রবিউল আখির ১৪২৮   ||   মে ২০০৭

এক মিনিটের নাই ভরসা

ইসহাক ওবায়দী

বছরের প্রতিটা দিনেই কোনো না কোনো ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে। তবে ইতিহাস বেত্তারা সব ইতিহাসকে ইতিহাসের পাতায় ধরে রাখতে পারে না। এমনি এক করুণ ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৯৯ ইং সালে। মানুষ মুখে যা বলে তা অনেক সময় মুখের কথাই থেকে যায়, অন্তরে রেখাপাত করে না। তাই যখন সেই মুখের কথাটি সত্য হয়ে দেখা দেয় তখন সবাই হকচকিয়ে যায়। এদেশের একজন নামী শিল্পী ফিরোজ সাঁই-এর বেলায় তাই ঘটেছিল। ঘটনাটি জাতীয় পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে ছাপাও হয়েছিল।

১৬ই ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। এই দিন আমরা বিজয়োৎসবে মাতোয়ারা হয়ে অনেক কিছুই করে থাকি। সরকারি-বেসরকারিভাবে চলতে থাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, আর কিছু না হলেও গানের অনুষ্ঠান তো হতেই হবে। কোথাও গায়ক-গায়িকাদের উপস্থিতির মাধ্যমে কনসার্ট আকারে, আর কোথাও মাইকে ধুম-ধড়াক্কা ক্যাসেট বাজিয়ে। মনে হয় যেন নাচ-গান ছাড়া আমাদের বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হওয়াই সম্ভব নয়। শুনেছি এমনি এক গানের অনুষ্ঠান চলছিল সম্ভবত শিল্পকলা একাডেমীতে। দেশের নামী-দামী শিল্পীরা এসে গান পরিবেশন করছিল। এক সময় মঞ্চে এল রক শিল্পী ফিরোজ সাঁই। রক শিল্পী  হলেও সে মরমী গানই বেশি পরিবেশন করত। সেই অনুষ্ঠানে ফিরোজ সাঁই গাইল- এক মিনিটের নাই ভরসা, বন্ধ হবে রং তামাশা। বলাবাহুল্য, সবাই হাতে তালি দিল এবং তাকে নিয়ে রং তামাশাও করল। গান শেষ করে শিল্পী মেকাপ রুমে গিয়ে বসল আর অমনি তার সকল রং তামাশা বন্ধ হয়ে গেল। অর্থ্যৎ সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।

শিল্পী যখন গান গাইছিল তখন এর মর্মবাণী কি কারও অন্তরে দাগ কাটতে পেরেছিল? স্বয়ং গায়কের অন্তরেও কি এমন কোনো চিন্তা উঁকি মেরেছিল? সত্যি কথা হল, গায়ক শ্রোতা কারও মনেই গানটির মর্মবাণী কোনো ছাপ রাখতে পারেনি। সবাই বরং গানের কথার মার-প্যাঁচ ও সুর-ঝংকারে বিমোহিত হয়ে সেই রং-তামাশাই করছিল। কিন্তু যখন কথাগুলো সত্যে পরিণত হল এবং গায়কের প্রাণপাখি উড়ে গেল তখন সবাই অবাক হয়ে ভাবল, এটা কেমন ব্যাপার? যা বলা হল তা-ই সত্যে পরিণত হল!

আসলে সবার ব্যাপারেই একথাটি প্রযোজ্য। কিন্তু আমরা কেউ বিষয়টিকে ওইভাবে চিন্তা করি না। আর চিন্তা করলেও প্রগাঢ় বিশ্বাসের সাথে করি না। বিষয়টি তো এমন নয় যে, শুধু ফিরোজ সাঁই-এর ব্যাপারেই গানটি বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্য কারো ব্যাপারে তা হবে না। সবার জন্যই একথা সত্য। দুদিন আগে বা পরে মানুষ মাত্রই মরণশীল। যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যু মানুষের সকল চঞ্চলতার অবসান ঘটাতে পারে। এটাই নিয়তির অমোঘ নিয়ম। এ বিষয়ে আস্তিক-নাস্তিক, কাফের-মুসলিম কারোই দ্বিমত নেই। সবাই অন্তর থেকেই তা বিশ্বাস করে। তবে বিশ্বাসের মতো বিশ্বাস করি না বলেই বিষয়টিকে কথার মালায় সাজিয়ে শুধু আমরা বলে থাকি- এক মিনিটের নাই ভরসা। যদি বিশ্বাসের মতো বিশ্বাস করতে পারতাম, তাহলে আমরা এতো অনাচার করতে পারতাম না। সমাজে এতো উশৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলা থাকত না। এ বিশ্বাস আমাদের অন্তরে প্রগাঢ়রূপে স্থান করে নিতে পারেনি বলেই রং তামাশা করতে করতেই আমরা কথাটা বলে থাকি।

প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী রহ. কে এক ব্যক্তি বলল, হুজুর, একজন মানুষ পাহাড়ের গুহায় শুধু যিকির ও ইবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকে, লোকালয় বা বাজার-সাজারে বের হয় না। হাসান বসরী রহ. লোকটাকে দেখতে গেলেন এবং তাকে সালাম করলেন। লোকটি সালামের উত্তর দিল আর কোনো কথা বলল না। হাসান বসরী রহ. জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই তুমি লোকালয়ে আস না কেন? লোকটি উত্তর দিল, সময় নেই। হাসান বসরী রহ. আবার প্রশ্ন করলেন, হাসান বসরীর সাথে তো দেখা করতে পার। লোকটি উত্তর দিল, ওই একই কারণে তাঁর সাথেও দেখা করতে পারি না। হাসান বসরী রহ. প্রশ্ন করলেন, কী তোমার এত কাজ? যার কারণে লোকালয়ে আস না? লোকটি উত্তরে বলল, আমি যখন চোখ মেলি তখন দেখতে পাই, আমার ওপর আমার মালিকের অগণিত নিয়ামত বর্ষিত হচ্ছে। আমি তখন তাঁর শোকরগুজারী করতে থাকি। আবার যখন চোখ মেলি, তখন দেখতে পাই, আমার মালিকের সাথে আমার হাজারো নাফরমানীর কাজ। তখন আমি তওবা-ইস্তেগফারে লিপ্ত হয়ে যাই। এই করতে করতেই আমার দিন-রাত শেষ হয়ে যায়। আমি আর কোথাও যাবার মতো সময় পাই না। লোকটার কথা শুনে হাসান বসরী রহ. বললেন, তুমি হাসান বসরী থেকেও উত্তম, তাই তুমি  তোমার কাজেই মগ্ন থাক, হাসান বসরীর সাথেও তোমার দেখা করার প্রয়োজন নেই।

এ ঘটনা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, লোকটি কখনো হযরত হাসান বসরী রহ.কে দেখেনি, তাই সাক্ষাতে হাসান বসরী রহ.কে চিনতে পারেনি। দেখেন, আল্লাহওয়ালারা মৃত্যুকে কীভাবে বিশ্বাস করেন? আর আমরা কিভাবে বিশ্বাস করি? বিশ্বাসে বিশ্বাসে কত তফাৎ! তাই বলছিলাম, শুধু শব্দমালায় সাজিয়ে মৃত্যুর স্মরণ করাই যথেষ্ট নয়। শব্দের মর্মবাণীকেও আত্মস্থ করতে হবে। তবেই আমাদের জীবন সফল হবে।

হাদীস শরীফে আছে, যে ব্যক্তি মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করবে, তার অন্তরে জং বা গোনাহর মরিচা থাকবে না এবং তার পাপরাশিও কমতে থাকবে - ভাবার্থ। মৃত্যুর স্মরণে পাপশক্তি বিলোপ পায়, কেননা তখন সামান্য সময়ের পার্থিব জীবনের তুলনায় আখিরাতের অসীম জীবন তার সামনে উপস্থিত থাকে। তাই ক্ষণিকের ভোগ-বিলাসের মাধ্যমে চিরস্থায়ী জীবনের সুখ-শান্তি, সফলতাকে সে ব্যর্থ করতে চায় না। ফলে তার দুনিয়া ও আখিরাত দুটোই সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়ে ওঠে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্যিকারভাবেই মৃত্যুর কথা চিন্তা করার তাওফীক দান করুন। আমীন

 

 

advertisement