মোতির হার
আমি কিছু দিন মক্কা নগরীর প্রবাসী ছিলাম। তার মধ্যে কোনো একদিন প্রচণ্ড ক্ষুধায় নিপতিত হলাম। ক্ষুধা দূরীভূত করার জন্য কোনো খাদ্যদ্রব্য জোগাড় করতে পারলাম না। হঠাৎ পথের মধ্যে একটি রেশমী কাপড়ের প্যাকেট পেলাম। তা আবার রেশমী সুতা দিয়েই বাঁধা ছিল। আমি ওটিকে উঠালাম এবং ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। ঘরে এসে প্যাকেট খুলে দেখলাম, তার মধ্যে একটি মোতির হার রয়েছে। ওরকম হার জীবনে আমি কখনও দেখিনি।
কোনো এক কাজে আমি ঘর থেকে বের হয়ে দেখলাম, এক বৃদ্ধ হাঁক-ডাক ছাড়ছেন। তার কাছে একটি পুঁটলির মধ্যে তখন পাঁচশ আশরাফি ছিল। তিনি বলছেন, “যিনি হারের প্যাকেটটি ফেরৎ দিবেন, এই পুঁটলিটি তাকে উপহার দেওয়া হবে।” আমি (মনে মনে) বললাম, আমি অভাবী, আমি ক্ষুধার্ত, আমি এই উপহার নিয়ে উপকার লাভ করতে পারি। আমি তাকে প্যাকেটটি ফেরৎ দিয়ে দিই।
আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, এদিকে আসুন। তারপর আমি তাকে ঘরে নিয়ে এলাম। তিনি আমাকে প্যাকেট, সুতা এবং মোতির আলামত ও তার সংখ্যা বললেন। আমি নিশ্চিত হয়ে তার কাছে প্যাকেটটি অর্পণ করলাম। তিনি আশরাফির পুঁটলিটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে আমার চিন্তায় পরিবর্তন এসেছে। আমি ওটি গ্রহণ করলাম না। আমি বললাম, “আমার কর্তব্যই ছিল এটি আপনার নিকট পৌঁছে দেওয়া। কাজেই কর্তব্য পালন করে কখনও বদলা নেওয়া যায় না।” তিনি আমাকে বললেন, “আপনাকে এটি গ্রহণ করতেই হবে।” একথা বলে তিনি অনেক পীড়াপীড়ি করলেন। কিন্তু আমি তা গ্রহণ করলাম না। অবশেষে তিনি চলে গেলেন।
এদিকে আমার কী হল? আমি মক্কা থেকে বের হয়ে সমুদ্রপথে রওয়ানা হলাম। মধ্য-সাগরে গিয়ে আমাদের জাহাজ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। মানুষগুলো ডুবে গেল। মাল-সামানা সব ধ্বংস হয়ে গেল। আমি জাহাজের একটি ভাঙা টুকরা ধারণ করে কোনো রকম প্রাণে বাঁচলাম। কিছুক্ষণ সাগরের মধ্যে হতভম্বের মতো কাটানোর পর ছোট্ট একটি দ্বীপে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে কিছু লোক বাস করত। আমি একটি মসজিদে আশ্রয় নিলাম। তারা যখন আমার কুরআন তেলাওয়াত শুনতে পেল, তখন আমার কাছে দলে দলে এসে বলতে লাগল, আমাদেরকে কুরআন পড়া শিখিয়ে দাও। আমি তাদেরকে কুরআন পড়া শিখিয়ে দিলাম। তারা আমাকে অনেক অর্থ-সম্পদ দ্বারা উপকৃত করল।
আমি সেই মসজিদে কুরআন শরীফ লেখা কতগুলো কাগজ পেলাম। আমি ওগুলো পড়তে লাগলাম। আমি লেখা পড়তে পারি দেখে লোকেরা আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি ভালো লিখতে পারেন? আমি বললাম, হ্যাঁ, পারি। তারা বলল, আপনি আমাদেরকে লেখা শিখিয়ে দিন। একথা বলে তারা আমার কাছে তাদের সন্তানদেরকে এনে দিল। আমি তাদেরকে লেখা শিখাতে লাগলাম। এখান থেকেও আমার অনেক অর্থ-সম্পদ লাভ হল। এরপর তারা আমাকে বলল, আমাদের কাছে একটি এতিম কিশোরী মেয়ে আছে, যার বেশ সয়-সম্পত্তিও আছে। আমরা চাই তাকে আপনার কাছে বিয়ে দিতে। একথা শুনে আমি আপত্তি করলাম। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। তারা আমাকে বলল, এ বিয়ে আপনাকে করতেই হবে। অবশেষে আমি সম্মতি প্রকাশ করলাম।
যখন আমি বাসর ঘরে মেয়েটির কাছে পৌঁছলাম, তখন হুবহু ওই হারটিই তার গলায় দেখতে পেলাম। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমি একদৃষ্টে অলংকারটি দেখতে লাগলাম। পরে পাশের লোকদের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। তারা বলল, “জনাব, তরুণীর দিকে লক্ষ্য না করে এভাবে অলংকারটির দিকে তাকিয়ে থেকে তো তার হৃদয় ভেঙে চুরমার করে দিলেন।” তাদের কথা শুনে আমি অলংকারের কাহিনীটি তাদের কাছে ব্যক্ত করলাম। তখন তারা চিৎকার দিয়ে উঠল এবং তকবীর ধ্বনিতে পুরো পরিবেশ মুখরিত করে ফেলল। আমি তাদেরকে বললাম, তোমাদের কী হয়েছে? তারা বলল, যে লোকটি আপনার নিকট থেকে এই অলংকারটি গ্রহণ করেছিলেন, তিনিই এই তরুণীর বাবা। তিনি বলতেন, “যিনি আমার কাছে এই অলংকারটি ফেরৎ দিয়েছেন তার মতো কোনো মুসলিম বর্তমান দুনিয়াতে নেই।” তিনি দু’আ করে করে বলতেন, “হে আল্লাহ, তুমি আমার সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটিয়ে দাও, আমি তাঁর কাছে আমার মেয়েটিকে বিয়ে দিব।” আর এখন তা বাস্তবায়িত হল।
আমি বেশ কিছুদিন মেয়েটির সাথে ঘর-সংসার করলাম। ইতিমধ্যে সে আমার ঔরসে দু‘টি পুত্র জন্ম দিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে যুবতী মারা গেল। তখন আমি ও আমার দুই পুত্র উত্তরাধিকারসূত্রে অলংকারখানির মালিক হলাম। এরপর আমার ছেলে দু‘টিও মারা গেল এবং পুরো হারটির মালিক আমি হয়ে গেলাম। আমি সেটি একলক্ষ দিনারের বিনিময়ে বিক্রি করলাম। আমার আজকের বিত্ত-বিভূঁই সে-সম্পদেরই অবশিষ্ট।
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল আলীম
সূত্র: ছাফাহাত মিন ছাবরিল উলামা পৃ. ২২৩-২২৪