অন্যের জন্য গর্ত করলে নিজেকেই সে গর্তে পড়তে হয়
বেশ কিছুদিন আগের কথা। আমাদের এক পরিচিত ব্যক্তির আলোচনা চলছিল। আমার ছোট মামা মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব আজাদ আমাকে বললেন, ওবায়দী, লোকটির অবস্থা জানিস? আমি বললাম, কী হয়েছে তার? তিনি বললেন, তার চতুর্মুখী ব্যবসা ও নানান কাজের ঝামেলায় তার চাকরিস্থল অগ্রণী ব্যাংকে সে বসতে পারত না। পাশের কলিগকে একশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে কোনোমতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এভাবে আর কত দিন করা যায়? অফিস কর্তৃপক্ষ তাকে ঠিকমতো অফিস করার ব্যাপারে জোর তাগিদ দিল, কিন্তু সে তার চাকরির চাইতেও বেশি লাভের ওই ব্যবসা—বাণিজ্য কিছুতেই ছাড়তে চাচ্ছিল না। শেষমেষ ভাবল, চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে নেবে, কিন্তু বছরগুলো হিসাব করে দেখা গেল এখন চাকরি ছাড়লে চাকরির ফুল বোনাসটা সে পাবে না। তাই একটা বুদ্ধি আঁটল। চাকুরিতে আন—ফিট দেখাতে পারলে অবসর গ্রহণের বেনিফিটটা হয়ত পুরা পাওয়া যাবে। যেমন বুদ্ধি তেমন কাজ। ডাক্তারের কাছে গেল তাকে একটা হার্টডেমেইজের সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য। ডাক্তার সাহেব সৎ হওয়াতে তিনি এভাবে পরীক্ষা—নিরীক্ষা ছাড়া মিথ্যা সার্টিফিকেট দিতে অপারগতা জানালেন। অগত্যা সে পরীক্ষা করতে রাজি হল। ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখেন যে, সত্যি—সত্যিই তার একটা বাল্ব নষ্ট হয়ে গেছে। বিষয়টি তাকে খুলে বললে সে খুব ঘাবড়ে গেল। জিজ্ঞাসা করল, এখন কী করব? ডাক্তার তাকে আরও কনফার্ম হওয়ার জন্য কোলকাতার বিখ্যাত বিড়লা হাসপাতালে যেতে পরামর্শ দিলেন। টাকার অভাব নেই। সাথে সাথেই কলকাতায় চলে গেল। পরীক্ষা—নিরীক্ষা করে তারাও তাই বলল। সে প্রশ্ন করল এখন কী করতে হবে? হাসপাতাল থেকে বলা হল, আমরা আপাতত ওষুধ দিলাম তবে অপারেশন করে বাল্ব লাগাতে হবে। সে বলল, অপারেশন যখন করতেই হবে, তাহলে এখনই করে ফেলুন। হাসপাতাল থেকে বলা হল, অনেক টাকা লাগবে। সে বলল, টাকার ব্যবস্থা এখনই করছি। এই বলে সে হুণ্ডির মাধ্যমে ঢাকা থেকে টাকার ব্যবস্থা করে ফেলল। হাসপাতালে অপারেশন হল। একমাস সেখানে থেকে ঢাকা ফিরে আসল।
মামার কাছ থেকে এই দাস্তান শুনে আমি বললাম, হায়! ধোকাবাজির পরিণাম, কৃত্রিমভাবে হার্টডেমেইজ দেখাতে গিয়ে সত্যিসত্যিই ডেমেইজ হয়ে গেল। তবে পরিচিতজন হিসেবে দেখতে যাওয়া উচিত।
ছেলেটি খুব চালাক চতুর ও কর্মঠ বলে অনেক ধরনের কাজ—কারবারই সে করত। মূল চাকরিটা ছিল অগ্রণী ব্যাংকে। কিন্তু সে অনেক ধরনের ব্যবসার সাথে হুণ্ডি ব্যবসা ও দলীল লেখার ব্যবসা পর্যন্ত করত, সব সময় তাকে হাসি—খুশি ও আনন্দিত দেখতাম। গুলিস্তান রমনা ভবনে বড় বড় দুটি কাপড়ের দোকান ছিল। আরও অনেক জায়গায় অনেক প্রপার্টিই তার ছিল। সায়েদাবাদ বিশ্বরোডের পূর্বপার্শ্বে নতুন গড়ে ওঠা মানিক নগরে বহুতল বিশিষ্ট একটি বাড়িও তৈরি করেছিল। আমার ছোট মামাসহ আমাদের অনেকের সাথেই তার পরিচয় ও বন্ধুত্ব ছিল, অসুস্থ হবার কিছু দিন আগেও আমার সাথে দেখা হয়েছিল। সমাজের ভালো—মন্দ উভয় শ্রেণীর সাথেই সে মানিয়ে চলতে জানত। ব্যাংকের চাকরিটা নিম্ন শ্রেণীর কেরানির চাকরি হলেও অনেক টাকা এবং অনেক সম্পদেরই সে মালিক ছিল। আমি একদিন মানিক নগরের বাড়িতে তাকে দেখতে গেলাম। দেখলাম, পথ—ঘাট ছাড়াই একটা নীচু জায়গায় তার বাড়িটি অবস্থিত। ড্রয়িংরুমে বিশাল এক আধুনিক এয়ারকুলার লাগানো আছে। সোফাসেট ও কার্পেট-বিছানো রমরমা অবস্থা। আমাকে দেখে খুব খুশি হল এবং খুব খাতির—তাওয়াজু করল। আমি তাকে এসব অস্থায়ী সম্পদের হাকীকত সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত কথা বলে আখেরাতমুখী হওয়ার আহবান জানিয়ে সে দিনের মতো বিদায় নিলাম। দু’একমাস পর মামার সাথে আবার সাক্ষাত হলে মামা বললেন, আবার কোলকাতা গিয়ে পরীক্ষা—নিরীক্ষা করে আসার কয়েক দিনের মধ্যে সে মারা গেছে। আমি শুনে খুব মর্মাহত হলাম। তার এত প্রপার্টি সে কার জন্য রেখে গেল? নিজেও ভোগ করতে পারল না। তার ছোট ছোট দু—একটি শিশু সন্তান, তারাও কি তা রক্ষা করতে পারবে? তার রমনার দোকানের ম্যানেজার ছিল তারই একজন খাঁটি ও সৎ বন্ধু, যাকে সে জীবদ্দশায় কিছু প্রপার্টির মালিকও বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু বন্ধুটি রাজি হয়নি। আমি ছুটে গেলাম তার কাছে। প্রস্তাব রাখলাম, তার বিধবা স্ত্রীকে যেন তিনি বিয়ে করেন, যাতে করে ওই শিশু ও বিধবা স্ত্রীর একটা উপায় হয় এবং তার অঢেল সম্পদও লুটপাট থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু বন্ধুটি আমাকে বললেন, আপনার প্রস্তাবটি যথাযথ ছিল, কিন্তু আমার এই বন্ধুটির স্ত্রী একটি নিচু পরিবারের মেয়ে। সে একজন কাজের মেয়েকে বিয়ে করেছিল। এখন তার মৃত্যুর সাথে সাথে গ্রাম থেকে মহিলার আত্মীয়—স্বজন সব তার সম্পদ লুটপাট করে নেওয়ার জন্য তার বাসায় অবস্থান করছে। আপনি ওখানে গেলে দেখতে পাবেন, গান—বাজনার হৈ—হুল্লোড় অবস্থা চলছে। এই ঘরের মালিক যে মারা গেছে, তাদের আচরণ দেখে কেউ তা আঁচ করতে পারবে না। তাহলে বলুন আপনার প্রস্তাব রক্ষা করা আমার পক্ষে কীভাবে সম্ভব?
এসব শুনে আমি আরও আঘাত পেলাম। হায়রে! এতো অল্প বয়সে বৈধ—অবৈধ উপায়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে কী লাভ হল? এই সম্পদ না তার নিজের কাজে লাগল, আর না তার পরিবারের কাজে লাগবে? মানুষ সম্পদ গড়ে ভোগ—বিলাসের জন্য, অথচ সে তা করতে পারল কোথায়? তার দিন—রাতের অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষ ফল কী হল? না তার ইহকাল সুন্দর হল? না পরকাল সুন্দর হল? কিসের পিছনে সে এতদিন ছুটে বেড়িয়েছে? মরিচিকা? তাই তো মনে হচ্ছে। সে চেয়েছিল অফিসকে ধোঁকা দিয়ে ডেমেইজ সার্টিফিকেট দেখিয়ে চাকরির ফুল বোনাস হাতিয়ে নিতে, কিন্তু কীসের জন্য এই ধোঁকাবাজি? অন্যকে ধোঁকা দিতে পারলেও মহাশক্তিশালী মালিক আল্লাহকে সে কীভাবে ধোঁকা দিবে? তাই নিজের ধোঁকায় নিজেই পতিত হল। প্রবাদ আছে, অন্যের জন্য গর্ত করলে সে গর্তে নিজেকেই পড়তে হয়। বিষয়টি অনেকটা সে রকমই হল।
সমাজে এক বাল্ব নষ্ট-হওয়া অনেক মানুষই বাস করছে, এমনকি দু’টি বাল্ব নষ্ট হয়ে গেছে, এমন দু—এক জনের জীবিত থাকার কথাও মনে হয় শুনেছি। কিন্তু টাকার গরম আর ঘাবড়ে যাওয়ার ফলে সে নিজের কবর নিজেই খনন করল।
দুআ করি, আল্লাহ যেন মরহুমকে ক্ষমা করেন আর আমরা যারা জীবিত আছি, তাদেরকে এই ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফীক দান করেন, আমীন।