আমার নানাজী
নানাজীকে জীবনের বহু চড়াই উতরাই অতিক্রম করতে হয়েছে। মা বাবার বড় ছেলে হওয়ার সুবাদে তার শৈশব কেটেছে আদর সোহাগের কোমল কোলে।
প্রাচুর্যে ও স্নেহে লালিত শিশুটি সেবাদানে নয় সেবাগ্রহণেই অভ্যস্ত ছিল। তার সকল আবদার পূর্ণ হত এবং ভুলত্রট্টটি এড়িয়ে যাওয়া হত। ভর্ৎসনা ও শাস্তির মুখোমুখি তাকে খুব কমই হতে হয়েছে।
কিন্তু হঠাৎ করেই এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটল। তার পিতা ইন্তেকাল করলেন এবং অল্প কিছুদিন পর মা—ও জান্নাতবাসী হলেন। ফলে বিশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তাকে গৃহকর্তা হতে হল। তাকে সহোদর ভাইদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হল এবং তাদের লালনপালন, পড়াশোনা ইত্যাদি সকল কিছুর ভার গ্রহণ করতে হল। বলাবাহুল্য, তার পড়াশোনাও তখন সমাপ্ত হয়নি। তাকে এমন এক অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, যে অবস্থায় তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না। জীবনযাত্রার এমন সব সমস্যার মোকাবিলাও তাকে করতে হয়েছিল যার সঙ্গে ইতপূর্বে তার পরিচয় ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তাকে সংকল্পের দৃঢ়তা দান করেছিলেন এবং নানাবিধ বৈশিষ্ট্যে ভূষিত করেছিলেন।
একসময় তিনি সকল প্রতিকূলতা জয় করতে সক্ষম হলেন এবং বক্তৃতা ও রচনার ক্ষেত্রে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন। যুগের বিশিষ্ট মনীষী ও ফকীহগণের মধ্যে তার স্থান হল।
যিনি ব্যক্তি এরূপ অনুকূল ও প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রম করে পরিশেষে এই ধরনের উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত হয়েছেন তার মধ্যে কিছুটা আত্মগরিমার ছাপ স্বাভাবিক মনে হতে পারে যেমনটি অনেক অজ্ঞানী ও অর্ধজ্ঞানীর মধ্যে লক্ষ করা যায় কিন্তু এখানেও নানাজী ব্যতিক্রম ছিলেন। জীবনপথের চড়াই উতরাই অতিক্রম করে মর্যাদা ও প্রসিদ্ধির অত্যুচ্চ আসনে সমাসীন হলেও এসব তাকে, এমনকি আমাদের মতো শিশু কিশোরদের সামনেও বিনীত হতে বাধা দিত না বিভিন্ন ঘরোয়া মজলিসে এবং হাসি-গল্পের মুহূর্তগুলিতে তিনি আমাদের বলতেন আমরা যেন তাকে তার উন্নতির ব্যাপারে সাহায্য করি এবং তার ত্রট্টটি বিচ্যুতিগুলো তাকে উপহার দেই। আমরা তার এ আহবানে সাড়া দিতে সংকোচ বোধ করতাম। কেননা, তিনি বয়স ও মর্যাদা উভয়দিক থেকে পরিবারের শীর্ষব্যক্তি ছিলেন। আমরা তাকে ভালোবাসতাম এবং শ্রদ্ধা করতাম।
স্বভাবতই তিনি সকল দোষ ত্রট্টটির উর্ধ্বে ছিলেন না। তার কোনো কথা বা আচরণ আমাদের কাছে অসঙ্গত মনে হলেও শ্রদ্ধা ও আদবের কারণে আমরা তা প্রকাশ করতে সংকোচ বোধ করতাম কিন্তু তিনি সবসময়ই আমাদের মতামত জানতে চাইতেন। আমাদের সংকোচ ভাঙ্গার জন্য বলতেন-
“পৃথিবীতে পূর্ণতা বলে কিছুই নেই। দোষ—ত্রুটি সকল মানুষেরই রয়েছে। তবে তা কতটা কমানো যায় সে চেষ্টাই করতে হবে। একটি প্রসিদ্ধ প্রবাদ বাক্য হল,
كفى بالمرأ نبلا أن تعد معايبه
‘মানুষের পূর্ণতার পরিচয় এই যে, তার বিচ্যুতিগুলো গণনা করা হয়। অথচ দেখ, মানুষ যতই ন্যায়পরায়ণ হোক না কেন, নিজেকে সে পুরোপুরি চিনতে পারে না। তাই নিজের দোষত্রট্টটি জানার জন্য অন্যের সাহায্য প্রয়োজন হয়। সারা জীবন দোষের বোঝা বহন করে আল্লাহর সামনে তা নিয়ে উপস্থিত হওয়ার চেয়ে মানুষের জন্য কি এটাই মঙ্গলজনক নয় যে, পৃথিবীতেই তার দোষত্রট্টটি ধরিয়ে দেওয়া হবে এবং সে তা থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করবে?” তার একথায় আমরা সাহস পেতাম এবং একে অপরকে উদ্বুদ্ধ করতাম। অবশেষে নিতান্ত আদবের সাথে আমরা আমাদের অনুভূতি প্রকাশ করতাম। তিনি আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেন এবং আশ্বাস দিতেন যে, বিষয়টি সংশোধনের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবেন। আমরা সবাই মিলে যখন কোনো ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতাম তখন তিনি বলতেন, তোমরা সাক্ষী থাক, আমি আজ থেকে এ বিষয়টি শোধরানোর চেষ্টা করব। তোমরাও আমাকে সাহায্য করবে এবং ভুলে গেলে আমাকে মনে করিয়ে দিবে।’
একটি প্রবাদ আছে
من شب على شيء شاب عليه
‘যৌবনের অভ্যাস বার্ধক্যেও যায় না।’
আমি নানাজীকে ষাট বছরের বয়সে দেখেছি এবং এসময়ের অভিজ্ঞতাই আমি এখানে উল্লেখ করেছি। তিনি কি তার সকল দোষ ত্রুটি জয় করতে পেরেছিলেন? স্বভাবতই তিনি তা পারেননি। কিন্তু তারপরও আত্মউন্নয়নে তার দুর্নিবার প্রচেষ্টা এবং সমালোচনা গ্রহণ করার মতো সহনশীলতা তাকে আমার দৃষ্টিতে অনেক উচ্চাসনে সমাসীন করেছিল।