দারিদ্রের কষ্টিপাথরে নিকষিত ইসলামের সোনালী মনীষা
ইমাম সুফয়ান সাওরী রহ. (জন্ম : ৯৭ হি., মৃত্যু : ১৬১ হি.)
হযরত সুফয়ান সাওরী রহ. একবার এরূপ অর্থ সংকটে পড়েন যে, তিন দিন যাবৎ কিছুই খেতে পাননি। এসময় তিনি এক বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে বাড়িতে ছিল বিবাহের অনুষ্ঠান। ক্ষুধার জ্বালায় তাঁর একবার ইচ্ছা হল যে, সেই বাড়িতে প্রবেশ করে কিছু খাবেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁকে রক্ষা করলেন। তাঁর মনে আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত হল। তিনি সে স্থান অতিক্রম করে তাঁর মেয়ের বাড়িতে গেলেন। মেয়ে তাঁকে শুকনো রুটি খেতে দেন। তিনি তা খেয়ে পানি পান করলেন। তারপর তৃপ্তির ঢেকুর তুলে একটি কবিতা বললেন। কবিতাটির ভাবার্থ এই : অন্যের বন্ধ দুয়ারে ঢুঁ মারার চেয়ে সামান্য লবন আর রুটিই তোমার জন্য যথেষ্ট। (১)
ইমাম খলীল ইবনে আহমদ রহ. (জন্ম : ১০০ হি., মৃত্যু : ১৭০ হি.)
নাহব শাস্ত্রের ইমাম খলীল ইবনে আহমদ রহ. বসরায় নিজের একটি বাঁশের ঘরে বসবাস করতেন। এমনও সময় তাঁর অতিবাহিত হত যে, দু‘টো পয়সা তাঁর হাতে থাকত না। অথচ তাঁর শিষ্যরা তাঁর নিকট থেকে ইলম শিখে অনেক অর্থ উপার্জন করত। তিনি বলতেন, আমি আমার বাসনার দুয়ার বন্ধ রাখি। যার ফলে আমার মনের কামনা-বাসনা আমার দরজা অতিক্রম করতে পারে না।
পারস্যের এক শাসনকর্তা-সুলায়মান ইবনে হাবীবের পক্ষ থেকে তিনি কিছু নির্ধারিত ভাতা পেতেন। একবার শাসনকর্তা কোনো প্রয়োজনে দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য তাঁকে একটি চিঠি লেখেন। এতে খলীল ইবনে আহমদ রহ.-এর আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। তিনি একটি কবিতায় তার উত্তর লিখে পাঠান। উত্তরের সারমর্ম এই :
“সুলায়মান ইবনে হাবীবকে জানিয়ে দাও, তার সাহায্য ছাড়াই আল্লাহর মেহেরবানীতে আমি সুখে আছি। যদিও আমি সম্পদশালী নই, তবুও তার দরবারে হাজিরা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। দারিদ্র্য থাকে মানুষের অন্তরে। অর্থ-সম্পদের সংকটকে আমি দারিদ্র্য মনে করি না। তদ্রূপ অমুখাপেক্ষিতাও মানুষের মনের ব্যাপার। অর্থ-সম্পদ মানুষকে অমুখাপেক্ষী করে না।”
শাসনকর্তা এরূপ জবাব পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ভাতা বন্ধ করে দেন। তখন খলীল ইবনে আহমদ রহ. উত্তরে লেখেন :
“যিনি আমার খাওয়ার জন্য মুখ সৃষ্টি করেছেন, আমার মৃত্যু পর্যন্ত খাবার দেওয়ার দায়িত্বও তাঁরই। আপনি আমার সামান্য ভাতা বন্ধ করে দিয়েছেন, তাতে আমার আপত্তি নেই। এতে আপনার সম্পদ বৃদ্ধি পাবে না।” এরূপ জবাব শাসনকর্তাকে হতভম্ব করে দেয়। এরপর শাসনকর্তা তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে পত্র লেখেন এবং তাঁর ভাতা দ্বিগুণ করে দেন। (২)
ইমাম মালিক রহ. (জন্ম : ৯৫হি. মৃত্যু : ১৭৯হি.)
ইমাম মালিক রহ. একবার এরূপ অর্থ সংকটে পতিত হন যে, নিজের ঘরের চাল খুলে তার কাঠ বিক্রি করে প্রয়োজন মিটাতে হয়। অবশ্য পরে তাঁর এ অর্থসংকট থাকেনি। এজন্য ইমাম মালিক রহ. বলতেন, দারিদে্র্যর স্বাদ নেওয়া ব্যতীত ইলম অর্জন করা যায় না। (৩)
ইমাম আবু ইউসুফ রহ. (জন্ম : ১১৩ হি., মৃত্যু : ১৮২ হি.)
ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বলেন, আমি হাদীস ও ফিকহের ইলম হাসিল করতাম। তখন আমি অতি দরিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্ত। একদিন আমার পিতা এসে দেখলেন, আমি ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর কাছে বসে ইলম শিখছি। তখন আমার পিতা আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, বাবা, তুমি ইমাম আবু হানীফার পেছনে পা বাড়িয়ো না। ইমাম আবু হানীফা ধনী মানুষ। আর তুমি প্রাণ বাঁচানোর মতো জীবিকার জন্য মুখাপেক্ষী। তার এ বক্তব্যের ফলে আমি বেশ কিছু দিন ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর দরসে ইলম শিখতে আসিনি। তখনকার মতো আমি পিতার কথা মেনে নেওয়াই শ্রেয় মনে করলাম। ইমাম আবু হানীফা রহ. দরসে আমাকে অনুপস্থিত দেখে আমার খোঁজ-খবর নিলেন এবং আমার সম্পর্কে অন্যদের কাছে জানতে চাইলেন। এরপর আমি পুনরায় তাঁর দরসে যোগদান করতে শুরু করি। অনুপস্থিত থাকার পর যখন প্রথম দিন তাঁর দরসে গেলাম, তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি দরসে অনুপস্থিত ছিলে কেন? আমি বললাম, জীবিকা উপার্জনের তাগাদা আর পিতার কথা পালন করতে গিয়ে আমাকে দরসে অনুপস্থিত থাকতে হয়েছে। এরপর দরসে বসলাম। লোকেরা যখন চলে গেল তখন তিনি আমার নিকট একটি থলি দিয়ে বললেন, এগুলো তোমার প্রয়োজনে ব্যয় করো। আমি দেখি, থলিতে একশ দিরহাম রয়েছে। এরপর তিনি আমাকে বললেন, তুমি নিয়মিত দরসে যোগদান করতে থাক। আর এগুলো শেষ হয়ে গেলে তুমি আমাকে জানাবে। সুতরাং আমি নিয়মিত দরসে যোগদান করতে থাকলাম। অল্প কয়েক দিন অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি আমাকে আরও একশ দিরহাম প্রদান করলেন এবং তিনি নিয়মিত আমার খোঁজ-খবর নিতেন। এরপর আমি আর কখনও তাঁকে আমার অভাব সম্পর্কে জানাইনি এবং অর্থ ফুরিয়ে যাওয়া সম্পর্কে অবহিত করিনি। মনে হত, যেন আমার অর্থ ফুরিয়ে যাওয়ার কথা কোনোভাবে তাঁর জানা হয়ে যেত। এরপর আল্লাহর ইচ্ছায় আমি সহায়-সম্পদ ও বিত্ত-বৈভবের মালিক হই। এভাবে একাধারে ১৭ বছর তাঁর দরসে যোগদান করার পর আমি আমার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হই এবং আল্লাহ তাআলা তাঁর বরকতে ও তাঁর নেক নিয়তের উসিলায় আমাকে ইলম ও সহায়-সম্পদ দান করেন। আল্লাহ তাআলা আমার পক্ষ থেকে তাঁকে এর উত্তম জাযা দান করুন এবং তাঁকে ক্ষমা করে দিন। (৪)
ইমাম নযর ইবনে শুমাইল বসরী রহ. (জন্ম : ১২২ হি., মৃত্যু : ২০৩ হি.)
ইমাম নযর ইবনে শুমাইল বসরী রহ. বসরায় একবার বেশ অর্থসংকটে পতিত হন। তখন তিনি খুরাসান গমনের উদ্দেশ্যে বসরা থেকে বের হন। এ সময় তাঁকে বিদায় জানানোর জন্য বসরার প্রায় তিন হাজার লোক তাঁর পেছনে পেছনে আসেন। এরা সবাই ছিলেন মুহাদ্দিস অথবা নাহ্ববিদ অথবা অভিধানবিদ বা ছান্দসিক কিংবা ইতিহাস বিশারদ। তিনি মিরবাদ নামক স্থানে পৌঁছে বসলেন এবং বসরাবাসীদের উদ্দেশ করে বললেন, “হে বসরাবাসীরা, তোমাদের বিচ্ছেদ আমার জন্য অতি কষ্টকর। আল্লাহর কসম করে বলছি, যদি প্রত্যহ আমার এক সের ডালের ব্যবস্থা হত তবে আমি তোমাদের ছেড়ে যেতাম না।” তাঁর সাথে যারা এসেছিলেন তাদের মধ্যে এমন কেউ ছিলেন না, যিনি এ ব্যয়ভারটুকু গ্রহণ করার মত সামর্থ্য রাখেন। ফলে তিনি সফর করে খুরাসান পৌঁছেন এবং সেখানে তিনি অনেক অর্থ-সম্পদের মালিক হন। তখন তিনি মার্ভ্ শহরে অবস্থান করতেন।
আব্বাসী খলীফা হারুনুর রশীদের পুত্র খলীফা মামুনুর রশীদের সাথে তাঁর মার্ভ্ শহরে অবস্থানকালীন কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা রয়েছে।
ইমাম নযর ইবনে শুমাইল রহ. বলেন, খলীফা মামুনের রাতের গল্পের আসরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হত। সেমতে এক রাতে আমি তার আসরে গেলাম, তখন আমার পরনে ছিল তালিদার পোষাক। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে নযর, আপনার এ দুরবস্থা কেন? আপনি আমীরুল মু‘মিনীনের দরবারে আসছেন এ জীর্ণ বস্ত্র পরিধান করে? উত্তরে আমি বললাম, হে আমীরুল মু‘মিনীন, আমি একজন বয়ঃবৃদ্ধ ও দুর্বল মানুষ; আর মারভ শহরের গরম প্রচণ্ড, তাই আমি এ জীর্ণ বস্ত্র পরিধান করে ঠাণ্ডা লাভ করি। তিনি বললেন, না, সম্ভবত আপনি আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত।
এরপর একটি হাদীসের আলোচনা উঠলে, ইমাম নযর ইবনে শুমাইল রহ. খলীফা মামুনের উদ্ধৃত হাদীসটির একটি শব্দের উচ্চারণ সংশোধন করে দেন। তখন খলীফা খুশি হয়ে তাঁকে পঞ্চাশ হাজার দিরহাম বখশিশ দেন। খলীফার এ ঘোষণাপত্র গভর্ণর ফাযল ইবনে সাহলের কাছে পেঁৗছলে তিনি আরও ত্রিশ হাজার দিরহাম বখশিশস্বরূপ বৃদ্ধি করে দেন। ফলে তিনি একটি শব্দের উচ্চারণ সংশোধন করে দেওয়ার বদৌলতে আশি হাজার দিরহামের মালিক হন।
ইমাম শাফেয়ী রহ. (জন্ম : ১৫০ হি. মৃত্যু : ২০৪ হি.)
ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, আমি যখন বাল্য বয়সে লেখা-পড়া শুরু করি, তখন আমার অবস্থা স্বচ্ছল ছিল না। উল্লেখ্য যে, তখন তাঁর বয়স ছিল তের বছরের চেয়ে কম। তিনি বলেন, তখন আমি সরকারী অফিসে গিয়ে এক পৃষ্ঠা লেখা কাগজ চেয়ে এনে তার অপর পৃষ্ঠায় লিখতাম।
ইমাম শাফেয়ী রা. বলেন, আমি যখন মক্তবের ছাত্র ছিলাম, তখন আমি শুনতাম, মাননীয় শিক্ষক ছাত্রদের পড়াচ্ছেন। তিনি যা পড়াতেন তা শুনে শুনে আমার মুখস্থ হয়ে যেত। আমি ছিলাম এতিম। শিক্ষককে পারিশ্রমিক দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমার মায়ের ছিল না। তবু মাননীয় শিক্ষক আমার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন যে, তার দরস দান শেষে চলে যাওয়ার পর আমি ছাত্রদেরকে পড়া বলে দিতাম। অথচ তারা পূর্বে থেকে লিখতে থাকত। আর শিক্ষকের লেখানো শেষ করার আগেই আমার লেখা সবটুকু মুখস্থ হয়ে যেত। একদিন তিনি আমাকে বললেন, তোমার নিকট থেকে কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করা আমার জন্য উচিত হবে না।
এরপর মক্তব থেকে বের হয়ে মাটির চাঁড়া, খেজুরের ডালের গোড়ার দিকের চেপটা অংশ, উটের বাহুর গোড়ার চেপটা হাঁড় কুড়িয়ে নিতাম এবং তাতে হাদীস লিখতাম। আর সরকারী অফিসে গিয়ে সেখান থেকে এক পৃষ্ঠায় লেখা কাগজ চেয়ে এনে তাতে লিখতাম। এরপর সেগুলো কলসিতে ভরে রাখতাম। এভাবে আমি আমার মায়ের অনেকগুলো কলসি ভর্তি করে ফেলি। (৫)
অনুবাদে : মাওলানা আহমদ মায়মুন
তথ্যসূত্র
১. -আলআসফাহানী, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৬/৩৭৩
২.-ইবনে খাল্লিকান, ওয়াফায়াতুল আয়ান ২/২২৪; যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৭/৪২৯
৩.-কাযী ইয়ায, তারতীবুল মাদাকি ১/১৩০ ১/৪২৯
৪.-খতীব বাদগদাদী, তারীখে বাগদাদ ১৪/২৪৪; আলমুওয়াফফাক, মানকিবু আবী হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফের আলোচনা ১/৪৯৬
৫.-বায়হাকী; মানাকিবুশ শাফেয়ী ১/৯৫; কাযী ইয়ায; তারতীবুল মাদারিক; ৩/১৭৫; ইয়াকুত হামাবী; মু‘জামুল উদাবা ১৮/২৮৪