সব হয়েছে, কেবল সেই কোল হারিয়ে গেছে
মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী রহ.-এর পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ইসলামের ইতিহাস ও মুসলিম মনীষীদের জীবন ও কর্মের ব্যাপারে তাঁর প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি গোটা মুসলিম বিশ্বের জ্ঞানীসমাজে স্বীকৃত। বিশেষত আমাদের এ অঞ্চলের দায়ী ইলাল্লাহ, মুজাহিদ ফী-সাবীলিল্লাহ ও সমাজ সংস্কারক ব্যক্তিবর্গের জীবন ও কর্মকে তিনি যেভাবে সংকলিত করে রেখে গেছেন তা অনেক দিন পর্যন্ত মুসলিম জাতির পথ ও পাথেয় হিসাবে কাজ করবে ইনশাআল্লাহ।
হযরত মাওলানা আলী নাদভী রহ. সম্পর্কে এই নিবন্ধে কিছু লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। তাঁর সংকলিত হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর জীবনী থেকে একটি অংশ উদ্বৃত করাই এ লেখার মূল উদ্দেশ্য। ‘হযরত মাওলানা ইলিয়াস আওর উনকী দ্বীনি দাওয়াত’ নামে তিনি যে জীবনী গ্রন্থটি সংকলন করেছেন তার মাধ্যমে হযরত মাওলানা রহ.-এর জীবন ও কর্মের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক যেমন সামনে আসে তেমনি দাওয়াত ও তাবলীগের এ মেহনতটির ব্যাপারে প্রজ্ঞা অর্জনেও তাঁর এই সংকলন অনেকখানি সহায়তা করে। এই উভয় বিষয়ে একটি পরিষ্কার ধারণা লাভের জন্য এই বইটি অধ্যয়ন করা জরুরি মনে করি। এখানে বইটির ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ উদ্ধৃত করতে চাই। একজন আরব লেখক লিখেছিলেন, ইসলামী ইতিহাসের কীর্তিমান ব্যক্তিবর্গের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাদের জীবন-নির্মাণের পেছনে তাদের পুণ্যাত্মা জননীদের নীরব ত্যাগ গভীরভাবে কাজ করেছে। এ কথাটির একটি জীবন্ত দৃষ্টান্ত হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর জীবনীতে পাওয়া যায়। হযরত নাদভী রহ.-এর বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ দামাত বারাকাতুহুম। সংশ্লিষ্ঠ অংশটির অনুবাদ পাঠকবৃন্দের খেদমতে উপস্থাপিত হল।
“মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর শৈশব কেটেছে কান্ধলায় নানির বাড়িতে এবং নিযামুদ্দীনে পিতার সান্নিধ্যে। তখন এই কান্ধলভী পরিবার ছিল তাকওয়া ও ধার্মিকতার এক অনন্য আদর্শ। পুরুষ মহলের কথা তো বলাই বাহুল্য; তাদের স্ত্রী মহলের ইবাদতনিমগ্নতা ও রাত্রিজাগরণ, যিকির, তেলাওয়াত ও নিয়মিত আমল অযীফার ঘটনাবলিও এ যুগের দুর্বলচিত্তদের ধারণারও বহু উর্ধ্বে। ঘরে স্ত্রীগণ সাধারণভাবে নিজ নিজ সুবিধামত কুরআন তেলাওয়াত করতেন, আর নিকটাত্মীয় পুরুষদের পিছনে নফল নামাযে দাঁড়াতেন। আর রমযানুল মুবারকে তো কুরআন তেলাওয়াতের যেন বাহার লেগে থাকত। ঘরে ঘরে বিভিন্ন কোণে কুরআন তেলাওয়াতের মধুগুঞ্জন দীর্ঘ সময় ধরে শোনা যেত।
‘কুরআন তরজমা, উর্দূ তাফসীর, মাযাহিরে হক, মাশারিকুল আনওয়ার ও হিছনে হাছীন-এই ছিল পরিবারের মেয়ে মহলের সাধারণভাবে প্রচলিত উচ্চ পর্যায়ের নেছাব বা পাঠ্যসূচি । তখন ঘরে বাইরে পারিবারিক মজলিসে হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদ রহ. ও হযরত শাহ আব্দুল আযীয রহ.-এর ঘটনাবলির সরগরম চর্চা হত। স্ত্রী-পুরুষ সকলেরই মুখে মুখে আলোচিত হত ওই সমস্ত বুজুর্গানের কাহিনী। ঘরের মা-বোনেরা শিশুদেরকে তোতা ময়নার কিসসা কাহিনীর বদলে ঈমান তাজা করার এসব কাহিনী শোনাতেন। তাছাড়া এগুলো তেমন কোনো পুরানো কথাকাহিনী ছিল না। ছিল মাওলানা মুযাফফর হোসাইন ছাহেবের চোখে দেখা এবং তাঁর কন্যা ভগ্নিদের কানে শোনা ঘটনাবলি। তাই শ্রোতাদের কাছে মনে হত যেন তা কালকের ঘটনা।
উম্মী বী
মাওলানা মুযাফফর হোসাইন ছাহেবের কন্যা এবং মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস রহ.-এর নানি বী আমাতুর রহমান ছিলেন ‘রাবেয়া চরিত্রের’ এক তাপসী নারী। খান্দানে তাঁর সাধারণ ডাকনাম ছিল উম্মী বী। নামায ছিল এমন যে, মাওলানা ইলিয়াস রহ. একবার বলেছিলেন, উম্মী বীর নামাযের নমুনা ও ছাপ আমি মাওলানা গাংগুহী রহ.-এর নামাযে দেখেছি। (আর মাওলানা গাংগুহীর নামায তাঁর সমস্তরেও ছিল অতি বিশিষ্ট।)
মাওলানার আম্মাজান
মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস রহ.-এর আম্মাজান মুহতারামা ছাফিয়্যা খুব উচ্চস্তরের হাফেজা ছিলেন। বিবাহের পর প্রথম পুত্র মাওলানা ইয়াহইয়া ছাহেবের দুধের সময় তিনি কুরআন হেফজ করেছিলেন। ইয়াদ এত পোক্ত ছিল যে, সাধারণ হাফেজ তাঁর সামনে দাঁড়াতে পারত না। রমযানে দৈনিক এক খতম ও অতিরিক্ত দশ পারা কুরআন তেলাওয়াত তাঁর নিয়ম ছিল।
‘এভাবে প্রতি রমযানে তাঁর চল্লিশ খতম কুরআন পড়া হত। তেলাওয়াত এত সাবলীল ও স্বতঃষ্ফূর্ত ছিল যে, ঘরের কাজকর্মে কোনো অসুবিধা হত না। বরং তেলাওয়াতের সময় হাতে কোনো না কোনো কাজ চালিয়ে যাওয়ার ইহতিমাম করতেন। রমযান ছাড়া অন্য সময় গার্হস্থ দায়িত্বের পাশাপাশি তাঁর দৈনিক আমল অযীফা ছিল এই-
দরূদ শরীফ- পাঁচ হাজারবার।
ইসমে যাত- পাঁচ হাজারবার।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম- এক হাজার নয়শবার।
ইয়া মুগনী- এগারশবার।
ইয়া হাইয়ু ইয়া কাইয়ুম- দু‘শবার।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ- বারশবার।
হাসবিয়াল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকীল- পাঁচশবার।
সুবহানাল্লাহ- দু‘শবার।
আলহামদু লিল্লাহ- দু‘শবার।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ- দু‘শবার।
আল্লাহু আকবার- দু‘শবার।
ইস্তিগফার- পাঁচশবার।
উফাওয়িজু আমরী ইলাল্লাহ- একশবার।
হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকীল- একশবার।
রব্বি ইন্নি মাগলূবুন ফানতাসির- একশবার।
রব্বি ইন্নি মাস্সানিয়াদ্দুররু ওয়া আন্তা আরহামুর রহিমীন- একশবার।
লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজজোয়ালিমীন- একশবার।”
এ ছাড়াও কুরআন তিলাওয়াত ছিল দৈনিক এক মঞ্জিল।
‘স্ত্রী লোকদের কুরআন বোঝার মত জ্ঞান ও বোধ ছিল। তাই তারা রস-স্বাদ আস্বাদন পূর্বক তেলাওয়াত করতেন। নামাযে তাদের আত্মনিমগ্নতা এমন হত যে, কখনো কোনো দুর্ঘটনাজনিত কারণে পর্দাযোগ্য পুরুষদের আসা-যাওয়া ও ছোটাছুটি টেরও পেতেন না তারা।
‘এধরনের কিছু ঘটনা শুনিয়ে একদিন মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস রহ. বলেছিলেন, “এমন মায়েদের কোলেই আমি প্রতিপালিত হয়েছি। পৃথিবীতে এ ধরনের কোল এখন আর কোথায় পাওয়া যাবে!” -মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস রহ. ও তাঁর দ্বীনী দাওয়াত ৪৬-৪৮
বলা বাহুল্য আজ আমাদের অনেক কিছু আছে। জ্ঞান আছে, বিজ্ঞান আছে। উন্নতি আছে, অগ্রগতি আছে। অর্থ আছে, বিত্ত আছে। কিন্তু ওই ‘কোল’ নেই, যে কোলে পুষ্পিত ও পল্লবিত হয়ে উঠতে পারতো উম্মাহর উজ্জ্বল ভবিষ্যত। কিন্তু এই দুরবস্থা কীভাবে হল? এর নেপথ্য কারণ খুব ভালোভাবেই আমরা জানি। যে সংস্কৃতি এভাবে একটি জাতিকে দেউলিয়া করে দিচ্ছে তা পরিত্যাজ্য কি না তা আমাদের খুব তাড়াতাড়ি ভাবতে হবে।