প্রিয়তম রাসূল
আলইনসান আব্দুল ইহসান’। অর্থ্যাৎ মানুষ অনুগ্রহের দাস। মনুষ্যত্বের অধিকারী কোনো মানব-সন্তানের পক্ষেই অনুগ্রহকারীর অনুগ্রহ অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কৃতজ্ঞতাই মানুষের পরিচয়, কৃতঘ্নতা নয়।
একের প্রতি অনের অনুগ্রহও নানা ধরনের, নানা পর্যায়ের হয়ে থাকে। পার্থিব হিসাবে সব চেয়ে বড় অনুগ্রহ হল জীবন রক্ষা, নব জীবন দান। এ জন্য মানুষ তার জীবন রক্ষাকারীর প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকে। কিন্তু মানুষের এই পার্থিব জীবনটিও তো ক্ষণস্থায়ী। মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তো এই জীবন রক্ষার অনুগ্রহটিও সমাপ্ত হয় মানুষের জীবনের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু এমন যদি হয়, একজন মানুষ একটি অসীম জীবনের অধিকারী হল আর সেই জীবনে মৃত্যু থেকে নয়; বরং মৃত্যুযন্ত্রণার নিগড় থেকে কোনো অনুগ্রহকারী সেই মানুষটিকে রক্ষা করল তাহলে তার এই অনুগ্রহটির কৃতজ্ঞতা কীভাবে আদায় হবে? বলা বাহুল্য, এই ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়। তবে স্বীকার করা সম্ভব। সবোর্চ্চ ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যমে তার এই ঋণ স্বীকার করা যায়। নবী আলাইহিস সালামের প্রতি উম্মতের মনে এই ঋণ স্বীকারের মানসিকতা থাকা উচিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তার নিকটে তার সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা এবং সকল মানুষ থেকে প্রিয় না হই।’ উপরোক্ত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্বোধন কিয়ামত পর্যন্ত তার সকল উম্মতের জন্য প্রযোজ্য হলেও এর প্রথম সম্বোধিত হলেন সাহাবায়ে কেরাম। সাহাবায়ে কেরাম রা. তাঁর এই সম্বোধনের হক আদায় করেছেন। পুরুষ সাহাবীগণ যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তদ্রূপ ছিলেন মহিলা সাহাবীগণও। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে সাহাবীয়াগণের সেই অনুরাগ ও আনুগত্যের কিছু দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছি।
উম্মে আতিয়্যাহ রা. একজন সাহাবিয়া। তিনি যখনই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম উল্লেখ করতেন বলতেন ‘বিআবী’ অর্থ্যাৎ আমার পিতা তাঁর প্রতি উৎসর্গিত হোক। -সুনানে নাসায়ী
একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানি বা দুধ পান করে উম্মে হানী রা.কে দিলেন। তিনি বললেন, যদিও আমি রোযা রেখেছি কিন্তু আপনার উদ্বৃত্ত পানীয় ফিরিয়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। -মুসনাদে আহমদ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো জিহাদে যেতেন তখন কোনো কোনো সাহাবিয়া তার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে মান্নত করতেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিশিষ্ট সাহাবিয়াগণও তাঁর বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করতেন । উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা.-এর কাছে রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি জামা সংরক্ষিত ছিল। উম্মুল মু’মিনীনের ইন্তেকালের পর জামাটি তাঁর বোন আসমা রা.-এর কাছে সংরক্ষিত থাকল। বংশের কোনো মানুষ অসুস্থ হলে জামাটি ভিজিয়ে সেই পানি তাকে পান করানো হত। -মুসনাদে আহমদ ৬/৩৪৮
আনাস রা.-এর মা উম্মে সুলাইম রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একজন বিশিষ্ট সাহাবিয়া ছিলেন। তিনি তার পু্ত্র আনাস রা.কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতের জন্য দিয়েছিলেন। উম্মে সুলাইম রা.-এর ভাই হারাম ইবনে মিলহান বি’রে মাউনার যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। এসব কারণে এই সাহাবিয়ার মন খুশি করার জন্য স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কখনো তাঁর গৃহে যেতেন। উম্মে সুলাইম রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আপ্যায়ন ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু চুল ও দেহের ঘাম মোবারক উম্মে সুলাইম রা.-এর নিকটে সংরক্ষিত ছিল। তিনি সেগুলো সুগন্ধির সঙ্গে মিশ্রিত করে রেখেছিলেন। আনাস রা. এর মৃত্যু পর্যন্ত সেগুলো সংরক্ষিত ছিল। আনাস রা. ইন্তেকালের সময় অছিয়ত করেছিলেন যে, এই সুগন্ধি যেন মৃত্যুর পর তার দেহে লাগিয়ে দেওয়া হয়। -সহীহ বুখারী
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতেও সাহাবিয়াগণ প্রস্তুত ছিলেন। উহুদ যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তে যখন তিনি কাফেরদের বেষ্টনীর মধ্যে এসে গিয়েছিলেন তখন যে ক‘জন ফেদায়ী সাহাবী জানবাজি রেখে তাঁকে শত্রট্টদের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন তাদের মধ্যে একজন সাহাবিয়াও ছিলেন। তিনি হলেন নাসীবাহ বিনতে কা’ব। তিনি আহতদের সেবা শুশ্রম্নষার জন্য মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে ছিলেন। তিনি যখন দেখলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফেরদের বেষ্টনীতে এসে পড়ছেন তখন পানির মশক ফেলে তরবারী হাতে লড়াই আরম্ভ করেছিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একজন সাহাবী তুলাইব ইবনে উমাইর রা.। ইনি ইসলাম গ্রহণের পর তার মা আরওয়া বিনতে আব্দুল মুত্তালিব রা.কে ইসলাম গ্রহণের সংবাদ দিলেন। জননী পুত্রের ইসলাম গ্রহণের সংবাদ শুনে তাকে বললেন, ইনিই হলেন তোমাদের সাহায্য-সহযোগিতার সবচেয়ে বড় হক্বদার। যদি পুরুষ মানুষের মতো আমার সামর্থ্য থাকত তাহলে আমিও তাঁর পক্ষ হয়ে লড়াই করতাম। -ইসতিআব
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ সমর্পণ ছিল সাহাবায়ে কেরামের একটি বৈশিষ্ট্য। ফাতিমা বিনতে ক্বায়স রা. একজন সাহাবিয়া ছিলেন। তাকে বিয়ে করার জন্য একদিকে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা.-এর মতো বিশিষ্ট ও ধনাঢ্য সাহাবী আগ্রহী ছিলেন, অন্যদিকে উসামা ইবনে যাইদ রা.-এর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা বলেছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, আপনি যার সঙ্গে ইচ্ছা আমাকে বিয়ে দিতে পারেন। -সুনানে নাসায়ী
একবার এক আনসারী সাহাবীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মেয়ে আমাকে দিয়ে দাও। সাহাবী খুশিতে বাগবাগ হয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি নিজের জন্য বলছি না, জুলাইবীব-এর জন্য প্রস্তাব করছি। জুলাইবীব রা. একজন রসিক প্রকৃতির সাহাবী ছিলেন। এজন্য আনসারী সাহাবী কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। ঘরে ফিরে স্ত্রীকে জানালে স্ত্রীও এই পয়গামের ব্যাপারে দ্বিধা করতে লাগলেন, কিন্তু যার জন্য পয়গাম দেওয়া হয়েছে তিনি বলতে লাগলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পয়গাম ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আমাকে তার হাওলা করে দাও। তিনি আমার ব্যাপারে কোনো অকল্যাণজনক সিদ্ধান্ত নিবেন না। -মুসনাদে আহমদ
একদিন উম্মুল মুমিনীন যাইনাব রা. তার কাপড় রঙ্গিন করছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে এসে এটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গেলেন। মুখে কিছু না বললেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কাপড় রঙ্গিন করা পছন্দ করেননি এটা তিনি বুঝতে পারলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সকল রঙ ধুয়ে ফেললেন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মহব্বত ও আনুগত্যের প্রেরণা সাহাবিয়াগণের মধ্যে এমন গভীরভাবে ছিল যে, তাদের সকল আবেগ-অনুরাগ পর্যন্ত এই আনুগত্যের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছিল।
যাইনাব বিনতে জাহ্শ রা.-এর ভাই মৃত্যুবরণ করলেন। মৃত্যুর পর সম্ভবত চতুর্থ দিন যাইনাব রা. সুগন্ধি ব্যবহার করলেন এবং বললেন, এই মুহূর্তে সুগন্ধি ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন আমার ছিল না। তবে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, কোনো নারীর জন্য বৈধ নয় স্বামী ব্যতীত অন্য কারও জন্য তিনদিনের অধিক শোক পালন করা।’ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সেই আদেশ পালন করলাম।
উম্মে হাবীবা রা. ও তার পিতার মৃত্যুর পর চতুর্থ দিন তার মুখমণ্ডলে সুগন্ধি লাগালেন এবং বললেন, আমার সুগন্ধি ব্যবহারের প্রয়োজন ছিল না। শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে সুগন্ধি ব্যবহার করলাম। -সুনানে আবু দাউদ
এগুলো হল সামান্য দৃষ্টান্ত। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বত ও আনুগত্যের যে চরম নিদর্শন সাহাবায়ে কেরাম রেখে গেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই। তাই খুব যৌক্তিকভাবেই তারা ‘রাযিআল্লাহু আনহুম’-এর বারতা পৃথিবীতেই লাভ করেছেন। তাদের এই পুণ্য জীবনে নিশ্চয়ই আমাদের জন্যও পয়গাম রয়েছে।