মুহমে শেখ ফরিদ, বগল মে ইট
একটি দৈনিক পত্রিকা প্রতি শুক্রবার ‘ইসলাম ও সমাজ’ নামে ধর্মপাতা প্রকাশ করে থাকে। সেখানে জনৈক কাউসার ইকবাল সাহেবের একটি ছোট লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লেখাটি তৈরি করেছিলেন। অথার্ৎ কুরআনের উদ্ধৃতিকেই আলোচনার মূল অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। লেখাটির মূল শিরোনামের উপরে ছোট করে দেওয়া আছে ‘আন্তঃধমীর্য় ঐক্য চেতনা।’ বড় শিরোনাম হল, ইবরাহীম আ.—এর ধমার্দর্শ অনুসরণ করা উচিত।’ আলোচনার মূল দাবিগুলো ছিল নিম্নরূপ,
১. অন্য সকল ধর্মাবলম্বীর মত মুসলিম জাতিও নবীতে নবীতে সেই পার্থক্য করে, যা না করার নির্দেশনা সূরা নিসার ১৫২ নম্বর আয়াতে রয়েছে।
২. অন্য সকল ধমার্বলম্বীর মত মুসলিম জাতিকেও ইবরাহীম আ.এর ধমার্দর্শ গ্রহণ করা উচিত।
৩. কুরআনের প্রতিশ্রম্নতি অনুসারে খৃস্টান জাতি আল্লাহ—বিশ্বাসীদের নেতৃত্ব দিবে। সূরা আলে ইমরানের ৫৫নং আয়াতে এই প্রতিশ্রম্নতি দেওয়া হয়েছে। শক্তিমত্তার দিক থেকে বর্তমান পাশ্চাত্য জগতের যে শ্রেষ্ঠত্ব তাতে কুরআনের সেই প্রতিশ্রম্নতিরই প্রতিফলন ঘটেছে।
৪. মুসলিমগণও নামাযে দরূদ শরীফে স্বীকার করে এসেছেন যে, ইবরাহীম আ. নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অধিক রহমত ও বরকত পেয়েছেন। তাই তারা অনুরূপ রহমত ও বরকত নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যও দাবি করে এসেছেন। তাহলে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থলে ইবরাহীম আ.এর অনুসরণ করলেই তারা অধিক রহমত লাভ করবেন।
প্রিয় পাঠক, আপনার কৌতূহল হচ্ছে? কী কৌশলে এসব কথা কুরআনের নামে চালানো হয়েছে তা জানতে ইচ্ছে করছে? ইনশা আল্লাহ, এখনই সব জানতে পারবেন।
১. নবীগণের মধ্যে পার্থক্য ও পবিত্র কুরআন
কাউসার সাহেব লিখেছেন, “আল— কুরআনের সূরা নিসার ১৫২ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণে বিশ্বাস করে এবং তাদের একের সাথে অপরের পার্থক্য করে না, তাদেরই তিনি (আল্লাহ) পুরস্কার দিবেন এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’
‘‘পরিতাপের বিষয় এই যে, বর্তমান পৃথিবীতে যারা আল্লাহতে বিশ্বাসী তারা আল্লাহর সব রাসূলের উপর বিশ্বাসী নয় এবং রাসূলদের একের সাথে অপরের পার্থক্য করে থাকে। রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারীরা রাসূল ঈসা আ., রাসূল দাউদ আ., রাসূল মূসা আ.এর প্রতি ততটা ভালোবাসা প্রকাশ করে না, যতটা রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি প্রকাশ করে।’’
প্রথমেই দেখা যাক, কুরআন ‘রাসূলগণের মধ্যে পার্থক্য করা’ বলতে কী বুঝিয়েছে। বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য আমরা বরং সূরা নিসার ১৫০ আয়াত থেকে শুরু করি। কেননা এ আলোচনার সূচনা সেখান থেকেই। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করে এবং চায় যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের মধ্যে পার্থক্য করবে আর বলে, আমরা কতককে বিশ্বাস করি আর কতককে প্রত্যাখ্যান করি আর মধ্যবতীর্ কোনো পথ অবলম্বন করতে চায়, নিঃসন্দেহে এরাই হল কাফের। আমি কাফেরদের জন্য লাঞ্ছনাযুক্ত আযাব প্রস্তুত করে রেখেছি।
যারা ঈমান আনে আল্লাহর প্রতি এবং.........ভালবাসা প্রকাশ করে না, যতটা রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি প্রকাশ করে থাকে।’ কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। কেননা আয়াতে শ্রদ্ধা—ভালোবাসার কথা হয়নি। ১৫০ আয়াত থেকেই এ বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা গেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, লেখক শুধু ১৫২ আয়াত উল্লেখ করেছেন। ১৫০ আয়াতটি একদম উল্লেখই করেননি।
এটাতো সাধারণ বুদ্ধিরও কথা যে, যাকে প্রত্যক্ষভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে আর যাকে প্রত্যক্ষভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না এই দুজনের প্রতি মনের টান এক সমান হওয়া সম্ভব নয়। এটা মানব—প্রকৃতি। পিতার প্রতি মনের যে পরিমাণ আকর্ষণ ঠিক সেই পরিমাণ যদি চাচার প্রতি না থাকে তাহলে একে দোষের ব্যাপার বলা যায় না। তবে যে পরিমাণ শ্রদ্ধা ভালোবাসা চাচার প্রাপ্য তা তাকে অবশ্যই দিতে হবে। মুসলিম জাতি এটা দিয়েও আসছে। সকল নবীর প্রতি ঈমান রাখা এবং আল্লাহর নবী হিসেবে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করা মুসলিম জাতির ঈমান ও ইসলামের অংশ। তবে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তো সবচেয়ে বেশি মহব্বত ও ভালোবাসা থাকতেই হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ আমি তার কাছে তার পিতা, সন্তান এবং সকল মানুষ থেকে প্রিয় না হব।
২. মুসলিম জাতি ও মিল্লাতে ইবরাহীম
উপরোক্ত বিষয়ে তিনি যা কিছু লিখেছেন তার সারমর্ম হল, অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের মত মুসলিম জাতিও মিল্লাতে ইবরাহীম থেকে বিচ্যুত। তাই তিনি মুসলিম জাতিকেও মিল্লাতে ইবরাহীমীর প্রতি আহ্বান করেছেন। তিনি লেখেন, ‘প্রশ্ন হতে পারে, ইহুদী, খৃস্টান ও ইসলাম ধর্মের অনুসারী এবং আল্লাহ—বিশ্বাসীরা একই প্লাটফর্মে আসবে কী করে? সব রাসূলের প্রতি সমান শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই বা দেখাবে কী করে? এর উত্তর হচ্ছে, আল্লাহ—বিশ্বাসী ইহুদী খৃস্টান ও মুসলমানদেরকে হযরত ইবরাহীম আ.এর ধমার্দর্শ অনুসরণ করতে হবে।’
তিনি আরো লিখেছেন, ‘মুসলমানরা যেহেতু এতদিন ধরে স্বীকার করেই এসেছে যে, ইবরাহীম আ. পৃথিবীতে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে বেশি রহমত ও বরকত লাভ করেছিলেন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বংশধরদের জন্য অনুরূপ রহমত ও বরকত দাবি করে আসছিলেন, সেহেতু আল্লাহ তাআলার নির্দেশ মোতাবেক ইবরাহীম আ.— এর ধমার্দর্শ অনুসরণ করলে এবং ইবরাহীম আ. যেভাবে সালাত কায়েম করেছিলেন সেভাবে সালাত কায়েম করলে মুসলমানরা অধিক রহমত ও বরকত লাভ করবে নিঃসন্দেহে।’
মুসলিম জাতি মিল্লাতে ইবরাহীমীর উপর প্রতিষ্ঠিত, না তা থেকে বিচ্যুত এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের সিদ্ধান্ত উদ্ধৃতি করার আগে মিল্লাতে ইবরাহীমীর দুটি মৌলিক বিষয় আলোচনা করি। এতেই পরিষ্কার হবে, কারা মিল্লাতে ইবরাহীমীতে প্রতিষ্ঠিত, আর কারা তা থেকে বিচ্যুত।
ইবরাহীম আ.এর ধর্ম—বিশ্বাসের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুটি। এক. নির্ভেজাল তাওহীদের বিশ্বাস। দুই. আল্লাহ তাআলার প্রতি শর্তহীন আনুগত্য। তাওহীদের ব্যাপারে ইবরাহীম আ.এর অবস্থান কুরআনে বারবার উদ্ধৃত হয়েছে, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, “এবং আপনি সেই সব লোকদেরকে ইবরাহীমের বৃত্তান্ত শুনিয়ে দিন, যখন তিনি তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে বললেন, তোমরা কীসের ইবাদত কর? তারা বলল, আমরা প্রতিমাসমূহের ইবাদত করি এবং এদের ইবাদতকেই নিষ্ঠার সাথে আঁকড়ে থাকি। ইবরাহীম বললেন, তোমরা যখন প্রার্থনা কর তারা শোনে কি? অথবা তোমাদের কোনো উপকার বা অপকার করতে পারে কি? তারা বলল, না, তবে আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের এরূপই করতে দেখেছি। ইবরাহীম বললেন, তোমরা কি এদের অবস্থা ভেবে দেখেছ যাদের ইবাদত করে চলেছ তোমরা এবং তোমাদের পূর্ববতীর্ পিতৃপুরুষরা? এরা যে আমার (নাউযুবিল্লাহ যদি আমি এদের পূজা করি) এবং তোমাদের জন্য ক্ষতির বস্তু। তবে রাব্বুল আলামীন। (তিনি তাঁর ইবাদকারীদের জন্য কল্যাণদানকারী) যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এরপর তিনিই আমাকে পথপ্রদর্শন করেন। যিনি আমাকে আহার ও পানীয় দান করেন। যখন আমি রোগাক্রান্ত হই তিনিই আমাকে আরোগ্য দান করেন। যিনি আমার মৃত্যু দিবেন। এরপর পুনজীর্বন দান করবেন এবং আমি আশা করি বিচার দিনে তিনিই আমার ভুল—ত্রুটি ক্ষমা করবেন।” -সূরা শুআরা
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা মুশরিক জাতির সাথে ইবরাহীম আ.এর চমৎকার তর্কের বিবরণ দিয়েছেন। এরপর তাঁর খলীলের সেই প্রসিদ্ধ বাণীটি উল্লেখ করেছেন— ‘আমি (সকল মত ও বিশ্বাস থেকে) বিমুখ হয়ে তাঁর দিকেই মুখ ফিরাচ্ছি যিনি আকাশসমূহ ও ভূমি সৃষ্টি করেছেন। আর আমি শিরককারীদের অন্তভুর্ক্ত নই।’ -সূরা আনআম ৭৯
তিনি আরো বলেছেন, যারা (আল্লাহর প্রতি) ঈমান রাখে এবং নিজেদের ঈমানকে শিরকের সাথে মিশ্রিত করে না তারাই নিরাপত্তা লাভ করবে। আর তারাই হল সঠিক পথের অনুসারী।’ -সূরা আনআম ৮২
আল্লাহ তাআলার সাথে শিরককারীদের ব্যাপারে তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের অবস্থান কী ছিল পবিত্র কুরআনে তাও উদ্ধৃত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। যখন তারা তাদের স¤প্রদায়কে বলে দিল, তোমাদের সাথে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ইবাদত কর তাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের প্রতি অস্বীকৃতি জানাই। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সর্বদার জন্য ঘৃণা ও শত্রট্টতা প্রকাশ পেয়ে গেল যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান নিয়ে আস।’ -সূরা মুমতাহিনা ৪
এই বিশুদ্ধ তাওহীদের বিশ্বাস এবং সত্যের ব্যাপারে আপোষহীন মানসিকতাই হল ইবরাহীম আ.এর ধমার্দর্শ। এ প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়া বাহুল্য হবে না যে, তাওহীদের এই বিশ্বাসকে শুধু ‘আল্লাহ বিশ্বাস’ শব্দে ব্যক্ত করা চলে না। আল্লাহতে বিশ্বাসের পাশাপাশি তাঁর সাথে সব ধরনের অংশী স্থাপন থেকে বিরত থাকলেই তাওহীদের মর্ম পূর্ণ হয়। ‘তিনি আছেন’ শুধু এটুকু বিশ্বাস কোনভাবেই যথেষ্ট নয়। তিনিই একমাত্র ইলাহ, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনিই রব, তিনি ছাড়া সৃষ্টির প্রতিপালক ও জগৎ পরিচালনার আর কেউ নেই। তিনিই বিধানদাতা। তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। এ সবগুলো বিশ্বাসই তাওহীদের জন্য জরুরি।
দ্বিতীয় বিষয়টি হল, আল্লাহ তাআলার প্রতি শর্তহীন আনুগত্য
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘যখন তার (ইবরাহীমের) পালনকতার্ তাকে বললেন, অনুগত হও, তিনি বললেন, আমি রাব্বুল আলামীনের অনুগত হলাম।’ -সূরা বাকারা ১৩১; একই সূরার ১২৮ নম্বর আয়াতে উদ্ধৃত হয়েছে, ‘তিনি ও ইসমাঈল আ. আল্লাহর কাছে দুআ করেছেন, ‘হে আমাদের পালনকতার্, আপনি আমাদেরকে আপনার (আরো অধিক) অনুগত বানিয়ে দিন এবং আমাদের বংশধরদের মধ্যে এমন একটি দল সৃষ্টি করুন যারা আপনার অনুগত হয়।’
ইবরাহীম আ.এর আনুগত্যের অনেক উদাহরণের মধ্যে দৃষ্টান্ত হিসেবে দুটি ঘটনাই যথেষ্ট— স্ত্রী হাযেরা রা. ও পুত্র ইসমাঈল আ.— কে আল্লাহর আদেশে জনমানবহীন শুষ্ক প্রান্তরে রেখে আসা এবং ইসমাঈল আ. যখন কিছুটা বড় হলেন তখন আল্লাহর আদেশে তাকে কুরবানী করতে প্রস্তুত হওয়া। পবিত্র কুরআনেও এ দুটি ঘটনা উদ্ধৃত হয়েছে।
সকল মানবীয় আবেগ—ভালোবাসা এবং সকল মনুষ্য বিচার—বিবেচনার বিপরীতে নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর আদেশ পালন করা এবং আসমানী শরীয়তের অনুসরণকে প্রাধান্য দেওয়ার এরচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে?
প্রিয় পাঠক, আল্লাহর আনুগত্যের সবচেয়ে বড় বিষয়গুলোর একটি হল, আল্লাহ তাআলা যে যুগে যে নবী পাঠিয়েছেন তার প্রতি ঈমান আনা ও তার অনুসরণ করা। এছাড়া আল্লাহর আনুগত্যের দাবি অর্থহীন।
ইবরাহীম আ.এর ধমার্দর্শের এই মৌলিক দুটি বিষয়ের নিরিখেও যদি বিচার করা হয় তাহলে স্পষ্ট হয়ে যাবে, কারা তাঁর ধমার্দর্শ থেকে বিচ্যুত এবং এই আদর্শের প্রতি কাদেরকে আহ্বান করা বেশি প্রয়োজন। কারা তাওহীদের শিক্ষা পরিত্যাগ করে আল্লাহ তাআলার সাথে শিরক করাকেই তাদের ধমার্দর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং আল্লাহ তাআলার শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অস্বীকার করে তাঁর আনুগত্য পরিহার করেছে।
কোথায় মিলবে মিল্লাতে ইবরাহীমী
ইবরাহীম আ.এর অনুসরণ করতে হলে তাঁর ধমার্দর্শের পূর্ণাঙ্গরূপটি আমাদের সামনে থাকতে হবে। তাঁর ইবাদত—বন্দেগীর পূর্ণ রূপ, লেনদেন, নৈতিকতা, সামাজিকতা ইত্যদি সব কিছুতে তার আদর্শ কী ছিল এটা সামনে থাকলেই তাঁর অনুসারী হওয়া সম্ভব।
‘অমুকের অনুসরণ করতে হবে’ শুধু এটুকু বললে দায়িত্ব পূর্ণ হয় না। অনুসরণের ক্ষেত্রগুলোতে তার আদর্শ উপস্থিত করা ছাড়া বা সেই আদর্শ কোথায় পাওয়া যাবে অন্তত তার সন্ধান দেওয়া ছাড়া এ ধরনের নির্দেশনার তেমন কোনো উপকারিতা নেই। তাই মিল্লাতে ইবরাহীমী বা ইবরাহীম আ.এর ধমার্দর্শের পূর্ণ বিবরণ কোথায় পাওয়া যাবে এটিই হল বড় প্রশ্ন।
একমাত্র মুসলিম জাতিই পূর্ণ আস্থা ও দৃঢ়তার সাথে মাথা উচু করে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। মহাগ্রন্থ আলকুরআন তাদেরকে এ বিষয়ে পথ দেখিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘ইবরাহীম ইহুদী ছিলেন না এবং নাসরানীও ছিলেন না। তিনি ছিলেন হানীফ (সকল মিথ্যা ধর্ম ও মিথ্যা মতবাদ থেকে বিমুখ) ও অনুগত। আর তিনি মুশরিকদের অন্তভুর্ক্ত ছিলেন না। যেসব মানুষ ইবরাহীমের অনুসরণ করেছিল এবং এই নবী (মুহাম্মাদ) ইবরাহীমের ঘনিষ্টতম। আর আল্লাহ হচ্ছেন মুমিনদের বন্ধু।’ -সূরা আলে ইমরান ৬৮—৬৯
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, আপনি বলে দিন আমার পালনকতার্ আমাকে সরল পথ প্রদর্শন করেছেন। মজবুত দ্বীন যা ধর্ম একাগ্রচিত্ত ইবরাহীমের।’ -সূরা আনআম ১৬২
সূরা হজ্জের ৭৮নং আয়াতে ইসলাম ধর্মকেই ইবরাহীম আ.এর মিল্লাত নামে অভিহিত করা হয়েছে।
মোটকথা, নবীগণের মাধ্যমে যে আদর্শ মহান আল্লাহ যুগে যুগে মানবজাতিকে দান করেছিলেন, কালের ধারাবাহিকতায় হযরত ইবরাহীম আ.ও তাই লাভ করেছিলেন। এরপর সময়ের চাকা সামনে অগ্রসর হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে মানব জাতির মধ্যে অনেক নবী এসেছেন। সবারই মূল আদর্শ অভিন্ন ছিল। সবশেষে আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মানবজাতির দিশারীরূপে পাঠিয়েছেন। তিনিও সেই আদর্শ মানবজাতির মধ্যে প্রচার করেছেন যা তাঁর পূর্ববতীর্ সকল নবী প্রচার করে গেছেন। তাঁর প্রচারিত সেই আদর্শ আজো পূর্ণরূপে সংরক্ষিত আছে। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ আসমানী কিতাব ‘আলকুরআন’ সম্পূর্ণ অবিকৃতরূপে বিদ্যমান। এখন ইবরাহীম আ.—এর আদর্শ বলুন কিংবা ব্যাপকভাবে একে সকল নবীর আদর্শ আখ্যা দিন বা সরাসরি মহান আল্লাহর নির্দেশনা বলুন একে সঠিকরূপে পেতে হলে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের বিকল্প নেই। ইবরাহীম আ.এর আদর্শে বা অন্যান্য সত্য নবীর আদর্শে যারা উজ্জীবিত নবী মুহাম্মাদের আনুগত্যে তাদের দ্বিধা থাকার কথা নয়। কেননা, আল্লাহর আনুগত্যের এটাই একমাত্র পথ। কুরআনের উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে এই মর্মই ধ্বনিত হচ্ছে।
মুসলিম জাতি মিল্লাতে ইবরাহীমীর উপর প্রতিষ্ঠিত
এখান থেকে এ বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, একমাত্র মুসলিম জাতিই মিল্লাতে ইবরাহীমীর উপর প্রতিষ্ঠিত। তবে যারা আল্লাহর আনুগত্যে বিশ্বাসী এবং সত্যিকার অর্থেই ইবরাহীম আ.কে অনুসরণ করতে চায় এতে তাদের আক্ষেপের কিছু নেই। এই আদর্শ তাদের জন্যও অবারিত। তারা যদি তা গ্রহণ করেন তাহলে তারাও হবেন পথপ্রাপ্ত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তারা বলে, তোমরা ইহুদী অথবা খ্রীস্টান হয়ে যাও তাহলে পথপ্রাপ্ত হবে। আপনি বলুন, (কক্ষনো নয়) বরং আমরা তো মিল্লাতে ইবরাহীমীর উপর আছি। তিনি মুশরিকদের অন্তভুর্ক্ত ছিলেন না। তোমরা বলে দাও, আমরা ঈমান রাখি আল্লাহর উপর এবং তার উপর যা আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার সন্তানদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আমরা সে বিষয়েও ঈমান রাখি যা মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে তাদের পালনকতার্র পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল। আমরা তাদের কারো মধ্যে পার্থক্য করি না। আর আমরা তো তাঁরই (আল্লাহর) অনুগত। অতএব তারাও যদি সেভাবেই ঈমান আনে যেভাবে তোমরা ঈমান এনেছ তাহলে তারা পথপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তাদের জন্য আপনার পক্ষে আল্লাহই যথেষ্ট। তিনিই শ্রবণকারী মহাজ্ঞানী।’
৩. আল্লাহবিশ্বাসীদের নেতৃত্ব ও আলকুরআন
এক জায়গায় কাউসার সাহেব লিখেছেন, ‘আর বিশ্বাসীদের দলকে যে ঈসা আ.এর অনুসারীরাই কেয়ামত পর্যন্ত নেতৃত্ব দেবে তাও আলকুরআনে বলা হয়েছে।’ এরপর তিনি সূরা আল ইমরানের ৫৫নং আয়াতের আনুবাদ উল্লেখ করেছেন। আয়াতটির সঠিক মর্ম পরে বলছি। এখানে প্রথম প্রশ্ন হল আজ যে জাতি ‘ঈসায়ী’ নামে আখ্যায়িত তাদেরকে আদৌ ঈসা আ.এর অনুসারী বলা যায় কি? আলকুরআনের দৃষ্টিতে তাদের এ দাবি কি যথার্থ? খ্রিস্টান জাতিকে ঈসা আ.এর অনুসারী বলার অর্থ কি এই নয় যে, নাউযুবিল্লাহ ঈসা আ. তাঁর জাতিকে শিরকের প্রতি আহ্বান করেছিলেন? তিনি তাদের বলেছিলেন, তোমরা আমাকে তোমাদের ইলাহ বানিয়ে নাও। একজন নবীর প্রতি এরচেয়ে বড় মিথ্যা অপবাদ আর কী হতে পারে? দেখুন কুরআন এ বিষয়ে কী বলছে-
‘এবং সে সময়টিও উল্লেখযোগ্য যখন আল্লাহ বলবেন, হে ঈসা ইবনে মারয়াম, তুমি কি মানুষকে বলেছ যে, তোমরা আল্লাহকে ছাড়াও আমাকে ও আমার জননীকে ‘ইলাহ’ বানিয়ে নাও? ঈসা আ. আরজ করবেন, আপনি পবিত্র। আমার পক্ষে কোনো ভাবেই শোভনীয় নয় যে, আমি এমন কথা বলব যার অধিকার আমার নেই। আমি যদি এ কথা বলতাম তাহলে আপনি অবশ্যই তা জানেন। আর আপনার জ্ঞানে যা আছে তা আমি জানি না। সকল ‘গায়ব’ একমাত্র আপনিই জানেন। আমি তো তাদেরকে শুধু তাই বলেছি যা আপনি আমাকে বলতে আদেশ করেছেন— ‘তোমরা আল্লাহ তাআলার বন্দেগী কর যিনি আমারও রব, তোমাদেরও রব।’ আমি তাদের ব্যাপারে অবগত ছিলাম যতক্ষণ তাদের মধ্যে ছিলাম। এরপর যখন আপনি আমাকে উঠিয়ে নিয়েছেন তখন আপনি তাদের ব্যাপারে অবগত থাকেন, আর আপনি সকল বিষয়ে পূর্ণ অবগত।” -সূরা মায়েদা ১১৬—১১৭
তাহলে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, কুরআনের সিদ্ধান্ত অনুসারে আজকের খ্রিস্টান জগত ঈসা আ.এর অনুসারী নয়। খোদ ঈসা আ. কিয়ামতের দিন তাদেরকে অস্বীকার করবেন। তবে এটা ঠিক যে, তারা ঈসা আ.—এর নাম নেয়। ইহুদীদের মতো তাঁকে অস্বীকার করে না এবং তার প্রতি বিভিন্ন ধরনের অশালীন অপবাদ আরোপ করে না।
দ্বিতীয় কথা হল পাশ্চাত্য জগত গোটা বিশ্বে বিশেষত মুসলিম জনপদগুলোতে যে জুলুম অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে এবং নানা ধরনের অনৈতিক কাজ কারবার সদর্পে করে যাচ্ছে একজন সাধারণ ঈমানদারের পক্ষেও কি এটা কল্পনা করা সম্ভব যে, ঐশীগ্রন্থ আল কুরআন এসবকে ‘আল্লাহ বিশ্বাসীদের নেতৃত্ব’ নামে আখ্যায়িত করবে। কুরআনের ভাষায় তো এটা ফেরআউনী বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কুরআনে ফেরআউন ও তার আমাত্যবর্গের যে অবস্থা উল্লেখ করা হয়েছে আজকের পাশ্চাত্য জগতের অবস্থা তার সাথেই বেশি সাযুজ্যপূর্ণ। কুরআন বলেছে, ‘ফেরআউন সম্প্রদায়ের সর্দাররা বলল, তুমি কি এমনি ছেড়ে দেবে মূসা ও তার সম্প্রদায়কে যাতে তারা ভূপৃষ্ঠে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং তোমাকে ও তোমার উপাস্যদের পরিত্যাগ করে? সে বলল, আমি এখনি হত্যা করব তাদের পুত্র সন্তানদেরকে আর জীবিত রাখব মেয়েদেরকে। আর আমরা তো তাদের উপর প্রবল।’ -সূরা আরাফ ১২৭
সে যুগে সত্যপন্থীদের সত্যের দাওয়াতকে যেমন ‘বিশৃঙ্খলা’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল, আজকের ফেরআউন ও তাঁর আমাত্যবর্গও ইসলামকে সন্ত্রাসী মতবাদ আখ্যা দিয়ে যাচ্ছে এবং এই মিথ্যাকে পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মরণপণ করেছে। কিছুদিন আগে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট—এর বক্তব্যের মধ্যেও কি এই একই সূর অনুরণিত হয়নি?
আল্লাহর নবী হযরত মূসা আ. ও তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নকারী মুমিনদের ব্যাপারে সেদিন ফেরআউনের যে দদ্ভোক্তি ছিল আজকের ফেরআউনের উদ্ধত ঘোষণার সাথে এর সামান্যতম অমিল নেই।
‘তোমাকে ও তোমার দেবদেবীরকে পরিত্যাগ করবে’ কুরআনের এই বাক্যাংশে ভাবুন আর আজকের নব্য ক্রুসেডারদের অবস্থানটিও দেখুন। ‘আমরা তো তাদের উপর প্রবল’ শব্দটির সাথে আজকের পাশ্চাত্য জগতের মদমত্ত আস্ফালনকেও একটু মিলিয়ে দেখুন তাহলেই আপনার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে, এরা কী ঈসা আ.এর অনুসারী, নাকি ‘আনা রাব্বুকুমুল আলা’ আমিই তোমাদের বড় খোদা ঘোষণাদাতা ফেরআউনের অনুগামী।
মোটকথা, এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, কুরআন কারীমের কোথাও বর্তমান খ্রিস্টজগতকে ঈসা আ.এর আদর্শের অনুসারী বলা হয় নি। কিংবা পৃথিবীতে শক্তির দিক দিয়ে তাদের বর্তমান প্রাবল্যকে ‘আল্লাহ বিশ্বাসীদের নেতৃত্ব’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়নি। বরং অতি স্পষ্টভাবে এর বিপরীত বিষয়টিই পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত হয়েছে। সূরা মায়িদার যে আয়াতটি তিনি এ স্থলে উদ্ধৃত করেছেন সেখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। বিষয়টি হল, ইহুদীরা যখন হযরত ঈসা আ.কে শুলিতে চড়াতে উদ্যত হয় তখন আল্লাহ তাআলা তাকে সান্তনা দিয়ে কতগুলো প্রতিশ্রম্নতি দেন। এর মধ্যে একটি প্রতিশ্রম্নতি এই ছিল যে, যারা তোমাকে অস্বীকার করছে এরা যদিও আজ তোমার ও তোমার অনুসারীদের ওপর প্রবল, কিন্তু এদেরকে আমি কিয়ামত পর্যন্ত তাদেরই অধীন করে রাখব যারা তোমার অনুগত, তুমি যে আদর্শ প্রচার করতে যেয়ে এই কষ্টের সম্মুখীন হয়েছ তার অনুসরণ করে বা অন্তত তোমার নাম নেয়।
পৃথিবীর ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয় যে, ইহুদীরা চিরদিন হয় মুসলিম জাতির অধীন ছিল অথবা খ্রিস্টান জাতির।
প্রিয় পাঠক, খ্রিস্টানদের বর্তমান ভ্রান্ত বিশ্বাসকে স্বীকৃতি দেওয়া কিংবা তাদেরকে সকল আল্লাহ বিশ্বাসীর ধমীর্য় নেতৃত্বের আসনে আসীন করার দূরতম কোন প্রতিশ্রম্নতি এখানে আছে কি?!
৪. ইবরাহীম আ.এর অনুরূপ রহমত ও বরকত
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, একদিকে তিনি বর্তমান খ্রিস্টান জগতকে ‘আল্লাহবিশ্বাসী’দের নেতৃত্বের আসনে আসীন করছেন, অন্যদিকে সুকৌশলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে মুসলিম মন—মানসে অনাগ্রহ সৃষ্টি করছেন। তিনি লেখেন, ‘নামাযের ভেতর দরূদ শরীফ পড়তে গিয়ে মুসলমানরা আল্লাহর উদ্দেশে বলছে, ‘হে আল্লাহ, তুমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বংশধরদের ওপর রহমত নাযিল কর, যেমন তুমি ইবরাহীম আ. ও তাঁর বংশধরদের উপর রহমত নাযিল করেছিলে। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসিত ও গৌরবান্বিত। হে আল্লাহ, তুমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বংশধরদের উপর বরকত নাযিল কর যেরূপ তুমি ইবরাহীম আ. ও তাঁর বংশধরদের উপর বরকত নাযিল করেছিলে। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসিত ও গৌরবান্বিত।’
“মুসলমানরা যেহেতু এতদিন ধরে স্বীকার করেই এসেছে যে, ইবরাহীম আ. পৃথিবীতে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে বেশি রহমত ও বরকত লাভ করেছিলেন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বংশধরদের জন্য এরূপ রহমত ও বরকত দাবি করে আসছিলেন আল্লাহর কাছে, সেহেতু আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক ইবরাহীম আ.এর ধমার্দর্শ অনুসরণ করলে এবং ইবরাহীম আ. যেভাবে সালাত কায়েম করেছিলেন সেভাবে সালাত কায়েম করলে মুসলমানরা অধিক রহমত ও বরকত লাভ করবেন নিঃসন্দেহে।”
তার এই কথাগুলো ভদ্রতার বিচারেও কতটুকু উত্তীর্ণ তা নিধার্রণের ভার সম্মানিত পাঠকবৃন্দের উপরই ছেড়ে দিচ্ছি। আমি যে কথাটি এখানে বলতে চাই তা হল, দরূদে ইবরাহীমীর যে ‘মর্ম’ তিনি বয়ান করেছেন তা কি সঠিক? মুসলিম জাতি কি এতদিন এই অর্থই গ্রহণ করে এসেছেন? শুধু ভাষার বিচারেও কি দরূদে ইবরাহীমীর এই মর্মই নিধার্রিত? যদি না হয় তবে তিনি এতটা নিশ্চিতভাবে তার বয়ানকৃত অর্থকেই একমাত্র মর্ম ধরে নিলেন কীভাবে? এবং কীভাবে সেটা সমগ্র মুসলিম জাতির কাঁধে চাপিয়ে দিলেন?
সহীহ বুখারী ও অন্যান্য হাদীসের কিতাবে দরূদে ইবরাহীমী সম্বলিত হাদীস অনেক স্থানে এসেছে। (দ্রষ্টব্য আলমুজামুল মুফহরাস লি আলফাযিল হাদীস) সহীহ বুখারীর বিখ্যাত ভাষ্যকার হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহ. হাদীস শরীফের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে দরূদে ইবরাহীমীর মর্মও উল্লেখ করেছেন। তিনি ‘যেমন তুমি ইবরাহীম ও তাঁর পরিবারবর্গের প্রতি রহমত করেছে’ এই বাক্যের ব্যাখ্যায় লেখেন, “হে আল্লাহ, আপনি ইতিপূর্বে ইবরাহীম আ. ও তাঁর বংশধরদের প্রতি রহমত ও বরকত নাযিল করেছেন। তাই আমরা আপনার কাছে আরো বেশি আশা নিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের জন্য রহমত ও বরকত প্রার্থনা করছি। সারকথা হল, এখানে ইবরাহীম আ. ও তাঁর পরিবারবর্গের উপমা তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে নয়; প্রার্থনায় কাতরতা প্রকাশ করার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে।” -ফাতহুল বারী ৮/৩৯৪
আল্লাহর খলীল হযরত ইবরাহীম আ. পৃথিবীতে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগে এসেছেন। তাই পৃথিবীতে তাঁর প্রতি রহমত ও বরকতও আগে হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় খলীলকে এমনই রহমত ও বরকতে সিক্ত করেছেন যা আরবী—আজমী নির্বিশেষে সব মানুষই জানেন। আরব ভূখণ্ডের অধিবাসীরা যেহেতু হযরত ইসমাঈল আ.এর বংশধর ছিলেন তাই তারাও এ বিষয়ে অবগত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে সেই সর্বজন বিদিত ঐশী করুণার উদ্ধৃতি দিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে শিখিয়েছেন। আর এই উদ্ধৃতির মূল উদ্দেশ্য হল আল্লাহ তাআলার সামনে বিনয় ও কাতরতা জানানো। অথার্ৎ হে আল্লাহ, আপনি পরম অনুগ্রহকারী। বিশিষ্ট বান্দাদের জন্য আপনার বিশেষ করুণার দ্বার অবারিত। ইতিপূর্বে আপনি আপনার খলীল হযরত ইবরাহীম আ.কে করুণা করেছেন, এবারে আপনার হাবীব হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিও করুণা করুন। এই হল প্রার্থনায় মর্ম। উত্তম—অনুত্তমের প্রশ্নই এখানে অবান্তর।
মহান আল্লাহ তাঁর হাবীব হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে করুণা করেছেন তা তো পবিত্র কুরআনের পাতায় পাতায় এবং হাদীস শরীফের ছত্রে ছত্রে বিধৃত রয়েছে। বলুন তো, কেয়ামতের দিন কোন নবীর উম্মত সংখ্যায় ও মর্যাদায় সবার্ধিক হবেন? কেয়ামতের কঠিন দিনে যখন মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ পূর্ণ ক্রোধ নিয়ে বিরাজমান থাকবেন এবং সকল নবী ‘নফসী’ ‘নফসী’ করবেন, সেই সংকমটময় সময়ে কোন মহামানব আল্লাহর সামনে গিয়ে সেজদাবনত হবেন? কোন মহাপুরুষের আত্মা বিগলিত হামদ ও প্রশংসায় সেদিন মহান আল্লাহর ক্রোধ প্রশমিত হবে? কে তিনি, যিনি সেই ছাতিফাটা তৃষ্ণার দিনে হাউজে কাউসারের অধিকারী হবেন এবং তার উম্মতকে শীতল বেহেশতী পানি পান করিয়ে পরিতৃপ্ত করবেন? কার উম্মতের সৌভাগ্য হবে সবার আগে বেহেশতে যাওয়ার? সন্দেহ নেই তিনি হলেন আকায়ে নামদার তাজদারে মদীনা খাতামুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। লক্ষ কোটি সালাম তাঁর প্রতি, তাঁর পরিবারবর্গের প্রতি।
প্রিয় পাঠক, আলোচনা আর দীঘার্য়িত করতে চাই না। ইতিমধ্যে আপনাদের ধৈর্যের উপর অনেক অত্যাচার করেছি। লেখাটির প্রতিবাদী ভাষা যদি আপনাদের কষ্টের কারণ হয়ে থাকে তবে তা নিজগুণে ক্ষমা করবেন। আপনাদের কাছে শেষ নিবেদন এটাই রইল যে, বিচার করুন, কাউসার সাহেবদের মত লেখকরা কাগজের বুকে যা কিছু উদগীরণ করেন এসব কি ‘ঐক্যপ্রচেষ্টা’, না ঐক্যের নামে ইসলাম বিরোধী অপতৎপরতা?