বাইতুল্লাহর ছায়ায় (৮)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বাইতুল্লাহর সফরনামা লিখতে হলে প্রথম কর্তব্য হলো, কী লিখবে,আর কী লিখবে না, তা নির্ণয় করা এবং পূর্ণ সংযম রক্ষা করে লেখা। কলমের সামান্য ভুল, সামান্য অসংযম এখানে হতে পারে অনেক বড় ক্ষতির কারণ। জানি না, এ পর্যন্ত এ কর্তব্য আমি করতে পেরেছি কি না! লেখার কথাগুলো আমি কি লিখেছি? না লেখার কথাগুলো আমি কি পরিহার করেছি? জানি না।
বাইতুল্লাহর মুসাফিরকে লিখতে হয় সতর্কতার সঙ্গে। আর যার লেখা বাইতুল্লাহর ছায়ায়, তাকে লিখতে হয় সাবধানতার সঙ্গে। এখানে লেখার কথা কম, না লেখার কথা অনেক বেশী। কারণ বাইতুল্লাহর সফর হলো প্রেম ও ভালোবাসা এবং ইশক ও মুহব্বতের সফর! এখানে দিলের জাহানে কত ভাব ও ভাবনা আসে এবং হৃদয়ের জগতে কত ঢেউ ও তরঙ্গ জাগে! এখানে আকাশ থেকে শিশির ঝরে, এখানে আসমান থেকে শবনম পড়ে! এখানে মাওলার সঙ্গে বান্দার...! সুতরাং এখানে আবরণেই সৌন্দর্য এবং গোপনীয়তার মধ্যেই সফলতা!
তবে একথাও সত্য, যিনি দান করেন, তিনি বিতরণে খুশী হন! বান্দা যত বিতরণ করে দাতা খুশী হয়ে তত দান করেন! বিচার হবে শুধু নিয়তের। নিয়ত ছহী হলে তো ‘ওয়া আম্মা বিনি‘মাতি রাব্বিকা ফাহাদ্দিছ’, কিন্তু নিয়তের গায়ে যদি সামান্য আচড় লাগে, আমল বরবাদ হয়ে যায়। ইবলিস বড় খতরনাক দুশমন! ভালো নিয়তের ভালো আমলেও সে রিয়ার গান্দেগি মেখে দেয়। আল্লাহর রহমত শুধু পারে বান্দাকে হিফাযত করতে।
প্রিয় পাঠক, আমি যা বলছি, তুমি যা শুনছো, দু‘আ করো নিয়ত যেন ছহী থাকে। আল্লাহ যেন কবুল করেন, আল্লাহ যেন খায়র দান করেন। আমাদের সবকিছু যেন হয় আল্লাহর জন্য, শুধু আল্লাহর জন্য।
আল্লাহর দয়া ও দান বান্দার উপর কতভাবে যে নেমে আসে! আফসোস, বান্দা দেখেও দেখে না, বুঝেও বোঝে না, আর শোকরের কথা তো মনেই পড়ে না!
এই সফরে মদীনা শরীফে একরাত্রের ঘটনা। বাবুস-সালামের সামনে ইহরামের একটি চাদর বিছিয়ে, দ্বিতীয়টি গায়ে জড়িয়ে বসে আছি দুয়ার খোলার প্রতীক্ষায়। আল্লাহর বান্দা আরো অনেকে ছিলো। সবার মুখে ছিলো দুরূদের গুঞ্জন, আর মুখমণ্ডলে ছিলো ‘কখন খোলে! কখন খোলে!’ এই ব্যাকুলতার ছাপ।
রাত তখন একটা। ডান দিকের একটি দরজা খোলা হলো, আর সবাই সেদিকে ছুটে গেলো, কে কার আগে সালামের নাযরানা নিয়ে হাযির হবে সেই ব্যাকুলতায়! আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম দুয়ার খোলার প্রতীক্ষায়, দাঁড়িয়েই থাকলাম। কিছুক্ষণ পর আমার সামনে অবারিত হলো বাবুস-সালামের দুই কপাট। অপূর্বএক পুলক-অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করলো। আমি যেন তখন দেহহীন শুধু আত্মা! দেহের জগতে নয়, যেন রূহের জগতে আমার বিচরণ। গোনাহগার, সিয়াহকার, তবু আমি তখন একমাত্র উম্মতি, যে দাঁড়িয়ে আছে উন্মুক্ত বাবুস-সালামে। সামনে আমার গালিচা বিছানো আলোকিত রাজপথ! কেউ নেই, তবু যেন কারা আছে! কায়া নেই, ছায়া নেই, তবু যেন কাদের উপসি'তির ঝিলিমিলি আছে, আছে অপার্থিব এক সুবাস! আহ, আল্লাহর রহমত ছাড়া এমন গোনাহগারের পক্ষে এমন দুর্লভ সৌভাগ্য কি কল্পনাও করা সম্ভব! যখন করুণার শিশির ঝরে, যা সম্ভব নয়, তাও তখন সম্ভব হয়। তোমার শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর!
দুরু দুরু বুকে ধীর শান্ত পদক্ষেপে অগ্রসর হলাম। কেউ ছিলো না, তবু যেন কোন সঙ্গ ছিলো, কোন স্পর্শ, কোন সংস্পর্শ যা শুধু অনুভব করা যায়, প্রকাশ করা যায় না। রওযা শরীফে হাযিরির পথে এমন অনুভূতি আর কখনো হয়নি।
যেন একা একা বহু শতাব্দীর সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আমি পৌঁছলাম উম্মতের জন্য আলোর উৎসের কাছে, যেখানে পাবে তুমি পরম নির্ভয়তা ও নির্ভরতা, পাবে শাফা‘আতের আশ্বাস ও সান্ত্বনা!
দিলের সকল তাপ ও উত্তাপ চোখের পানি হয়ে ঝরে গেলো, আর ভিতরে একটি প্রশান্তির শীতল প্রবাহ অুনভূত হলো। ধীরে ধীরে অস্ফুট কণ্ঠে নিবেদন করলাম দুরূদ ও সালামের নাযরানা। কেউ বললো না, সরে যাও, বরং কারা যেন বললো, যতক্ষণ পারো দাঁড়িয়ে থাকো। সৌভাগ্যের এমন দুর্লভ মুহূর্ত হয়ত আর আসবে না কখনো। যতটুকু পারো বিগলিত হও, আলোকিত হও, উদ্ভাসিত হও, সিক্ত ও স্নাত হও এবং স্নিগ্ধ হও।
হঠাৎ আমার কানে একটি মধুর সুরের রিমঝিম সুধা বর্ষিত হলো-
يا خير من دفنت بالقاع أعظمه
(মৃত্তিকাগর্ভে সমাধিস্থ যত মানব, হে নবী, আপনি তাদের সর্বোত্তম) নবীপ্রশস্তির সেই রিমঝিম সুর- মূর্ছনায় আমি তখন আত্মহারা! আমার কণ্ঠ নেই, কুণ্ঠা আছে। তাই কুণ্ঠিত স্বরে আমিও শামিল হলাম সেই নবীবন্দনায়-
فطاب من طيبهن القاع و الأكم
(আপনারই দেহের সুবাসে সুবাসিত মৃত্তিকা ও তার উদ্যান)
এমন সুমধুর কণ্ঠ কি কোন মানুষের হতে পারে! বেদনার এমন দহন কি মানুষ ছাড়া আর কারো কণ্ঠে হতে পারে! আমার পাশে সেদিন যিনি দাঁড়িয়েছিলেন তিনি কি মানুষ ছিলেন? হয়ত! তিনি কি ফিরেশতা ছিলেন? হয়ত!
নবী-প্রেমের এমন দহন, এমন নিবেদন ও আত্মনিবেদন এযুগেও হয়, হতে পারে! আবার সেই রিমঝিম সুর-
نفسي الفدآء لقبر أنت ساكنـه
(আপনি যে কবরে শায়িত, তার প্রতি আমার আত্মা উৎসর্গিত)
নিজের অজান্তেই ফিরে তাকালাম। সুবহানাল্লাহ! এমন আলোঝলমল মুখমণ্ডল! এমন নূর ও নূরানিয়াত! দু’টি চোখ থেকে ঝরছে কি ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু, না বিন্দু বিন্দু মুক্তা!
এবার শেষ পংক্তিটি নিবেদিত হলো, যেন শেষ অশ্রুবিন্দুর নিবেদন
فيه العفاف و فيه الجود و الكرم
(কেন নয়! এ কবর যে, পবিত্রতা, বদান্যতা ও দানশীলতার খনি!)
বহু যুগ আগে এখানে রাওযা শরীফের মাকামে যে আরব বেদুঈন এই নবী-প্রশস্তি নিবেদন করেছিলেন, আর পেয়ারা হাবীবের কাছ থেকে মাগফেরাতের মুজদা লাভ করেছিলেন, দেখতে তিনি কেমন ছিলেন? এমনই উজ্জ্বল! এমনই আলোঝলমল! কেমন ছিলো তার কণ্ঠস্বর? এমনই বেদনাবিধুর! এমনই স্নিগ্ধ মধুর! তিনিও কি কেঁদেছিলেন এখানে এভাবে? এমন কান্না কারা কাঁদতে পারে নবীর বিরহে! নবীর প্রেমে! আসমানের দয়া ছাড়া নবীর দরবারে এমন অশ্রু কারো চোখে আসে না; এমন কান্না কেউ কাঁদতে পারে না। এমন অশ্রু, এমন কান্না দেখতে পাওয়া, সেও তো বড় সৌভাগ্য, আমাদের মত গোনাহগারদের জন্য!
সালাম আরয করে তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন। ভাবলাম, এখন বের হবেন, কিন্ত না, তিনি বসলেন কদম মোবারকের কাছে, খুব আদবের সঙ্গে। অন্য সময় উঠিয়ে দেয়, এখন কেউ কিছু বললো না। এসময় কিছু বলে না। আর এমন মানুষকে হয়ত কখনোই কিছু বলা হয় না। আমার মনে হলো, এই ‘খোশলামহা’, এই সুবর্ণ সুযোগ হয়ত আর আসবে না। আমিও গিয়ে বসলাম তাঁর পাশে। বসাটা দৃশ্যে এক হলেও অদৃশ্যে এক হলো কি না জানি না; তবে দৃশ্যের অভিন্নতারও তো মূল্য আছে।
কেমন লাগলো তখন? হৃদয়ের গভীরে ভাব ও অনুভবের কেমন বর্ণচ্ছটা বিচ্ছুরিত হলো? বন্ধু! ভাবের জগত তো মহাসাগরের চেয়ে বিস্তৃত! অন্য দিকে শব্দের জগত যেমন স্থূল তেমনি সঙ্কুচিত। পৃথিবীর কোন ভাষার কোন শব্দ হৃদয়ের ভাব কীভাবে ধারণ করবে! এখন, এতদিন পরে শুধু বলতে পারি, আমি সেখানে বসেছিলাম বর্তমানের সঙ্গে নয়, অতীতের অন্য একটি শতাব্দীর সংস্পর্শে। সেই স্নিগ্ধ সংস্পর্শ যেন আমাকে অনুভব করার সৌভাগ্য দান করেছিলো পবিত্র কদমের শীতলতা ও স্নিগ্ধতা। আলোকিত মানুষটির দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলাম, ‘এখান থেকে তুমি যদি কিছু অর্জন করতে পারো, আমিও তাহলে বঞ্চিত হবো না। আমি যে তোমার সঙ্গে ছিলাম!’
তিনি তাকালেন। আহা, এমন কোমল হয় চোখের দৃষ্টি! এত শিশির ঝরে চোখের তারা থেকে!
তিনি মৃদু হাসলেন। আহা, এমন স্নিগ্ধ হয় মুখের হাসি! এত ‘শবনম’ ঝরে মুখের তাবাস্সুম থেকে!
তিনি উঠলেন এবং বের হলেন। আমি যেন কোন অদৃশ্যের আকর্ষণে চালিত হয়ে তাঁকে অনুসরণ করলাম। আকাঙ্ক্ষা জাগলো, সালাম করে দোয়ার আবেদন জানাই। শাহস হলো না। ভয় হলো, এটা যদি স্বপ্ন হয়, আর কথা বলার কারণে স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়!
দক্ষিণ দিক দিয়ে বাবুস-সালামের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ পিছন থেকে, কোমল মধুর কণ্ঠে একটি সম্বোধন্ত
اسمع يا أخا الإسلام!
এমন অভূতপূর্ব সম্বোধন!
أخي المسلم
শুনেছি অনেকবার, কিন্তু
أخا الإسلام!
মনে পড়লো, জাহেলিয়াতের যুগে আরব আরবকে সম্বোধন করতো,
أخا العرب
বলে। মন্ত্রমুগ্ধের মত ফিরে তাকালাম। কে ডাকছে আমাকে ‘ইসলামের ভাই’ বলে! তিনি! তিনি তো সামনে ছিলেন। আমি তো তাকে অনুসরণ করছিলাম! তিনি এগিয়ে এসে আমার হাত ধরলেন, বললেন্ত
خذ، هذه هدية
আমি কেমন এক আচ্ছন্নতার মধ্যে ছিলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি চলে গেলেন। আমি শুধু তাকিয়ে থাকতে পারলাম তার গমন পথের দিকে! তিনি বাবুস-সালামের আড়াল হলেন। আমার আচ্ছন্নতা দূর হলো। তাকিয়ে দেখি, হাতে পাঁচশ রিয়াল!
এখন, এতক্ষণে সবকিছু আমার কাছে পরিষ্কার হলো। গতরাতের ঘটনা। ঘরে প্রচুর ফলফলাদি। যে আসে, ফল নিয়ে আসে। কত খাওয়া যায়! সব এখন নষ্ট হওয়ার উপক্রম। বুদ্ধিটা দিলেন নাজমুল করীম ভাই। পথে বাংলাদেশীরা কাজ করে। ওরা খুশী হয়ে নেবে। চিন্তাটা ভালো, কিন্তু দায়িত্বটা পড়লো আমার উপর। দু’টি পলিথিনে ফলগুলো নিয়ে সেহরীর কিছু আগে ঘর থেকে বের হলাম। প্রথম যার সঙ্গে দেখা হলো, তাকে কিছু ফল দিলাম, আর তিনি আমাকে দিলেন ভালো একটি শিক্ষা। বললেন, ‘ফল না দিয়ে কিছু রিয়াল দিলে কাজে লাগতো।’
তাই তো! ফলগুলো তো দিচ্ছি আমার প্রয়োজনে, তার প্রয়োজনের কথা তো ভাবিনি। এমনই হয় আমাদের দান। নষ্ট হবে তাই দান করা। তাতে না থাকে দরদ, না হামদর্দি, আর না গরীবের প্রয়োজনের চিন্তা। নিজেকে খুব ছোট মনে হলো। যেন লজ্জা ঢাকার জন্য তার খোঁজখবর নিলাম। নামটা এখনো মনে আছে। বাড়ী জামালপুর। বাবা নেই, মা আছেন। ভিটেবাড়ি ছাড়া কিছু ছিলো না। সেটাই বন্ধক রেখে, বলতে কষ্ট হচ্ছে, সুদের উপর টাকা নিয়ে, সউদী আরব এসেছেন। বছর হয়ে গেছে এখনো পুরো টাকা আদায় হয়নি। হবে কীভাবে, বেতন তো তিনশ রিয়াল, সঙ্গে কিছু দান্তখয়রাত। আর খাটুনি পরিশ্রম! সে দৃশ্যও কিছুটা দেখেছি পরবর্তী এক সফরে। ‘কিছুটা’, কারণ যা পড়েছি এবং যা শুনেছি তা আরো ভয়াবহ!
দৃশ্যটা এখনো ভুলিনি। মসজিদে নববীতে যোহর আদায় করে ঘরে ফিরছি। ঘর ছিলো দক্ষিণ দিকে মসজিদে বেলাল পার হয়ে। ফায়সাল ব্রিজ মাত্র অতিক্রম করেছি; দেখি, এক ‘ঝাড়-দার’ কাঠফাটা রোদে কাজ করছে। তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম কিছুটা মমতা, কিছু অসহায়ত্বের দৃষ্টিতে। হঠাৎ লোকটি পড়ে গেলো। এত দূর থেকেও পতনের শব্দ শোনা গেলো। অবচেতন মন বললো, পানি দরকার। তাই সেদিকে না গিয়ে ছুটলাম পানির বোতল আনতে। ততক্ষণে কিছু হাজীছাহেবানের জটলা হয়ে গেছে। নাহ, বাঙ্গালীর দোষ শুধু শুধু! জটলা আসলে সব জাতিরই পছন্দ! চোখেমুখে পানির ছিটা দিলাম। চোখ মেলে তাকালো। জ্ঞান হারায়নি, মাথাটা ঘুরে গিয়েছিলো। আসলে বেচারা ক্ষুধায়-পিপাসায় কাহিল হয়ে পড়েছিলো। ক্ষুধার সময় বাড়তি কিছু খাবে, পিপাসায় ঠাণ্ডা কিছু পান করবে, এমন বিলাসিতার সুযোগ কোথায়! দেশে রেখে আসা করুণমুখগুলো যে মনে পড়ে যায়, আর মনে পড়ে যায় পাওনা আদায়ের কঠিন বাস্তবতা!
জামালপুরের যুবক ছেলেটি তার দুঃখের বলছিলো, আর কাঁদছিলো। আমারও চোখ ভিজে উঠেছিলো।
এর মধ্যে আরো তিনচারজন জড়ো হলো। একজন বুড়ো বয়সের, সাদাদাড়ি, বললেন, ‘দেশের কত হাজী সামনে দিয়া আসে, যায়, ফিরাও চায় না।’
আমাদের আর দোষ কী! পবিত্র ভূমিতে আমরা তো আর ওদের দিকে ফিরে তাকাতে আসিনি, এসেছি ছাওয়াব কামাতে।
একটু দরদের ছোঁয়া পেয়ে সবাই যেন গলে গেলো। সবার কষ্টের কথা শুনে আমিও যেন কেমন হয়ে গেলাম। হঠাৎ মুখ থেকে বের হয়ে গেলো, ভাই, আমার কাছে যদি পাঁচশ রিয়াল থাকতো, আপনাদের সবাইকে বাঁট করে দিয়ে দিতাম।
এতটুকুতে এত খুশী! সবার চোখে মুখে এমন তৃপ্তির হাসি! বুড়ো লোকটি বললেন, আপনে বলছেন, এতেই আমরা খুশী! অল্পতে কারা খুশী হয়? যাদের অল্প আছে তারা!
হাতে পাঁচশ রিয়াল দেখে গত রাতের ঘটনা মনে পড়ে গেলো, আর আমি অভিভূত হৃদয়ে, কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকালাম। হে আল্লাহ, অশেষ তোমার দয়া, হিকমত তোমার বড় নিরালা। কতভাবে তুমি মদদ করো বান্দাকে! কতভাবে তুমি ইমতিহান করো বান্দাকে!
মদীনা শরীফ থেকে বিদায়ের দু’দিন আগে হঠাৎ করে এবং অকল্পনীয়ভাবে আমার ছোট মেয়ের বিয়ে হলো সালমানের সঙ্গে। বিয়ে হলো রাওযাতুম-মিন রিয়াযিল জান্নায় বসে। বিয়ে পড়ালো আমার ‘জিগরি দোস্ত’ ইয়াহয়া জাহাঙ্গীর, দেশে বড় মেয়ের বিয়েও সে পড়িয়েছিলো। তামান্না ছিলো ছোট মেয়ের বিয়েও সে পড়াবে। এতসব কিছু কীভাবে মিলে গেলো! আল্লাহর গায়বি মদদের এটাই তো কারিশমা। কিন্তু থাক ব্যক্তি-জীবনের কথা।
তার চেয়ে ভালো হয় যদি একটি জানাযার কথা বলি। বিয়ে ও জানাযা! আহ, অনেক দিন আগের একটি দৃশ্য মনে পড়ে গেলো। একবিষুদবারে রাত দশটায় কাকরাইল থেকে বাসায় ফিরছিলাম আমি ও মাওলানা ইসমাঈল। রিকশা যখন হাইকোর্ট মাযারের মোড়ে তখন একদিক থেকে আসছিলো বরযাত্রীর গাড়ী, অন্যদিক থেকে একটি জানাযার গাড়ী যাচ্ছিলো আজিমপুরের দিকে। দু’টো গাড়ীর সঙ্ঘর্ষ হলো, আর দৃশ্যটা আমরা দেখলাম! দুনিয়ার আবাদি ও বরবাদির এমন মুখোমুখি এমন মর্মান্তিক দৃশ্য সেদিন আমাদের ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিলো।
মেয়ের বিয়ের প্রসঙ্গে জানাযার আলোচনা ঠিক হলো না! কেন ঠিক হবে না! জীবনের আনন্দ ও মৃত্যুর বেদনা একসঙ্গেই মনে রাখতে হয় মুমিনকে। কারণ আমাদের আসল ঠিকানা মৃত্যুর ওপারে। তাই আমাদের ইতিহাসে আছে জিহাদ, শাহাদাত ও বাসররাতের একত্রসমাবেশের ঘটনা। আর কোন জাতির ইতিহাসে তুমি পাবে না এর নমুনা।
তারিখটা মনে নেই, রামাযানের বার বা তের। আছরের পর ভাই মছলল্লাহ জানালেন মাওলানা আশিকে ইলাহী বুলন্দশহরী ইনতিকাল করেছেন। এশার পর জানাযা হবে। দিলের ভিতরে বড় একটা ধাক্কা লাগলো। পাঁচ বছর আগে এখানে এই মসজিদে নববীতে তারাবীর পরে তাঁকে দেখেছিলাম এবং দেখা করেছিলাম। আজ পাঁচবছর পর তাঁর জানাযা, এখানে মসজিদে নববীতে এবং রামাযান মাসে। আমরা জানাযার খবর শুনি, তারপর একসময় হয়ে যাই জানাযার খবর। মাঝখানের সময়টা কেটে যায় গাফলাতের ঘোরে। আশ্চর্য আমাদের গাফলত!
পাঁচবছর আগের দৃশ্যগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। তারাবীর পর দেখা হলো ইংল্যান্ডপ্রবাসী জনাব মুফতি আব্দুল হান্নান ছাহেবের সঙ্গে। তিনি আমার ভঙ্গিপতি মাওলানা ফারুকের মামা। মালিবাগ মাদরাসায় ছিলেন। ভালো মানুষ। লন্ডন থেকে এক বড় কাফেলা নিয়ে ওমরায় এসেছেন। আমি তাকে দেখতে পাইনি। কারণ আমার দৃষ্টি ছিলো মসজীদে নববীর প্রথম চত্বরের উত্তরপূর্ব কোণে একটি মজমার দিকে। মজমার কেন্দ্রে একজন বৃদ্ধ আলিম, নূরানি চেহারা। তাকিয়ে আছি, আর ভাবছি, কে ইনি?! এমন সময় মুফতি ছাহেব আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। অপ্রত্যাশিত আনন্দে আমরা আলিঙ্গনাবদ্ধ হলাম। পরে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ঐ যে মজমা, কে তিনি? মুফতি ছাহেব অবাক, আচ্ছা, হযরত বুলন্দশহরীকে চেনেন না!
আমিও অবাক, ইনিই তিনি!
মুফতি ছাহেব বললেন, চলেন পরিচয় করিয়ে দিই।
মজমার পিছনে বসলাম। কথা শোনা যাচ্ছিলো অস্পষ্ট। মজমা শেষে মুফতি ছাহেব পরিচয় করিয়ে বললেন, ইনি আমাদের দেশের আদীব ছাহেব। বহু কিতাব লিখেছেন।
অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে মুছাফাহা করে তিনি বললেন, তাহলে তো আপনি আমারই বেরাদরির লোক!
বিভিন্ন প্রসঙ্গে অনেক কথা হলো। বিদায়ের সময় বললেন, ‘যিন্দেগি ভী বড়ী আজীব হায়!’ মুহূর্তের দেখায় কেমন মুহব্বত হয়ে গেলো। অথচ যিন্দেগিতে হয়ত আর কখনো মুলাকাত হবে না। তারপর এই ‘শুকনো মওলবী’ মসজিদে নববীতে বসে বললেন, ‘জব ইয়াদ মেরী আয়ে মিলনে কি দু‘আ করনা।’ সঙ্গে নিজে থেকে যোগ করলেন, ‘ইনশাআল্লাহ জান্নাত মেঁ’
বুলন্দশহরী মদীনা শরীফে হিজরত করে এসেছিলেন জান্নাতুল বাকীতে মাদফূন হওয়ার তামান্না নিয়ে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দিলের তামান্না পূর্ণ করেছেন। বান্দার দিলের তামান্না আল্লাহ পুরা করেন।
আমার প্রিয় ছাত্র, এখন বড় মাওলানা, আবুতাহের রাহমানী, তার ভগ্নিপতি সপরিবারে মদীনায় ছিলেন। আমাদের বাসার কাছেই ছিলো তাদের বাসা, মাত্র একটি গলি পরে। রাহমানীর বোন ও ভগ্নিপতি পরম আন্তরিকতার আচরণ করেছে। নিষেধ না শুনে আমাদের জন্য খাবার তৈরী করে এনেছে। আমার স্ত্রী ও মেয়েকে মসজিদে নববীতে দীর্ঘ সময় সঙ্গ দিয়েছে। রাহমানীর বড় ভাগিনা মাহমুদ তখন বয়স ছিলো কম। আমার সঙ্গে অনেক কথা বলতো। তার কথায় বুদ্ধির ছাপ ছিলো। এমন ছেলেদের তা‘লীম ও তারবিয়াতের আয়োজন করতে হয় সুচিন্তিতভাবে, হিকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে। পরে শুনেছি, একবার রাস্তা পার হতে গিয়ে মারাত্মক গাড়ীদুর্ঘটনায় পড়েছিলো। অনেক দেরীতে খবর পেয়েছিলাম। মাহমূদের বয়স এখন পঁচিশের কম হবে না। কোথায় এখন সে ও তার মা-বাবা?! এখনো তাদের কথা মনে পড়ে এবং তাদের জন্য দু‘আ করি।
আমাদের মাদরাসাতুল মাদীনাহর ছাত্র সাইফুল্লাহ, তার আব্বা ক্বারী নেয়ামতুল্লাহ ছাহেব তখন মদীনায় ছিলেন। মসজীদে নববীতে তাহফীযুল কোরআনের দরস দিতেন। তাছাড়া মসজিদে নববীর দক্ষিণ দিকে ছূকুল হারামে তার আতরের দোকান ছিলো। তার আন্তরিকতাও ছিলো মনে রাখার মত এবং আমি মনে রেখেছি। মদীনায় তিনি আমার এত বড় উপকার করেছিলেন, যা ভোলার মত নয়। নাজমুল কারীম ভাইয়ের ছেলে তানবীর হঠাৎ অসুস' হয়ে পড়লো। রাত্রের হালকা জ্বর সকালে একেবারে একশ পাঁচ! ছেলে প্রলাপ বকে, আর মা-বাবা অসি'র-পেরেশান হয়। আমিও পেরেশান। কোথায় ডাক্তার, হাসপাতাল জানি না। কী করণীয় তাও বুঝতে পারি না। এবিপদে যদি তাদের কোন উপকারে আসা যেতো, নিজের কাছে ভালো লাগতো।
বসে আছি পেরেশান, তখন ফিরেশতার মত উদিত হলেন ক্বারী নেয়ামতুল্লাহ। নিজের গাড়ীতে করে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। ছোটাছুটি করে সব ব্যবস্থা করলেন। পাকিস্তানি ডাক্তারও পেশার প্রতি নিষ্ঠার পরিচয় দিলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা প্রায় একসঙ্গে হলো। আমার দেশে হলে হয়ত বলা হতো, রিপোর্টসহ আগামীকাল দেখা করুন।
যাই হোক, আল্লাহর রহমতে তানবীর ধীরে ধীরে সুস্থ হলো। ক্বারী ছাহেবের আন্তরিকতায় নাজমুল করীম ভাই অভিভূত হলেন। আমিও কৃতজ্ঞতা জানালাম। বিপদের বন্ধুদের যদি আমরা ভুলে যাই, ক্ষতি আমাদেরই। কারণ আমলের আজর ও বিনিময় তো আল্লাহর কাছে। কিন্তু কৃতজ্ঞতার গৌরব থেকে বিচ্যুতি ঘটে মানুষের।
সেবার মসজিদে কোবায়, শোহাদায়ে অহুদের মাযারে এবং অন্যান্য স্থানে ক্কারী ছাহেবই আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন এবং আমরা আত্মিক তৃপ্তি লাভ করেছিলাম।
এমন ভালো মানুষটির একসময় বড় একটি বিপদ ঘটেছিলো। দেশে এসে আর যেতে পারেননি নিজেরই সরলতার ভুলে। পরে অবশ্য যাওয়া হয়েছে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে। কিন্তু তত দিনে ক্ষতি হয়ে গেছে অপূরণীয়। তবে আল্লাহর শোকর, বিপদের রাত এখন ভোর হতে শুরু করেছে। তার অনুভূতি হলো, ‘আল্লাহ যে আবার পেয়ারা হাবীবের শহরে এনেছেন তাতেই আমি শোকরগুজার।’
আল্লাহ তাকে ভালো রাখুন।
বিদায়ের বাকি আর মাত্র একদিন। এর মধ্যে যেতে হলো বেড়াতে, যা আমার একদম না-পছন্দ। আমার স্ত্রীর ফুফাত বোন থাকে মদীনায়। স্বামীর নাম আবু আহমদ। ভালো মানুষ। জোর করে সম্মতি আদায় করে নিলেন। তারপর দিনে তার অবসর নেই বলে সময় ঠিক করলেন এশার পর। এসে গাড়ীতে করে নিয়ে যাবেন। এলেন এবং আমাদের নিয়ে গেলেন। নতুন এলাকা। পথের দু’পাশে সবুজ বৃক্ষের সারি, আর ঝিরঝির বাতাস, খুব ভালো লেগেছিলো। তার ঘরে কিতাবের সংগ্রহ দেখে মুগ্ধ হলাম। ‘মাহাযার’ আপ্যায়ন করলেন, খুশী হলাম। বিদায়ের সময় প্রধান সড়কে এসে গাড়ী থেকে নামিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে বাস থামে। বাসার কাছাকাছি নামিয়ে দেবে। মুছাফাহা এবং মুআনাকা করে তিনি চলে গেলেন, আমরা বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাস এলো, আমরা উঠলাম। টিকেট নিতে হবে; পকেটে হাত দিয়ে বুঝলাম, ভুল হয়েছে। ভাগ্য ভালো, স্ত্রীর ব্যাগে দশ রিয়াল ছিলো এবং দশ রিয়ালেরই প্রয়োজন ছিলো। স্ত্রীদের এই রকম উপকারগুলো ভুলে যেতে আমরা স্বামীরা বেশ পটু।
বাস প্রায় যাত্রীশূন্য। আমরা ‘পাঁচজন’ বাদে তিনজন। গাড়ীর যিনি চালক তাকে বাদ দেই কেন? এটা কি আমাদের স্বভাব?! যাই হোক, যাত্রী না থাকায় যাত্রাটা বিনোদনের সঙ্গেই হলো। যাওয়ার পথে দেখিনি, এখন দেখলাম সুন্দর একটি ফোয়ারা। তাতে আবার আলোর বিচ্ছুরণ। এখন অবশ্য মদীনায় এধরনের ফোয়ারা ও বাগান বেশ ক’টি হয়েছে। অর্থাৎ যাকে বলে বিউটিফিকেশন ও সৌন্দর্যায়ন, তা ভালোই হচ্ছে।
বাস যেখানে আমাদের নামালো, সেটা বাসার কাছে ছিলো না এবং পথটাও আমার ভালো করে জানা ছিলো না। জিজ্ঞাসা করে করে হেঁটে হেঁটে শেষ পর্যন্ত অবশ্য পৌঁছতে পেরেছিলাম।
আজ বিদায়! দুপুরে বিদায় সালাম আরযকালে নাজমুল করীম ভাই ও আনওয়ার ভাই যেভাবে কাঁদলেন তা আমাকেও স্পর্শ করলো। মসজিদ থেকে বের হয়ে খোলা চত্বরে এসে মুনাজাত করলাম। আমি শুধু মুনাজাত করলাম; যারা আমীন আমীন বললেন, তারা জারজার কাঁদলেন। ইমাম ও মুক্তাদির মু‘আমালা এমনও হয়। ফিকাহর মাসআলায় মুক্তাদি ইমাম থেকে এগিয়ে গেলে মুক্তাদির নামায ফাসিদ। সেটা অবশ্য শুধু কাতারের ক্ষেত্রে। মর্যাদার ক্ষেত্রে মুক্তাদি তার ইমাম থেকে এগিয়ে থাকতেই পারে।
মুনাজাতে মনে মনে বললাম, হে আল্লাহ, চোখে আমার পানি নেই, দিলে আমার তাপ নেই। যারা আমীন বলছে, তাদের চোখের ও দিলের বরকতে আমাকেও তুমি কবুল করো।
ছেলে মুহম্মদ এতক্ষণ আমাদের সঙ্গেই ছিলো এবং চুপচাপ ছিলো। হঠাৎ বলে উঠলো, আব্বু, আমরা নবীজীর দেশে থেকে যেতে পারি না! আমাদের থাকতে দেবে না! তার এই একটি কথা বুঝিয়ে দিলো, তার ছোট্ট হৃদয়েও ‘তরঙ্গ’ আছে তার মত করে। অনেক কিছুই সে ভাবছে মনে মনে। হে আল্লাহ, তোমার এই ছোট্ট বান্দার ছোট্ট হৃদয়ের আকুতি একদিন না একদিন তুমি পূর্ণ করে দিয়ো।
নাজমুল করীম ভাইয়েরা বাসায় গেলেন, আমি ও মুহম্মদ সেখানে অপেক্ষা করলাম, উম্মে মুহম্মদ ও উখতে মুহম্মদের জন্য। কিছুক্ষণ পর তারা এলো মেয়েদের ওখান থেকে বিদায় সালাম আরয করে। আমরা অনেক্ষণ সেখানে বসে থাকলাম। সবুজ গম্বুজের স্নিগ্ধ সান্নিধ্যে হৃদয়ের তাপ ও উত্তাপ শীতল করার চেষ্টা করলাম। হায়, আর কি কখনো আসা হবে না নবীজীর শহরে, নবীজীর দরবারে! আর কি কখনো দেখা হবে না এই কুব্বাতুল খাযরার জামাল, এই সবুজ গম্বুজের সৌন্দর্য!
মেয়েটি আমার এমনই তন্ময় বিভোর ছিলো যে, আমার শুধু মনে হলো, সবুজের সান্নিধ্যপরশে সে নিজেই বুঝি সবুজ হয়ে গেলো। ইচ্ছে হলো, বলি, হে আল্লাহ, আমরা দু’জন ওর মা-বাবা!
বিদায় হে মদীনাতুর-রাসূল! বিদায় হে রাওযাতুর-রাসূল! ‘আবার আসিব ফিরে এই খেজুরের দেশে, এই সবুজের পরশ পেতে’!
পথের কথা এবার থাক। শুধু মানযিলের কথা বলি; গভীর রাতে পৃথিবীর জনপদগুলো যখন ঘুমিয়ে থাকে, আলোর শহর মক্কা তখনো জেগে থাকে। মক্কা চিরজাগ্রত, চির জীবন্ত। মক্কায় যে আছে বাইতুল্লাহ! আছে আবে যামযাম! গভীর রাতে আলোকিত মক্কায়, জাগ্রত ও জীবন্ত মক্কায় আমরা যখন পৌঁছলাম, মুহূর্তে দূর হয়ে গেলো আমাদের নিদ্রা ও ক্লান্তির জড়তা! জীবন ও সজীবতার পরশে আমরাও সজীব হয়ে উঠলাম। তুমি যখনই আসবে মক্কায়, সকালে-সন্ধ্যায়, দিনের দুপুরে এবং রাতের গভীরে, মক্কা তোমাকে তার মমতার কোলে তুলে নেবে, বাইতুল্লাহ তোমাকে রহমতের ছায়া দেবে। এবার গভীর রাতে মক্কায় এসে এমন অনুভূতিই আমার হলো। যৌবনের শুরু থেকে যখনই মক্কায় এসেছি, বাইতুল্লাহর সামনে দাঁড়িয়েছি, মক্কা আমাকে নতুন উপলব্ধি দান করেছে, বাইতুল্লাহ আমাকে নতুন প্রশান্তি উপহার দিয়েছে। আমি কৃতজ্ঞ হে মক্কা! আমি শোকরগুজার হে বাইতুল্লাহ! আমার ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীর জন্য মক্কার সৌভাগ্য ও বাইতুল্লাহর সা‘আদাত ছিলো এই প্রথম। তাই তাদের বুকের কম্পন ও হৃদয়ের স্পন্দন ছিলো অন্য রকম। মেয়েটিকে আমার মনে হলো, খুশিতে হাসতে চায়, পারে না, আনন্দে কাঁদতে চায়, পারে না। প্রশান্ত নীরবতাই ছিলো তার ভাব ও আবেগ এবং অনুভব ও অনুভূতির আশ্চর্য সুন্দর প্রকাশ। বাবা হিসাবে নিজেকে তখন আমার খুব ভাগ্যবান মনে হলো।
সালমানকে বললাম, যাও, তোমার স্ত্রীকে নিয়ে আল্লাহর ঘর দেখতে যাও। কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গেই যাবে। তাই হলো। আমরা একসঙ্গে হারামে প্রবেশ করলাম। আমার প্রিয় উম্মে হানিতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ঘর দেখলাম। ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী দেখলো জীবনের প্রথম দেখা। দেখলো, কাঁদলো এবং হাসলো। আল্লাহর ঘরের সামনে মানুষের এই হাসি-কান্নার দৃশ্য কত যে স্নিগ্ধ ও পবিত্র!
সবসময় দেখেছি, আমার মায়েরা, আমার মেয়েরা আল্লাহর ঘরের সামনে আমাদের চেয়ে অন্যরকম। সৃষ্টিতেই তারা বড় নাযুক ও কোমল! আল্লাহর নবীর ভাষায় কাওয়ারীর ও কাঁচের পাত্র! তার উপর কিছুটা দোষ ও দুর্বলতার কারণে, আর বাকিটা ত্যাগ ও আত্মত্যাগের গুণের কারণে জীবনের সবক্ষেত্রে তারা থাকে বড় অসহায়, নিভু নিভু অবস্থায়। এমনকি আল্লাহর ঘরে আসতেও তাদের লাগে কোন না কোন পুরুষের সঙ্গ ও নির্ভরতা। তাই যখন তারা এখানে আসে এবং আল্লাহর ঘর দেখে, তখন আমরা পুরোপুরি আল্লাহর বান্দা হতে না পারলেও তারা একেবারে আল্লাহর বান্দী হয়ে যায়! আল্লাহর ঘর দেখে আমরা খুশী হই, আনন্দে আপ্লুত হই, ভাবের তরঙ্গে আন্দোলিত হই, অনেক কিছু হই। কিন্তু তারা কিছু হয় না, কিছু হতে পারে না। শুধু দাঁড়িয়ে থাকে, আর তাকিয়ে থাকে! আল্লাহর যেন তখন দয়া লাগে! বাইতুল্লাহর যেন তখন মায়া জাগে। জীবনের কত রকম ঝড়ঝাপটার মুখেএত দিনের নিভু নিভু প্রদীপ যেন নতুন আলো লাভ করে! তারা আরো কোমল ও স্নিগ্ধ হয়, আরো সুরভিত ও পবিত্র হয়। গিলাফ ও বোরকার বর্ণই শুধু তখন এক হয় না, গিলাফের আড়ালে এবং বোরকার ভিতরেও কিছু একটা হয়। জীবনের সকল দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা ও লাঞ্ছনা-বঞ্চনা তারা তখন ভুলে যায়। তাদের চোখের তারায় তখন থাকে শুধু বাইতুল্লাহর ছবি, আর এই মিনতি, হে আল্লাহ, তোমার ঘর দেখেছি, আমার আর কোন দুঃখ নাই! হে আল্লাহ তোমার ঘরের তাওয়াফ করেছি আমার আর কোন কষ্ট নাই!
নারিত্বের কত লাঞ্ছনা ভোগ করেছি স্বামী ও সন্তানের হাতে, এমনকি ভাই ও বাবার হাতে, হে আল্লাহ, কারো প্রতি আমার কোন অভিযোগ নাই। সব ভুলে গেলাম, সবাইকে মাফ করে দিলাম!
আমার মায়ের ও বোনের ‘আল্লাহর ঘর দেখা’ আমি দেখিনি! আজ মেয়ে ও তার মায়ের আল্লাহর ঘর দেখা দেখতে পেলাম। আর একবার দেখেছি এক ‘জনমদুঃখিনী’র আল্লাহর ঘর দেখা। তার জীবনের প্রতিটি দিন ছিলো কষ্টের, প্রতিটি সকাল-সন্ধ্যা ছিলো বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার। জীবনে কারো কাছে তার চাওয়া ও পাওয়ার কিছুই ছিলো না; একটাই শুধু আকুতি ছিলো! একটাই শুধু মিনতি ছিলো! তোমরা কেউ নিয়ে যাও না একবার আমাকে আমার আল্লাহর ঘরে! কিন্তু কারো সময় ছিলো না, সুযোগ ছিলো না এবং .. এবং ইচ্ছাও ছিলো না। সারা জীবন সবার তিনি শুধু সেবাই করেছেন, আর হজ্বের সফরের সামান বেঁধে দিয়েছেন। কেউ তার সেবা করেনি; কেউ তার সামান বেঁধে দেয়নি!
জীবন্তযন্ত্রণার সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, আশা ও নিরাশার দোলাচলে দুলে দুলে জীবনের প্রায় সায়াহ্নে তিনি যখন আল্লাহর ঘর দেখলেন, তখন তার আল্লাহর ঘর দেখা আমি দেখেছি! আহা, কী শুভ্রতা ও পবিত্রতা! কী কোমলতা ও স্নিগ্ধতা! শান্তি ও প্রশান্তির কী জান্নাতি উদ্ভাস! তাকে দেখেছি, আর ভেবেছি, জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট তিনি ভুলে গেছেন। সকল বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন! তার চোখের পানি এখন কষ্টের নয়, শান্তির, তার নীরবতা এখন বেদনার নয়, প্রশান্তির! হে আল্লাহ, এতদিন মনে ছিলো, এখন মুখে আসতে চায়! বলবো হে আল্লাহ!ভুল হলে মাফ করে দিয়ো হে আল্লাহ! আমার বলতে ইচ্ছে করে হে আল্লাহ! কা‘বাঘর বানিয়েছেন ইবরাহীম, কিন্তু কা‘বাঘর স্ত্রী-হাজেরার!
কা‘বাঘরের পাথর বহন করেছেন ইসমাঈল, কিন্তু কা‘বাঘর মা-হাজেরার!
আমার বলতে ইচ্ছে করে, হে স্বামী, হে সন্তান, হে পিতা ও ভাই! যদি পারো তোমার স্ত্রীকে, মাকে, কন্যা ও বোনকে আল্লাহর ঘরে এনো। আল্লাহর ঘর দেখিয়ে তারপর দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়ো, জীবনের বহু অনাচার ও অত্যাচারের দায় থেকে তুমি মুক্ত হয়ে যাবে।
আল্লাহর ঘর আগেও দেখেছি, আগেও তাওয়াফ করেছি এবং ছাফা-মারওয়ায় দৌড় দিয়েছি। এখানে আমি আল্লাহর নেক বান্দা হাফেজ্জীর ছোহবত লাভ করেছি। কিন্তু স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে আল্লাহর ঘর দেখা এবং তাওয়াফ ও সাঈ করা জীবনে এই প্রথম। আজ যখন আল্লাহর ঘর দেখলাম, আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করলাম, দুই সবুজের মাঝে দৌড় দিলাম, আর মেয়ে ও তার মা ধীর শান্ত পদক্ষেপে সবুজ সীমানা পার হলো তখন সবকিছুতে নতুন স্বাদ ও শান্তি, নতুন তৃপ্তি ও প্রশান্তি পেলাম। মনে হলো, গায়ব থেকে বলা হলো, এবার তুমি হে বান্দা, আমার পেয়ারা মেহমান, আমার দুই বান্দীকে যে সঙ্গে এনেছো!
আজ বিশে রামাযান। একটু একটু করে এগিয়ে আসাছে সময় ই‘তিকাফের। আমিও শামিল হলাম হারামের ই‘তিকাফে। নাজমুল করীম ভাইয়েরা ছিলেন, তাই ই‘তিকাফ করা সহজ হলো, ই‘তিকাফ করলাম। মাকে ও ভাইকে হারামে ছেলেই আনা-নেয়া করতো। ছোট্ট হলেও ছেলে তো, ভাই তো! ছোট্ট হলেও ‘বাবার বেটা’ তো! সাতাশ তারিখে তো জনসমুদ্রের মধ্যেই তারাবীর আগে মা ও বোনকে তাওয়াফ পর্যন্ত করিয়ে আনলো! ‘ইনশাআল্লাহ পারবো’ বলে নিয়ে গেলো এবং আলহামদু লিল্লাহ পারলো।
কত কথা আজ মনে পড়ছে! দিলের পর্দায় কত ছবি ভেসে উঠছে! বিস্মৃতির আড়াল থেকে কত স্মৃতি জেগে উঠছে! সবকিছু বলা কি সম্ভব, না সঙ্গত!
ঈদের পর নাজমুল করীম ভাই বললেন, আমরা দুবাই হয়ে, সেখানে বেড়িয়ে দেশে যাবো, আপনারাও চলুন সঙ্গে।
ছেলে বললো, না আব্বু, আমরা আল্লাহর ঘরে থাকবো। মেয়ে বললো আমার মায়ের মত, ‘আল্লাহর ঘরের শান্তি ছেড়ে কোথায় যাবো!’
নাজমুল করীম ভাইয়েরা গেলেন। সালমান তাদের জিদ্দায় বিমানে তুলে দিয়ে এলো। আমাদের টিকেট পরিবর্তনের দৌড়ঝাঁপও সেই করলো, আমাকে কিছু করতে হলো না, কিছু ভাবতে হলো না। বোঝা গেলো, আমি আরেকটি ছেলে পেয়েছি। এ অনুভূতি একজন কন্যার পিতার জন্য কত যে শান্তিদায়ক তা শুধু আল্লাহ জানেন।
রামাযানের পর সমাগম ধীরে ধীরে হালকা হতে লাগলো। একদিন আমার বাবা বলে, আব্বু, আমার না, হাজরে আসওয়াদ চুমু খেতে ইচ্ছে করে। মাসুম বাচ্চার এমন পবিত্র ইচ্ছা পুরা করার চেষ্টা তো করতে হয়। তখন আমি যুবক ছিলাম না, তবে এখনকার মত বুড়োও ছিলাম না। তাওয়াফের পর বিসমিল্লাহ বলে অগ্রসর হলাম। কাছে গিয়ে ছেলেকে কাঁধে নিলাম। একসময় খুব কাছে পৌঁছে গেলাম এবং .. এবং তখনই বুঝলাম কত বড় ভুল করেছি! এগুতে তো পারছিই না, পিছাতেও পারছি না। তার উপর প্রচ চাপে দিশেহারা অবস্থা। ছেলে বুঝতে পেরেছে পরিসি'তিটা। বলে কি, আব্বু আমাকে নামিয়ে দাও!
চোখে তখন অন্ধকার নেমে আসছে। মনে হলো এবার পড়েই যাবো। তাতে পরিণতিটা কী হতে পারে! আল্লাহ, তুমি হেফাযত করো!
এবং আল্লাহ হেফাযত করলেন। হাজরে আসওয়াদের সঙ্গে একটু উঁচু স্থানে যে সিপাহী দাঁড়িয়ে থাকেন, তিনি অবস্থা বুঝতে পারলেন। বুঝতে পেরে ছেলেকে আমার কাঁধ থেকে নিয়ে তার পাশে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমি নিশ্চিত পতন থেকে রক্ষা পেলাম। সিপাহী সঙ্গতভাবেই আমাকে কঠোর তিরস্কার করলেন। খারাপ লাগেনি, কারণ আমার পাওনা ছিলো আরো বেশী।
আছর হতে তখন বেশী বাকি নেই। ধীরে ধীরে কাতার তৈরী হচ্ছে। বাবাকে নিয়ে কাতারে বসলাম। তাওয়াফের তখন সাময়িক বিরতি। শৃঙ্খলারক্ষাকারী পুলিশেরা হাজরে আসওয়াদ ঘিরে রেখেছে। হঠাৎ আল্লাহ তা‘আলা একটি চিন্তা দান করলেন। ছেলেকে বললাম, বাবা, তুমি যাও। তুমি মাসুম বাচ্চা, তোমাকে কিছু বলবে ন।
সত্যি কেউ কিছু বললো না। একজন বরং কোলে নিয়ে সাহায্য করলো হাজরে আসওয়াদে চুমু দিতে। শোকর আলহামদু লিল্লাহ। ছেলে আমার, মুখে বিশ্বজয়ের হাসি নিয়ে ফিরে এলো। আমার দিলের খুশিও তখন উপচে পড়ার মত, এমনকি অন্যরাও আনন্দ প্রকাশ করলো এবং আদর করলো। সেই ছোট্ট ছেলে মুহম্মদের বয়স এখন কত! মুহম্মদ বিন কাসিমের চেয়ে মাত্র কয়েক মাস কম!
এ সফরে পরিচয় হলো ভাই মনছূরের সঙ্গে। পরিচয়ের দৃশ্যটি বেশ চিত্তাকর্ষক। সম্ভবত আছরের পর উম্মে হানিতে বসে আছি। তিনি কাকে যেন তালাশ করছেন। কাছে এসে আমাকেই আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম, এমন করে কেউ যদি আমাকে পেতে চায়, আর আমার তা ভালো লাগে, তাহলে কি খুব দোষের হবে?! অপ্রত্যাশিত আনন্দে তিনি যেন আত্মহারা হলেন। ভালোবাসার কত কথা বললেন! মুহব্বতের কত আফসানা শোনালেন! এমন ভালোবাসা ও ভক্তি-মহব্বত কার না ভালো লাগে! কার না পেতে ইচ্ছে করে! যদি তা হয় আল্লাহর পথে, আল্লাহর জন্য!
অদ্ভুত একটা বিষয়! আমাকে যারা মুহব্বত করে, তারা আমাকে শুধু খেতে বলে। ভাই মানছুরও দেখি ব্যতিক্রম নন। কখনো ঘরের খাবার, কখনো হোটেলের, খেতে তোমাকে হবেই। এ যেন সেই কথা, ‘মান ইয়া না মান, তু মেরা মেহমান’! কখনো রীতিমত মুজাহাদা করতে হয়েছে। তবু খেয়েছি। কারণ আমি খেতাম আর তার মুখে দেখা দিতো তৃপ্তির উদ্ভাস। এটা আমার দেখতে ইচেছ করতো। আমার জানা সত্য হোক, তাকে আমার মুখলিছ মনে হয়। তার মুহব্বত আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। অবশ্য প্রত্যেকেরই মুহব্বতের আলাদা স্তর থাকে এবং তা প্রকাশের নিজস্ব ‘আদা ও আন্দায’ থাকে। ঐ সফরে এবং পরে তিনি আমাকে অনেক কিতাব দিয়েছেন। তিনি সপরিবারে থাকতেন মক্কার অদূরে নাকাসা অঞ্চলে। আমি যাইনি, তবে আমার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরা তার বাসায় বেড়িয়েছে। বিপদ ও মুছীবত ভালো মানুষের ভাগে বেশী পড়ে। তিনিও বেশ বড় বিপদে পড়েছিলেন, আবার আল্লাহ মেহেরবান উদ্ধারও করেছেন। এখন তিনি দেশে আছেন। আশা করি, ইনশাআল্লাহ আমাদের মুহব্বত জান্নাত পর্যন্ত ‘কায়েম, দায়েম’ থাকবে।
পবিত্র ভূমিতে আমাদের অবস্থানের মেয়াদ দশদিন বেড়েছে। হঠাৎ মনে হলো। আমরা তো আবার মদীনা শরীফের ছফর করতে পারি! আবার রওযা শরীফ যিয়ারত করতে পারি! আবার ইহরাম ধারণ করে আল্লাহর ঘরে ফিরে আসতে পারি! শুনে সবাই খুশী হলো। সাফফানার খুশিটাই যেন বেশী! তবে প্রকাশে ওর সংযম থাকে। ওর আনন্দ বলো, বেদনা বলো, তার প্রকাশ উদ্ভাসে ও ছায়াতে, অন্যকিছুতে নয়।
এই সফরে সালমানও আমাদের একজন হলো। নিজেকে বড় ভারমুক্ত মনে হলো, আর কোন সফরে যা মনে হয়নি। সব আয়োজন সে-ই করলো। আমি শুধু গাড়ীতে উঠলাম। ছেলে বড় হলে তো বেশ আরাম!
দিনের আলোতে আবার মদীনার পথের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম, আবার মদীনার পথে চলার আনন্দে বিভোর হলাম। সবকিছু আবার যেন নতুন করে হলো। আবার ছাল্লে ‘আলা...! আবার বুকের দুরু দুরু কম্পন! হৃদয়ের গভীরে আবার অপূর্ব শিহরণ! আবার খেজুরবাগান! দূর থেকে আবার ‘ঐ যে মিনার! ঐ যে মিনার!’ এবং আবার সবুজ গম্বুজ অবলোকন! হে আল্লাহ, বান্দাকে তুমি কত রকম করে আদর করো! সমাদর করো! আনন্দ দাও! পুলকিত করো! আমরা তো কিছু করি না, তবু কেন তুমি এত কিছু করো! তাহলে একটু শোকর আদায় করার, একটু কৃতজ্ঞ থাকার তাওফীকও দান করো!
আবার রাওযা শরীফে দুরূদ ও সালামের নাযরানা, আবার রিয়াযুল জান্নায় ছালাতে শোকরানা! আবার ছুফফার মাকামে হাযিরি মু‘আদ্দাবানা! কল্পনায়ও ছিলো না, এত নিকটে, এত সহজে আবার হবে এত সৌভাগ্য! বান্দার কল্পনার চেয়ে বড়ই হয় আল্লাহর দান। ‘ওয়ালা খাতারা আলা কালবি বাশার’, দুনিয়াতেও আছে এর ছায়া ও ছোঁয়া। তোমার শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর!
মদীনা শরীফে পরিচিত যারা ছিলো কাউকে আর জানালাম না, আমাদের আগমন্তসংবাদ। কারণ মাওলার ইশারায় মাহবূবের মদীনায় এটা তো ছিলো আমাদের গোপন অভিসার!
সালমান সঙ্গে আছে, তাই আমি মসজিদে নামায পড়ি, মসজিদেই পড়ে থাকি। রাত্রে একবার যাই, আর বাবুস-সালামের দুয়ার খোলার আগে ফিরে আসি। ভোরের রাঙ্গা সূর্য আমাদের গায়ে মুঠি মুঠি আলো ছড়ায়, আমরা মা-বাবা এবং আমাদের ছেলে-মেয়ে সবুজ গম্বুজের কাছে বসে থাকি। আমাদের কাছে আবার যেন ফিরে আসে সোনালী যুগের মদীনা! ভুল বলেছি, আমরা যেন ফিরে যাই নূরানি যুগের নূরের মদীনার কাছে!
কত কম সময়ে পার হয়ে গেলো তিনটি রাত, তিনটি দিন! সময় তো পার হলো, কিন্তু কখনো যা মনে হয়নি, এবার তা মনে হলো। সবুজ গম্বুজ যেন বলছে, আমার ছায়ায় থাকো আরো দু’টি দিন! আহা, কী অপার শান্তির, কী পরম সৌভাগের দু’টি দিন! এমন সুখের দিনের স্মৃতিচারণ করেই বুঝি আরবের কবি বলেছেন্ত
سقى اللـه تلك الأيام
সেই দিনগুলোকে তুমি হে আল্লাহ, রাখো সিক্ত সজীব!
সবুজ গম্বুজ থেকে এবার যেন ইশারা হলো, ‘আবার এসো’!
সেদিন রাতে কারো মন চায় না বাসায় যেতে! উন্মুক্ত চত্বরে আলোর বন্যার মধ্যেই বসে থাকলাম। একটি আরব পরিবার ছিলো সেখানে। আমার ছেলের বয়সেরই একটি ছেলে ছিলো। ভাষা ও ভূগোল সব ভুলে দু’টিতে কেমন এক হয়ে গেলো! ছোটাছুটি করলো, জড়াজড়ি করলো। হাসলো, খেললো, ভালোবাসা নিলো, ভালোবাসা দিলো। তারপর! হাত নেড়ে বিদায়, হয়ত চিরকালের জন্য! ওরা দু’জনেই ভুলে গেছে, মুহূর্তের বন্ধুত্ব! কিন্তু আমার মনের পর্দায় সেই যুগল ছবি আঁকা হয়ে আছে চিরকালের জন্য।
সকালে বিদায় যিয়ারত এবং আখেরি সালাম; বিকালে রওয়ানা! এই রওয়ানা তো চলছে চিরকাল, মদীনা থেকে, মক্কা থেকে এবং যিন্দেগি থেকে, পার্থক্য শুধু ‘কোই আগে, কোই পীছে’!
যুলহোলায়ফা থেকে ইহরাম গ্রহণ করা হলো। আবার আমরা বাইতুল্লাহর মুসাফির। আবার দেহে আমাদের সাদা লেবাসের শুভ্রতা এবং হৃদয়ে ইহরামের পবিত্রতা। ছোট্ট ছেলেকে সেই ছোট্ট ইহরামে আবার দেখা হলো, বড় ভালো লাগলো!
কিছু দূর আসার পর হয়ত গায়বের ইচ্ছে হলো, আরো কিছুক্ষণ থাকি আমরা মদীনার কাছে। তাই যান্ত্রিক ত্রুটির ‘বাহানায়’ গাড়ী থেমে গেলো। সেখানে সন্ধ্যা হলো, বালুর টিলার আড়ালে সূর্য অস্ত গেলো। আমরা মরুভূমির ভিতরে কিছু দূর গেলাম। বালুর মুছল্লায় মাগরিব আদায় করলাম। মদীনার পড়শী বালুর নরম ছোঁয়া কী যে ভালো লাগলো! পূর্ণিমার পথে অগ্রসর চাঁদটি ছিলো আকাশে! মেঘ ছিলো, তাই কিছুটা আলো, কিছুটা ছায়া ছিলো। সেই আলো-ছায়ার মাঝে কিছুক্ষণ আমরা যেন বাঁধা ছিলাম অপূর্ব এক মায়ার জালে! এখনো আমার মনে আছে মেঘ ও চাঁদের সেই আলো-ছায়া, সেই বালুর টিলা, সেই বালুর নরম ছোঁয়া!
কুদরতের বরাদ্দ সময়টুকু শেষ হলো, তাই যান্ত্রিক ত্রুটি দূর হলো এবং গাড়ীর যাত্রা আবার শুরু হলো। ষ
(চলবে ইনশাআল্লাহ)