আকীকা ও খতনা বিষয়ক ভুলভ্রান্তি
আকীকার দিন তারিখ প্রসঙ্গ
এ ব্যাপারে দু‘ধরনের প্রান্তিকতা লক্ষ করা যায়। কিছু মানুষ রয়েছেন যারা ৭ম দিনে আকীকা করার প্রতি গুরুত্ব দেন না। ক্লিনিক, ডাক্তার, প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় টেষ্ট ইত্যাদির পিছনে হাজার হাজার টাকা খরচ করলেও যৎসামান্য টাকা খরচ করে আকীকা করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ হাদিস শরীফে ৭ম দিনের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে নির্বাচিত সময়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয় না, কিন্তু শরীয়ত যে বিষয়ে কোনো দিন তারিখ নির্ধারিত করে দেয়নি সেখানে খুব তোড়জোড় করতে দেখা যায়। -আলমাদখাল ৩/২৯২-২৯৩
আবার কেউ কেউ ৭ম দিনে আকীকা করতে না পারলে মনে করে পরবতীর্তে আর আকীকা করা যায় না। অথচ মাসআলা হল,৭ম দিনে করতে না পারলে ১৪তম দিনে, তাও সম্ভব না হলে ২১তম দিনে আকীকা দিবে। -মুসতাদরাকে হাকিম ৪/২৩৮; ইলাউস্ সুনান ১৭/১১৬; আলমুগনী ১৩/৩৯৬
এটিও যদি সম্ভব না হয় তবে পরবর্তীতে যে কোনো দিন আকীকা করবে এবং এক্ষেত্রেও ৭-এর হিসাবের প্রতি লক্ষ রাখা যেতে পারে। এর সহজ নিয়ম হল, যে বারে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছে তার আগের দিন আকীকা করা। যেমন সোমবারে জন্মগ্রহণ করলে রবিবারে আকীকা করা।
আকীকা না করে কুরবানী করা
এমনও শোনা যায় যে, আকীকা না হয়ে থাকলে তা আদায় করা পর্যন্ত নাকি কুরবানী দেওয়া যায় না। এ ধারণা ভুল। আকীকা দেওয়া না-দেওয়ার সাথে কুরবানীর কোনো সম্পর্ক নেই; বরং কারো আকীকা না হয়ে থাকলেও ওয়াজিব কুরবানী অবশ্যই আদায় করতে হবে। আর সম্ভব হলে আকীকাও দিবে।
দাওয়াত অনুষ্ঠান করে নাম দেওয়া হয় “আকীকা”
অনেকে সন্তানের জন্মগ্রহণকে কেন্দ্র করে দাওয়াত অনুষ্ঠান করে। হোটেল রেস্তোরাঁ কিংবা হল রুমগুলোতে চুক্তি করে খানার আয়োজন করা হয়। সেখানে গোস্তের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব রেস্তোরাঁওয়ালাদের উপরই থাকে। এ অনুষ্ঠানকে যদিও আকীকা অনুষ্ঠান নাম দেওয়া হয় তবুও এতে আকীকার সুন্নত আদায় হবে না। শরীয়তের শেখানো পদ্ধতিতে পশু জবাইয়ের মাধ্যমেই আকীকা করতে হবে। -ইলাউস্ সুনান ১৭/১১৭; তুহফা ৭৫-৭৬
আজকাল আকীকা অনুষ্ঠানের রেওয়াজ বেড়েছে। কিন্তু খাইরুল কুরূনে আকীকাকে কেন্দ্র করে দাওয়াত করে খাওয়ানোর প্রচলন ছিল না। এ প্রথা পরবতীর্ যুগের। এ অনুষ্ঠানে অনেক ধরনের শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ হতে দেখা যায়। এগুলো না থাকলেও আকীকাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান না করাই শ্রেয়। কেননা সাহাবা তাবেয়ীনের যুগে এর প্রচলন ছিল না। আকীকার গোস্ত কাঁচা বা রান্না করে গরীব-দুখী, আত্নীয়-স্বজনকে দিবে এবং নিজেরা খাবে। -আলমাদখাল ৩/২৯২; তুহফা ৮০,৭২; ইসলামী ফিকহ ২/১০৫-১০৬
আকীকা অনুষ্ঠানে উপঢৌকনের রেওয়াজ
আকীকা অনুষ্ঠানে বাচ্চার জন্য বিভিন্ন উপঢৌকন আনার প্রচলনটিও ঠিক নয়। কেননা এতে কারও মুখলজ্জায় পড়ে উপঢৌকন দেওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। আর এভাবে কেউ কোনো জিনিস দিলে তা নেওয়া ও ব্যবহার করা জয়েয হয় না। -মুসনাদে আহমদ ৫/১১৩
মা বাবার জন্য আকীকার গোশত খাওয়া
এ ধারণাও কেউ কেউ রাখে যে, মা বাবা সন্তানের আকীকার গোশত খেতে পারবে না। ফলে আকীকার গোস্ত মান্নতের মতো পুরোটাই বিতরণ করে দেওয়া হয়। এটা ঠিক নয়। আকীকার গোস্ত সন্তানের মা-বাবাও খেতে পারবে। -ইলাউস্ সুনান ১৭/১১৬; তুহফা ৭৮
আকীকার প্রাণীর চামড়া
আকীকার চামড়ার হুকুম কুরবানীর চামড়ার মতোই। কিন্তু অনেককে এ চামড়া কসাইকে পারিশ্রমিক হিসাবে দিয়ে দিতে দেখা যায। অনেকে আবার চামড়াটি বিক্রি করে তার মূল্য নিজে ভোগ করেন। এ সবই ভুল। আকীকার চামড়া কুরবানীর চামড়ার মতো ইচ্ছা করলে নিজেরা ব্যবহার করতে পারবে, তবে যদি তা বিক্রি করা হয় তাহলে এ টাকা গরীব-মিসকীনকে সদকা করে দেওয়া জরুরি। -তুহফা ৮২-৮৩; ইলাউস্ সুনান ১৭/১১৭; আল মাদখাল ৩/২৯২
আকীকার গোস্ত বণ্টন করা
অনেকে মনে করে আকীকার গোস্ত থেকে ফকীরদেরকে দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। এ গোস্ত আত্মীয়-স্বজন ও নিজেদের জন্য। এটি ভুল। আকীকার গোস্ত কুরবানীর গোস্তের মতোই ফকীর মিসকীনদের দেওয়ার নিয়ম আছে। -তুহফা ৭৯
আকীকার প্রাণী
অনেকে মনে করে, ছাগল ছাড়া আকীকা করা যায় না। এটি ভুল ধারণা। যে সব প্রাণী দ্বারা কুরবানী জায়েয সে সব প্রাণী দ্বারা আকীকাও জায়েয। এমনকি গরু মহিষ ও উটের এক সপ্তমাংশ দ্বারাও আকীকা করা যাবে। তবে শর্ত হচ্ছে ওই পশুর বাকি ছয় অংশও কুরবানী, আকীকা বা এ ধরনের পুণ্যের উদ্দেশ্যে হতে হবে। হাদীস শরীফে এসেছে, আনসারী সাহাবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করলে উট জবাই করে আকীকা করা হয়েছিল। অবশ্য আকীকার জন্য গরু, মহিষ ও উটের চেয়ে ছাগল বা দুম্বাই উত্তম। -মুসতাদরাকে হাকেম ৪/২৩৮; তুহফা ৭৭; ইলাউস্ সুনান ১৭/১১৬-১১৭
নিজের আকীকার গোশত খাওয়া
সন্তান বড় হয়ে যাওয়ার পর তার আকীকা করা হলে ওই সন্তান নিজের আকীকার গোশত খেতে পারবে না ভাবা হয়। এটিও ভুল ধারণা।
একটি ভ্রান্তি
আকীকার দিনের একটি রেওয়াজ আছে যে, এদিনে সন্তানের হাতে কলম খড়ি দেওয়া হয়, দেওয়া হয় সোনা-রূপা ও টাকা-পয়সা। যেন বড় হয়ে সে পড়া-লেখা শিখে অনেক অর্থবিত্ত গড়তে পারে। এগুলোর সাথে শরীয়তের কোনোই সম্পর্ক নেই। এগুলো নিছক কু-রসম, যা পরিত্যাজ্য। -আলমাদখাল ৩/২৯০
আকীকার হুকুমকে গুরুত্ব না দেওয়া
অনেকে আকীকার প্রতি গুরুত্ব দেয় না, এটা ঠিক নয়। কেননা আকীকা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। একাধিক সহীহ হাদীসে এর প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। খতনা বিষয়ক ভুলত্রুটি
খতনা অনুষ্ঠান
অনেকে সন্তানের খতনা উপলক্ষে খানা-পিনার অনুষ্ঠান করে থাকে। খতনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান করাটা শরীয়তের কোনো হুকুম নয়।
সাহাবী হযরত উসমান বিন আবিল আস রা.কে খতনা উপলক্ষে দাওয়াত করা হলে তিনি সেই দাওয়াতে অংশগ্রহণ করতে অসম্মতি প্রকাশ করেন এবং বলেন,
إِنَّا كُنَّا لَا نَأْتِي الْخِتَانَ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَا نُدْعَى لَهُ.
অর্থ: রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে আমরা খতনাকে কেন্দ্র করে সমবেত হতাম না এবং আমাদেরকে এজন্য দাওয়াতও দেওয়া হত না”। -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৭৪৫০ (৪/২১৭)
মনে রাখা আবশ্যক, খতনা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শরীয়ত বিরোধী অন্য কোনো জিনিস না পাওয়া গেলেও পূর্বোক্ত হুকুম প্রযোজ্য। কিন্তু আজকাল অনুষ্ঠানে আরও অনেক ধরনের গুনাহের সমারোহ ঘটে থাকে। এতে করে এই অনুষ্ঠানের অবৈধতা আরও প্রকট আকার ধারণ করে।
কুদরতী খতনা
কোনো সন্তান জন্মগতভাবে কিংবা ঘুমন্ত অবস্থায় কুদরতীভাবে খতনা হয়ে যায়। একে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়। নাম যাই দেওয়া হোক না কেন, কোনো ছেলের ব্যাপারে এমনটি ঘটলে তার থেকে পানি পড়া নেওয়া কিংবা তাকে আল্লাহ তা’আলার খাস বুযুর্গ ভাবা একটি হাস্যকর ব্যাপার।
খতনার পর চামড়া বেড়ে গেলে
এক্ষেত্রে চামড়া বেড়ে অগ্রভাগ ঢেকে গেলেও পুনরায় খতনার প্রয়োজন মনে করা হয় না। অথচ একবার খতনা করার পর আবার কোনো কারণে চামড়া বেড়ে সামনের অধিকাংশ ঢেকে গেলে আবারও খতনা করা জরুরি। এর জন্য পূর্বের খতনা যথেষ্ট নয়।
নওমুসলিমের খতনা
প্রাপ্তবয়স্ক কোনো বিধর্মী ইসলামগ্রহণ করলে তার খতনাকে জরুরি মনে করা হয় না অথচ সাবালক হলেও তার খতনা করা অপরিহার্য। -সহীহ বুখারী-ফাতহুল বারী ১/৯১; আল ইসতিযকার ২৬/২৪৫; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩৮২