খাদ্য গ্রহণে ও স্বাস্থ্য সংরক্ষণে ইসলামের রীতিনীতি
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অপচয় না করা
বিভিন্নভাবে খাবারের অপচয় হয়ে থাকে। বিষয়টি এখন আমাদের দেশেও মহামারীর আকার ধারণ করেছে। খাদ্যের সাথে অপচয় শব্দটি যুক্ত হলেই বিষয়টির নাড়িনক্ষত্র সবার চোখের সামনে ফুটে ওঠে। অথচ কুরআনে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে,
اِنَّ الْمُبَذِّرِیْنَ كَانُوْۤا اِخْوَانَ الشَّیٰطِیْنِ.
নিশ্চয় অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। -সূরা বনী ইসরাঈল, ২৭
পক্ষান্তরে মুমিনদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, তারা যখন ব্যয় করে তখন অপচয় করে না, কৃপণতা করে না; বরং তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবতীর্। -সূরা ফুরকান, ৬৭
অর্থাৎ তারা সবক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখে।
অন্য এক আয়াতে খাদ্যের নেয়ামতরাজি উল্লেখ করার পর সুস্পষ্ট আদেশ করা হয়েছে যে, এগুলো থেকে আহার কর, তবে অপচয় করো না।
ইরশাদ হয়েছে,
وَ هُوَ الَّذِیْۤ اَنْشَاَ جَنّٰتٍ مَّعْرُوْشٰتٍ وَّ غَیْرَ مَعْرُوْشٰتٍ وَّ النَّخْلَ وَ الزَّرْعَ مُخْتَلِفًا اُكُلُهٗ وَ الزَّیْتُوْنَ وَ الرُّمَّانَ مُتَشَابِهًا وَّ غَیْرَ مُتَشَابِهٍ ؕ كُلُوْا مِنْ ثَمَرِهٖۤ اِذَاۤ اَثْمَرَ وَ اٰتُوْا حَقَّهٗ یَوْمَ حَصَادِهٖ ۖؗ وَ لَا تُسْرِفُوْا ؕ اِنَّهٗ لَا یُحِبُّ الْمُسْرِفِیْنَ.
‘আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন উদ্যান মাচাবাহিত ও মাচাবিহীন এবং খেজুর গাছ, বিভিন্ন প্রকার ফলের ক্ষেতখামার এবং যায়তুন ও আনার, একটি অপরটির সদৃশ ও বিসদৃশও। যখন তা ফলবান হয় তখন তার ফল খাও। আর তোলার দিন তার দেয় প্রদান কর এবং অপচয় করো না। তিনি অপচয়কারীদের আদৌ পছন্দ করেন না।’-সূরা আনআম, ১৪১
‘হাদীস শরীফে খাবারের প্রতিটি লোকমাকে কত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং যাতে এতটুকু খাবার নষ্ট বা অপচয় না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে।
জাবের রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَحْضُرُ أَحَدَكُمْ عِنْدَ كُلِّ شَيْءٍ مِنْ شَأْنِهِ، حَتَّى يَحْضُرَهُ عِنْدَ طَعَامِهِ، فَإِذَا سَقَطَتْ مِنْ أَحَدِكُمُ اللُّقْمَةُ، فَلْيُمِطْ مَا كَانَ بِهَا مِنْ أَذًى، ثُمَّ لِيَأْكُلْهَا، وَلَا يَدَعْهَا لِلشَّيْطَانِ، فَإِذَا فَرَغَ فَلْيَلْعَقْ أَصَابِعَهُ، فَإِنَّهُ لَا يَدْرِي فِي أَيِّ طَعَامِهِ تَكُونُ الْبَرَكَةُ.
আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, শয়তান সর্বাবস্থায় তোমাদের আশপাশে বিচরণ করে, এমনকি খাদ্য গ্রহণের সময়ও। যখন তোমাদের কারো হাত থেকে খাবারের লোকমা পড়ে যায় তখন সে যেন তা তুলে পরিস্কার করে খেয়ে ফেলে এবং শয়তানের জন্য রেখে না দেয়। আর যখন খাওয়া শেষ হয় তখন যেন আঙ্গুল চেটে খায়। কেননা খাবারের কোন অংশে বরকত রয়েছে সে তা জানে না। -সহীহ মুসলিম
এ হাদীসে খাবারের কিয়দাংশ পড়ে গেলে তা উঠিয়ে পরিস্কার করে খাওয়ার আদেশ করা হয়েছে। খাদ্যের সামান্য থেকে সামান্য অংশ বিনষ্ট করাও অপচয়।
আমাদের দেশের বড় বড় ভোজ অনুষ্ঠানগুলোর দিকে নজর দিলে দেখা যাবে অপচয়ের কী ভয়াবহ রূপ। যেহেতু অনুষ্ঠানগুলোর খাবারের আইটেম হয় অন্য সময় থেকে ভিন্নতর তাই অনেকে খাবারের এই পরিবর্তনের কথা আমলে না এনে প্লেটে মাত্রাতিরিক্ত খাদ্য নিয়ে ফেলেন। ফলে দেখা যায়, শেষমেষ সবটা খাবার তিনি আর খেতে পারছেন না। এতো গেল অতিথিদের অসর্তকতা। আর নিমন্ত্রণকারীদের অবহেলা হল, সম্মান রক্ষার্থে এ পরিমাণ খানা দেওয়া হয় যে, অতিথি কখনো তা খেয়ে শেষ করতে পারবে না। ফলে যা হবার তাই হয়, খাবারগুলোর স্থান হয় ডাস্টবিনে।
বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদিও দেখা যায় এটা ব্যক্তিগত অপচয়, কিন্তু সামাজিক জীবনেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
অপচয়ের আরেক নমুনা দেখা যায় হোটেল রেস্তোরাগুলোতে। হোটেলের টেবিলগুলোতে দেদারছে ভাত—তরকারি অচয় হয়। নষ্ট হয় আল্লাহর নেয়ামত। এতে প্রতিদিন খাবারের বরকত থেকে বঞ্চিত হয় অসংখ্য মানুষ।
হোটেলের পরিবেশে অনেকের প্লেটের চারপাশে চিত্র দেখলে মনে হয়, মুরগি—ছানার খাদ্য ছিটানো হয়েছে। অথচ ইসলাম আমাদের কতসুন্দর পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে। সে পদ্ধতিতে হোটেল, বস্তি বা শাহী মহলের পরিবেশকে খাস করে দেওয়া হয়নি। তাহলে কেন আমাদের এই খাদ্যের অপচয়। আমাদের কি এটা নিয়ে ভাববার সুযোগ হবে?
এতক্ষণ অপচয় থেকে বেচে থাকা সম্পর্কে কুরআনের আয়াত ও একটি হাদীস উল্লেখ করা হল। প্রয়োজনে ক্ষুধার্ত থাকার শিক্ষাও হাদীসে রয়েছে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরা জীবনে অনেক দিন ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন সময় ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন অতিবাহিত করেছেন এবং হাসিমুখে এই অবস্থাকে বরণ করেছেন। এর কারণে কিন্তু তাঁদের আমলে বা ইবাদতে কোনো প্রভাব পরেনি; বরং ক্ষুধার্ত থাকাই তাদেরকে আরও বেশি আল্লাহঅভিমুখী করেছে এবং আল্লাহর স্মরণে অনুপ্রাণিত করেছে। খোদ রাসূলের যবানে একটি হাদীসে ক্ষুধার্ত থাকার কী অপূর্ব নজীর বর্ণিত হয়েছে তা লক্ষ করুন,
عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ عَرَضَ عَلَيَّ رَبِّي لِيَجْعَلَ لِي بَطْحَاءَ مَكَّةَ ذَهَبًا، قُلْتُ: لاَ يَا رَبِّ وَلَكِنْ أَشْبَعُ يَوْمًا وَأَجُوعُ يَوْمًا، أَوْ قَالَ ثَلاَثًا أَوْ نَحْوَ هَذَا، فَإِذَا جُعْتُ تَضَرَّعْتُ إِلَيْكَ وَذَكَرْتُكَ، وَإِذَا شَبِعْتُ شَكَرْتُكَ وَحَمِدْتُكَ.
رواه الترمذي وقال : هذا حديث حسن.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার পালনকর্তা মক্কার বাতহা নামক পাহাড়কে আমার জন্য স্বর্ণে রূপান্তরিত করে দেওয়ার কথা বললেন। আমি বললাম, হে প্রভু! আমি এটা চাইনা; বরং আমি একদিন পরিতৃপ্ত থাকব, আরেকদিন ক্ষুধার্ত থাকব। যখন ক্ষুধার্ত থাকব তখন আপনার প্রতি বিনীত হব এবং আপনাকে স্মরণ করব। আর যখন পরিতৃপ্ত থাকব তখন আপনার শুকরিয়া আদায় করব এবং আপনার প্রশংসা করব। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৪৭
উল্লেখিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন পরিতৃপ্ত শিক্ষা দিয়েছেন, তেমনি ক্ষুধা নিয়ে দিন যাপন করারও শিক্ষা দিয়েছেন এবং ক্ষুধার সময় আল্লাহর প্রতি বিনয়াবনত হওয়ার ও আল্লাহকে স্মরণ করার তা’লীম দিয়েছেন। সুতরাং মানুষ কখনো পরিতৃপ্ত হবে, কখনো অল্পেতুষ্ট থাকবে, আবার প্রয়োজনে কখনো ক্ষুধার কষ্ট স্বীকার করবে এটাই ইসলামের চিরাচরিত শিক্ষা।
তিরমিযী শরীফের একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
تَجَشَّأَ رَجُلٌ عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: كُفَّ عَنَّا جُشَاءَكَ فَإِنَّ أَكْثَرَهُمْ شِبَعًا فِي الدُّنْيَا أَطْوَلُهُمْ جُوعًا يَوْمَ القِيَامَةِ.
رواه الترمذي وقال : هذا حديث غريب من هذا الوحه وفي الباب عن أبي جحيفة.
এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে ঢেকুর দিল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমাদের সামনে তোমার ঢেকুর সংযত কর। কেননা পার্থিব জগতে যারা বেশি উদরপূর্তি করে, কিয়ামতের দিন তারা বেশি ক্ষুধার্ত থাকবে। -তিরমিযী, হাদীস ২৪৭৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৩৫০
এই হাদীস দ্বারা বোঝা যায়, দুনিয়ার আরাম—আয়েশ ভোগ করে প্রতিদিন পেট পুরে খেয়ে যদি গাফেল হয়ে থাকে তাহলে এই আরাম—আয়েশ তাদের জন্য আখেরাতে কষ্টের কারণ হবে। সুতরাং যারা ইসলামের বিধানমতে জীবন পরিচালনা করে; তৃপ্তির সময় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে আর ক্ষুধার্ত থাকলে আল্লাহকে স্মরণ করে, তারা আখেরাতে পরিতৃপ্ত ও সফলকাম হবে।
খন্দক যুদ্ধে পরিখা খননের সময় যখন ক্ষুধা ও কষ্টে সবাই কাতর তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুবারক যবানে যে বাণী উচ্চারিত হয়েছিল, ইতিহাসে তা চির অমর হয়ে রয়েছে-
اللَّهُمَّ إِنَّ العَيْشَ عَيْشُ الآخِرَهْ، فَاغْفِرْ لِلْأَنْصَارِ وَالمُهَاجِرَهْ فَقَالُوا مُجِيبِينَ لَهُ: نَحْنُ الَّذِينَ بَايَعُوا مُحَمَّدَا عَلَى الجِهَادِ مَا بَقِينَا أَبَدَا.
হে আল্লাহ! আখেরাতের জীবনই একমাত্র জীবন। আপনি মুহাজির ও আনসারদের প্রতি রহম করুন।
তখন নবী—প্রেমিকরা বলে উঠলেন, মুহাম্মাদের হাতে আমরা আমরণ জিহাদের শপথ করছি। —সহীহ বুখারী, হাদীস ৪০৯৯
অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ أَلَسْتُمْ فِي طَعَامٍ وَشَرَابٍ مَا شِئْتُمْ ؟ لَقَدْ رَأَيْتُ نَبِيَّكُمْ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا يَجِدُ مِنَ الدَّقَلِ مَا يَمْلَأُ بِهِ بَطْنَهُ.
নুমান ইবনে বাশীর রা. বলেন, ‘তোমরা কি এখন যা ইচ্ছা তাই পানাহার করছ না? অথচ আমি তোমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি পেট ভরার জন্য সামান্য নিম্নমানের খেজুরও তাঁর জুটত না।’
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন শরীরের সামঞ্জস্য বজায় রেখে পরিমিত খাদ্য গ্রহণ করা এবং অল্পেতুষ্ট থাকা। তাহলে ওই অল্প খাদ্যের বরকতেই স্বস্থ্য ঠিক থাকবে।
তাসাউফ ও দর্শন শাস্ত্রের ইমাম গাযালী রাহ. তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন’—এর অল্প খাওয়া এবং চাহিদা থাকতে খাবার শেষ করার দশটি উপকারিতা উল্লেখ করেছেন। সেই উপকারিতাগুলো এখানে তুলে ধরছি।
১. এর মাধ্যমে কলবের স্বচ্ছতা, স্বভাবের পরিচ্ছন্নতা ও বুদ্ধিমত্তার কার্যকারিতা সৃষ্টি হয়।
২. হৃদয়ে নম্রতা ও কমনীয়তা পয়দা হয়, যার মাধ্যমে মুনাজাত ও যিকিরের স্বাদ লাভ হয়।
৩. বিনয় ও আত্মসংযম সৃষ্টি হয় এবং অহংকার ও মন্দ কাজ পরিহার করার অভ্যাস গড়ে ওঠে।
৪. আল্লাহর পরীক্ষা ও শাস্তির ভয়ে অন্তর ভীত থাকে। বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা সৃষ্টি হয়।
৫. ক্ষুধার্ত থাকার কারণে অপরাধের নেশা অবদমিত হয় এবং নফসে আম্মারার উপর কতৃর্ত্ব লাভ হয়। সৌভাগ্যবান ওই ব্যক্তি যে নফসকে নিজের অধীনে রাখে, আর দুর্ভাগা ওই ব্যক্তি খোদ নফস যাকে চালনা করে।
৬. রাত জাগার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। অতি ভক্ষণে জীবনের মাকসাদ বিফলে যায়, তাহাজ্জুদও ছুটে যায়।
৭. ইবাদতে নিয়মানুবর্তিতা সহজ হয়। কেননা সর্বদা ভালো খাবারের চিন্তায় থাকলে ইবাদত বাধাগ্রস্ত হয় এবং খাওয়ার পিছনে অনেক সময় ব্যয় হয়ে যায়।
৮. অল্প খাবারে শরীর সুস্থ থাকে, রোগমুক্ত থাকে। অন্যথায় চিকিৎসার পিছনেও অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৯. খরচ অল্প হয়। কেননা যে খাবারে সংযমী তার জন্য সামান্য অর্থই যথেষ্ট।
১০. অতিরিক্ত খাদ্য মিসকীনকে সদকা করার এবং খাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার অভ্যাস অর্জিত হয়। এতে কিয়ামতের দিন সদকার শীতল ছায়ায় স্থান পাওয়া যাবে। যারা এখানে সদকা করবে তারা এর বিনিময়ে আল্লাহর ফযল ও রহমত লাভ করতে সক্ষম হবে।
আধুনিক বিজ্ঞানের সমার্থন
সুদীর্ঘ চৌদ্দশ বছর আগে খাদ্য গ্রহণে ইসলাম যে শিক্ষা প্রদান করেছে তার আলোচনা করা হচ্ছে। বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষের যুগে খাদ্য—গবেষক ও বড় বড় মুসলিম—অমুসলিম ডাক্তাররা খাদ্য গ্রহণে ইসলামের রীতি নীতিকে উপকারী ও বাস্তব—নির্ভর শিক্ষা হিসাবে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছেন। কোনো কোনো গবেষক তো এ শিক্ষার সামান্য একটি সাইড নিয়ে পিএইচডি করছেন। তবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ এটা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা দেওয়া পদ্ধতি। তিনি তা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হয়ে উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন। তাই এই শিক্ষার ফায়দা ও রহস্য সুগভীর। এজন্যই অনেক অমুসলিম গবেষক সম্পর্কে শোনা যায়, তারা একটি বিষয়ে দীর্ঘ গবেষণার পর যে ফলাফলে পৌঁছেছেন, যখন তাকে বলা হয়, এটা তো সেই চৌদ্দশ বছর আগেই আমাদের নবী আমাদেরকে বলে গেছেন, তখন তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। অনেক গবেষক, এধরনের জবাব শুনে মুসলমান হয়েছেন। নববী শিক্ষা ও আধুনিক সায়েন্সের মাজে যোগসূত্র তুলে ধরে বিভিন্ন ভাষায় অনেক গ্রন্থও রচিত হয়েছে।
তার মধ্যে উদূর্ ভাষায় রচিত একটি গ্রন্থ হল, ‘সুন্নাতে নববী আওর জাদীদ সায়েন্স’। উক্ত গ্রন্থে লেখক খাবার সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, সকল খাদ্য—বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে একমত যে, একশ ভাগ রোগই খাদ্যের গড়মিলের কারণে হয়ে থাকে। আধুনিক বিজ্ঞানে বার বার এই কথার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে যে, কম খাও; আয়ু দীর্ঘ হবে।
এরপর লেখক মাত্রাতিরিক্ত খাওয়ার কারণে শরীরে কী কী রোগ দেখা দেয় তার একটি তালিকা প্রফেসর রিচারবার্ড—এর উদ্ধৃতিতে তুলে ধরেছেন। সেই তালিকায় ডায়েবেটিস, হাইব্লাড—প্রেশার, হার্টের রোগসহ অনেক বড় বড় রোগের কথা উল্লেখ করেছেন। এরপর বলেছেন, এগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে প্রফেসর সাহেব দীর্ঘ গবেষণা করে রোগের যে লিস্ট তৈরি করেছেন সেটা মৃত্যুর লিস্ট ছাড়া আর কিছু নয়।
লেখক তার আলোচনার এক পর্যায়ে বলেছেন, ক্ষুধার্ত থাকা শরীরের জন্য চিকিৎসাস্বরূপ। তিনি আধুনিক সায়েন্স থেকে তার বাস্তব উদাহরণ পেশ করেছেন। সাথে সাথে ইসলাম ক্ষুধার্ত থাকার যে শিক্ষা দিয়েছে সেটার সাথে আধুনিক সায়েন্সের মিল দেখিয়েছেন।
পরিশেষে ইসলাম উদরকে তিন ভাগে ভাগ করে খাওয়ার যে পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে, সেটাকে খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে বাস্তব ও উপযুক্ত পদ্ধতি হিসেবে আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতামত পেশ করেছেন। মোটকথা, তিনি তার দীর্ঘ আলোচনা দ্বারা এ বিষয়টি স্পষ্ট তুলে ধরেছেন যে, খাদ্য গ্রহণে ইসলামের যে শিক্ষা সেটাই আসল শিক্ষা। এটাকে সমসাময়িক বিধমীর্ খাদ্য—গবেষকরাও একবাক্যে গ্রহণ করেছেন।
ডায়েট কন্ট্রোলের কথা শুধু আধুনিক চিকিৎসকগণ বলেছেন তা নয়; বরং বাদশা হারুনুর রশীদের যামানার বিখ্যাত হাকিমগণও খাদ্য—সংযমের ব্যাপারে তাকিদ করেছেন। ইহইয়াউ উলূমিদদীন গ্রন্থে একটি ঘটনা বিস্তারিতভাবে উল্লেখিত রয়েছে, যার সার সংক্ষেপ হল, বাদশা হারুনুর রশীদ একবার চার দেশের চার জন অভিজ্ঞ চিকিৎসককে একত্র করলেন। এরপর বাদশা প্রত্যেককে একেক করে জিজ্ঞাসা করলেন, এমন কোনো ওষুধের কথা বলুন, যা ব্যবহার করলে সকল রোগ—ব্যধি থেকে মুক্ত থাকা যাবে।
প্রথম তিনজন প্রত্যেকে একটি করে ওষুধের নাম বললেন। কিন্তু চতুর্থজনকে যখন জিজ্ঞাসা করা হল, তখন তিনি বললেন, এদের কারও কথা ঠিক নয় এবং যুক্তির মাধ্যমে তা বুঝিয়ে দিলেন। তাকে বলা হল, তাহলে আপনি বলে দিন সেটা কোনো মহৌষধ? তিনি তখন বললেন, সেই মহৌষধ হল, ততক্ষণ পর্যন্ত না খাওয়া যতক্ষণ খাবারের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ সৃষ্টি না হবে এবং ওই মুহূর্তে খাওয়া বন্ধ করা যখন আরও কিছু খাওয়ার আগ্রহ বাকি থাকে। একথা শুনে সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন, আপনার কথাই সঠিক। -ইহইয়াউ উলূমুদ্দীন, ২/১২৬
শেষ কথা
আলোচ্য বিষয়ে ইসলামী শিক্ষাগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সুস্বাস্থ্যের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করা। কেননা মানুষ যত খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করুক না কেন যদি আল্লাহ তা’আলা সেগুলো শরীরের জন্য কল্যাণকর না বানান তাহলে এই খাদ্য গ্রহণ কোনো কাজেই আসবে না। তদ্রূপ সুখাদ্য খেলেই যে শরীর ভালো থাকবে এবং শক্তি সামর্থ্য বাড়বে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই; যদি আল্লাহ এ খাদ্যকে খাদ্য গ্রহণকারীর উপকারী না করে দেন। তাই প্রকৃত উপকার প্রদানকারী প্রভুর কাছে সুস্বাস্থ্যের জন্য দুআ করা আবশ্যক। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে এই শিক্ষা দিয়েছেন।
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الدُّعَاءُ لاَ يُرَدُّ بَيْنَ الأَذَانِ وَالإِقَامَةِ، قَالُوا: فَمَاذَا نَقُولُ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: سَلُوا اللَّهَ العَافِيَةَ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ..
رواه الترمذي، وقال : هذا حديث حسن.
একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আযান, ইকামতের মাঝের দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। একথা শুনে আনাস রা. বললেন, আমরা তখন কী দুআ করব ইয়া রাসূলুল্লাহ? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের সুস্থতা ও নিরাপত্তা কামনা করবে। -তিরমিযী, হাদীস ৩৫৯৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩/১১৯
এছাড়াও আরও অনেক হাদীস রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্থতা ও রোগমুক্তির জন্য দুআ করার শিক্ষা দিয়েছেন।
অতএব, আল্লাহর পক্ষ থেকে কাউকে দুনিয়ায় সুস্থতার নেয়ামত দান করা হলে সে যদি এই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করে; বরং এটাকে অবহেলা করে এবং মনের চাহিদামত এই সুস্থতাকে ব্যবহার করে শরীয়তগর্হিত কাজে লেগে থাকে তাহলে এজন্য আল্লাহর সামনে তাকে কড়া হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে,
‘عن أبي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّه قَالَ إِنَّ أَوَّلَ مَا يُسْأَلُ عَنْهُ العَبْدُ يَوْمَ القِيَامَةِ مِنَ النَّعِيمِ أَنْ يُقَالَ لَهُ: أَلَمْ نُصِحَّ لَكَ جِسْمَكَ، وَنُرْوِيَكَ مِنَ المَاءِ البَارِدِ ؟
‘আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সর্বপ্রথম মানুষকে নেয়ামতের ব্যাপারে যে প্রশ্ন করা হবে তা হল, আমি কি তোমার শরীর সুস্থ রাখিনি? তোমাকে শীলত পানি পান করাইনি? (অর্থাৎ, এর শুকরিয়া হিসাবে তুমি কী আমল করেছো?) -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৭৩৬৪; তিরমিযী, হাদীস ৩৩৫৮
সুতরাং সুস্থতা যত বড় নেয়ামত এটার মূল্যায়নও তত বেশি জরুরি। তাই আমাদের কর্তব্য হল, ইসলামের শিখানো পদ্ধতিতে আহার গ্রহণ করা। শরীরকে সুস্থ রাখা এবং সুস্থতা স্থায়ী হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করা। এরপর সুস্থতাসহ সকল নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।