রবিউল আখির ১৪২৮   ||   মে ২০০৭

মুমিনের জীবনে ব্যক্তি স্বাধীনতা

মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন

স্বাধীনতা আল্লাহর অনেক বড় নিয়ামত। এই নিয়ামতের মর্ম ও মূল্য এবং তা ভোগ করার পন্থা ও সীমানা আল্লাহ তাআলা নবীগণের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। যারা প্রবৃত্তি ও শয়তানের দাসত্বে কিংবা ভিনজাতির কৃষ্টি-কালচার ও মূল্যবোধের সেবা দাসত্বে নিমজ্জিত তারা এই স্বাধীনতার মর্মই বা কীভাবে অনুধাবন করবে আর তার মূল্যায়নই বা কীভাবে তাদের পক্ষে সম্ভব হবে? এই জ্ঞান তো কেবল নবীগণের মাধ্যমেই হাসিল হতে পারে, যাদের মধ্যে সর্বশেষে আগমন করেছেন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

বস্তুবাদ ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির উপাসনার এই যুগে-যা ঈমানী দুর্বলতা ও কুরআন হাদীসের শিক্ষা থেকে বিমুখতারই বিষফল- লোকেরা অন্য সকল বিষয়ের মতো বিভিন্ন মূল্যবান পরিভাষাকেও পাশ্চাত্যের চশমায় দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, যে কারণে অনেক পরিভাষা তার প্রকৃত মর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। সে সব দুর্ভাগা পরিভাষাগুলোর মধ্যে একটি হল স্বাধীনতা। এর সঠিক মর্ম উপলব্ধি থেকে হারিয়ে যাওয়ার কারণে একশ্রেণীর মানুষ আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর আনুগত্যকেও পরাধীনতা বলে ভাবতে আরম্ভ করেছে।

অন্যদিকে স্বেচ্ছাচারিতা, বল্গাহীনতা ও অন্যের অধিকারে অন্যায় হস্তক্ষেপকে স্বাধীনতা নামে আখ্যায়িত করছে। অথচ আল্লাহ বান্দাদের খালিক ও মালিক, তাদের পালনকর্তা ও রিযিকদাতা, তাদের প্রেমিক ও প্রেমাস্পদ, রহীম ও রহমান। তিনি বান্দার পর নন, সবচেয়ে আপন। তাহলে তার রহমতের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ কখনো পরাধীনতা নয়। যদি কেউ বক্র চিন্তার বশবর্তী হয়ে প্রকৃত স্বাধীনতা এবং পরাধীনতা থেকে মুক্তি লাভের একমাত্র পথ অর্থাৎ আল্লাহর গোলামী ও তাঁর আদেশ-নিষেধের আনুগত্যকেই পরাধীনতা নামে আখ্যায়িত করে তাহলে আমরা একথাই বলব যে, হাঁ, পার্থিব জীবনে মানুষকে পরাধীনই থাকতে হবে। আর এই পরাধীনতার মধ্যেই তার মুক্তি ও উন্নতির বীজমন্ত্রটি লুকায়িত রয়েছে। উপস্থিত প্রবন্ধে আলোচ্য বিষয়কে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই পেশ করা হয়েছে। -তত্ত্ববধায়ক

 

স্বাধীনতা কথাটি পরাধীনতা-এর বিপরীত। স্বাধীনতার শাব্দিক অর্থ নিজের অধীনতা। আর পরাধীনতার শাব্দিক অর্থ পরের অধীনতা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় বিদেশী কর্তৃক শাসিত হওয়াকে পরাধীনতা আর এর বিপরীতকে বলা হয় স্বাধীনতা। আলোচ্য প্রবন্ধে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা বা পরাধীনতা সম্বন্ধে নয় বরং ব্যক্তির নিজস্ব স্বাধীনতা বা পরাধীনতা সম্বন্ধে আলোচনা করা উদ্দেশ্য। এটা আলোচনা করা উদ্দেশ্য এ কারণে যে, সম্প্রতি ব্যক্তি-স্বাধীনতা কথাটার চরম অপব্যবহার চালু হয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, একজন কোনো অন্যায় কাজ করলেও নাকি অন্যজন তাকে বাধা দিতে পারে না। কারণ তাতে নাকি তার ব্যক্তি-স্বাধীনতা খর্ব হয়। এ কারণেই নাকি পাশ্চাত্য দেশগুলিতে বিয়ে ছাড়া নর-নারীর একত্রে বসবাস (লিভ ইন লাভার) এমনকি সমকামীদের বিয়েও চার্চ কর্তৃক স্বীকৃত ও অনুমোদিত হয়েছে। কারণ বিপরীত হলে নাকি ব্যক্তি-স্বাধীনতা খর্ব হয়। এই ব্যক্তি-স্বাধীনতার দোহাই দিয়েই অনেকে অবাধ যৌনাচারিতাকে বৈধতার লেবাস পরানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, যাচ্ছে তাই করাই যদি ব্যক্তি-স্বাধীনতা বলে স্বীকৃতি পেতে পারে, তাহলে চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাবী ইত্যাদি যার যা ইচ্ছা তা করুক, সেটা তার ব্যক্তি-স্বাধীনতা, তাতে বাধা দেওয়া হয় কেন? চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাবী ইত্যাদির মন্দ প্রভাব সমাজের অন্যের প্রতিও বিস্তৃত হয়, অন্যেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এর দ্বারা, এ কারণে এগুলি যদি ব্যক্তি-স্বাধীনতা বলে স্বীকৃতি না পায় ও নিন্দিত হয়, তাহলে অবাধ যৌনাচারিতা ও অবাধ অসামাজিক কার্যকলাপের ফলে যখন সমাজে নৈতিক অধঃপতনসহ নানা রকম রোগ-ব্যাধির বিস্তৃতি হয় (এমনকি এইডসের মতো রোগও) তার ফলে কি সেটা নিন্দিত হতে পারে না? আসলে ব্যক্তি-স্বাধীনতা বলে এরূপ যেসব বিষয়কে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে তা আদৌ ব্যক্তি স্বাধীনতা নয়; বরং তা হল বল্গাহীনতা। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও বল্গাহীনতার মধ্যে যে দুস্তর পার্থক্য রয়েছে- এতটুকুও কি তারা চিন্তা করে দেখেন না?

ব্যক্তি-স্বাধীনতা কথাটিকে যদি নিজের ইচ্ছার স্বাধীনতা অর্থে গ্রহণ করতে চাওয়া হয়, তাহলে একজন মুমিনের জীবনে সেরূপ ব্যক্তি স্বাধীনতা কতটুকু রয়েছে, সেটা বোঝা নির্ভর করছে তার জীবন কিসের জন্য তা বোঝার উপর। মুমিনের জীবন হল আল্লাহর ইবাদত করার জন্য, আল্লাহর দাসত্ব করার জন্য। আর ইবাদতের সংজ্ঞা হল, জীবনের সর্বস্তরে আল্লাহর হুকুম-আহকামের সামনে চরমভাবে নতি স্বীকার করা। মুমিনের জীবনের সব কিছু আল্লাহর হুকুমের সামনে নত হয়ে যাবে- মুমিনের কথা-বার্তা, তার কাজ-কর্ম, তার হাটা-চলা, তার শয়ন-স্বপন, তার নিদ্রা-জাগরণ সব কিছু আল্লাহর হুকুমের সামনে চরমভাবে নতিস্বীকার করবে। অর্থাৎ, তার কোনো কিছুই তার নিজের ইচ্ছা মতো চলবে না; বরং চলবে আল্লাহর হুকুম মত। এটাকেই বলা হয় দাসত্ব। এটাই হল ইবাদত। মুমিন আল্লাহর দাসত্ব করবে। মুমিন হল আল্লাহর দাস। দুনিয়ার একজন দাস তার মুনিবের হুকুম মতো তার সব কিছু চালায়, তার নিজের ইচ্ছামতো সে কিছুই করে না। একজন দাস যেমন এটা ভাবতে পারে না যে, আমার যেমন ইচ্ছা তেমন করব, যা ভালো বুঝি তা-ই করব, তদ্রƒপ একজন মুমিন তথা আল্লাহর দাসও নিজের ইচ্ছামতো কোনো কিছু করার কথা ভাবতে পারে না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারও ইচ্ছামতো সে চলতে পারে না। একজন মুমিন যেহেতু আল্লাহ ছাড়া আর কারও দাসত্ব করতে পারে না, তাই দুনিয়ার কোনো মানুষের হুকুমমতো, দুনিয়ার কোনো মানুষের কথামতো তার কোনো কিছু চালাতে পারবে না। এমনকি তার নিজের ইচ্ছামতোও নিজেকে চালাতে পারবে না। তার মন যা বলবে, তার চিন্তা যা বলবে সে অনুযায়ীও সে চলতে পারবে না। তার নিজের চাহিদা বা চিন্তা-চেতনার দাসত্বও চলবে না, তার নিজের পছন্দ-অপছন্দের দাসত্বও চলবে না, তার নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাসত্বও চলবে না। শুধু চলবে এক আল্লাহর দাসত্ব। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে,

اَمَرَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ.

অর্থাৎ, তিনি হুকুম দিয়েছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য। -সূরা ইউসুফ : ৪০

দুনিয়ার দাসত্বের সাথে আল্লাহর দাসত্বের আর একটা মিল হল-দুনিয়ায় যে দাসত্ব করে অর্থাৎ, যে দাস হয়, সে কোনো দিন মুনিবের সামনে নিজস্ব যুক্তি বা নিজস্ব বুঝ প্রকাশ করতে পারে না। মুনিব যা বলবে তাই তাকে করে যেতে হবে। মুনিবের হুকুমের সামনে তার নিজস্ব বিবেচনা বা যুক্তির কোনো স্থান নেই। কোনো দাস এটা বলতে পারবে না যে, আমার বিবেচনায় এটাই ভালো মনে হয়, তাই-আমি এটাই করব মুনিব যাই বলুক না কেন! আমার যুক্তিতে এটাই ভালো মনে হয়, তাই আমি এটাই করব মুনিব যাই বলুক না কেন! কোনো দাস এরকম বলতে পারে না। কারণ, মুনিবের কথার সামনে দাসের কোনো যুক্তি বিবেচনা চলে না। আল্লাহ পাক আমাদেরকে এরকম দাসত্বই শিক্ষা দিয়েছেন যে, তুমি নিজের যুক্তি বিবেচনায় চলতে পারবে না। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে,

عَسٰۤی اَنْ تَكْرَهُوْا شَیْـًٔا وَّ هُوَ خَیْرٌ لَّكُمْ ۚ وَ عَسٰۤی اَنْ تُحِبُّوْا شَیْـًٔا وَّ هُوَ شَرٌّ لَّكُمْ.

অর্থাৎ, অনেক কিছুকে তোমরা খারাপ মনে করবে, অথচ সেটা খারাপ নয়; বরং ভালো, আবার অনেক কিছুকে তোমরা ভালো মনে করবে কিন্তু আসলে তা ভালো নয়; বরং খারাপ। -সূরা বাক্বারা ২১৬

এ আয়াতে আল্লাহ পাক বোঝাচ্ছেন যে, নিজস্ব যুক্তি-বুদ্ধির ভিত্তিতে ভালো-মন্দ বিচার করে সেভাবে তোমরা চলতে পারবে না। কারণ, তোমাদের চিন্তা-বিবেচনা, তোমাদের যুক্তি-বুদ্ধি ভুলও হতে পারে। তবে হ্যাঁ শরীয়তে নিজস্ব যুক্তি বিবেচনা চালানোর অবকাশ যেসব ক্ষেত্রে রাখা হয়েছে, সে ক্ষেত্রগুলি অবশ্যই ব্যতিক্রম। কিন্তু সাধারণভাবে নিজস্ব বিবেচনা ও নিজস্ব যুক্তি-বুদ্ধির ভিত্তিতে ভালো-মন্দ বিচার করে সেভাবে চলার অবকাশ রাখা হয়নি। কারণ মানুষের নিজস্ব বিবেচনা, মানুষের নিজস্ব যুক্তি-বুদ্ধি ভুলের উর্ধ্বে নয়।

মানুষের নিজস্ব বিবেচনা, মানুষের নিজস্ব যুক্তি-বুদ্ধি যে ভুল হতে পারে, যুগে যুগে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং এখনও পাওয়া যাচ্ছে। বিংশ শতাব্দীর মাঝের দিকে প্রায় সারা দুনিয়ার মানুষ চোখ-কান বন্ধ করে সমাজতন্ত্রের পেছনে এমনভাবে ছুটল যে, এত সুন্দর আদর্শ আর হয় না! কত যুক্তি, কত লেখালেখি, কত বইপত্র বের হল। তারপর আবার একটা সময় আসল যখন সবাই ভুল বুঝতে পারল এবং সমাজতন্ত্রকে ঘৃণাভরে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করল। এভাবে বহু কিছুকেই মানুষ ভালো মনে করেছে কিন্তু এর সময় তা খারাপ প্রমাণিত হয়েছে, আবার তার বিপরীত বহু কিছুকে তারা খারাপ মনে করেছে কিন্তু এক সময় তা ভালো বলে প্রমাণিত হয়েছে।

যাহোক দাসত্ব হল আল্লাহর হুকুম-আহকামের মোকাবেলায় নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, নিজের পছন্দ-অপছন্দ, নিজের যুক্তি-বিবেচনা কোনো কিছুকেই পরিচালকের মর্যাদা প্রদান না করা। জীবনের সব ক্ষেত্রেই আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী চলতে হবে। এ অর্থে মুমিনের ব্যক্তি-স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, মুমিন আল্লাহর হুকুম-আহকাম যা কিছুই পালন করবে, তা করবে নিজের ইচ্ছায়- এ অর্থে তার ব্যক্তি-ইচ্ছা তথা ব্যক্তি-স্বাধীনতা আছে বলাও যেতে পারে। আবার নফল, মুস্তাহাব বা মুবাহ কাজ ইচ্ছা হলে করতে পারে আবার ইচ্ছা হলে ছাড়তেও পারে-এ হিসেবেও তার ব্যক্তি ইচ্ছা তথা ব্যক্তি-স্বাধীনতা আছে বলা যেতে পারে। তবে সেটা হল আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমানার মধ্যে থেকে স্বাধীনতা। সেটা আদৌ স্বেচ্ছাচারিতা নয়, সেটা আদৌ বল্গাহীনতা নয়, সেটা আদৌ তথাকথিত ব্যক্তি-স্বাধীনতা নয়।

আরেক প্রকার ইচ্ছার স্বাধীনতা রয়েছে তা পার্থিব জীবনে পরীক্ষা স্বরূপ মানুষকে দেওয়া হয়েছে। এটা হল আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়ত ও হেদায়াত অবলম্বন করা বা না করার স্বাধীনতা। এহিসেবে শরীয়তের ফরজ ওয়াজিবের ক্ষেত্রেও তা আদায় করা বা আদায় না করার স্বাধীনতা-শক্তি মানুষকে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেরূপ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। জন্মগত ও সৃষ্টিগতভাবে যতটুকু ইচ্ছার স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে সেটা ভুল পথে প্রয়োগ করার জন্য নয়; বরং সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এই পরীক্ষা স্বরূপ যে, বান্দা অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও সেরূপ ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে আল্লাহর অবাধ্য হয় কি না। অতএব সে স্বাধীনতা স্বীকৃত নয়। মুমিনের জীবনে স্বীকৃত স্বাধীনতা শুধু এতটুকু যে, সে ইচ্ছা করলে কোনো মুবাহ কাজ ছাড়তে পারে, আবার ইচ্ছা হলে করতেও পারে। মুস্তাহাব বিষয়েও করা বা না করার স্বাধীনতা রাখা হয়েছে। কিন্তু যেহেতু মুস্তাহাব বিষয়গুলিও করাটা কাম্য, ছাড়াটা কাম্য নয়, অতএব মুস্তাহাবের ক্ষেত্রে প্রদত্ত স্বাধীনতাও মুমিনের জীবনে কাম্য নয়।

কাজ ও চিন্তার ক্ষেত্রে মুমিনকে বল্গাহীন স্বাধীনতা প্রদান করা হয়নি। সে যা ইচ্ছা করতে পারবে না। সে ইচ্ছা করলে হারাম খেতে পারবে না, ইচ্ছা করলে হারাম পরিধান করতে পারবে না, ইচ্ছা করলে হারাম উপার্জন করতে পারবে না, ইচ্ছা করলে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই করতে পারবে না, ইচ্ছা করলে মিথ্যা কথা বলতে পারবে না, গীবত-শেকায়েত চোগলখুরী করতে পারবে না, ইচ্ছা করলে গান-বাদ্য করতে বা শুনতে পারবে না, ইচ্ছা করলে যেনা করতে পারবে না, গায়র মাহরাম নারীর দিকে তাকাতে পারবে না। এভাবে কর্মের পরিমণ্ডলে যথেচ্ছা স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সীমানা এঁটে দেওয়া হয়েছে। চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রেও রয়েছে এরূপ সীমানা। সেই সীমানা লঙ্ঘন করার স্বাধীনতা তাকে দেওয়া হয়নি। সে ইচ্ছা করলে ঈমান বিরোধী চিন্তা-চেতনাকে মনে প্রশ্রয় দিতে পারবে না, ইচ্ছা করলে কারও বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বা কোনো কুট পরিকল্পনা আঁটতে পারবে না, কোনো গোনাহের চিন্তা মনে লালন করতে পারবে না। এভাবে উঠা-বসা, চলা-ফেরা, খাওয়া-দাওয়া, আয়-উপার্জন, লেন-দেন, কায়-কারবার, নিদ্রা-জাগরণ থেকে শুরু করে চিন্তা-চেতনা পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই ইসলাম সীমানা এঁটে দিয়ে মুমিনের যথেচ্ছাচারিতার পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। অতএব তথাকথিত ব্যক্তি স্বাধীনতা বনাম যথেচ্ছাচারিতা মুমিনের জীবনে থাকতে পারবে না। মুমিন বল্গাহীন অর্থে স্বাধীন নয়। মুমিন যথেচ্ছাচারী অর্থে স্বাধীন নয়। মুমিন নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে স্বাধীন। এটাকে স্বাধীনতা বলা হোক বা পরাধীনতা, সেই বলার দ্বারা তেমন কোনো পার্থক্য সূচিত হবে না। এটাকে স্বাধীনতা বললে তা হবে আল্লাহ কর্তৃক আরোপিত পরাধীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ স্বাধীনতা। এরূপ পরাধীনতা শুধু ইসলামে নয় বরং সব ধর্ম এবং সব আদর্শেই রয়েছে। কোনো ধর্মই তার আকীদা-বিশ্বাস ও নিয়ম-নীতি লঙ্ঘনের স্বাধীনতা প্রদান করে না। পৃথিবীর কোনো মতবাদ তার নীতি-আদর্শ লঙ্ঘনে অনুমোদন দেয় না। এমনকি রাজনৈতিক আদর্শ ভিত্তিক কোনো দলও তার গঠনতন্ত্রের বিরোধিতা করার স্বাধীনতা প্রদান করে না। এভাবে সব ধর্ম এবং সব মতবাদই কিছু না কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে থাকে। যার নীতি-আদর্শের গণ্ডি যত বিস্তৃত তার সীমাবদ্ধতার পরিসরও সে অনুপাতেই কম বা বেশি। ইসলাম ধর্ম যেহেতু জীবনের সব ক্ষেত্রের জন্য ব্যাপক আদর্শভিত্তিক একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, সেহেতু জীবনের সব ক্ষেত্রেই ইসলাম আরোপিত সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান রয়েছে। জীবনের সব ক্ষেত্রেই সে সীমানা এঁটে দিয়েছে। মুমিনের জীবনে তাই সীমাবদ্ধতা অনেক বিস্তৃত, মুমিনের জীবনে স্বাধীন ইচ্ছা চরিতার্থের সুযোগ খুবই সীমিত। তবে মুমিনের জন্য এই পরাধীনতা নিন্দনীয় নয়; বরং প্রশংসনীয়। এটা সঙ্কীর্ণতা নয়; বরং স্বকীয়তা। এটা হল নিজ আদর্শের ব্যাপকতার পরিচায়ক।

এই পরাধীনতা মুমিনের জীবনে অবাঞ্ছিত কোনো কলঙ্ক নয়; বরং এই পরাধীনতাই মুমিনের জীবনের গর্ব। মুমিন নিজের সকল ইচ্ছা ও চাহিদাকে তার প্রেমাস্পদ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের ইচ্ছা ও চাহিদার মধ্যে বিলীন করে দিয়ে প্রেমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করবে। খাঁটি প্রেমিকের অবস্থা তো এমনটিই হয়ে থাকে। খাঁটি প্রেম নিজ ইচ্ছা চরিতার্থ করার স্বাধীনতা বোঝে না, খাঁটি প্রেম শুধু বোঝে প্রেমাস্পদের তরে নিবেদিত হওয়া।

 

 

advertisement