আল্লাহকে ডাকা কত সোজা
কুরআন বলে, বান্দা ও আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা নেই; আল্লাহর বান্দা সরাসরি আল্লাহকে ডাকতে পারে এবং তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাতে পারে। জাহেলী যুগের লোকেরা মনে করত, আল্লাহকে সরাসরি ডাকা যায় না। তারা নানা ধরনের কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল। তারা অসংখ্য দেব—দেবীতে বিশ্বাস রাখত এবং প্রয়োজন পূরণের মালিক মনে করে এদেরই পূজা করত। অন্যদিকে তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করত এবং তাঁকে আসমান—জমীনের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা মনে করত। তাহলে তারা এতসব মূর্তির পূজা করত কেন? তারা এর পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলত, আমরা এদের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য পেতে চাই। কুরআন শরীফে সূরা যুমারে তাদের এ কথাটি উল্লেখিত হয়েছে
مَا نَعْبُدُهُمْ اِلَّا لِیُقَرِّبُوْنَاۤ اِلَی اللّٰهِ زُلْفٰی.
‘আমরা শুধু এজন্যই তাদের উপাসনা করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর কাছে পৌঁছে দিবে।’
সে সময়ের আরব জাতির মতো পৃথিবীর আরও অনেক জাতি একই যুক্তিতে হাতেগড়া প্রতিমার পূজা করে।
অনেকে আবার সারু—সন্ন্যাসী, গণক-জ্যোতিষী কিংবা ধর্মীয় গুরুদেরকে বান্দার ডাক আল্লাহর কাছে পৌছে দেওয়ার মাধ্যম মনে করে থাকে। এগুলো হল মূর্খতা। যাদের কাছে আল্লাহর পরিচয় নেই তারাই এসব বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। পবিত্র কুরআন স্পষ্টভাবে আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরেছে। আল্লাহ সরাসরি তার বান্দাদের প্রর্থনা শোনেন। তাঁর কাছে প্রার্থনা জানানোর জন্য কিংবা তাঁর নৈকট্য অর্জন করার জন্য আরও পূজা করার প্রয়োজন নেই; বরং এটি হল শিরক। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে—
وَ اِذَا سَاَلَكَ عِبَادِیْ عَنِّیْ فَاِنِّیْ قَرِیْبٌ ؕ اُجِیْبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ اِذَا دَعَانِ.
(হে নবী) আমার বান্দাগণ যখন আপনার কাছে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে তখন (আপনি বলুন,) আমি নিকটেই আছি। প্রার্থনাকারী যখন আমাকে ডাকে আমি তার ডাকে সাড়া দেই।’
তাহলে আল্লাহকে ডাকা কত সোজা। অথচ অজ্ঞতার কারণে মানুষ কত কুসংস্কারের জন্ম দিয়েছে।
অন্তরে ইসলাম
স্যার রোলান্ড জর্জ উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের একজন বিখ্যাত বৃটিশ ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৯১৩ সালে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। অ বিংঃবৎহ অড়িশব ফরহম ঃড় রংষধস নামক গ্রন্থে তিনি তার অনুভূতি এভাবে ব্যক্ত করেছেন-
‘আমার কোনো কোনো বন্ধু ভাবতে পারেন, আমি মুসলমানদের চাপে পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছি। কিন্তু সত্য কথা হল, এ ধরনের কোনো কিছু আমাকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেনি। আমার বহু বছরের অধ্যয়নই আমাকে ইসলামের প্রতি আস্থাশীল করেছে। আমি আমার চিন্তাধারার সঙ্গে ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের আশ্চর্য মিল দেখে অবাক হয়েছি।
‘মানুষকে এই দ্বীন গ্রহণ করতে হবে তার অভ্যন্তরীণ প্রেরণা থেকেই, যেমনটি কুরআন বলে, বাইরের কোনো চাপে তা হবে না।
‘আমি ইসলাম গ্রহণের আগের অবস্থা ও পরের অবস্থার মাঝে তুলনামূলক বিশেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, পাশ্চাত্যের হাজার হাজার নারী-পুরুষ মানসিকভাবে মুসলমান হয়ে গেছে। কিন্তু তারা তাদের পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে এবং বিদ্রূপও সমালোচনার ভয়ে তা প্রকাশ করতে পারছে না।
আমি যে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিলাম এতেও আমার পূর্ণ আশঙ্কা রয়েছে যে, আমার বন্ধুরা আমাকে সরল পথ থেকে বিচ্যুতই ভাববেন। তবে আমি বিগত বিশ বছর যাবৎ এই বিশ্বাসই পোষণ করে আসছি যা এখন প্রকাশ করলাম এবং যা তাদেরকে ক্ষুব্ধ করছে।’
ড. আহমাদ শালাবী, আলইসলাম ফী উরুব্বা ৩৭—৩৮
আমাদের নবীজী
আনাস ইবনে মালিক রা. বলেছেন, আমি পরিবার পরিজনের প্রতি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম— এর চেয়ে অধিক দয়ালু আর কাউকে দেখিনি। (তাঁর শিশুপুত্র) ইবরাহীম মদীনার এক দুধমাতার কাছে ছিলেন। তার দুধপিতা ছিলেন একজন কর্মকার সাহাবী। তাদের ঘরটি হাপরের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যেত। এর মধ্যেই নবীজী আমাদের নিয়ে প্রিয় পুত্রকে দেখতে যেতেন।’ -সহীহ মুসলিম; ফাতহুল বারী ৩/২০৭
দ্বীনের দাওয়াত
মুসলিম সমাজের যে বিরাট অংশ সীমাহীন পশ্চাৎপদতা ও মূর্খতার শিকার, তাদের প্রতি হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ.—এর অপরিসীম দরদ ছিল। তাদের শিক্ষাদীক্ষার প্রবল আগ্রহ তাঁর মনে ছিল। একবার এ উদ্দেশ্যে তিনি খুব গুরুত্বের সঙ্গে সড়ক-পাড়ে মসজিদ সংলগ্ন একটি মকতব এবং আরেকটু আগে বেড়ে চৌরাস্তার মুখে হুক্কা—পানির ব্যবস্থা সম্বলিত আরেকটি মকবত কায়েম করলেন। মকতব মানে প্রচলিত ধরনের কোনো মকতব—মাদরাসা নয়। এক গাছের নিচে চট জাতীয় কোনো বিছানা পেতে একটি তাবলীগী জামাতের অবস্থানই হল তাঁর মকতব, যারা আসহাবে ছুফফার অনুসরণে দ্বীন শেখা ও শেখানোর কাজে মগ্ন থাকত।
তখন ছিল আজমীরী ওরসের যমানা। হিন্দুস্তানের দূর দূরান্ত থেকে বিপুল সংখ্যক সাধারণ গরীব মুসলমান হযরত নিযামুদ্দীন আওলিয়া রহ.—এর যিয়ারতে আসত। পথে গাছের শীতল ছায়া এবং তাজা হুক্কা ও ঠাণ্ডা পানি দেখে তাদের লোভ হত একটুখানি জিরিয়ে নেওয়ার। ‘ধুম্রসেবনের’ এই অবসরে মুবাল্লিগগণ তাদের ‘আসল কাজ’ সেরে ফেলতেন। কোমল ও বিনম্র ভাষায় তাদেরকে দ্বীনের পয়গাম শুনিয়ে দিতেন। এভাবে হাজারো জাহেলী মুসলমানের কানে তারা দ্বীনের কথা পৌঁছিয়েছেন। -মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস রহ. ও তার দ্বীনী দাওয়াত ১৬৫—১৬৬
আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন
আবু হাফস উমার ইবনে শাহীন একজন মুহাদ্দিস ছিলেন। বাগদাদের এক আতর সওদাগরের দোকানে তিনি হাদীসের দরস দিতেন। তাঁর শীষ্য আবু যর বলেন, আমরা একদিন সেই দোকানে শায়খের নিকটে বসে ছিলাম। ইতোমধ্যে একজন ফেরিওয়ালা আসল, যে ফেরি করে আতর বিক্রি করত। লোকটি দোকানে এসে দশ দিরহামের আতর কিনল কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় হঠাৎ হেঁাচট খেয়ে তার আতরের শিশিগুলো মাটিতে পড়ে গেল এতে লোকটি অস্থির হয়ে কাঁদতে লাগল। এ দৃশ্য দেখে শায়খ সওদাগরকে বললেন, আপনি কি লোকটিকে কিছু অনুগ্রহ করবেন? দোকানদার খুশিমনে শায়খের অনুরোধ রাখতে রাজি হল এবং যে পরিমাণ আতর মাটিতে পড়ে গিয়েছিল তা নিজের পক্ষ থেকে দিয়ে দিল। শায়খ ফেরিওয়ালাকে বললেন, ভাই দুনিয়ার কোনো জিনিস নষ্ট হলে এত দুঃখিত হতে নেই। লোকটি বলল, জনাব, এই সামান্য বস্তু বিনষ্ট হয়েছে বলে আমি অস্থির হইনি। আমার বন্ধুবান্ধব আমাকে একজন ধৈর্য্যশীল মানুষ বলেই জানে। এক সফরে আমার একটি দীনারপূর্ণ থলে খোয়া গিয়েছিল। ওতে চার হাজার দীনার ছাড়াও আরো চার হাজার দীনার সমমূল্যের পাথর ছিল। এত অর্থ খোয়া গেলেও আমি তখন সামান্যও অস্থির হইনি। কেননা, তখন আমার কাছে আরও অর্থ—সম্পদ ছিল। কিন্তু এখনকার কথা আলাদা গতরাতে আমার একটি সন্তান জন্মলাভ করেছে। আমার স্ত্রীর কিছু জিনিসপত্রের প্রয়োজন। কিন্তু আমার কাছে এই দশটি দিরহাম ছাড়া আর কিছুই নেই। এই অর্থটুকু দ্বারা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে ফেললে আমি একদম রিক্তহস্ত হয়ে যাব। তাই আমি এই দশ দিরহামের আতর কিনতে মনস্থ করেছিলাম। এগুলো বিক্রি করলে কিছু লাভ হবে। তা দিয়ে প্রয়োজনীয় সওদাপাতি কিনব এবং মূলধনটুকু রেখে দিব। যখন আতরগুলো পড়ে গেল তখন আর আমার ঘরমুখো হওয়ার উপায় ছিল না। তাই আমি আস্থির হয়ে পড়েছিলাম।
শায়খ আবু হাফস—এর মজলিসে একজন সৈনিক উপস্থিত ছিল। সে শায়খকে বলল, হযরত, আমি লোকটিকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই। আমরা ভাবলাম, সে হয়তো তাকে কিছু সাহায্য করবে। সে- আমাদেরকেও তার গৃহে নিয়ে গেল। সৈনিক ফেরিওয়ালার ঘটনা পুনরায় শুনল এবং সেই কাফেলার লোকদের সম্পর্কে জানতে চাইল। ফেরিওয়ালা উত্তর দিল। সৈনিক বুঝল, লোকটি সত্য কথাই বলছে। তখন সে থলেটি কেমন এবং কোন জায়গায় তা খোয়া গেছে ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে বলল, থলেটি দেখলে কি তুমি চিনতে পারবে? ফেরিওয়ালা বলল, অবশ্যই চিনব। এবার সৈনিকটি ঘরের ভেতর থেকে একটি থলে এনে তার সামনে রাখল। ফেরিওয়ালা তা দেখামাত্র চিৎকার করে উঠল এবং বলল, এই তো আমার খোয়া যাওয়া থলে। এতে এই বর্ণের এই এই পাথর রয়েছে ইত্যাদি। আমাদের সবার সামনে থলেটি খোলা হল এবং দেখা গেল, বিবরণ সম্পূর্ণ সত্য। সৈনিক তাকে থলেটি দিয়ে বলল, নাও তোমার জিনিস তুমি নিয়ে যাও। আল্লাহ তোমাকে বরকত দান করুন। থলের মালিক ওই সৈনিককে বলল, ভাই, এই পাথরগুলোর খুব মূল্যবান আমি তোমাকে এগুলো খুশি মনে উপহার দিচ্ছি। সৈনিক তা নিতে অপারগতা জানিয়ে বলল, তোমার জিনিস আমার কাছে আমানত ছিল। আমি তা তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি এই যথেষ্ট। এর বিনিময়ে আমি কিছু নিব না।
আমরা এই ঘটনা দেখে অবাক হলাম। আল্লাহর কী শান! কিছুক্ষণ আগে যে দুর্ঘটনায় সে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল তা—ই তার স্বচ্ছলতার দুয়ার খুলে দিল।
-আল মুসতাতরাফ, শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে আবী আহমাদ ২/১৩৯—১৪০