মুহাররাম ১৪৩২   ||   ডিসেম্বর ২০১০

শরীয়তের ফরজ ও সালাফের তা‘আমুল : লেবাস্তপোশাকে নাহি আনিল মুনকার

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

ঈমানদার নারী ও পুরুষ সর্বাবস্থায় শরীয়তের হুকুম-আহকামের অধীন। কুরআন মজীদে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে-

 

وما كان لمؤمن ولا مؤمنة اذا قضى الله ورسوله امرا ان يكون لهم الخيرة من امرهم ومن يعصى الله ورسوله فقد ضل ضلالا مبينا

 

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ কিংবা নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। কেউ  আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।-সূরা আহযাব : ৩৬

এজন্য কেউ বলুক আর না বলুক মুমিন নারী ও পুরুষকে সকল বিষয়ে আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে হবে। এরই নাম আবদিয়াত।  আর এই গুণের অধিকারী ব্যক্তি হল আল্লাহর বান্দা।

আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ভালোবাসেন। দুনিয়ার পবিত্র জীবন আর  আখিরাতের চিরশানি-ও আল্লাহর বান্দাদের জন্যই। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর ইতাআত ও ফরমাবরদারীর বিষয়ে উন্নাসিকতা প্রদর্শন করে তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর অসন'ষ্টি ও জাহান্নামের মর্মন্তুদ শাস্তি

আল্লাহর বিধানের প্রতি পূর্ণ সমর্পন ঈমান ও ইসলামের অপরিহার্য শর্ত। এই আত্মসমর্পণ ছাড়া কেউ মুসলিম হতে পারে না।  তদ্রূপ আল্লাহর বিধানের বিপরীতে অন্য কারো আনুগত্য কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ শর্তহীন ও নিরঙ্কুশ আনুগত্য একমাত্র  আল্লাহ তাআলার জন্য। এটি তাওহীদের অন্যতম দাবি । এক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন 

لا طاعة لبشر في معصية الله، إنما الطاعة في معروف

অর্থাৎ আল্লাহর নাফরমানীর ক্ষেত্রে কারো আনুগত্য বৈধ নয়। মানুষের আনুগত্য শুধু শরীয়তসম্মত বিষয়েই হতে পারে।-সহীহ  মুসলিম হাদীস : ১৮৪০; সহীহ বুখারী, হাদীস : ৭১৪৫ 

কুরআন মজীদে উলুল আমরবা দায়িত্বশীলদের অনুগত থাকার যে আদেশ করা হয়েছে এর অর্থও তাই। অর্থাৎ শরীয়তের সীমারেখার ভিতরেই তাদের আনুগত্য, শরীয়তের সীমারেখার বাইরে  তাদের আনুগত্যের অবকাশ নেই। 

দায়িত্বশীলদের কর্তব্য হচ্ছে অধীনস্তদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের হুকুম মোতাবেক পরিচালিত করা। পিতা-মাতা ও শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে শুরু করে সমাজ ও রাস্ট্রের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ পর্যন্ত সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের উপর তা শরীয়তের পক্ষ হতেই আরোপিত। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন

يا ايها الذين آمنوا قوا انفسكم واهليكم نارا وقودها الناس والحجارة عليها ملائكة غلاظ شداد لا يعصون الله ما امرهم ويفعلون ما يؤمرون

 

হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর অগ্নি থেকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর, যাতে  নিয়োজিত আছে নির্মমহৃদয় কঠোরস্বভাব ফিরিশতাগণ, যারা অমান্য করেন না যা আল্লাহ তাদেরকে আদেশ করেন। আর তারা যা করতে আদিষ্ট হন তাই করেন।-সূরা তাহরীম : ৬

এক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন

    لا يسترعي الله تبارك وتعالى عبدا رعية قلت أو كثرت إلا سأله الله تبارك وتعالى عنها يوم القيامة أقام فيهم أمر الله تبارك وتعالى أم أضاعه حتى يسأله عن أهل بيته خاصة

আল্লাহ যে বান্দাকে কিছু মানুষের দায়িত্বশীল বানিয়েছেন, সংখ্যায় তারা কম হোক বা বেশি, তাকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করবেন যে, অধীনস্তদের মাঝে সে আল্লাহর বিধান কায়েম করেছে না বরবাদ করেছে। এমনকি প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার পরিবার সম্পর্কেও  জিজ্ঞাসা করা হবে।-মুসনাদে  আহমদ  ২/১৫;৫/২৫

একটি আদর্শ সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে উপরোক্ত দায়িত্ব পালনের বিকল্প নেই। ইসলামের স্বর্ণযুগে নৈতিকতা, চারিত্রিক পবিত্রতা ও  সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলার যে অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল এটি ছিল তার অন্যতম প্রধান কারণ। সমাজের সকল ক্ষেত্রে আমর  বিল মারূফনাহি আনিল মুনকারকার্যকর ছিল। ব্যক্তি থেকে রাস্ট্র সবাই ছিল এই বিধানের অধীন এবং সমাজের সর্বস্তরে ছিল  এর ব্যাপক চর্চা। ফলে ন্যায় ও মারূফ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং অন্যায় ও মুনকার বিলুপ্ত হয়েছিল। বর্তমান প্রবন্ধের বিষয়বস' যেহেতু লেবাস্তপোশাক, তাই এখানে শুধু এ বিষয়েরই কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চাই, যদ্বারা প্রতীয়মান হবে যে, পোশাক-পরিচ্ছদের বিষয়েও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ কত গুরুত্ব দিয়েছেন । 

এখানে বলে দেওয়া আবশ্যক যে, লেবাস্তপোশাক সংক্রান্ত বিধান শুধু নারীর জন্য নয়, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য। নবী সাল্ল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই আল্লাহর বিধান বর্ণনা করেছেন এবং নারী-পুরুষ সকলকে আল্লাহর বিধান  মোতাবেক পরিচালিত করেছেন। হাদীসের পাঠকগণ এ বিষয়ে সম্যকরূপে অবগত। একটি তথ্যের মাধ্যমেও তা অনুমান  করা যাবে। আল্লামা ইবনুল আছীর রাহ. সংকলিত জামিউল উসূলকিতাবের লিবাস অধ্যায়ে যে হাদীসগুলি সংকলিত হয়েছে তার  সংখ্যা এক হাজার একশত চব্বিশটি। আল্লামা হাইছামীর মাজমাউয যাওয়াইদকিতাবে সংকলিত হয়েছে আরও চার শতাধিক  হাদীস। আলিমগণ জানেন যে, উপরোক্ত দুই কিতাবে যেসব মৌলিক গ্রন্থ থেকে হাদীস সংকলন করা হয়েছে তার বাইরেও  অনেক হাদীসের কিতাব আছে এবং সেসব কিতাবেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হাদীস বিদ্যমান রয়েছে। এ থেকে খুব সহজেই অনুমান  করা যায় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত গুরুত্বের সাথে লেবাস্তপোশাক সংক্রান্ত হুকুম-আহকাম বর্ণনা করেছেন এবং  সাহাবায়ে কেরামের তারবিয়ত করেছেন। তরবিয়তের কিছু দৃষ্টান্ত পাঠক বর্তমান প্রবন্ধে দেখতে পাবেন। 

দুই.

স্বয়ং আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বলেছে

 

يا ايها النبى قل لازواجك وبناتك ونساء المؤمنين يدنين عليهن من جلابيبهن

 হে নবী, বলুন আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীদেরকে, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের উপর টেনে  দেয়।’-সূরা আহযাব : ৫৯

অন্যত্র বলেছেন

قل للمؤمنين يغضوا من ابصارهم ويحفظون فروجهم ذلك ازكى لهم ان الله خبير بما يصنعون وقل للمؤمنات يغضضن من ابصارهن ويحفظن فروجهن ولا يبدين زينتهن الا ما ظهر منها وليضربن بخمرهن على جيوبهن

মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। এটাই তাদের জন্য উত্তম।  তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবগত। 

‘‘আর মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। তারা যেন সাধারণত  যা প্রকাশিত তা ছাড়া তাদের যীনত ( সজ্জা ও সৌন্দর্য) প্রকাশ না করে, তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে।’-সূরা নূর : ৩০-৩১

লক্ষ্যণীয় যে, এই আয়াতগুলিতে আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করেছেন। মুমিন নারী ও পুরুষকে সম্বোধন  করার পরিবর্তে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছেন, তিনি যেন মুমিন নারী-পুরুষকে পর্দা করার ও নজরের  হেফাযত করার আদেশ দেন। এতে পর্দার বিষয়ে দায়িত্বশীলদের তত্ত্বাবধানের গুরুত্ব বোঝা যায়।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রী, কন্যা ও মুমিন নারীদেরকে পর্দার আদেশ করেছেন এবং তারা অনুগত চিত্তে সে আদেশ  পালন করেছেন। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন, আমি আনসারী নারীদের চেয়ে উত্তম আর কাউকে দেখিনি। আল্লাহর  কিতাবের প্রতি ঈমান ও বিশ্বাস এবং তাসদীক ও আনুগত্যে তারাই শ্রেষ্ঠ। যখন সূরা নূরের আয়াত নাযিল হল তখন  পুরুষররা ঘরে গিয়ে স্ত্রী-কন্যাদের তা পাঠ করে শোনালেন। আর নারীরা আল্লাহর বিধানের প্রতি সমর্পিত হয়ে চাদর দ্বারা নিজেদের  আবৃত করলেন।-তাফসীরে ইবনে কাছীর ৫/৯০

এই হাদীসে লেবাস্তপোশাকের বিষয়ে পরিবার-পরিজনের তরবিয়তের একটি নমুনা পাওয়া গেল। এটি ছিল খাইরুল কুরূনের একটি  সাধারণ বৈশিষ্ট্য। মুরব্বীরা যত্নের সাথে ছোটদের তরবিয়ত করেছেন আর ছোটরা অনুগত চিত্তে তা গ্রহণ করেছেন। 

আলকামা ইবনে আবু আলকামা তার মা থেকে বর্ণনা করেন যে, একবার হাফসা বিনতে আব্দুর রাহমান তার ফুফু উম্মুল মুমিনীন  আয়েশা রা.-এর নিকটে এল। তখন তার পরনে ছিল একটি পাতলা ওড়না। উম্মুল মুমিনীন তা ছিড়ে ফেললেন এবং একটি মোটা ওড়না পরিয়ে দিলেন।-মুয়াত্তা মালেক, পৃষ্ঠা : ৩৬৬

আব্দুর রাহমান ইবনে ইয়াযীদ বলেন, ‘‘আমরা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর নিকটে ছিলাম। ইতিমধ্যে তাঁর এক পুত্র সেখানে    এল, যার পরনে ছিল রেশমের জামা। ইবনে মাসউদ রা. জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা তোমাকে কে পরিয়েছে?’ পুত্র বলল, ‘মা পরিয়েছেন।  ইবনে মাসউদ রা. জামাটি ছিড়ে ফেললেন এবং বললেন, ‘যাও তোমার মাকে বল, অন্য জামা পরিয়ে দিতে’’-আলমুজামুল কাবীর তবারানী ৮৭৮৬, ৮৭; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ১৯৯৩৭

ইবনে আবী শাইবার  বর্ণনায় আছে, ইবনে মাসউদ রা. বললেন, ‘এটা তো মেয়েদের পোশাক।’ (হাদীস : ২৫১৪৪, ৪৫)

সায়ীদ ইবনে জুবায়ের রাহ. বলেন, ‘‘হযরত হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রা. এক সফর থেকে ফিরে এসে দেখলেন, তার সন্তানদের  পরনে রেশমের লেবাস। তখন তিনি পুত্রদের জামা খুলে ফেললেন আর কন্যাদের পরতে দিলেন।’’-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫১৪৬

পিতামাতা ছাড়া অন্য মুরব্বীরাও শিশুদের তরবিয়তের দিকে লক্ষ্য রাখতেন।     

আব্দুর রাহমান ইবনে আওফ রা. তার শিশুপুত্রকে নিয়ে ওমর ফারূক রা.-এর দরবারে এলেন। পুত্রের পরনে ছিল রেশমের জামা।  হযরত ওমর রা. তা ছিড়ে ফেলেন।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫১৪৭

সায়ীদ ইবনে আবু হুসাইন নিজের শৈশবের কথা বর্ণনা করে বলেন, ‘‘আমি হযরত উম্মে সালামা রা.-এর নিকটে গিয়েছিলাম।    আমার হাতে ছিল সোনার আঙটি। তিনি তা দেখে একজন মেয়েকে বললেন, ‘ওর হাত থেকে আঙটিটি খুলে নাও।সে তা খুলে নিল।   উম্মুল মুমিনীন বললেন, ‘এটা তার পরিবারের কাছে ফেরৎ দিবে এবং একটি রূপার আঙটি বানিয়ে আনবে।আমি বললাম, ‘তাদের এ আঙটির প্রয়োজন নেই।তিনি তখন বললেন, ‘তাহলে তা সদকা করে দিও এবং ওর জন্য একটি রূপার আঙটি বানিয়ে এনো’’-ইবনে  আবী শাইবা, হাদীস : ২৫৬৫২

রাইহানা বলেন, ‘‘একটি শিশুর সাথে আমাকে ওমর ফারুক রা.-এর নিকটে পাঠানো হয়েছিল। শিশুটির পরনে ছিল ঘন্টি (বাজনাদার কিছু)।  হযরত ওমর রা. বললেন, ‘ঘরের লোকদের বলবে, এই ঘন্টির পিছনে শয়তান থাকে’’-ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫৪৪৩

মুজাহিদ বলেন, ‘উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর নিকটে একটি শিশুকন্যাকে আনা হয়েছিল, যার পরনে ছিল ঘন্টি। উম্মুল মুমিনীন বললেন, ‘তুমি তো ফেরেশতাদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছ!তারপর বললেন, ‘একে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাও’’-ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫৪৪৬

মুজাহিদ রাহ. নিজের ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, ‘‘আমি আব্দুর রাহমান ইবনে আবী লাইলার নিকটে গেলাম। আমার হাতে ছিল এক  খণ্ড স্বর্ণ। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা দিয়ে কি মুসহাফের অলঙ্করণ করবে?’ আমি বললাম, জ্বী না। তিনি বললেন, ‘তাহলে কি তরবারীতে লাগাবে?’ আমি বললাম, ‘জ্বী না, এটা দিয়ে কন্যার জন্য অলঙ্কার বানাব।তিনি বললেন, ‘তুমি বোধহয় বাজনাদার ঘন্টি  বানাবে। তা কিন' অপছন্দনীয়’’-ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫৪৪৪

এই দৃষ্টান্তগুলো থেকে অনুমান করা যায় যে,  সাহাবা-তাবেয়ী যুগে শিশুদের তারবিয়তের বিষয়ে কত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।  শরীয়তের হালাল-হারামের বিধান শিশুদের উপর বর্তায় না। তবে শৈশব থেকেই তাদেরকে শরীয়তসম্মত জীবন যাপনে অভ্যস্ত করার দায়িত্ব মুরব্বী ও অভিভাবকদের। অন্যথায় সাবালক হওয়ার পর শরীয়তের হুকুম-আহকাম মেনে চলা তাদের পক্ষে কঠিন হয়।

নিজ সন্তানের তারবিয়তের একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত হযরত আবু হুরাইরা রা.-এর জীবনীতে পাওয়া যায়। তিনি তার কন্যাকে বললেন, “কূলী-ইয়া আবাতি! ইন তুহাল্লীনিয যাহাব, তাখশা আলাইয়া নারাল লাহাব’! অর্থাৎ ছন্দের ভাষায় তিনি শিশুকন্যাকে তালকীন করছেন যে, বল, “বাবা! তুমি যদি আমায় স্বর্ণের অলঙ্কার পরাও তাহলে তো আমি জাহান্নামের আগুনের ইন্ধন হয়ে যেতে পারি।ছড়া ও ছন্দে শিশুকে শিক্ষা দেওয়ার এটি একটি উত্তম দৃষ্টান্ত। শিশুর তরবিয়ত, বিশেষত   কন্যাসন্তানের তরবিয়তের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোমল পন্থা অবলম্বন করাই কর্তব্য।

তরবিয়ত শুধু ছোটদের নয়, বড়দেরও প্রয়োজন। আল্লাহওয়ালা মুরব্বীর অধীনে থাকা শরীয়তের হুকুম মোতাবেক চলার সহজ  উপায়। ইসলাহ ও আত্মসংশোধনের জন্যও তা অতি জরুরি। সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত আনুগত্যের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরবিয়ত গ্রহণ করেছেন, অতপর অন্যদের তরবিয়ত করেছেন। লেবাস্তপোশাক সংক্রান্ত কিছু দৃষ্টান্ত : 

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, ‘‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম, আমার লুঙ্গি ছিল কিছুটা নীচে।  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে সম্বোধন করে বললেন, ‘হে আল্লাহর বান্দা! তোমার লুঙ্গি উপরে তোল।আমি উপরে  তুললাম। তিনি বললেন, ‘আরো তোল।আমি আরো তুললাম। এরপর থেকে আমি সর্বদা ঐ পর্যন্ত তুলে লুঙ্গি পরিধান করি। জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন পর্যন্ত?’ আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বললেন, ‘পায়ের নলার মাঝামাঝি পর্যন্ত’’-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২০৮৬

অন্য বর্ণনায়  আছে যে, ইবনে ওমর রা. মৃত্যু পর্যন্ত এভাবেই লুঙ্গি পরিধান করেছেন। দেখুন : মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৬২৬৩

সাহাবী আমর ইবনে যুরারাহ আনসারী রা. নিজের ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে (টাখনুর নীচে) ঝুলিয়ে লুঙ্গি পরতে দেখলেন। তখন তিনি নিজের কাপড়ের একাংশ ধরে বিনয় ও তাওয়াযুর সাথে বলতে লাগলেন, ‘ইয়া আল্লাহ! (আমি) তোমার দাস এবং তোমার দাস ও দাসীর পুত্র!একথা শুনে আমর রা. ফিরে তাকালেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে  দেখে বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমার পায়ের নলা খুব চিকন।নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে আমর ইবনে যুরারাহ,  আল্লাহর সকল সৃষ্টিই সুন্দর। হে যুরারাহর বেটা আমর, টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন না। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাটুর নীচে চার আঙুল রেখে বললেন, ‘হে আমর, এই হল লুঙ্গির স্থান।এরপর তার নীচে চার আঙুল রেখে বললেন, ‘হে আমর, এই হল লুঙ্গির স্থান।এরপর তার নীচে চার আঙুল রেখে বললেন, ‘হে আমর, এই হল লুঙ্গির স্থান’’- আলমুজামুল কাবীর, হাদীস : ৭৯০৯

অর্থাৎ এই তিন জায়গার কোনো এক জায়গা পর্যন্ত তুলে লুঙ্গি পরতে হবে। এর নীচে গেলে তা টাখনুর নীচে চলে যাবে, যা শরীয়তে হারাম।

জনৈক সাহাবী বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে লুঙ্গি ঝুলিয়ে নামায পড়তে দেখে বললেন, ‘যাও, অযু করে এস।তিনি অযু করে এলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় বললেন, ‘যাও, অযু করে এস।তিনি  পুনরায় অযু করে এলেন এবং আরজ করলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, কেন অযু করার আদেশ করছেন?’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম   বললেন, ‘সে লুঙ্গি ঝুলিয়ে নামায পড়ছিল। আর আল্লাহ তাআলা লুঙ্গি ঝুলিয়ে পরিধানকারীর নামায কবুল করেন না’’-মুসনাদে আহমাদ ৪/৬৭    

ওমর ফারূক রা. এক ব্যক্তিকে টাখনুর নীচে লুঙ্গি পরতে দেখে তিরস্কার করলেন। এরপর একটি ছুরি দিয়ে লুঙ্গির নীচের অংশ কেটে দিলেন।’-ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫৩২৬; কানযুল উম্মাল, হাদীস : ৪১৮৯৪

ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর মুমূর্ষ অবস্থার ঘটনা। মুশরিক আবু লুলুআর খঞ্জরের আঘাতে আহত হয়ে তিনি অন্তিমশয্যায় শায়িত। আল্লাহর নবীর সাহাবীগণ তাঁকে শান্তনা দিচ্ছিলেন এবং তাঁর নেক আমল ও ইসলামের খেদমতের কথা বলে আল্লাহর রহমতের আশা দিচ্ছিলেন। সে সময় একজন যুবক তাঁর নিকটে এলেন এবং তাকে শান্তনা দিলেন। ফিরে যাওয়ার সময় হযরত ওমর  দেখলেন তার লুঙ্গি টাখনুর নীচে। ওমর ফারূক রা. তাকে ডেকে বললেন, ‘ভাতিজা, লুঙ্গি ওপরে তোল। কারণ তা খোদাভীতির পরিচায়ক এবং কাপড়ের পরিচ্ছন্নতার পক্ষে সহায়ক।

 

 

يا ابن أخي ارفع إزارك فإنه أتقى لربك وأنقى لثوبك

 

 

এই ঘটনা বর্ণনা করে ইবনে মাসউদ রা. বলেন, ‘হায়! কী ছিলেন ওমর! মুমূর্ষ অবস্থাতেও যখন আল্লাহর বিধানের অন্যথা হতে দেখেছেন তিনি তা সংশোধন করেছেন।’-ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫৩১২

হযরত আবু হুরাইরা রা. এক ব্যক্তিকে মাটিতে লুঙ্গি টেনে চলতে দেখলেন। তখন তিনি মাটিতে পদাঘাত করতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তির দিকে ফিরেও তাকাবেন না, যে অহঙ্কার করে মাটিতে লুঙ্গি টেনে টেনে চলে।সে সময় হযরত আবু হুরায়রা ছিলেন বাহরাইনের আমীর।-সহীহ মুসলিম ২/১৯৫, হাদীস : ২০৮৭; আরো দেখুন : ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫৩০৭

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এক আরাবীকে (টাখনুর নীচে) লুঙ্গি ঝুলিয়ে নামায পড়তে দেখে বললেন্ত

 

المسبل إزاره في الصلاة ليس من الله في حل ولا حرام

 

 

অর্থাৎ যে টাখনুর নীচে কাপড় ঝুলিয়ে নামায পড়ে, আল্লাহর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই, না নামাযের ভিতরে, না নামাযের বাইরে।-আলমুজামুল  কাবীর  তবারানী  হা : ৯৩৬৮

হযরত হুবাইব ইবনে মুগাফফাল রা. মুহাম্মাদ কুরাশীকে লুঙ্গি টেনে চলতে দেখে বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-

 

من وطئه خيلاء وطئه في النار

  যে ব্যক্তি অহঙ্কারবশত পায়ের নীচে কাপড় ফেলে চলবে সে জাহান্নামে (যাবে এবং) এভাবে চলবে’’-মুসনাদে আহমদ ৩/৪৩৭ 

আরবে টাখনুর নীচে লুঙ্গি পরা ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। তাই জাহেলী যুগ থেকেই এ বিষয়ের আম রেওয়াজ ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা সংশোধন করেছেন।

কোনো কোনো রেওয়াত থেকে বোঝা যায়, আরবের নারীদের মাঝেও জামার ঝুল অতি দীর্ঘ রাখার রেওয়াজ ছিল। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইরশাদ করলেন যে, ‘অহঙ্কার করে টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানকারীর দিকে আল্লাহ তাআলা ফিরেও তাকাবেন নাতখন সাহাবিয়াগণ মেয়েদের করণীয় সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন। এক রেওয়ায়েতে আছে যে, উপরোক্ত হাদীস শোনার পর হযরত উম্মে সালামা রা. আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! মেয়েরা তাদের জামার ঝুল কীভাবে রাখবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এক বিঘৎ ঝুলিয়ে দিবে।উম্মুল মুমিনীন পুনরায় আরজ করলেন, ‘তাহলে তো পা দেখা যাবে?’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাহলে এক হাত ঝুলিয়ে দিবে, এর বেশি নয়’’-মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস : ১৯৯৮৪; জামে তিরমিযী ১/৩০৩, হাদীস : ১৭৩১; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৯৭৪২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫৩৮৮

আনাস ইবনে মালিক রা.বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রীকে দাঁড় করালেন এবং তার জামার ঝুল/আস্তীন মেপে দিলেন এক বিঘৎ বা দুই বিঘৎ। এরপর বললেন, ‘এর বেশি যেন না হয়’’-আবু ইয়ালা, হাদীস : ৩৭৮৪; মাজমাউয যাওয়াউদ, হাদীস : ৮৫৪৩

উপরের রেওয়ায়েতে স্ত্রীর লেবাস্তপোশাকের তত্ত্বাবধানের একটি দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল। এ প্রসঙ্গে উসামা ইবনে যায়েদ রা.-এর একটি ঘটনাও এখানে উল্লেখ করা যায়।

হযরত ঊসামা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে একটি কুবতীচাদর দিলেন, যা তাঁকে দিহয়া কালবী রা. হাদিয়া দিয়েছিলেন। আমি তা স্ত্রীকে দিয়ে দিলাম। একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘তুমি সেই কুবতী চাদরটি পরো না কেন?’ আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ চাদরটি আমার স্ত্রীকে দিয়েছি।তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাকে বলবে, কাপড়টির নীচে যেন আরেকটি কাপড় ব্যবহার করে। কেননা, ঐ কাপড়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আকার ফুটে উঠার সম্ভাবনা আছে।

 

مرها، فلتجعل تحتها غلالة لا تصفها

-মুসনাদে আহমদ ৫/২০৫; মুজামে কাবীর তবারানী, হাদীস : ৩৭৬; আরো দেখুন : কানযুল উম্মাল, হাদীস : ৪১৯৩০-৩১

মেয়েদের এত পাতলা কাপড় পরিধান করা নিষেধ যাতে শরীর দেখা যায়। এজন্য পাতলা কাপড় ব্যবহার করতে হলে নীচে সেমিজ জাতীয় কিছু ব্যবহার করতে হবে। তদ্রূপ যে কাপড়ে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আকৃতি ফুটে ওঠে তাও বর্জনীয়। 

আবু ইয়াযীদ মুযানী বলেন, ওমর রা. মহিলাদেরকে কাবাতীপরতে নিষেধ করতেন। লোকেরা বলল, ‘এই কাপড়ে তো ত্বক দেখা যায় না।তিনি বললেন, ত্বক দেখা না গেলেও দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটে ওঠে।

إن لا تشف فإنها تصف

-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫২৮৮, ৮৯, ৯১

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকেও অনুরূপ নির্দেশনা বর্ণিত আছে।-প্রাগুক্ত, হাদীস : ২৫২৯০

কাবাতীএক ধরনের সাদা কাপড়, যা মিসরে প্রস্তুত হত। শব্দটি বহুবচন, এর একবচন কুবতিয়া   

পুরুষের  স্বর্ণ ব্যবহার শরীয়তে নিষেধ। অনেক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা বর্ণনা করেছেন। এ বিষয়েও তরবিয়তের কিছু দৃষ্টান্ত দেখুন :

সালিম ইবনে আবুল জাদ তার গোত্রের একজন ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেন যে, ‘‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়েছিলাম, আমার হাতে ছিল একটি সোনার আঙটি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি ছড়ি নিয়ে আমার হাতে আঘাত করলেন এবং বললেন, ‘এটা ফেলে দাও।আমি বের হয়ে তা ফেলে দিয়ে এলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আঙটিটি কী করলে?’ আমি বললাম, ‘তা ফেলে দিয়েছি।নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তা ফেলে দিতে বলিনি তবে (পরিধান করা ছাড়া অন্যভাবে) কাজে লাগাতে বলেছি’’-মুসনাদে আহমাদ ৪/২৬০, ৫/২৭২ 

আবুল কানুদ বলেন, ‘‘আমার হাতে একটি স্বর্ণের আঙটি ছিল। ইবনে মাসউদ রা. তা দেখতে পেয়ে আমার কাছ থেকে নিয়ে নিলেন  এবং মাড়ির দাঁতের নীচে রেখে ভেঙে ফেললেন। এরপর তা ফেরৎ দিয়ে বললেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে স্বর্ণের আঙটি পরিধান করতে নিষেধ করেছেন’’-ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫৬৪৬

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. নিজের ঘটনা বর্ণনা করেন যে, আমার হাতে একটি সোনার আঙটি ছিল। হযরত ওমর রা. সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি তা বুঝতে পেরে আমার হাত এগিয়ে দিলাম। তিনি আঙটিটি খুলে নিলেন এবং ছুড়ে ফেলে দিলেন। পরে আমিও আর তা খুঁজিনি এবং কেউ পেয়েছে কিনা জিজ্ঞাসাও করিনি।-ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫৬৫০

স্বর্ণের মতো রেশমের কাপড় পরিধান করাও পুরুষের জন্য নিষেধ। এপ্রসঙ্গে সুয়াইদ ইবনে গাফালা রা. নিজের ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, আমরা ইয়ারমুকের যুদ্ধে শরীক হয়েছিলাম। তিনি বলেন, আমরা যখন ওমর রা. এর নিকটে এলাম তখন আমাদের পরনে ছিল রেশমের পোশাক। তিনি আমাদের দিকে পাথর নিক্ষেপ করতে বললেন। আমরা বুঝতে পারলাম যে, আমাদের পোশাক তিনি অপছন্দ করেছেন। আমরা তা খুলে ফেললাম এবং তার নিকটে হাজির হলাম। তিনি আমাদের মারহাবা বলে গ্রহণ করলেন এবং বললেন, ‘তোমরা আমার নিকট এসেছিলে মুশরিকদের লেবাসে। আল্লাহ তাআলা তো তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্যও রেশমের লেবাস পছন্দ করেননি।’-ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫১৬৮

হযরত আলী রা. এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সে একটি  কোর্তা পরেছেন, যার বুকে রেশম লাগানো। হযরত আলী রা. তখন বললেন, তোমার দাড়ির নীচে এই নাপাকী কেন? লোকটি বলল, ভবিষ্যতে আর কখনো আমাকে এমন জামা পরতে দেখবেন না।-ইবনে জারীর তাহযীবুল আছার-কানযুল উম্মাল, হাদীস : ৪১৮৫৪

কিছু কিছু রং পুরুষের জন্য অপছন্দনীয়। এ বিষয়েও তারবিয়তের কিছু নমুনা দেখুন। 

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে উসফূরদ্বারা রাঙানো দুটি কাপড় পরতে দেখে বললেন, ‘তোমার মা কি তোমাকে এই কাপড় পরতে বলেছেন।আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ আমি কি তা ধুয়ে ফেলব? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘বরং তা পুড়ে ফেল।অন্য রেওয়ায়েতে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এটা হচ্ছে কাফিরদের লেবাস। অতএব তুমি তা পরিধান করো না।’ -সহীহ মুসলিম ২/১৯৩, হাদীস : ২০৭৭; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ১৯৯৭৪

উসফূর হচ্ছে একক ধরনের ছোট গাছ। এর ফুল থেকে লাল রং পাওয়া যায়, যা কাপড় রাঙানোর কাজে লাগে।

ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. এক ব্যক্তিকে উসফূর-রাঙানো কাপড় পরিহিত দেখে বললেন, ‘এই ঝলমলে কাপড় মেয়েদের জন্য রেখে দাও।’-মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস : ১৯৯৭০

তিন. 

এ পর্যন্ত লেবাস্তপোশাকের বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের তারবিয়তের কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। মানব-জীবনের অন্যান্য বিষয়ের মতো পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রেও শরীয়তের হুকুম আহকাম মেনে চলা এবং অধীনস্তদেরকে সে অনুযায়ী পরিচালিত করা অতি জরুরি; বরং অন্য অনেক বিষয়ের চেয়ে লেবাস্তপোশাকের বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ একারণে যে, তা একটি প্রকাশ্য বিষয়। অতএব এ বিষয়ে শরীয়তের হুকুম আহকাম লঙ্ঘিত হওয়ার অর্থ হল মুনকার কাজ প্রকাশ্যে হওয়া। উপরন্তু পোশাক-পরিচ্ছদ হল এক ধরনের শিআর বা পরিচয়-চিহ্ন। অতএব এ ক্ষেত্রে ইসলামের হুকুম-আহকাম মেনে চলার অর্থ ইসলামের পরিচয় সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা আর তা লঙ্ঘন করার অর্থ ইসলাম-বিরোধী শিআর সমাজে প্রচলিত করা। একজন প্রকৃত মুসলিম কি স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে তা সমর্থন করতে পারে?

অভিভাবক ও দায়িত্বশীলদের কর্তব্য, অধীনস্তদেরকে ঐসব হুকুম-আহকাম মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করা এবং হেকমত ও  প্রজ্ঞার সাথে শরীয়তসম্মত পন্থায় তাদেরকে বাধ্য করা। পিতা-মাতা, উস্তাদ-শিক্ষক, উলামা-মাশাইখ, রাষ্ট্রীয় ও  সামাজিক পর্যায়ের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ এবং সর্বস্তরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের এটা অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

উপরের দৃষ্টান্তগুলি থেকে অনুমান করা কঠিন নয় যে, ইসলামের সোনালী যুগে এ দায়িত্ব কত গুরুত্বের সাথে পালিত হয়েছে। এসব দৃষ্টান্তের মূলকথা হল আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার। এটি এমন এক বিষয় যা ছাড়া ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের উন্নতি ও সংশোধনের কথা চিন্তাই করা যায় না। আমরা যখন মুসলিম উম্মাহর সোনালী যুগের কথা স্মরণ করি তখন এই বৈশিষ্ট্যকে দেখতে পাই উম্মুল মাহাসীন বা সকল সৌন্দর্যের জননীরূপে। ব্যক্তি ও সমাজের সংশোধনের বিষয়ে আগ্রহী হলে আমাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে অতীতের দুয়ারে।        

 

 

 

 

advertisement