সফর ১৪২৮   ||   মার্চ ২০০৭

অধীনদের প্রতি দয়া প্রদর্শন

ইসহাক ওবায়দী

রেডিও বাংলাদেশে আমার চাকুরি করার প্রাক্কালে আমার অতি প্রিয় দুইজন বস ছিলেন। একজন হলেন রেডিও বাংলাদেশ ঢাকা কেন্দ্রের প্রধান জনাব আশফাকুর রহমান খান। অন্যজন আমার সেকশন সংবাদ প্রবাহ-এর অনুষ্ঠান প্রযোজক জনাব নবীদুর রহমান। আশফাক সাহেব একসময় রেডিওতে অনুষ্ঠানঘোষক হিসেবে কাজ করেছিলেন। পরে অফিসার পদে যোগ দিয়ে রেডিওর একজন জনপ্রিয় পরিচালক পর্যন্ত হয়েছেন। সম্ভবত তিনি এখন অবসর গ্রহণ করেছেন। একটা কথা আছে, মানুষ উপকারীর গোলাম হয়ে যায়। আমার কাছেও তিনি উপকারের কারণেই এতটা প্রিয় হয়েছেন। আমার প্রথম আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট করার সময় একজন গেজেটেড অফিসারের দস্তখত প্রয়োজন হওয়াতে আমি তার কাছে যাই। তিনি আগ-পাছ কিছু না ভেবেই আমার মতো একজন অপরিচিত প্রায় নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারীর পাসপোর্টের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমার গ্রাণ্টার হয়ে গেলেন দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। শুনেছি, বিদেশে পাসপোর্ট হোল্ডারের কোনো সমস্যা দেখা দিলে, এই গ্রাণ্টার ব্যক্তিকেই তা সামলাতে হয়। এত ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিষয়ে তিনি আমার গ্রাণ্টার হয়ে আমার উপকার করলেন দেখে আমি তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লাম।

আজকের নতুন সংসদ ভবনের সামনের খালি জায়গায় একসময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা বসত। তখনো সংসদ ভবনটি চালু করা সম্ভব হয়নি। আমাদের সংবাদ প্রবাহ অনুষ্ঠানের জন্য আমি বাণিজ্যমেলায় গিয়ে কাজ সেরে আসার পথে মানিক মিয়া এভিনিউতে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, পশ্চিম দিক থেকে আমার পাশে একটি প্রাইভেট কার এসে থামল। ভেতর থেকে কে যেন বলল, ওবায়দী গাড়িতে ওঠো। আমি দরজা খুলে গাড়িতে উঠে দেখলাম, ঢাকা রেডিওর সুপ্রিম অথরিটি পরিচালক আশফাক সাহেব তার শ্বশুরালয় সংসদ ভবন কোয়ার্টার থেকে অফিসে যাচ্ছেন। সন্ধ্যার পর রাত তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। মানিক মিয়া এভিনিউ তখনো লাইট-ফাইট দিয়ে এত সজ্জিত ছিল না। এতটা অন্ধকারে একটা চলতি গাড়ি থেকে তার একজন নগণ্য অধঃস্তন কর্মচারিকে রাস্তায় দেখতে পাওয়া এবং তাকে গাড়িতে উঠিয়ে নেওয়া আমার কাছে খুব সাধারণ কাজ মনে হয়নি। অথচ কোথাও অনুষ্ঠান কভারেজ দিতে গিয়ে আসার সময় গাড়ির জন্য যে আমাদের কত বিড়ম্বনা পোহাতে হত, তা বলে শেষ করার নয়। অনুষ্ঠানের জন্য বরাদ্দকৃত গাড়ি নিয়ে বসেরা বাজার-সাজার অথবা অন্য কাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর আমরা অনুষ্ঠান শেষে গাড়ির অপেক্ষায় হয়তো রাত পোহাচ্ছি। অনেক সময় মন্ত্রী-মিনিস্টারদের গাড়িতেও ড্রপ নিতে হত আমাদের।

শিল্পকলা একাডেমীতে এমনি এক অনুষ্ঠান শেষে আমার গাড়ির বিলম্ব দেখে রেডিওর তখনকার এক মহাপরিচালককে গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছেন দেখে নত স্বরে জানালাম, স্যার আমার গাড়ি আসেনি। তিনি গাড়িতে উঠতে উঠতে গম্ভীর স্বরে বললেন, অপেক্ষা করুন। এই বলেই সাঁ করে চলে গেলেন। আর আমার অপেক্ষার বিড়ম্বনা কে দেখে। একবার ভেতরে গিয়ে গাড়ির জন্য টেলিফোন করা আবার গেটে আসা। এই করতে করতেই হয়তো অনেক রাত হয়ে গেল। আচ্ছা আপনারাই বলুন দেখি! এই লোকটিকে আমি শ্রদ্ধা করব? নাকি ওই আশফাক সাহেবকে? যিনি অন্ধকার রাতেও তাঁর অধীন কর্মচারীকে রাস্তার পাশ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে নিজের গাড়িতে বসিয়েছিলেন। নবীদুর রহমান সাহেব হলেন দেশের অন্যতম সেরা চিকিৎসা বিজ্ঞানী, জাতীয় অধ্যাপক ডাক্তার নুরুল ইসলাম সাহেবের ভাগ্নে, আমার ইমিডিয়েট বস। আমার সেকশনের সুপ্রিম এক বস যে কোনো কারণে আমার উপর অন্যায়ভাবে অসন্তুষ্ট থাকায় ঘণ্টায়-ঘণ্টায় মিনিটে-মিনিটে আমার বিরুদ্ধে লেখা-লেখি করতেন। যেমন ৭টা থেকে ৭টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত আপনাকে অফিস কক্ষে পাওয়া যায়নি কেন? ইত্যাদি। এই সমস্ত অফিসিয়াল নোটের উত্তর আমার ইমিডিয়েট বস জনাব নবীদুর রহমান সাহেব খুব সুন্দর করে এমনভাবে দিতেন যে, ওই সুপ্রিম বসকে সব সময় তটস্থ করে রাখতেন এবং তিনি  এসব উত্তরে রীতিমতো হিমশিম খেয়ে যেতেন।

একবার মদীনা ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়ন করার জন্য সৌদী স্কলারশিপে আমি দরখাস্ত করেছিলাম। গোটা রেডিও অফিসে বিষয়টি শুধু নবীদুর রহমান সাহেবই জানতেন, আর কেউ জানত না। তিনি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফর আহমদের যেখানেই অনুষ্ঠান হত, সেখানে শুধু আমাকেই এসাইনমেন্ট দিতেন। উদ্দেশ্য দেখা-সাক্ষাতের মাধ্যমে যেন স্কলারশিপ কমিটির সভাপতি শিক্ষামন্ত্রীর দ্বারা আমি আমার কাজটা বাগিয়ে নিতে পারি।

নিউজ মিডিয়াতে অনুষ্ঠান যারা কভারেজ দেয়, তাদের সাথে সব সময় মন্ত্রী-মিনিস্টার বা উপরস্থ ব্যক্তিবর্গের ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। সব সময় এদেরকে সরাসরি রিপোর্ট করতে দেখে এদের সাথে সম্পর্ক হয়ে যাওয়া অবাস্তব কিছু নয়। এমনিভাবে মিডিয়া জগতের সুপ্রিম বস তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাবীবুল্লাহ খানের সাথে আমার বিশেষ সম্পর্ক হয়ে যাওয়াতে আমি আমার চাকরির স্থায়ীকরণ বিষয়ে একটি দরখাস্ত করেছিলাম। বিষয়টি আমার সেকশনে নবীদুর রহমান সাহেব ছাড়া আর কেউ জানত না। একদিন রাত ১০ টার দিকে অনুষ্ঠান শেষে সেকশনের অন্যান্য কলিগদের সাথে আমরা সবাই বাসার দিকে বের হচ্ছিলাম। এমন সময় দোতলা থেকে ঢাকা রেডিওর তৎকালীন প্রধান পরিচালক সাহেবও নেমে আসছিলেন। সবার সাথে আমাকে দেখে তিনি বড় করে বললেন, ওবায়দী সাহেব, আপনি বোধ হয় আপনার চাকরির স্থায়ীকরণ বিষয়ে মন্ত্রীর কাছে দরখাস্ত করেছেন, কিন্তু পদ কোথায়? আমি বললাম, কেন স্যার, আমাদের সেকশনেই তো দুটি পদ শূন্য হয়ে আছে। একটি কয়েস মারা গেল তার পদ, আরেকটি জামাল বিদেশে চলে গেছে তার পদ। তিনি আর কিছু বললেন না, চুপ হয়ে গেলেন। পরে মন্ত্রী হাবীবুল্লাহ খান যখন তার পি,এস মোমেন সাহেবকে বলতে লাগলেন যে, ওবায়দী সাহেবের রিপোর্টটি শাহবাগ থেকে আসতে এত দিন লাগে নাকি? তাড়াতাড়ি রিপোর্ট দিতে বলুন। তখন নিশ্চয়ই পরিচালক সাহেব আমার পদের স্থায়ীকরণটা না হওয়ার মতো করেই রিপোর্ট পেশ করেছিলেন। না হয় আমার কাজটা মন্ত্রী মহোদয় করতে চাওয়ার পরও না হবার কারণ কোথায়? এখন দেখুন নবীদুর রহমান চট্টগ্রামের লোক, আমার আত্মীয়ও নন এবং এলাকার লোকও নন। আর এই পরিচালক সাহেব আমার নোয়াখালীরই লোক কিন্তু দেশের একটি ছেলের চাকরি স্থায়ীকরণটা তার সহ্য হল না। বলুন, আমি কাকে শ্রদ্ধা করব? নবীদুর রহমান সাহেবকে, নাকি পরিচালক সাহেবকে?

জগতের নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে সাহাবী হযরত আনাস রা. বলেন, আমার বয়স যখন ১০ বছর তখন আমাকে আমার মা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর  খেদমতে দিয়ে যান। আমি তাঁর দরবারে প্রায় ১০ বছরকাল পর্যন্ত অবস্থান করেছি এবং খেদমত করেছি, কিন্তু এই দশ বছরের মধ্যে কোনোদিন আমাকে কেন শব্দটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবহার করেননি। অর্থাৎ কেন এটা করেছো, অথবা কেন এটা করনি? ইত্যাদি বলেননি। হযরত আনাস রা. মাত্র দশ বছরের একটি শিশু হিসাবে কত ব্যাপারেই তো তার ভুল-ভ্রান্তি হওয়ার কথা, কিন্তু দয়ার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো তাকে কেন শব্দটি পর্যন্ত বলেননি। কেমন মহানুভব ছিলেন তিনি, বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয়। যথাসম্ভব রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সর্বশেষ বাণীটি নামায ও দাস-দাসীর ব্যাপারেই সাবধান বাণী ছিল।

অধীনদের কাছ থেকে যারা যথাযথ কাজ উদ্ধার করতে আগ্রহী, তাদের উচিত, তারা যেন তাদের প্রতি দয়ার ব্যবহার দেখান। তাহলে তারা তাদের স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে আরও যত্নবান হতে বাধ্য। অধীনদেরকে অধীন মনে করে তাদের সাথে যা তা ব্যবহার করা ইসলাম কখনো অনুমোদন করে না। কাজের লোকদের সাথেও আমাদের যথাযথ দয়ার ব্যবহার করাই ইসলামের মহান বিধান। এ ব্যাপারে নবীর শেষ বাণীটিই অবিস্মরণীয়।

 

 

advertisement