আমাদের আত্মার পরিচয়
‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’
‘মুহাম্মাদ’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জগত সংসারে এক চিরবিষ্ময়কর নাম। জগতে মানুষ আসে, মানুষ যায়। রেখে যায় সাধনার স্মারক, সাফল্যের পথ। পরবর্তীকালের আগতরা বিগত মানুষদের আদর্শ, সাধনা ও নির্দেশনাকে অনুসরণ করে কুড়িয়ে আনে সফলতার ধন। কিন্তু শুধু নাম জপে, নাম শুনে, নাম লিখে কাড়ি কাড়ি সাফল্যের মনি—মুক্তায় যে আচল পূর্ণ করার নজীর সৃষ্টির ইতিহাসে আছে কি? আছে। একটি মাত্র উপমা আছে। সে আমাদের প্রিয়তম কামলীওয়ালা হৃদয়ের বাদশাহ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এ শুধু একটি নাম নয়, কল্যাণ ও রহমতের অফুরন্ত ফল্গুধারা।
কী অবাক করা নাম! পাঠক শ্রোতা এ নাম পড়বে, শুনবে সঙ্গে সঙ্গে এক অদৃশ্য চুম্বকটানে উচ্চারিত হবে— ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’। বিশ্বাস, চেতনা, অনুভব আলোড়িত হবে এক অব্যক্ত প্রাণের ছোঁয়ায়! এক অলৌকিক শক্তি ও সজীবতায় দুলে ওঠবে মুমিনের সমুদয় অস্তিত্ব। দুলে ওঠবে অসীম গর্বে। কারণ, মহান মালিক পাক কালামে ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ নবীর প্রতি সালাম বর্ষণ করেন, সালাত প্রার্থনা করেন তার ফিরিশতাগণ। হে ঈমাদারগণ, তোমরাও নবীর জন্যে সালাত ও অনুগ্রহ প্রার্থনা কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।’ -সূরা আহযাব ৫৬
আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণের পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদপাঠের আমন্ত্রণ পেয়েছি আমরা ঈমানদাররাই। এ সৌভাগ্য কোথায় রাখি? তাছাড়া এই ইলাহী নির্দেশ ও নিমন্ত্রণে দরূদপাঠে ধন্য মুমিনের উচ্চারিত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি একথাই প্রমাণ করে না যে, আমি ঈমনদার? আমি সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর এক গর্বিত উম্মত? তিনি মুহাম্মাদ আমি মুহাম্মাদী? তাঁর সাথে রয়েছে আমার নিবিড় গভীর বন্ধন? সে আত্মিক বন্ধনের আলোড়িত উচ্চারিত রূপই—‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।’
‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ আমাদের সর্বাধিক সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ পরিচয়। এ পরিচয় রং, রূপ, ভাষা ও সীমান্তের উর্ধ্বে। বিচিত্র নামাবলির এই বিশাল পৃথিবীতে কত ভাষার কত অঞ্চলের কত মানুষের কত নাম। যে নাম প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হয় প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে। কিন্তু কী উত্তরে কী দক্ষিণে কী পূবে কী পশ্চিমে যখনই উচ্চারিত হয় ‘মুহাম্মদ’, যদি সেখানে থাকে কোনো ভাগ্যবান, সঙ্গে সঙ্গে সে নাম বরণ করে নেয় ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বলে। নজরুলের ‘বিশ্বব্যাপী মুসলিম আমি সারাটি জাহান বেঁধেছি ঘর’—এর এই তো পরিচয়। আবিশ্ব আত্মীয়তার এই তো পাসওয়ার্ড।
দুই.
‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’—আল্লাহ তাঁর প্রতি রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন। এ নাম শোনামাত্রই কেন আমরা নির্দেশিত কিংবা নিমন্ত্রিত হই এই প্রার্থনা জানাতে? এর কারণ সহজ।
কেননা, তিনি যদি আগমন না করতেন; নিজের ও স্বজন—প্রিয়জনদের জীবনবাজি রেখে যদি আদর্শের সংগ্রামে অবতীর্ণ না হতেন, তাহলে আমরা থেকে যেতাম অন্ধকারে। প্রভুর পথ, সন্তুষ্টি কিংবা জীবনের কাঙ্খিত টার্গেট খুঁজে পেতাম না আমরা। আমাদের জীবন হত অন্ধকার, অন্ধত্ব ও বিভ্রান্তিতে আবৃত। মানুষ ও পশুর পার্থক্য, মানুষের গর্বিত পরিচয়, জীবনের আকাঙ্খিত মূল্যবোধ, মানবিক মর্যাদা ও তার বিকাশপথ আমরা তাঁর কাছেই শিখেছি। তাঁর কাছে মানবগোষ্ঠীর ঋণ অসীম। ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’সেই ঋণের স্বীকৃতিবাণী মাত্র। ঋণ উপলব্ধির মতো পরিচ্ছন্ন মেধা যাদের আছে ঋণ স্বীকার করার মতো চারিত্রিক ও আত্মিক শক্তি যাদের আছে মূলত ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বলে তারাই পারে গর্বের, মর্যাদার ও সম্মানের এই ঋণকে স্বীকার করতে। দয়াময় আল্লাহ ঋণ স্বীকারের এই মহিমাপূর্ণ নির্দেশই দিয়েছেন উপরোক্ত আয়াতে। যে কেউ তো যে কারো কাছে ঋণী হতে পারে না। ঋণও একটা সম্পর্ক। এ সম্পর্ক মানুষের অবস্থান ও মর্যাদাকে চিহ্নিত করে। স্বাভাবিক রীতির বিচারেই বলতে পারি, নবীজীর প্রতি ঋণের এই স্বীকৃতিও আমাদের বর্তমান জীবনে মর্যাদার মহামূল্য স্মারক। ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’বলে আমরা প্রকারান্তে এ দাবিও করি যে, ঋণের সুবাদে হলেও আমরা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুতোয় গাঁথা।
তিন.
হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন ‘যে আমার প্রতি এক বার দরূদ পাঠ করবে আল্লাহ তাআলা তার প্রতি দশ বার রহমত বর্ষণ করবেন।’ -সহীহ মুসলিম; রিয়াযুস সালেহীন, হাদীস ১৩৯৭
অন্য হাদীসে ইরশাদ করেছেন, ‘যে আমার প্রতি যত বেশি দরূদ পাঠ করবে কেয়ামতের দিন সে আমার শাফায়েতের তত বেশি হকদার বলে বিবেচিত হবে।’-জামে তিরমিযীর, হাদীস ১৩৯৮
এ সকল হাদীস দ্ব্যর্থহীনভাবে একথাই প্রমাণ করে যে, ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ শুধু আমাদের গৌরবময় পরিচয় আর অফুরন্ত ঋণের সুরভিত স্বীকৃতিই নয় এ বাণী একটি মহামূল্য নেকআমলও বটে।
তবে এই নেকআমলটির একটি অপার্থিব বৈশিষ্ট্য হল, পাপী—তাপী আমার কলঙ্কিত কণ্ঠে উচ্চারিত দরূদের বাণী কবূল হল কি হল না সে তো নির্ঘাত অনিশ্চিত, কিন্তু তার বিনিময়ে প্রভুর পক্ষ থেকে অর্জিত রহমতের সওদা শতভাগ সুনিশ্চিত। ফলাফলের বিচারে আমলের এ এক অবাক আয়োজন। ক্ষুদ্র বাকযন্ত্র সঞ্চালিত একবিন্দু উচ্চারণ, অতঃপর প্রভুর পক্ষ থেকে অবারিত রহমতের ফণ্ডুধারা সঞ্চিত হবার এই সহজ সুযোগকে পরম করুণাময়ের বিশেষ করুণা ছাড়া আর কী বলা যায়? একারণেই আমাদের সম্মানিত আলিমগণ লেখার ক্ষেত্রে ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ এর সংক্ষেপায়নকে অন্যায় বলেছেন। সুতরাং পরম করুণাময়ের অপার করুণাপ্রাপ্তির আলোকিত উপলক্ষকে কেটে সংক্ষিপ্ত করার এই প্রক্রিয়াকে কোন ছুতায় সমর্থন করব?
চার.
একবন্ধু বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্যে আমাদের আলেম সমাজের উপস্থিতি খুবই গতানুগতিক। বিষয়ে বৈচিত্র নেই; বর্ণনায় নতুনত্ব নেই; উপস্থাপনায় নেই অভিনবত্ব। এই সেকেলে আদলে চর্চিত সাহিত্যে কী লাভ! বললাম, বন্ধু শোন। এ ঢাকা শহরের এক আধুনিক মুসলমান! কথা প্রসঙ্গে একবার বলেছিল, ‘একদিন সকালে ‘মর্নিং ওয়াক’—এ গিয়ে কলার ছিলকায় পা পিছলে হাসপাতালে ছিলাম দীর্ঘ দিন। কোমর ও মাথায় ভীষণ আঘাত পেয়েছিলাম। তখন বুঝেছি, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন পথ থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলতে বলেছেন। তারপর থেকে অন্তত কলার ছিলকা দেখলে আমি অবশ্যই সরিয়ে ফেলি।’ এই গল্পটা আমার মাঝে মধ্যেই মনে পড়ে। আরও মনে পড়ে আমরা আক্রান্ত হলেই কেবল নবীর কথার সত্যতা বুঝতে পারি। যৌথবাহিনীর যৌথ অপারেশন শুরু হলে মানবতার কক্ষচ্যুত ‘আব্দুদ দীনার—অর্থের দাসেরা’ও বুঝতে পারে— হারামে আরাম নেই। অথচ সময় থাকতে যদি ভেবে দেখতাম তাহলে অবশ্যই ভেবে গর্বিত হতাম নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আহ্বানে পথের কষ্টদায়ক আবর্জনা সরিয়ে ফেললে যেমন আমাদের পা, কোমর আর মাথা অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা থেকে মুক্তি পেতে পারে, জীবন থেকে মরণ পর্যন্ত তার নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করতে পারলে মাথা থেকে পা, রাষ্ট্র থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত আমাদের পূর্ণ জীবনটাই মুক্তি পেত অনাকাঙ্খিত সব দুর্ঘটনা ও পদস্খলন থেকে। বলি, সেই নবীর জীবন-শিক্ষা ও বাণীর চাইতে সুন্দর আধুনিক ও হৃদয়গ্রাহী কথা আর কী হতে পারে? এতে যদি স্বার্থকতার কিছু না থাকে, তাহলে অন্তত এই পাক নামের বরাতে লিখতে গিয়ে যে বারবার লিখি ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ মহান ও পুণ্যময় এই প্রার্থনা অঙ্কনের আলোকিত ‘অর্জনকে’ উপেক্ষা করি কীভাবে? যে যাই বলুক, আমার কাছে মনে হয়, একজন ‘মুসলমান’ সাহিত্যকর্মীর জীবনে সর্বোচ্চ প্রাপ্তি, সর্বাধিক মর্যাদা ও অর্জন হল এই ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’। অবশ্য ‘উপার্জন’ নয়। সুতরাং ডাল-ভাত আর কালো পানির উপার্জন—নিক্তিতে বিচার করলে সে হতভাগা বিচারকের দৃষ্টিতে এই মহৎ ও মহান ‘অর্জন’ও ক্ষুদ্র মনে হতে পারে কিন্তু হৃদয়বান মুমিনের দৃষ্টিতে নয়। ‘অর্জন’ আর উপার্জনের পার্থক্য বোঝা কি সবার পক্ষে সম্ভব?