শিশুর মন—মনন গঠনে মা—বাবার দায়িত্ব
শিশুকালটা বাচ্চাদের গড়ে ওঠার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়; অথচ এই সময়টাকেই কলুষিত করার কত সরঞ্জাম আমাদের আশপাশে ছড়ানো! এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হল টেলিভিশন ও শিশু—কিশোর সাহিত্যের ছদ্মাবরণের চেতনা বিধ্বংসী বইপত্র। টিভি এখন ধনীর প্রাসাদ থেকে শুরু করে গরীবের কুটির পর্যন্ত সব জায়গায়ই পেঁৗছেছে। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোতে যে ধরনের অনুষ্ঠান ও নাচ—গান সম্প্রচারিত হয়ে থাকে সেগুলোকে কখনো সুস্থ বিনোদন বলা যায় না। শিশুর কচি মনে এর যে প্রভাব পড়ে থাকে তার পরিণতি রীতিমতো ভয়াবহ। অনেক মা সন্তানদেরকে কেবল শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দেখার জন্য টিভি দেখতে দেন; কিন্তু বাচ্চারা শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ফাঁকে ফাঁকে অন্যান্য অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনচিত্রও দেখে থাকে। আর এগুলোই তাদের মনে বেশি প্রভাব বিস্তার করে।
একবার ছয় বছরের এক বাচ্চাকে নাম জিজ্ঞাসা করলে সে এমন একটা নাম বলল যে, তাকে আমার মুসলমান বলেই ধারণা করতে কষ্ট হল। শেষে তার বাবা—মার নাম জিজ্ঞাসা করে বুঝতে পারলাম যে, সে একটি মুসলিম শিশু। বাচ্চাটি যেমন প্রিয়দর্শন তেমনি হাসিখুশি ও বুদ্ধিদীপ্ত। অল্পক্ষণেই সে আমার সঙ্গে গল্পে মেতে উঠল। বলল, জানেন ফুপী, আমি বড় হয়ে ঠিক, এক গায়কের নাম নিয়ে বলল, তার মতো হব। বললাম, কেন? সে কি খুব ভালো মানুষ?
সে আশ্চর্য হয়ে বলল, ওমা! আপনি বুঝি টিভি দেখেন না? সে কত সুন্দর করে গান গায়!
বললাম, তোমার কি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম—এর মতো হতে ইচ্ছে করে না? কিংবা উমরের রা.—এর মতো? সে আবার আশ্চর্য হয়ে বলল, মহানবী, হযরত উমর রা. তারা কে ফুপী? তারা কি আরও ভালো মানুষ? তাদেরকে তবে টিভিতে দেখা যায় না কেন?’
ছোট্ট মাসুম বাচ্চার এই প্রশ্নে খুব ব্যথিত হয়েছিলাম। টিভি দেখতে দেখতে তার চেতনার উর্বর ভূমিতে যে বিষ—কাটার অঙ্কুর গজাচ্ছে বয়স বাড়ার সাথে সাথে এগুলোই যে পুষ্ট হয়ে তার চিন্তা—চেতনা ও ধ্যান-ধারণাকে আচ্ছন্ন করে নেবে এতে কি কোনো সন্দেহ আছে?
এরপর আসে বাচ্চাদের বই পড়া প্রসঙ্গ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের শিশুসাহিত্যের সিংহভাগই ভুত—প্রেত, দেও—দানব আর নানা রূপকথা দিয়ে বোঝাই। এগুলোর পরিবর্তে ছোটদের নবী-কাহিনী, শিশু আকীদা সিরিজ, মরহুম অধ্যাপক শাহেদ আলী রচিত রূহীর প্রথম পাঠ-এ ধরনের অন্যান্য বই এবং আমাদের শিশুসাহিত্যে জীবন গড়ার প্রেরণামূলক এবং জানা অজানা ও জ্ঞান বিজ্ঞান বিষয়ক যে বইগুলো আছে সেগুলো পড়তে দেওয়া উচিত। শিশুদের মন অকর্ষিত জমির মতো। এখানে যে বীজ বপন করা হবে তারই অঙ্কুরোদগম হবে। অসার ও অবাস্তব কল্পকাহিনীর জঞ্জালে এই জমিন কন্টকিত করার চেয়ে সত্য—সুন্দর ও আলোকিত আদর্শের বীজ বপন করাই কি উত্তম নয়?
তবে বই পড়া নিয়ে সবচেয়ে ভয়—ধরানো ব্যাপার হল বার চৌদ্দ বছর বয়সী সদ্য কৈশোরপ্রাপ্ত বাচ্চাদেরকে নিয়ে, যাদের নিজেদের লক্ষ্য স্থির করার বুদ্ধিও তখন হয়ে উঠে না। আবার জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জানার কৌতুহলও এই বয়সে থাকে অসম্ভব রকমের বেশি। তারা তখন হাতের কাছে যা পায় তাই পড়ে ফেলতে চায় আর আমাদের বই—পুস্তক ও পত্র—পত্রিকায় বলতে গেলে এখন নোংরামী ও বেহায়াপনারই রাজত্ব চলছে। ফুটপাতের হকার থেকে শুরু করে নামী দামী বড় বড় বুকস্টলে সমানতালে চলছে এই রুচিহীনতার জয়—জয়কার।
মাস তিনেক পূর্বে রেলে সফর করছিলাম। একজন হকার ঘুরে ঘুরে সাপ্তাহিক মাসিক বিভিন্ন ম্যাগাজিন বিক্রি করছিল। আমাদের সামনের সীটের কয়েকজনকে পত্রিকা কিনতে দেখে আমারও কৌতুহল হল। আমার স্বামীকে বললে তিনি হকারের কাছ থেকে সব কটি পত্রিকা নিয়ে আমার হাতে দিলেন, আমি সবগুলো কাগজ উল্টেপাল্টে দেখে হতাশ হলাম। লিটল ম্যাগ কিংবা রুচিশীল কোনো কাগজ এর মধ্যে নেই। সবকটারই প্রচ্ছদ-চিত্র আপত্তিকর। শেষে ডাক্তারী পত্রিকা এবং চিকিৎসা বিষয়ক কিছু থাকতে পারে ভেবে ‘চিকিৎসা সাময়িকী’ নামে একটি মাসিক কিনলাম। বাড়িতে গিয়ে এটি খুলে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। পাতার পর পাতা অশীল বিজ্ঞাপন আর সীমাহীন কদর্য নোংরা কয়েকটি লেখা ছাড়া চিকিৎসা বিষয়ক কোনো কিছুর নাম—গন্ধও নেই। অন্য কারো হাতে পড়তে পারে ভেবে পত্রিকাটি আমি সাথে সাথে পুড়ে ফেলতে বাধ্য হলাম। শালীনতার মোড়কে আচ্ছাদিত চিকিৎসা নাম দেওয়া একটি কাগজের অবস্থা যদি এমন হয় তবে অন্য যেগুলো নগ্নতার প্রকাশ্য স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছে সেগুলোর কী অবস্থা?
আমাদের কিশোর ও যুবসমাজের অধঃপতনের কারণগুলোর মধ্যে এও একটি কারণ। তাই মা—বাবাকে, বিশেষ করে মাকে কিশোর বয়সী বাচ্চাদের বই পড়া নিয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদের পাঠ্যবই ছাড়া অন্যান্য বই নিজেরাই নির্বাচন করে দেওয়া উচিত।
আরেক ধরনের বই, যেগুলোর কথা না বললেই নয়। বর্তমানে সায়েন্স ফিকশন, গোয়েন্দা বই ও রহস্য গল্পের নামে আজব কিছু কল্পকাহিনীতে বাজার ছেয়ে গেছে। এগুলোতে না আছে কোনো বাস্তবতা আর না আছে শিক্ষণীয় কিছু। আর এগুলোর অধিকাংশেরই সাহিত্য মানও ভালো নয়। উদ্ভট কিছু কিচ্ছা—কাহিনীর জাদুতে এগুলো আমাদের কিশোরদের মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। এক কথায় মেধাবী ও সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী কিছু মানুষের মেধার অপচয় ছাড়া এগুলোকে আর কিছু বলা যাবে না। তার উপর কিশোর পাঠকদের কাছে এর নেশাও মারাত্মক। অনেক মেধাবী কিশোর কিশোরী এ নেশায় পড়ে মাদরাসা ও স্কুলে পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ করে। সব কিছুই মধ্যম পর্যায়ে থাকা ভালো। অতি নেশা ভালো কাজেও ধ্বংস ডেকে আনে। গোয়েন্দা বইয়ের পাঠক যতজনকে আমি দেখেছি তাদের অধিকাংশই স্বাভাবিক সীমা অতিক্রম করে গেছে। বেশিরভাগ সময়েই তারা অন্যসব পড়া—লেখা বাদ দিয়ে এগুলো নিয়েই পড়ে থাকে। বইয়ের কাহিনীকে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করতে চায়। অহেতুক একে ওকে সন্দেহ করে। রাতের বেলা স্বপ্নে চিৎকার করে উঠে। মোটকথা, তাদের মনে এগুলো এত গভীর প্রভাব বিস্তার করে যে, চেতনে অবচেতনে তারা এর বাইরে অন্য কিছুই ভাবতে পারে না।
এর অর্ধেক মনোযোগও যদি অন্য কোনো ভালো কাজে কিংবা ভালো বই পড়ায় ব্যয় হত, তবে তার সময়টা সার্থক হত। আসলে এর পুরো দায়িত্বটাই মা—বাবার বিশেষত মায়েরা আন্তরিক হলে ছেলে—মেয়েদেরকে এসব ফালতু নেশা থেকে ফিরিয়ে ভালো কোনো সৃজনশীল কাজে লাগিয়ে দিতে পারেন। বর্তমানে শিশু কিশোরদের উপযোগী ভালো বইয়ের সংখ্যা আশানুরূপ না হলেও একেবারে নেই তা-ও নয়। তাদের মন—মনন গঠনের জন্য সে বইগুলো সংগ্রহ করা যেতে পারে। তাদের মনে কুরআন পাক হিফয করার আগ্রহ সৃষ্টি করা যেতে পারে এবং বাংলা সাহিত্য চর্চা বা নতুন কোনো ভাষা শেখার প্রতিও উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। এ রকম আরও অনেক কিছুই করার মতো আছে। প্রয়োজন মায়েদের সদিচ্ছা ও সচেতনতা। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন।