মারকাযের দিনরাত
১/১২/১৪২৭ হি. মোতাবেক ২৩/১২/০৬ ঈ.
মারকাযের আমীনুত তালীম মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব পূর্ব নির্ধারিত সফরে জামালপুর গেলেন। গায়রে মুকাল্লিদ ভাইদের সাথে মুনাযারার উদ্দেশ্যে তাঁর এই সফর। সেখানে একদল গায়রে মুকাল্লিদ সাধারণ মানুষের মাঝে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার করে তাদেরকে বিভ্রান্ত করছে। তারা বলে বেড়াচ্ছে, তোমাদের নামায হয় না। হানাফী মাযহাবের অনুসারীরা কাফের-মুশরিক। দেওবন্দী আলেমরা কাফের। এ ধরনের আরও অনেক বিদ্বেষমূলক কথা রটাচ্ছে। সাধারণ মানুষ গায়রে মুকাল্লিদদের এই প্রোপাগান্ডায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। তাদের মনে প্রশ্ন জাগছে আসলেই কি আমাদের নামায হয় না? চৌদ্দশ বছর ধরে যে নামায চলে আসছে সেটা কি তাহলে ভুল নামায? এ জাতীয় আরও অনেক প্রশ্ন তাদের মনে দেখা দিচ্ছে। এক পর্যায়ে কতিপয় গায়রে মুকাল্লিদ আলেম ফিকহে হানাফীর আলোকে কুরআন সুন্নাহর অনুসরণকারী হানাফী আলেমদের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দেয় এবং একটি তারিখও তারা নির্ধারিত করে। তখন উক্ত এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা জামালপুর শহরের আলেমদের সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে তারা আলোচনায় বসার জন্য সম্মত হন এবং ঢাকা থেকে মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেবকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেন।
নির্দিষ্ট তারিখে আলোচনাসভা শুরু হল। হানাফী আলেমগণ আলোচনার জন্য স্টেজে উপস্থিত থাকলেও এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণত যা হয়ে থাকে এখানেও তাই হল। গায়রে মুকাল্লিদরা আসলেন না। অনেক চেষ্টার পর তাদেরকে পার্শ্ববর্তী একটি মাদরাসায় আনা সম্ভব হলেও তারা সেখানেই বসে রইলেন। স্টেজে আসলেন না এবং নতুন কোনো তারিখও দিলেন না। অবশেষে উলামায়ে কেরাম উপস্থিত শ্রোতাদেরকে ইত্তেবায়ে সুন্নতের গুরুত্ব এবং হাদীসের সাথে ফিকহে হানাফীর সম্পর্ক আলোচনা করে সভা সমাপ্ত করলেন। মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব তাঁর বয়ানে ফিকহে ইসলামীর উৎস, ফিকহে হানাফী ও ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর পরিচয় এবং হানাফী মাযহাবের অনুসরণের অর্থ ও তাৎপর্য ইত্যাদি বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা করেন। শ্রোতারা বিমুগ্ধ চিত্তে তা শুনতে থাকেন। তিনি আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন, ইমাম আবু হানীফা রহ. জন্মগ্রহণ করেছেন ৮০ হিজরীতে। তিনি একজন উঁচু পর্যর্ায়ের তাবেয়ী ছিলেন। কয়েকজন সাহাবীকে তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। আর ইমাম বুখারী রহ.-এর জন্ম আবু হানীফা রহ.-এর ইন্তেকালেরও পরে ১৯৪ হিজরীতে। আবু হানীফা রহ. ইন্তেকাল করেছেন ১৫০ হিজরীতে। ইমাম বুখারী রহ. ইন্তেকাল করেছেন ২৫৬ হিজরীতে। এখন যে ব্যক্তি সরাসরি সাহাবীদের দেখেছেন, সাহাবীদের আমল দেখেছেন, (আর সাহাবীরা রাসূলের আমল দেখেছেন) সে ব্যক্তির আমল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলের সাথে অধিক মিল থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
সুতরাং আমরা যে ফিকহে হানাফীর অনুসরণ করি, তা রাসূলের আমলের সাথে অধিক মিল থাকার কারণেই করি।
তিনি আরও বলেছেন, ইমাম বুখারী রহ. যে সকল উস্তাদের মাধ্যমে সহীহ বুখারীতে হাদীস বর্ণনা করেছেন তারা অনেকেই এবং তাদের উস্তাদদের অনেকে ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর শাগরিদ ছিলেন বা তাঁর শাগরিদের শাগরিদ ছিলেন। তারা সবাই ফিকহে হানাফীর অনুসারী ছিলেন এবং আবু হানীফার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। যেমন আবু আসেম আননাবীল, আবু নুয়াইম ফযল ইবনে দুকাইন, মাক্কী ইবনে ইবরাহীম, মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুছান্না আলআনসারী, আবু আব্দুর রহমান আলমুকরী, ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মোবারক, ওকী ইবনুল জাররাহ, ইয়াযীদ ইবনে হারুন, আব্দুর রাজ্জাক ইবনে হাম্মাম প্রমুখ।
০৫/১২/১৪২৭ হি. মোতাবেক ২৭/১২/ ২০০৬ ঈ.
মারকাযুদ দাওয়াহ এর চলতি কার্যক্রমের মধ্যে সাপ্তাহিক মোহাযারা অন্যতম। আল্লাহর রহমতে আজ এ বছরের প্রথম মোহাযারা হয়েছে। মোহাযারার বিষয় বস্তু ছিল “মাক্বামু আবী হানীফা রহ,” মারকাযের আমীনুত তালীম মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব প্রায় দেড় ঘণ্টা এ বিষয়ের উপর সারগর্ভ আলোচনা করেন। ছাত্র জীবন থেকেই এ বিষয়টির সাথে তাঁর আত্মার সম্পর্ক ছিল। এ বিষয়ে তিনি অনেক কিতাব অধ্যয়ন করেছেন। আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি “আবু হানীফা আলমুফতারা আলাই” ও “নাযরাতুন আ’বিরাহ হাওলা তানকীলিল ইয়ামানী” নামক দুটি মাকালা, যা তাখাসসুস ফী উলূমিল হাদীসিশ শরীফ পড়ার সময় লিখেছিলেন-এর কথা বললেন। এ সময় তার অতি প্রিয় এবং শফীক উস্তাদ হযরত মাওলানা আব্দুর রশীদ নোমানী রহ.-এর কথা মনে পড়লে তিনি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন। উস্তাদের সাথে তার কী পরিমাণ সম্পর্ক ছিল তা যেন দরসে উপস্থিত ছাত্ররা স্বচক্ষে অবলোকন করল এবং হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করল, যা শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মাকালা দুটির শিরোনাম নোমানী রহ. নিজেই নির্বাচন করেছিলেন। তিনি মাকালা দুটি দেখে বেহদ খুশি প্রকাশ করেছিলেন এবং লেখককে অনেক অনেক দুআ দিয়েছিলেন।
০৩/০১/১৪২৮ হি. মোতাবেক ২৩/০১/০৭ ঈ.
মারকাযের মুদীর এবং প্রধান মুফতী মাওলানা আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ (দা. বা.) আজ ছাত্রদের উদ্দেশে মুহাযারা পেশ করলেন। মুহাযারার বিষয় ছিল “বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ”। তিনি প্রায় আড়াই ঘণ্টা এ বিষয়ের উপর তাহকীকী ও গবেষণামূলক আলোচনা করলেন। রাষ্ট্রের মৌলিক বিভাগগুলোর বিশদ বিবরণ তুলে ধরলেন। আইন বিভাগের আলোচনা করতে গিয়ে তিনি জাতীয় সংসদের কার্যক্রম ও পরিচালনা বিধি ছাত্রদেরকে সুন্দর করে বোঝালেন। যেহেতু বিচার বিভাগ তাঁর আলোচনার মূল বিষয় ছিল তাই বিভাগটির প্রাথমিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কার্যক্রমগুলো খুলে খুলে তালিবুল ইলমদের সামনে আলোচনা করেন এবং এ বিভাগের ত্রট্টটির দিকগুলো চিহ্নিত করে দেখান। প্রতিটি বিষয়ের পারিভাষিক ও সাংবিধানিক শব্দ ও সেগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ বিষয়টি খুব সহজবোধ্য করে তুলে ধরেন।
বিচার বিভাগ পৃথক করা কেন প্রয়োজন এবং এতে কী ফায়দা রয়েছে, কোন কোন শর্ত এখানে লক্ষ রাখা জরুরি এসব বিষয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন। ছাত্ররা তার মূল্যবান মোহাযারা থেকে খুবই উপকৃত হয়েছে।
২৩/০১/১৪২৮ হি. মোতাবেক ১৩/০২/০৭ ঈ.
দারুল উলূম দেওবন্দের প্রধান মুফতী মাওলানা হাবীবুর রহমান খায়রাবাদী (দা. বা.) আনুমানিক রাত আটটার সময় মারকাযে তাশরীফ আনলেন। তিনি ঘুরে ঘুরে মারকায পরিদর্শন করলেন। বিশেষ করে মারকাযের কিতাবগুলোর প্রতি গভীর আগ্রহের সাথে নযর বুলালেন। নিজেই দেখে দেখে কিতাবের নাম উচ্চারণ করে পড়তে লাগলেন। এক সময় বললেন, “আপনে তো বহুতসী কিতাবেঁ জমা করলী হাঁয়! ”
তিনি মারকাযের কার্যক্রম ও ব্যবস্থাপনা দেখে অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করেন। অতঃপর তালিবুল ইলমদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত মূল্যবান নসীহত পেশ করলেন। তিনি বলেছেন, তাহকীক বহুত উচুঁ কাজ,
এজন্য তাহকীক যতই করা হোক সেটা পরিমাণে খুব কম। সুতরাং কোনো ব্যক্তি তাহকীকের ময়দানে যত উচুঁ পর্যায়েই পৌছুক সেটাকে কম মনে করতে হবে এবং যে বিষয়েই সে তাহকীক করুক সেটাকে যেন চুড়ান্ত এবং শেষ সীমা মনে না করে এবং যে কারো কথার উপর জলদি ইতেমাদ না করে; বরং নিজেই বিভিন্ন কিতাব দেখে যখন আশ্বস্ত হবে যে, এটা গ্রহণযোগ্য এবং সহীহ মত আর ওটা যয়ীফ ও দুর্বল কেবল তখনই তার উপর নির্ভর করবে। ইলমের কোনো হদ নেই। যে যত মেহনত করবে আল্লাহ তাআলা তাকে তত উচুঁ পর্যায়ে উঠাবেন।
ইলম এমন সম্মানের বিষয় যার চেয়ে বেশি সম্মানের কোনো বিষয় দুনিয়াতে নেই। যে ব্যক্তি ইখলাসের সাথে ইলম হাসিল করবে আল্লাহ তাআলার ভয় তার মধ্যে পয়দা হবে। ঈমান ও আমলে ইখলাস নসীব হবে এবং তাওয়াযু হাসিল হবে। এই তিনটি গুণ আলেমে দ্বীনের মধ্যে বিশেষভাবে থাকা উচিত। উচুঁ ডিগ্রী হাসিল করার জন্য গবেষণা করছি, তাহকীক করছি, তাখাসুস করছি, এটা করছি, ওটা করছি, যদি এরকম অহংকার ও তাকাব্বুর পয়দা হয় তাহলে এই অহংকারই তার ইলমকে ধ্বংস করে দিবে। ইজ্জতের পরিবর্তে বে-ইজ্জত করবে। সুতরাং ইলমে দ্বীন হাসিল করার পরে নফসের মধ্যে কখনো এই খেয়াল না রাখা চাই যে, আমি অনেক কিছু জানি, অনেক কিছু শিখে ফেলেছি; বরং ইলমে দ্বীনের বৈশিষ্ট্য হল, যত বেশি ইলম হাসিল হবে তত বেশি বিনয় ও নম্রতা পয়দা হবে এবং তত বেশি নিজের মধ্যে ইনকিসারী সৃষ্টি হবে। তাসাওউফের ইমামগণ লিখেছেন, মানুষের মধ্যে যে আখলাক্বে রাযীলা (নিকৃষ্ট স্বভাব) রয়েছে তার মধ্যে সর্বশেষ যেটা মানুষের অন্তর থেকে বের হয় সেটা হল কিবির বা অহংকার। সুফিদের মুজাহাদা রিয়াযত ও চিল্লাকাশী দ্বারা এটা পরীক্ষিত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রক্ষা করুন এবং কবুল করুন। আমীন