আসুন, অগ্রিম ক্ষমার সুসংবাদ নিই
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বড়ই দয়ালু। তাঁর দয়া অসীম, অফুরন্ত। কলমের কালি শেষ হয়ে যাবে; কাগজ ফুরিয়ে যাবে তবু তাঁর দয়ার কথা, দানের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। তিনি বান্দার ক্ষুদ্র আমলেরও মূল্যায়ন করেন তা-ই নয়, এর বিনিময় অনেক বড় আকারে প্রদান করে থাকেন। তাই হাদীস শরীফে এসেছে,
لَا تَحْقِرَنَّ مِنَ الْمَعْرُوفِ شَيْئًا .
“কোনো সৎকাজকে ক্ষুদ্র ভেবে তাচ্ছিল্য করো না।” -সহীহ মুসলিম ২/৩২৯, হাদীস, ২৬২৬
যেকোনো একটি পাপে অসন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ যেমন জাহান্নামে নিক্ষেপ করার মতো প্রবল প্রতাপের অধিকারী, তেমনি কোনো একটি ক্ষুদ্র সৎকর্মে খুশি হয়ে জীবনের বিশাল পাপ-পঙ্কিলতার বোঝাও নিমিষেই ক্ষমা করে দেওয়ার মতো গাফূরুর রাহীমও তিনি। শুধু কি তাই? হাদীস শরীফে এমন অনেক নেক কাজের কথা এসেছে যা দেখতে অতি ক্ষুদ্র ও সহজসাধ্য মনে হলেও মহান আল্লাহর কাছে তা এতই প্রিয় যে, এর বদৌলতে জীবনের বিগত দিনের গুনাহসমূহ তো বটেই ভবিষ্যৎ জীবনের পাপ-পঙ্কিলতাও অগ্রিম ক্ষমা করে দেন। পাপ হওয়ার আগেই অগ্রিম ক্ষমার সুসংবাদপ্রাপ্ত সৌভাগ্যবান মানুষ সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ছিলেন, যারা জীবদ্দশাতেই এ সুসংবাদ পেয়েছিলেন যে, আল্লাহ তাঁদের বিগত ও আগত সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। যেমন বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবায়ে কেরামকে আল্লাহ তাআলা এ সুসংবাদ দিয়েছিলেন- ‘তোমরা যেমন খুশি আমল করতে থাক, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম।’ -সহীহ বুখারী ২/৬৭, হাদীস ৩৯৮৩
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার হযরত উসমান রা.কে সম্বোধন করে বললেন, ‘আল্লাহ তোমার পূর্বাপর এমনকি কেয়ামত পর্যন্ত যত দোষ-ত্রুটি হবে সব ক্ষমা করে দিয়েছেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩২৭২২; হিলয়াতুল আউলিয়া ১/৯৭
আর একবার তিনি উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. -এর জন্য এ মর্মে দুআ করেছিলেন যে, ‘আল্লাহ তোমার পূর্বাপর, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব গুনাহ ক্ষমা করে দিন।’ -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৭১১১
আল্লাহ তাআলার এই ক্ষমা, এই করুণা লাভের পথ এখনো খোলা রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত খোলা থাকবে। এ প্রবন্ধে এমন কিছু নেক আমলের কথা আলোচনা করব, যার ব্যাপারে হাদীস শরীফে এই প্রতিশ্রম্নতি এসেছে যে, বিগত জীবনের তো বটেই, ভবিষ্যত জীবনের পাপও আল্লাহ তাআলা অগ্রিম ক্ষমা করে দিবেন।
১. উসমান ইবনে আফফান রা.-এর ক্রীতদাস হুমরান রা. বলেন, প্রচণ্ড শীতের মওসুম। এক রাতে হযরত উসমান রা. অজুর পানি চাইলেন। পানি নিয়ে এলাম। তিনি তাঁর মুখমণ্ডলে ও হাতে প্রচুর পানি ঢালতে লাগলেন। আমি বললাম, হযরত প্রচণ্ড শীতের রাত! যথেষ্ট হয়েছে, পরিপূর্ণ অজু আপনি সেরেছেন। হযরত উসমান রা. বললেন, তুমি পানি ঢালতে থাক। আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাকে বলতে শুনেছি, যে বান্দা পরিপূর্ণরূপে ভালোভাবে (সমস্ত আদব-কায়দাসহ মাসনূন তরীকায়) অজু করল, তার বিগত ও আগত দিনের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। -বাযযার-মাযমাউয যাওয়ায়েদ ১/৫৪২, হাদীস ১২১৬
২. হযরত সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুয়াজ্জিনের
أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ
এর জবাবে একথা বলবে,
أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَضِيتُ بِاللَّهِ رَبًّا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، وَبِمُحَمَّدٍ نَبِيًّا
আল্লাহ তাআলা তার পূর্বাপর সব গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। এক ব্যক্তি (বিস্ময়ভরা কন্ঠে) বলে উঠল, ‘হে সাআদ, পূর্বাপর সব গুনাহ! হযরত সা‘দ রা. জবাব দিলেন, ‘আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এভাবেই বলতে শুনেছি। -আবু আওয়ানা ১/৩৪০
৩. হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব রা.কে বলেছেন, ‘হে আমার চাচা, আমি কি আপনাকে দান করব না? আপনার প্রতি অনুগ্রহ করব না? আপনাকে মঙ্গলের কথা বলব না? সুপথের সন্ধান দিব না? আপনাকে কি এমন দশটি কাজের কথা বলে দিব না যা করলে আল্লাহ তাআলা আপনার বিগত ও আগত, নতুন ও পুরাতন, ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত, ছোট ও বড়, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য-সব গুনাহের কালিমা মুছে দিবেন? অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সালাতুত তাসবীহ নামক নামায শিখিয়ে দেন। -আবু দাউদ ১/১৮৩-১৮৪, হাদীস ১২৯৭; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১২১৬
৪. আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসে রাত্রি জাগরণের জন্য পরামর্শমূলক আদেশ করতেন এবং বলতেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাস ও সওয়াবের আশায় রমজান মাসে রাত্রি জাগরণ করবে তার পূর্বাপর সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৭২৩৮; সুনানে কুবরা, নাসায়ী, হাদীস ২৫১২
৫. হযরত উবাদা ইবনে সামেত রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, লাইলাতুল কদর রমযানের শেষ দশকে। যে ব্যক্তি সওয়াবের আশায় ওই রাত্রিগুলি জাগ্রত থাকবে, আল্লাহ তাআলা তার পূর্বাপর সব গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। আর লাইলাতুল কদর রয়েছে বেজোড় রাত্রিসমূহে। যেমন উনত্রিশ, সাতাশ, পঁচিশ, তেইশ বা শেষ রাত্রিসমূহ। -মুসনাদে আহমদ ৫/৩২১, হাদীস ২২২৩৫
৬. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আরাফার দিনের রোযা বিগত এক বছর এবং আগত এক বছরের পাপসমূহ মুছে দেয়। -সহীহ মুসলিম ১/৩৬৮, হাদীস ১১৬২
৭. উম্মে সালমা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি মসজিদে আকসা হতে মসজিদে হারামের উদ্দেশ্যে হজ্ব বা উমরা করতে আসবে তার পূর্বাপর সকল গুনাহ মাফ হয়ে যাবে এবং তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।’ -আবু দাউদ ১/২৪৩, হাদীস ১৭৪১
৮. জাবির রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি যথাযথভাবে হজ্বের কার্যাদি সমাপন করল এবং মুসলমানরা তার হাত ও মুখ থেকে নিরাপদ থাকল তার পূর্বাপর সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ -আহমাদ ইবনে মানী-আলমাতালিবুল আলিয়া, হাদীস ১২৩৪
৯. সাহল ইবনে মুআয ইবনে আনাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি খাওয়ার পর এ দুআ পড়ল
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَطْعَمَنِي هَذَا الطَّعَامَ، وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّي وَلَا قُوَّةٍ.
তার পূর্বাপর সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে এবং যে ব্যক্তি কাপড় পরিধানের পর এ দুআ পড়ল
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي كَسَانِي هَذَا الثَّوْبَ وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّي، وَلَا قُوَّةٍ .
তার পূর্বাপর সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।’ -আবু দাউদ ২/৫৫৮ হাদীস ৪০২৩
১০. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, জুমার নামাযে তিন ধরনের লোক উপস্থিত হয়ে থাকে। কিছু লোক জুমায় এসে অনর্থক কাজ কিংবা কথাবার্তায় লিপ্ত হয়; যেহেতু এটাই তার প্রাপ্য। আর কিছু লোক এসে দুআ মুনাজাতে মশগুল হয়। যেহেতু তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে, তাই তিনি তা কবুলও করতে পারেন, চাইলে ফিরিয়েও দিতে পারেন। আর কিছু লোক জুমায় এসে একাগ্রচিত্তে নিশ্চুপ ও নীরব বসে থাকে। কোনো মুসলমানকে ডিঙ্গিয়ে সামনে এগিয়ে যায় না এবং কাউকে কোনো কষ্ট দেয় না। ফলে এ জুমা হতে পরবর্তী জুমা এবং আরও অতিরিক্ত তিনদিনের পাপ-পঙ্কিলতা ক্ষমা করে দেওয়া হয়। কারণ, আল্লাহ পাক বলেছেন,
مَنْ جَآءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهٗ عَشْرُ اَمْثَالِهَا
যে ব্যক্তি একটি সৎকাজ করল, সে তার দশগুণ প্রতিদান পাবে। -আবু দাউদ ১/১৫৮, হাদীস ১১১৩
উল্লেখিত হাদীসগুলো ছাড়াও এধরনের সুসংবাদবাহী আরও একাধিক হাদীস রয়েছে। আল্লাহ তাআলা এধরনের নেক কাজে প্রতিযোগিতা করে আমাদের কে পাপ-পঙ্কিলতা মূক্ত একটি সুন্দর আদর্শ ইসলামী জীবন গড়ার তাওফীক দান করুন।