মারকাযের দিনরাত
১৮/১/১৪২৮ হি. মোতাবেক ৭/২/০৭ঈ.
আজ মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার শিক্ষাবিভাগ দুটির (আততাখাসসুস ফী উলূমিল হাদীস ও আততাখাসসুস ফিলফিকহী ওয়াল ইফতা) প্রথম সাময়িক পরীক্ষার ই’লান লাগানো হয়েছে। এবারের ই’লানে পরীক্ষার্থীদের জন্য কিছু নতুন ব্যাপার ছিল। এবার পরীক্ষার নিয়ম কানুন ও পদ্ধতিগত দিক থেকে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেহেতু গতানুগতিক রেওয়াজের প্রয়োজনীয় সংস্কার মারকাযের অন্যতম উদ্দেশ্য তাই সেদিক বিবেচনা করেই মারকাযের শিক্ষা পরিচালনা কমিটি পরীক্ষা পদ্ধতির ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। শিক্ষা পদ্ধতি ও আনুষঙ্গিক দিকগুলো কীভাবে আরো উন্নত ও ফলপ্রসূ করা যায় তার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ।
বর্তমান পদ্ধতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, শিক্ষা বিভাগ দুটির পাঠ্যসূচিতে ফনের মৌলিক যে কিতাবগুলো দরসে বা মুতালাআয় রয়েছে সেগুলোর পরীক্ষা মাকালা (প্রবন্ধ) ভিত্তিক নেওয়া হবে। মাকালার বিষয়বস্তু আগেই নির্ধারণ করে তালিবুল ইলমের কাছে দেওয়া হবে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সবাইকে মাকালা জমা দিতে হবে। বিভাগীয় মুশরিফ (প্রধান) এগুলো দেখবেন এবং নির্দিষ্ট তারিখে মাকালাগুলো নিয়ে পরীক্ষার্থীদের সাথে মুনাকাশা (আলোচনা) করবেন। মাকালা এবং ফনভিত্তিক বিভিন্ন প্রশ্ন এই আলোচনার অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এভাবে পরীক্ষা নেওয়ার উদ্দেশ্য হল, পরীক্ষাটা যেন ছাত্রদের জন্য ফায়দাজনক হয় এবং শিক্ষণীয়ও হয়। কারণ, এভাবে পরীক্ষা নিলে অনুমাননির্ভর উত্তর দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। সময়স্বল্পতার ওজরও চলবে না। এবং ছাত্ররা তাদের অধিত ফন কতটুকু আয়ত্ব করতে পেরেছে, তারা কি ফনের গভীরে পৌঁছতে পেরেছে নাকি ভাসা ভাসা জ্ঞানলাভ করেছে সেটাও এখান থেকে প্রকাশ পাবে। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে যে ফলাফল পাওয়া যাবে তা থেকে দায়িত্বশীলদের জন্য ফায়দাজনক পদক্ষেপ নেওয়াও সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। উল্লেখ্য, সাধারণ নিয়মে লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষাও যথারীতি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
৪/২/১৪২৮হি. মোতাবেক ২২/২/০৭ ঈ.
আজ বেলা বারোটায় প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শেষ হল। দারুল মুতালাআয় তালিবুল ইলমদের নিয়ে একটি মজলিসের আয়োজন করা হয়। মজলিসে উপস্থিত ছিলেন মারকাযের পরিচালক মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, আমীনুত তালীম মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব এবং অন্যান্য আসাতিযায়ে কেরাম। তালিবুল ইলমদের উদ্দেশে বয়ান করতে গিয়ে আসাতিযায়ে কেরাম বলেন, ইসলামে তা’তীল বা বন্ধ বলতে কিছু নেই, ইলমের সাথে যাদের সম্পর্ক তারা তো কখনও কাজ বন্ধ করতে পারে না। খুব বেশি হলে কাজের স্বার্থে বিশ্রাম নিতে পারে। কাজের সময়সূচি পরিবর্তন করতে পারে।
মাদরাসার পরিবেশে নিয়মতান্ত্রিক এক ধরনের কাজে তালিবুল ইলমরা মশগুল ছিল। বাড়ির পরিবেশে ভিন্ন কাজে নিয়োজিত হবে। পরিবেশের পরিবর্তন হবে কিন্তু কাজ থেকে অবসর নেওয়ার কোনো সুযোগ দ্বীনের মুসাফিরদের নেই। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, দৈনন্দিন নামায, তিলাওয়াত, তাসবীহ—তাহলীল এগুলো যেমন সর্বদা চলমান, কখনও বন্ধ হয় না তদ্রূপ দ্বীনের কাজ, ইলমের কাজও বন্ধ হয় না এবং এর ধারক বাহকরা কখনও অবসর সময় কাটাতে পারে না।
তাঁরা আরও বলেন, বাড়িতে গিয়ে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করবে। মা—বাবার খেদমত করবে। কোনো কোনো তালিবুল ইলমের অভ্যাস আছে, বাড়িতে গেলে মা—বাবার খেদমত করার পরিবর্তে মা—বাবা তার খেদমত করুক এই আশায় বসে থাকে। এটা বড় অন্যায়। মাদরাসায় পড়াশুনার ব্যস্ততায় তুমি মা—বাবার খেদমত করার সুযোগ পাওনি এখন বাড়িতে গিয়ে সে সুযোগ পেয়েছ। একে গনীমত মনে করে কাজে লাগাও।
এছাড়া মাহরাম আত্মীয়—স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাত করা, তাদের প্রয়োজনীয় খেঁাজ—খবর নেওয়া, এলাকা অধিবাসীদের খেদমতে সচেষ্ট হওয়া, আর সুযোগ থাকলে তাবলীগ জামাতের সাথে সময় লাগনোর চেষ্টা করা, আল্লাহ সবাইকে বুঝ দান করুন।
১৮/৩/১৪২৮ হি. মোতাবেক ৮/৩/০৭ ঈ.
গতকালই সংবাদ এসেছিল, আজ সকাল নয়টায় মারকাযে একজন ইরাকী আলেম আসবেন। তাই তালিবুল ইলমরা তার আগমনের প্রতীক্ষায় ছিল। তিনি তাশরীফ আনলেন নটার কিছু পরে। দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। মারকাযে আসার উদ্দেশ্য হল, প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করা এবং আহলে মারকাযের সাথে ইলমী মতবিনিময় করা। তিনি প্রথমে মারকাযের দফতরে মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেবের সাথে দীর্ঘক্ষণ ইলমী মোযাকারা করেন। এক পর্যায়ে মারকাযের কার্যক্রম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব তাকে এ বিষয়ে অবগত করেন এবং মারকাযের দারুত তাসনীফ থেকে প্রকাশিত কিতাবাদি দেখান। তিনি ‘আলমাদখালু ইলা উলূমিল হাদীসিশ শরীফ’ কিতাবটি দেখে তার দেশের একজন প্রসিদ্ধ আলেমের লেখা দুটি কিতাবের নাম বললেন। একটি হল, ‘মানতিকুল কুরআনিল কারীম’ অপরটি হল, ‘মানতিকুল হাদীসিশ শরীফ’ এবং কিতাব দু’টির খুব প্রশংসা করলেন। আব্দুল মালেক সাহেব কিতাব দুটি সংগ্রহের আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি বললেন, এগুলো ইরাক ছাড়া অন্য কোথায়ও পাওয়া যায় না। আব্দুল মালেক সাহেব বললেন, তাহলে ইরাক সফর করেই সংগ্রহ করব ইনশাআল্লাহ। আসলে আল্লাহর কাছে তো কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। এরপর তিনি মারকাযের কুতুবখানা, দারুত তাসনীফ, দারুল ইফতা, দারুল মুতাআলা পরিদর্শন করেন এবং ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন কিতাবাদি দেখে অত্যন্ত খুশি প্রকাশ করেন। এক পর্যায়ে বললেন, আমার ব্যক্তিগত কুতুবখানায় ছয় হাজার কিতাব আছে। সেখান থেকে কিতাব ধার নেওয়ারও সুযোগ আছে। অনেক প্রফেসর, লেখক, গবেষক সেগুলো থেকে উপকৃত হয়ে থাকেন। কিতাব দেখা শেষ হলে আব্দুল মালেক সাহেব মারকাযে সংরক্ষিত বিভিন্ন কিতাবের পাণ্ডলিপির কথা বলেন। তিনি সেগুলো দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলে তাকে সেগুলো দেখানো হয়। এরমধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপি দেখে তিনি খুব আশ্চর্য হন। পাণ্ডলিপিটি হল প্রসিদ্ধ আলেম আবেদ সিন্ধির রচিত ‘তাওয়ালিউল আনওয়ার আলাদ্দুররিল মুখতার’। কোনো কোনো মুহাক্কিক আলেমের মতে এটি ফাতওয়া শামী থেকেও উচ্চ মানের শরাহ। এটি মোট ষোল খণ্ডে সমাপ্ত। প্রতি খণ্ড সাত আটশ পৃষ্ঠায় লিখিত। মেহমান যেহেতু হানাফী মাযহাবের আলেম তাই হানাফী আলেমের রচিত এই বিশাল কীর্তির সাথে পরিচিত হয়ে আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করলেন। আব্দুল মালেক সাহেব তাকে বললেন, এই পাণ্ডুলিপিটি তাহকীক করে ছাপানোর ইচ্ছা রয়েছে, দুআ করবেন আল্লাহ যেন সেই আশা পূরণ করেন। তিনি ছাপানোর খরচাদি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আব্দুল মালেক সাহেব মুচকি হেসে বললেন, আল্লাহ ভরসা। আল্লাহর খাযানায় কোনো কিছুর অভাব নেই।
মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা কিতাবটির নতুন সংস্করণ শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামাহ —এর তাহকীক দেখে তিনি বললেন, এই তাহকীকী নুসখা আমার কাছে নেই। কিতাব দেখা শেষ হলে তিনি দারুল মুতালাআয় উপস্থিত তালিবুল ইলমদের উদ্দেশে গুরত্বপূর্ণ বয়ান করেন। বয়ানের মূল বিষয় ছিল, আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক কায়েম করা। এই সম্পর্ক কায়েম করতে হলে অন্তরে নূর অর্জন করতে হবে। কুরআন—সুন্নাহ হল আল্লাহ তাআলার নূর।
বান্দা যখন এই নূর হাসিল করবে তখন তার কথায় কাজে এই নূর প্রকাশ পাবে। কিন্তু এই নূর অর্জন করার জন্য শর্ত হল, অন্তর, মন—মস্তিষ্ক ও অঙ্গ—প্রত্যঙ্গ পরিশুদ্ধ করা। এগুলো যখন ঠিক হয়ে যাবে বান্দা তখন আল্লাহর মিরাজ হাসিল করতে পারবে। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক হয়ে গেলে দিন দিন অন্তরে নূর বৃদ্ধি পেতে থাকবে। নামাযের মাধ্যমে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে। তেলাওয়াতের মাধ্যমে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে। তাসবীহ তাহলীলের মাধ্যমে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে। তদ্রূপ দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমেও আল্লাহ সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে এবং যাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হবে তাদের মাঝেও ওই নূরের প্রভাব প্রকাশ পাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ইরাকের মাটিতে যে মুসলিম মনীষীরা শুয়ে আছে তাদের অনেকের নাম উল্লেখ করে বলেন, তাঁদের প্রত্যেকের কবরের পাশে মসজিদ মাদরাসা রয়েছে।
সবচেয়ে বড় মাদরাসাগুলো যাদের কবরের পাশে অবস্থিত বিশেষভাবে তাদের নামও বললেন। তারা হলেন ইমাম আযম আবু হানীফা রাহ., মারূফ কারাখী রহ. এবং আব্দুল কাদির জিলানী রহ.। তিনি নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, আমার নাম মুহাম্মাদ, উপনাম আবুল আমান। আমার বংশ হযরত আলী রা. এর সাথে গিয়ে মিলেছে। এক পর্যায়ে আবেগে উদ্বেলিত হয়ে বললেন, আমি যখন দাওয়াত তাবলীগের এই সফরে বের হওয়ার ইচ্ছা করলাম তখন মুরব্বীদের পরার্শক্রমে ইস্তেখারা করি। রাতে স্বপ্নে দেখলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসেছেন। আমি তাঁর সাথে মু’আনাকা করলাম, তিনি আমাকে আলিঙ্গন করে আমার ঠোঁটে চুমু দিলেন এবং তার ঠোঁট মোবারক আমার ঠোঁট থেকে কানের লতি পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। আমি জাগ্রত হয়ে গেলাম।
সকালে ইরাকের প্রধান মুফতী শায়খ মওলুদকে আমার রাতের দেখা স্বপ্ন জানালাম। তিনি এর তা’বীর করলেন, তোমার ঠোঁটে চুমু খাওয়ার অর্থ হল, তোমার ইরাদা আল্লাহ কবূল করেছেন। আরবী ভাষায় ‘তাক্ববীল’ অর্থ হল চুমু খাওয়া। এই ধাতু থেকে ‘ক্বাবিলা’-কবুল করার অর্থ নির্গত হয়েছে। আর কান পর্যন্ত ঠোঁট এনে রেখেছেন এর অর্থ হল, তোমাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কেননা ‘কান’ আরবী হল ‘উযুন’ আর ‘অনুমতি প্রদান করল’ —এর আরবী ‘আযিনা’ উভয় শব্দ একই ধাতু থেকে নির্গত। স্বপ্নের এই তাবীরের পরে আমি আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার সুযোগ লাভ করি।
এভাবে তিনি নিজের জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং উপস্থিত শ্রোতাদের মাঝে অন্তরঙ্গ পরিবেশ সৃষ্টি করেন। আলোচনার শেষ পর্যায়ে বলেন, দ্বীনের খোলাসা হল, ইলম, আমল, ইখলাস ও তাবাররী। এগুলো যে যত মজবুতভাবে অর্জন করতে পারবে তার মধ্যে দ্বীনের ঔজ্জ্বল্য তত বেশি দেখা যাবে। সবকাজ দ্বীনের মানশা মোতাবেক করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমীন