তিনটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপির মুদ্রণ: ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর মাসানীদ ও মানাকিবের কিতাবসমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
বর্তমান সংখ্যায় ইচ্ছা ছিল সালাতুত বিতর বিষয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধটির উপর আলোচনা করব, কিন্তু এবার হজ্বের সফরে আল্লাহ তাআলা নিজ ফযল ও করমে যে নেয়ামত দান করেছেন সাথীদের নিবেদন, আলকাউসারের পাঠকদেরকেও তাতে শরীক করা হোক। তাই বর্তমান সংখ্যায় এ বিষয়েই কিছু আরয করি।
এই লেখার যে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে তার উপর ইনশাআল্লাহ মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার দারুত তাসনীফের কোনো সাথী লিখবেন, আমি কয়েকটি বিক্ষিপ্ত কথা আরজ করেই শেষ করব।
১. হজ্বের মূল ফায়েদা তো তাওহীদ ও ইত্তেহাদের জযবা নতুন করে আহরণ করা। তাওহীদের ইমাম সাইয়েদুনা ইবরাহীম আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম ও সাইয়েদুনা মুহাম্মাদ মুসতাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহ দর্শন করে এবং তাঁদের সম্মানিত আ’ল ও আসহাব ও আল্লাহর নেক বান্দাদের ইখলাস ও কোরবানীর নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে ঈমানী কুওয়ত ও হিম্মত এবং কলবের পাকিযগী ও তহারাত হাসিল করা এবং শাআইরুল্লাহ ও মাশাইরে মুকাদ্দাসা তথা আল্লাহর ইবাদতের নিদর্শনাবলি ও পবিত্র স্থানসমহের সম্মান ও তাজীমের বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে নিজের মধ্যে নূর ও নূরানিয়াত এবং তাকওয়া ও খাশিয়াত পয়দা করা, সর্বোপরি বার বার লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকের অযীফা পাঠের মাধ্যমে ইহসান ও ইহতিসাব পয়দা করা, কিন্তু এই সব ফায়েদা ছাড়াও প্রত্যেক শ্রেণীর যিয়ারতকারীর উপযোগী আরো বহু ধরনের ফায়েদা হজ্বের দ্বারা হাসিল হয় বা হাসিল করা যায়। এই সকল কিছুই আল্লাহ তাআলার বাণী-
ليشهدوا منافع لهم
এর উমূম-ব্যাপকতার অন্তর্ভুক্ত। তালিবানে ইলমের উপযোগী একটি ফায়েদা হল, কোনো আহলে ফিকহ আলিম বা ছাহিবে দিল বুযুর্গের সাথে সাক্ষাত হওয়া, কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির নিকট থেকে কোনো ইলমী বিষয় জানতে পারা কিংবা কোনো ভালো রিসালা বা কিতাবের সন্ধান পাওয়া ইত্যাদি।
সালাফের যুগে উলামা-তালাবার হজ্ব ও যিয়ারতের সফর যেমন ইবাদতের সফর ছিল তেমনি দ্বিতীয় পর্যায়ে তাহসীলে ইলম, তালীম ও তারবিয়াতেরও সফর ছিল। এটি হজ্বের তারীখ, ইলমের ইতিহাস এবং আসমাউর রিজালের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ সংক্রান্ত বিক্ষিপ্ত তথ্যাবলি যদি একত্র করা যায় তাহলে কয়েক খণ্ডের দীর্ঘ গ্রন্থ প্রস্তুত হতে পারে।
হজ্বের মুসাফিরদের মধ্যে যারা আহলে দিল মানুষ, তারা তো সর্বক্ষণ মূল ফায়েদার দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন, এরপর অন্যান্য বিষয় আপসে আপ যতটুকু হাসিল হয় তাতেই আল্লাহর শোকরগোযারী করেন। কিন্তু আল্লাহ মাফ করুন হজ্ব ও যিয়ারতের সফরে, যা শুধু আল্লাহর ফযল ও করমেই হয়েছে, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ইলমী ফায়েদা হাসিলও ছিল আমার একটি আলাদা কাজ। এবার তো অনেকটা পোখতা ইরাদাই ছিল যে, কোনো কুতুবখানার ধারে কাছেও যাব না, কিন্তু এরাদা ঠিক রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে কয়েকটি কুতুবখানার যিয়ারত হয়েছে। পরে মনে হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলার রহমতই আমাদের টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
ইয়া আল্লাহ! আমাদের যা কিছু দ্বীনী কাজ তা যেন নিছক স্বভাবের প্রেরণা থেকে না হয়; বরং দ্বীনী চেতনা থেকে শুধু তোমার রেযামন্দির জন্য হয়।
اللهم لا تجعلنا من الأخسرين أعمالا الذين ضل سعيهم في الحيوة الدنيا وهم يحسبون أنهم يحسنون صنعا، اللهم لا تجعلنا منهم ولا معهم
২. জামেয়া উম্মুল কুরা (আযীযিয়া শিমালিয়া)র দিকে যেতে রাস্তার দুই পার্শ্বে আলমাকতাবাতুল মাক্কিয়াহ, মাকতাবা ইসমাইল, মাকতাবাতুল ইমদাদিল ইলমী, মাকতাবাতুল আসাদী প্রভৃতি কুতুবখানা রয়েছে। রাস্তা থেকে জামেয়ার মাদখালের দিকে এলে ডান দিকে আলমাকতাবাতুল মাক্কিয়া ও উল্টা দিকে অন্যান্য কুতুবখানা পড়বে। ফেরার সময় মাকতাবাতুল আসাদীকে ডানে রেখে রাস্তায় পৌঁছার পর ডান দিকে কিছু দূর গেলে মাকতাবাতুল আসাদীর বড় ‘মা’রিয’ পাওয়া যাবে। এগুলো ছাড়াও জামেয়া উম্মুল কুরার নিকটে আলমুছতাশফাত তুনিসীর আশেপাশে দুটি বড় কুতুবখানা আছে : একটি মাকতাবাতুর রুশদ, যা একটি বড় তিজারতি কুতুবখানা। এর প্রধান কেন্দ্র সম্ভবত রিয়াদে, সৌদী আরবের বিভিন্ন জায়গায় এর অনেকগুলো শাখা আছে। দ্বিতীয় কুতুবখানাটি হচ্ছে মাকতাবাতুল হারামিল মাক্কী। এটি একটি প্রাচীন ইলমী ও মারজিয়ী কুতুবখানা। আগে মিনায় ছিল এখন জামেয়া উম্মুল কুরার কাছে অবস্থিত। এতে অনেক দুর্লভ পাণ্ডুলিপি রয়েছে।
আগে মসজিদে হারামের কাছে কয়েকটি বড় বড় কুতুবখানা ছিল। যেমন বাবুল উমরার সামনে আলমাকতাবাতুল ইমদাদিয়া, বাবুল ফাতহের অদূরে আলমাকতাবাতুল মাক্কিয়ার একটি শাখাসহ আরো কয়েকটি কুতুবখানা। আরেকটু সামনে গেলে দারুল মিনহাজ, মাকতাবা মুসতাফা আলবায, অতপর বড় বড় কুতুবখানা ছিল। এখন হরমের তৃতীয় সমপ্রসারণের কারণে এই এলাকায় বেশ রদ-বদল হচ্ছে। এজন্য এইসব কুতুবখানা বা তার অধিকাংশই আর এখানে নেই। মুসতাফা নাযযারের কুতুবখানা এখন শারিয়ে মানসুরে ব্রিজের নিকট এবং আব্বাস আলবায এর কুতুবখানা সোলাইমানিয়াতে অবস্থিত।
আলমাকতাবাতুল ইমদাদিয়া এখন মিসফালার শেষ প্রান্তে চলে গেছে। হরম থেকে শারিয়ে ইবরাহীম খলীল ধরে চললে যেখানে ‘মাওয়াক্বিফে কুদাই’র ইশারা রয়েছে সেখান থেকে বামে মোড় নিলে এবং আলবেনকুল আরাবীকে ডানে রেখে কিছু দূর এগোলে ডান দিকে আলমাকতাবাতুল মক্কিয়ার মিসফালা-শাখা এবং আরো কিছু দূর এগিয়ে ডানে গেলে মসজিদের সাথে আলমাকতাবাতুল ইমদাদিয়া অবসি'ত।
তবে নাদির ও দুষ্প্রাপ্য কিংবা সদ্যপ্রকাশিত গ্রন্থসমূহের জন্য এবং শুধু গবেষকদের প্রয়োজন হয় এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সমসাময়িক বিষয়ের উপর লিখিত বইপত্রের জন্য মদীনা মুনাওয়ারা, জিদ্দা ও রিয়াদের বড় বড় কুতুবখানায় খুঁজতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈরুত ও কায়রোর কুতুবখানাগুলির সাথেও যোগাযোগ করতে হয়। আর আনদারুন নাওয়াদির বা অতি দুর্লভ শ্রেণীর কিতাবপত্র তো আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গ্রন্থমেলাতেও পাওয়া যায় না। সেসব কিতাবের জন্য এককথায় পুরা হিম্মত কোরবান করতে হয়, যদি মুহাব্বত ও খাঁটি তলব থাকে তাহলে অবশ্যই আল্লাহর নুসরত হয়ে থাকে। নাদির ও দুর্লভ গ্রন্থ সংগ্রহের বিষয়টিও আমাদের ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়, যার উপর স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রন্থ রচিত হতে পারে। যাইহোক, বিভিন্ন কুতুবখানা ও তার অবন্থান সম্পর্কে আলোচনা করা এ নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হল কত সহজে কত বড় নেয়ামত আল্লাহ তাআলা দান করেছেন তা বোঝানো। আমরা কয়েক সাথী আলমাকতাবাতুল মক্কিয়ায় দাখিল হলাম। সম্ভবত রিদওয়ান ছাহেব বললেন, এই যে দেখুন ‘ফাযাইলু আবী হানীফা ওয়া আসহাবিহী’’। কিছুক্ষণ পর আরেক সাথী দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন ইবনে খসরূ সংকলিত মুসনাদুল ইমামিল আ’যম-এর দিকে। আমি বললাম, ভাই! আর কিছু না, এই কিতাবগুলির জন্যই আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এদিকে এনেছেন। ফিরে এসে ‘ফাযাইলু আবী হানীফা’ কিতাবটির বাইনা ইয়াদাইল কিতাব পড়ে জানতে পারলাম যে, আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ হারিছী সংকলিত ‘মুসনাদুল ইমামিল আ’যম’ ও প্রকাশিত হয়েছে। এই দুটি কিতাবের প্রকাশক আলমাকতাবাতুল ইমদাদিয়ায় ফোন করলে জানানো হল, মিসফালাহতেই তৃতীয় কিতাবটিও পাওয়া যাবে, এর জন্য উম্মুল কুরার সামনের মাকতাবাতুল ইমদাদিল ইলমীতে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। ইশার পর দুই সাথী আলমাকতাবাতুল ইমদাদিয়া মিসফালায় পৌঁছলেন। আল্লাহর শোকর, তৃতীয় কিতাবটিও সেখানে পাওয়া গেল।
এই কিতাবগুলি পেয়ে আমার মনে পড়ে গেল হযরাতুল উস্তায, আলহুজ্জাতুল কুদওয়াহ মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী রাহ. (১৩৩৩ হি.-১৪২০ হি.) এবং লাজনাতু ইহয়াইল মাআরিফিন্ নুমানিয়া হায়দারাবাদের আল্লামা আবুল ওয়াফা আফগানী রাহ. (১৩১৩ হি.-১৩৯৫ হি.) এর ইলমী যওকের কথা এবং আমাদের সংগৃহীত কিতাবগুলির জন্য ও এ ধরনের অন্যান্য কিতাবের জন্য তাদের তড়প ও অস্থিরতার কথা। এমন এক হালত পয়দা হল যে, আর থাকতে পারলাম না। সাথীদের কাছে আরজ করলাম, ইমাম আবু হানীফা রা.-এর সীরাত ও ফাযাইল এবং জীবন ও বৈশিষ্ট্যের উপর লিখিত প্রাচীন কিতাবসমূহের মাঝে আবুল কাসিম ইবনু আবিল আওয়ামের এই কিতাবটি শীর্ষস্থানীয়। মুহাদ্দিস আবুল কাসিম হিজরী তৃতীয় শতকের শেষ ও চতুর্থ শতকের প্রথম দিকের ব্যক্তিত্ব। তিনি ইমাম নাসাঈ (২১৫ হি.-৩০৩ হি.), আবু বিশর দুলাবী (২২৪ হি.-৩১০ হি.), ইমাম তহাবী (২৩৯ হি.-৩২১ হি.) প্রমুখ বিখ্যাত ইমামগণের শাগরিদ।
মানাকিব ও ফাযাইল বিষয়ে লেখক-সংকলকদের মাঝে তাসাহুল-শিথিলতার রেওয়াজ আছে, কিন্তু মুহাদ্দিস আবুল কাসিম সতর্ক ও মুহতাত এবং মুতকিন ও নিষ্ঠাবান মুহাদ্দিসগণের মতো সকল রেওয়ায়েত সনদসহ বর্ণনা করেছেন এবং মাশাআল্লাহ তাঁর সনদের অধিকাংশ রাবী মশহুর ও সুপরিচিত।
মোল্লা আবদুল কাদের আফগানী নামে একজন আলিম গত হয়েছেন। শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর নেগরানীতে কয়েকটি মাখতূতা থেকে এই কিতাবটি পরিষ্কার করে নকল করেছিলেন, যার একটি ফটোকপি হযরত নুমানী রাহ.-এর সংগ্রহে ছিল। হযরতের কাছেই প্রথম এই কিতাবটি দেখি। হযরতের ইজাযতে তার কয়েকটি ফটোকপিও করেছিলাম এবং একটি কপি দারুল উলূম করাচির কুতুবখানাতেও হাদিয়া দিয়েছিলাম। পরে শায়খ রাহ.-এর কাছে মূল নুসখা দেখার সৌভাগ্য হয়। শায়খ আমাকে বলেছিলেন, মোল্লা আবদুল কাদির একজন নেক মানুষ। তার শ্রবণশক্তি মাযুর ছিল, তাই কানে শুনতেন না। কয়েকজন শায়খের সাথে যোগাযোগ করেছেন, কেউ তার খেদমত করেননি। আলহামদুলিল্লাহ, আমি তাঁর খেদমতের চেষ্টা করেছি। যা কিছু বলার দরকার হত কাগজে লিখে দিতাম (অথচ শায়খের দৃষ্টিশক্তিও এত দুর্বল ছিল যে, লেখার জন্য তাঁকে মেশিনের সহায়তা নিতে হত।)
হামিলীনে ইলমের মাঝে যারা বিভিন্ন বিশিষ্টতার অধিকারী ছিলেন, আইম্মায়ে হাদীস, হুফফাযে হাদীস ও মুহাদ্দিসগণ তাঁদের বর্ণিত হাদীসগুলোকে, অন্য ভাষায় বললে তাদের সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহকে আলাদা কিতাবে সনদসহ সংকলন করেছেন। এই ধরনের সংকলনসমূহের একটি শিরোনাম হল ‘মুসনাদ।’ অবশ্য ঐ সব কিতাবকেও মুসনাদ বলে, যেগুলিতে শুধু মারফূ হাদীস সাহাবীদের নামের ক্রম-অনুসারে সংকলন করা হয়েছে। যেমন মুসনাদে তয়ালিসী, মুসনাদে আহমদ, মুসনাদে ইবনে আবী শাইবা, মুসনাদে আবদ ইবনে হুমাইদসহ শত শত কিতাব। কিন্তু মুসনাদ শব্দটি প্রথমোক্ত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। যাই হোক, ইমাম আবু হানীফা রাহ. (৮০ হি.-১৫০ হি.) ঐসব খোশ কিসমত ব্যক্তিদের অন্যতম, যাদের রেওয়ায়েতকৃত হাদীস ও আছারের অনেক মুসনাদ তৈরি হয়েছে। ঐ মুসনাদ সংকলকদের মাঝে বড় বড় ইমাম ও হাফিযুল হাদীসও রয়েছেন।
দেড় দশকেরও আগে ইমাম আবু নুয়াইম আসপাহানী (৩৩০ হি.) সংকলিত ‘মুসনাদু আবী হানীফা’ নযর আলফারাবী নামক একজন নওজোয়ান আলিমের তাহকীক-সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। এরপর আমাদের হযরতুল উসতাযের ছাহেবযাদা ড. আবদুশ শহীদ নুমানী-হাফিযাহুমাল্লাহু ওয়া রাআহুমা-এর তাহকীক-সম্পাদনায় দীর্ঘ ভূমিকা ও টীকা-টিপ্পনীসহ প্রকাশিত হয়েছে।
আল্লামা আবুল ওয়াফা আফগানী রাহ. ‘তুরকিয়া’র প্রাচীন কুতুবখানাসমূহ থেকে কয়েকটি ‘মুসনাদের’ ফটোকপি বা নকল সংগ্রহ করেছিলেন পরে হযরত নুমানী রাহ.ও সম্ভবত তিনটি মুসনাদের কপি সংগ্রহ করেছিলেন। দু’জনই এই মূল্যবান পাণ্ডুলিপিগুলোর উপর কাজ করতে চেয়েছেন কিন্তু আল্লাহ তাআলা এ কাজ তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরী শায়খ লতীফুর রহমান আলবাহরাইজির মাধ্যমে করিয়েছেন। তাঁর সম্পাদনায় প্রথমে মুহাদ্দিস ইবনে খসরূ (৫২২ হি.) সংকলিত মুসনাদুল ইমামিল আযম’ দুই জিলদে, এরপর মুহাদ্দিস আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ হারিছী (৩৪০ হি.) সংকলিত ‘মুসনাদুল ইমামিল আযম’ দুই জিলদে, অতপর আবুল কাসিম ইবনু আবিল আওয়াম সংকলিত ‘ফাযাইলু আবী হানীফা’ এক জিলদে প্রকাশিত হয়, যার একটি বড় অধ্যায়ে ‘মুসনাদু আবী হানীফা’ এবং বেশ কয়েকটি অধ্যায়ে ইমাম ছাহেব রাহ.-এর বিভিন্ন সঙ্গীদের আলোচনাও রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা সম্পাদক, প্রকাশক এবং এ কাজের প্রেরণাদাতা শায়খ মালিক আবদুল হাফীয মক্কী-হাফিযাহুল্লাহু ওয়া রাআহু-কে গোটা উম্মতের পক্ষ থেকে জাযায়ে খায়র দান করুন। আমীন।
মুহাদ্দিস আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ হারিছী সম্পর্কে হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ.-এর হাওয়ালায় বলেছিলাম যে, তিনি এই ‘মুসনাদ’ অত্যন্ত পরিশ্রম করে সংকলন করেছেন। ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে তাঁর আরো দুটি কিতাব আছে : ১. কাশফুল আছারিশ শারীফাহ ফী মানাকিবিল ইমাম আবী হানীফা। এই কিতাবটিও অচিরেই প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ।
ইতিহাসে আছে, আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ হারিছী যখন এই কিতাব ‘ইমলা’ করাতেন তখন হাজিরীনের সংখ্যা এত অধিক হত যে, চার শত মুসতামলি’র প্রয়োজন হত।
ولما أملي مناقب أبي حنيفة كان يستملي عليه أربع مئة مستمل
(আলজাওয়াহিরুল মুযিয়্যাহ, আবদুল কাদির আলকুরাশী ২/৩৪৫)
মুসতামলির কাজ অনেকটা নামাযের মুকাব্বিরের মতো। সে সময় যেহেতু লাউড স্পিকার ছিল না, তাই বড় মাজমায় শায়খের কথা সবার নিকটে পৌঁছানোর জন্য মুসতামলীর প্রয়োজন হত।
২. ওয়াহামুত তবাকাতিয যালামাতি আবা হানীফা, শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ. (৭৪৮ হি.) সিয়ারু আলামিন নুবালা’ কিতাবে আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ হারিছীর আলোচনায় এই কিতাবের কথা বলেছেন।
শায়খ লতীফুর রহমানের তাহকীক ও সম্পাদনায় যে তিনটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি মুদ্রিত আকারে হাতে পেয়েছি তা নিঃসন্দেহে মোবারকবাদ ও শোকর গোযারীর হক্বদার। যদিও সম্পাদনার মান আরো উন্নত হতে পারত এবং বিভিন্ন দিক থেকে আরো কিছু কাজ হতে পারত তবুও এখন মূল কিতাব সকল পাঠকের সামনে এসে গেছে এবং এর উপর আরো কাজ করা সহজ হয়ে গিয়েছে।
‘ফাযাইলু আবী হানীফা’ কিতাবটির উপর মারকাযুদ দাওয়ার দারুত তাসনীফেও কাজ হয়েছে। প্রথমে রেওয়ায়াতসমূহের মুফাসসাল তাখরীজ, অতপর রিজালের তারাজিম-পরিচিতির উপর কাজ হয়েছে, দারুত তাসনীফের নেগরানদের নযরে ছানী ও তাদকীকের পর তা প্রকাশের পরিকল্পনা ছিল। হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ ছাহেব বিষয়টি জেনে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, ইনশাআল্লাহ এই কিতাবের প্রকাশনায় আমিও হিস্যা নিব। আলহামদুলিল্লাহ কিতাবটি প্রকাশিত হয়ে গেছে। তবে এর উপর কাজ করার কোনো প্রয়োজন নেই, এমন নয়। এই প্রসঙ্গে দ্বিতীয়বার পাঠকবৃন্দের কাছে মারকাযুদ দাওয়ার জন্য, বিশেষত এর দারুত তাসনীফের জন্য (যার বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে তাহকীকুত তুরাছ তথা প্রাচীন পাণ্ডুলিপির সম্পাদনা বিভাগটিও অত্যন্ত জরুরি) দুআর আবেদন করছি। আল্লাহ তাআলা যেন জাহেরী ও বাতেনী সকল আসবাবের ব্যবস্থা করে দেন এবং দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের এমন কিছু মানোত্তীর্ণ ও কালোত্তীর্ণ কাজের তাওফীক দান করেন, যা তাঁর দরবারে মকবুল হয়, তাঁর খাস বান্দাদের কাছে পছন্দনীয় হয় এবং গোটা উম্মতের জন্য মুফীদ ও উপকারী হয়। আমীন।
ভূমিকা হিসেবে কয়েকটি কথা আরজ করলাম। প্রবন্ধের যে শিরোনাম আমি উল্লেখ করেছি দারুত তাসনীফের কোনো সাথী ঐ শিরোনামের হক্ব আদায় করে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠকবৃন্দের সামনে পেশ করবেন ইনশাআল্লাহ।
দারুত তাসনীফ
[২৩-১২-১৪৩১ হি., ২৯-১১-২০১০ ঈ.
সোমবার দিবাগত রাত ১টা ৩০ মিনিট]