সে দোকানে তেল কিনতে গেল। খৃস্টান দোকানী যখন জানল যে, সে বাহলুল রা.-এর জন্য তেল কিনতে এসেছে তখন বলল, তোমরা মুসলমানরা যেমন এই বুযুর্গের খিদমতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি আশা কর, তেমনি আমরাও তা করি। একথা বলে সে দুই দীনারে অনেক বেশি তেল দিল। লোকটি খুশি মনে বুহলুল রহ.-এর কাছে এসে ঘটনা বর্ণনা করল। বুহলুল রহ. বললেন, ভাই,তুমি আমার একটি কাজ করেছিলে এবার আরেকটি কাজ করে দাও। অনুগ্রহপূর্বক এই তেল ফেরৎ দিয়ে আমার সে দীনার দু’টি নিয়ে এস। লোকটি অবাক হয়ে বলল, কেন জনাব? বুহলুল বললেন, তোমার তেল কেনার ঘটনা শোনার পর আমার এই আয়াতটি মনে পড়ল। আল্লাহ বলেছেন, ‘যে জাতি আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখে তারা যেন কখনো ওই সব লোকের প্রতি মহব্বত পোষণ না করে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে দুশমনী করেছে।’
আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আমি যদি এই তেল ব্যবহার করি তাহলে সেই খৃস্টান দোকানীর কথা আমার মনে পড়বে এবং তার প্রতি আমার মনে কিছুটা মহব্বত সঞ্চারিত হবে। তাহলে বিষয়টা এই দাঁড়াবে যে, দুনিয়ার তুচ্ছ বস্তুর কারণে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দুশমনীর মধ্যে পড়ে যাব।’ -তারতীবুল মাদারিক - টীকা,রিসালাতুল মুসতারশিদীন পৃ. ১৫২-১৫৩
ঝড়-বৃষ্টির সময়ের দু‘আ
১। উম্মুল মু‘মিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আকাশে মেঘ দেখলে বলতেন,
اللهم إنا نعوذ بك من شر ما أرسل به
‘ইয়া আল্লাহ, আমরা আপনার কাছে এর অকল্যান থেকে আশ্রয় চাই।’ অতঃপর যদি তা থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হত তখন বলতেন,
اللهم صيبا نافعا
ইয়া আল্লাহ আপনার কাছে উপকারী বৃষ্টি প্রার্থনা করছি। - সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫০৯৯
২। অন্য হাদীসে এসেছে, বৃষ্টিপাতের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দু‘আ পড়তেন
- اللهم صيبا نافعا
‘ইয়া আল্লাহ, আপনার কাছে উপকারী বৃষ্টি প্রার্থনা করছি।’ -সহীহ বুখারী, ১০৩২
অন্য একটি বেওয়ায়েতে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দু‘আ দুইবার বা তিনবার বলতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৭/৩২
তাই উপরোক্ত দু‘আ তিনবার বলা ভালো।
৩। উম্মুল মু‘মিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, প্রবল বেগে বাতাস বইতে শুরু করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দু‘আ পড়তেন,
اللهم إني أسألك خيرها وخير ما فيها وخير ما أرسلت به، وأعوذ بك من شرها وشر ما فيها وشر ما أرسلت به.
ইয়া আল্লাহ, আমি আপনার কাছে কল্যাণকর বাতাস প্রার্থনা করি এবং অকল্যাণকর বাতাস থেকে আপনার আশ্রয় কামনা করি।-সহীহ মুসলিম, আয়াত ৮৯৯
৪। চার দিক অন্ধকার করে ঝড়-তুফান শুরু হলে সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়বে। উকবা ইবনে আমির রা. বলেন, একবার এক সফরে আমরা ‘যুহফা’ ও ‘আবওয়া’র মাঝামাঝি জায়গায় ছিলাম। এমন সময় চারদিক অন্ধকার হয়ে এল এবং ঝড় শুরু হল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়তে লাগলেন এবং বললেন, হে উকবা, এই সূরা দ্বারা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা কর। কেননা, কোনো আশ্রয়প্রার্থনাকারী এমন কথা দ্বারা আল্লাহর আশ্রয় চাইতে সমর্থ হয়নি। অর্থাৎ এই দুই সূরা হল আশ্রয়প্রার্থনার সর্বোত্তম কথা। -সুনানে আবু দাউদ ১৪৬৩