হাদীসের সফল অধ্যয়ন, কীভাবে?
প্রশ্ন : আপনি কি কোনো ব্যক্তিকে একা একা বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফের হাদীস অধ্যয়নের পরামর্শ দিবেন?
শায়খ নূহের উত্তর : যে কোনো মুসলমান বুখারী এবং মুসলিম শরীফের হাদীস পড়ে উপকৃত হতে পারবে, সেটা সে নিজে একা একা পড়–ক অথবা অন্যের মাধ্যমে পড়–ক। কিন্তু কথা যদি হয় হাদীস অধ্যয়নের বিযয়ে, তবে শাইখ শোআইব আল-আরনাউত, যার কাছে আমি এবং আমার স্ত্রী ইদানীং ইমাম সুয়ুতী রহ. এর “তাদরীবুর রাবি” বইটি অধ্যয়ন করছি; তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, উলূমুল হাদীস অনেক ব্যাপক এবং জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, বিশাল তথ্যসমুদ্র নিয়ে আলোচনা করে, যে সমুদ্রের জাহাজ চালনায় একজন দক্ষ নাবিক প্রয়োজন। যোগ্যতা ছাড়া যেকেউ এর অথৈ পানিতে ডুবে যেতে বাধ্য। সংশ্লিষ্ট বিষয়েই একবার শায়খ শোআইব আমাদেরকে বলেছিলেন,“ইসলামের যে কোনো শাখায় যার কোনো ওস্তাদ নেই, শয়তান তার ওস্তাদ”। অন্য কথায়, সাধারণ মুসলমান কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে হাদীস পড়ে উপকৃত হতে পারবে, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে উপকৃত হতে পারবে না, যদি না সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয় এবং হাদীস সংক্রান্ত অন্যান্য সাহিত্য বিশেষ করে হাদীসের শরাহ্ বা ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোর বিস্তারিত বিবরণের সাহায্যে হাদীসটির মর্মার্থ এবং সার্বিকভাবে ইসলামের সাথে তার সম্পর্ক নিরূপণ করতে না পারে।
বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীস পড়ে একজন সাধারণ মুসলমান যে বিষয়ে উপকৃত হতে পারবে তা হচ্ছে, আল্লাহ সম্পর্কে বিশ্বাস, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বিশ্বাস, আখেরাতের উপর বিশ্বাস, আখলাক, সৎ কাজের উৎসাহ, গুনাহ থেকে বিরত থাকা, নামাযের গুরুত্ব, রোযার গুরুত্ব, নফল নামাযের ছওয়াব, তাহাজ্জুদ নামায, সোমবারে ও বৃহস্পতিবারে রোযা রাখার ছওয়াব ইত্যাদি। যেকোনো মুসলমান এই বিষয়ের হাদীসগুলো পড়ে আমল করলে সে হাদীসগুলো পড়ার জন্য প্রচুর বিনিময় পাবার আশা রাখতে পারে। এমনকি সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আখলাক বা চরিত্রকে নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টার মাধ্যমে দো-জাহানের প্রভূত মঙ্গল অর্জন করতে পারবে। হাদীস পড়ার মাধ্যমে (একজন ওস্তাদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে কিছুদিন অধ্যয়ন ছাড়া) যে দুটি বিষয় অভিপ্রেত নয় তা হল, আলেম হবার চেষ্টা করা এবং শরীয়তের ফিকহী মাসআলা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেওয়ার চেষ্টা করা। অনেক হাদীস রয়েছে যা আনাড়ি পড়–য়া একজন পথ প্রদর্শক ছাড়া নিজে নিজে পড়ে ভুল বুঝবে এবং এই ভুলগুলো তার জীবনে অঙ্গীভূত হয়ে যাবে। ভুলগুলো যদি না শুধরানো হয় তবে ধীরে ধীরে জমতে জমতে স্তুপীকৃত হয়ে উঠবে এবং সে এই ভুলগুলো থেকে পরিত্রাণের পথও খঁুজে পাবে না। এক পর্যায়ে তার দ্বারা একা একা আলেম হওয়ার আশা প্রহসনে পরিণত হবে। এই ধরনের ব্যক্তি আধুনিক ধর্মীয় গোঁড়ামিপূর্ণ মতাদর্শের খুব সহজ শিকারে পরিণত হয়। তারা তথাকথিত খাঁটি ধর্মমতের পোশাক পরে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে কুরআন ও হাদীস থেকে উদ্ধৃতিময় বই-পত্র ছাপিয়ে স্বল্পজ্ঞানী লোকদের সামনে মোহময় যুক্তির অবতারণা করে, যে রকম প্রচেষ্টা কিনা ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে বাতিল ফেরকার লোকেরা করে আসছে যে, “তারাই একমাত্র শুদ্ধ” বাকিরা পথভ্রষ্ট।
এই রকম একটি আন্দোলনের লোকেরা প্রমাণ হিসেবে একটি হাসান হাদীস পেশ করে। আয়েশা রা. থেকে হাকিম তিরমিযী রহ. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শিরক আমার উম্মতের মধ্যে অন্ধকার রাত্রিতে মসৃণ পাথরের উপর দিয়ে পিপিলিকার চলা থেকেও অধিক লুক্বায়িত। -নাওয়াদিরুল উসূল ফি মারিফাতি আহাদীসির রাসূল ৩৯৯
এই হাদীসটি একটি দল কর্তৃক উদ্ধৃত হয়, সাধারণ মানুষকে বোঝানোর জন্য যে, বেশির ভাগ মুসলমান সত্যিকার অর্থে মুসলমান নয়; বরং মুশরিক। যারা তাদের আলেমদের মতের সাথে একমত নয় তারা ইসলামের গণ্ডির বাইরে।
এর উত্তরে আমরা বলতে পারি যে, মুহাদ্দিসগণ বলেন, এই হাদীসে যে কথাটি বলা হয়েছে তা সাধারণভাবে শিরকে আসগর বা লঘু শিরকের ব্যাপারে বলা হয়েছে, যেটা গুনাহ হলেও কাফিরে পরিণত করে না।
শরীয়তে “শিরক” শব্দের অর্থে প্রকারভেদ রয়েছে। তা দু‘টি অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রথমত শিরকে আকবর বা গুরুতর শিরক, যেটা ইবাদতের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমা করেন না কেউ যদি তাঁর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার স্থাপন করে, কিন্তু ক্ষমা করেন এটা ছাড়া যাকে ইচ্ছা।” -সূরা নিসা ৪৮
এখানে আল্লাহ কুফরের শিরক সম্পর্কে বলেছেন। দ্বিতীয়ত, শিরকে আসগর বা লঘু শিরক যা কিনা গুনাহ সম্পর্কে বলা হয়েছে, সেটা ইসলাম থেকে কোনো ব্যক্তিকে খারিজ করে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সৃষ্টি বস্তু থেকে লাভ বা ক্ষতি হবার বিশ্বাসকে শিরক বলা হয়। কেননা লাভ ও ক্ষতি দেওয়ার একমাত্র মালিক আল্লাহ। আবার লোক দেখানো আমল, যা ‘রিয়া’ নামে পরিচিত তাকেও শিরক বলা হয়েছে। একটি সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন “নেক কাজে সামান্যতম লোক দেখানোও শিরক।” -আল মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন
দ্বিতীয় প্রকারের শিরক কাউকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয় না, যদিও এগুলো অবাধ্যতা ও ঈমানের স্বল্পতার পরিচায়ক। আলেমরা বলেন, উক্ত হাদীস দ্বারা শিরকে আসগর বা লঘু শিরক উদ্দেশ্য। এটা যদি শিরকে আকবর বা গুরুতর শিরকের ব্যাপার হত তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও একে “আমার উম্মতের” বলে উল্লেখ করতেন না। কেননা শিরকে আকবর বা গুরুতর শিরক ইসলাম থেকে আলাদা করে দেয়। এ ব্যাপারে এটাও উল্লেখযোগ্য যে, আবু বকর সিদ্দিক রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে ‘আমার উম্মতের’ পরিবর্তে “ফীকুম” বা ‘তোমাদের মধ্যে’ বলা হয়েছে
-নাওয়াদিরুল উসূল ৩৯৭, যা সরাসরি সাহাবাদেরকে নির্দেশ করে। হাদীসে বরং বলা হয়েছে শিরকে আসগর বা লঘু শিরক সম্পর্কে। হাদীসে উল্লেখিত শিরককে এতটা লু্ক্কায়িত বলা হয়েছে যে, তাকে অন্ধকার রাতে মসৃণ পাথরের উপর দিয়ে পিঁপড়ার চলার মতো যা অনুভব করা কঠিন বলা হয়েছে। এ কথা বলে বোঝানো হয়েছে যে, মানুষ তার সূক্ষ্ম প্রেরণার দ্বারা খুব সহজে এর মাধ্যমে প্রতারিত হতে পারে।
একইভাবে বুখারী শরীফের এক রেওয়ায়েতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “নিশ্চয়ই তোমরা অনুসরণ করবে তোমাদের পূর্ববর্তীদিগকে, প্রতি বিঘতে-বিঘতে এবং প্রতি হস্তে-হস্তে এমনকি তারা যদি সাপের গর্তে গিয়ে ঢুকে তোমরাও সাপের গর্তে গিয়ে পৌঁছাবে। সাহাবারা বললেন, ইয়া রসূলুল্লাহ, ইহুদী ও খ্রীস্টানদেরকে? তিনি বললেন আর কাদেরকে? -সহীহ বুখারী ৯/৭৩২০
এই হাদীসটি তথাকথিত আধুনিক ইসলামী সংস্কার আন্দোলনকারীদের কর্তৃক কুরআন ও সুন্নাহের দিকে প্রত্যাবর্তনের শ্লোগানের অন্তরালে এটা বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নী মুসলিম যারা মূলধারার সুন্নী মুজতাহিদ ইমামদের ফিকহের আকিদা পোষণ করে (যাদের শ্রেষ্ঠ রচনাদির সাথে তাদের মতের খুব একটা মিল হয় না) এ সমস্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরাই হাদীসটি দ্বারা উদ্দেশ্য। তারাই ইহুদী খৃস্টানদের অনুসারী গর্তে পতিত দল। অথচ এই উম্মতের নিষ্ঠাবান সংখ্যাগরিষ্ঠ জামাআতই আল্লাহ কর্তৃক গোমরাহী থেকে মুক্ত থাকবেন, এর পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণাদি রয়েছে।
মুসতাদরাকে হাকিমে রেওয়ায়েতকৃত একটি সহীহ হাদীসে আছে “আল্লাহর হাত জামাআতের উপর রয়েছে, যে কেউ জামায়াত ছেড়ে বিপদগামী হয় সে জাহান্নামে পতিত হবে।” -আল মুসতাদরাক ১/১১৬
অনেকে আবার কুরআনের আয়াত “তোমরা যদি পৃথিবীতে তাদের অধিকাংশকে অনুসরণ কর তবে তারা তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে পথভ্রষ্ট করবে।” (সূরা ৬/১১৬) উদ্ধৃতি হিসেবে পেশ করে একথা বোঝানোর জন্য যে, অধিকাংশকে অনুসরণের মধ্যে গোমরাহী বিদ্যমান। কিন্তু এখানেও অধিকাংশ বলতে ঐতিহ্যগত মুসলিম উলামাদেরকে বোঝানো হচ্ছে না। (তাঁরা কখনও পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্য থেকে ছিলেন না) এখানে বরং অমুসলিমদের বোঝানো হয়েছে যারা মনুষ্যজাতির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
পূর্বে উল্লেখিত হাদীসে ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে অনুসরণের উদ্ধৃতিটিতে ওই সমস্ত মুসলিমদের সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে যারা পাশ্চাত্য রীতি-নীতির অনুসরণ করে যৌক্তিক, অযৌক্তিক সমস্ত ব্যাপারে এবং তারা ইহুদী ও খৃস্টানদের অনুকরণে এতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে যে, সূদ (রিবা) ভিত্তিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে ইসলামের পবিত্র শহরগুলোকে পর্যন্ত অপবিত্র করতে ছাড়েনি। যার নজীর ইসলামের ইতিহাসে পাওয়া যায় না। অথবা হাদীসটি তাদের সম্পর্কে ব্যক্ত হয়েছে যারা গোঁড়া ধর্মমতের মাধ্যমে সংস্কার আন্দোলনের ছদ্মবেশে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, যেভাবে ইহুদী খৃস্টানরা তাদের নিজেদের ধর্মে করেছে। মূলধারার উলামা কেরামকে আল্লাহ এমন গোমরাহী থেকে হেফাজত রেখেছেন সেই ইলমের মাধ্যমে, যা একজন জীবন্ত ওস্তাদ থেকে অন্য জীবন্ত ওস্তাদ হয়ে অবিচ্ছিন্ন ধারায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছয়।
আমরা আমাদের প্রশ্নে ফিরে আসি, একটি সুশৃঙ্খল শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও বিজ্ঞ উস্তাদগণের সাহায্য গ্রহণ ছাড়া একা একা আলেম হওয়ার কিংবা শুধু বুখারী মুসলিমে যেসব হাদীস রয়েছে তার ভিত্তিতে ফতোয়া দিতে মনস্থ করা কখনো সমীচীন হবে না । কেননা শরীয়তের বিধান সংক্রান্ত সহীহ হাদীসসমূহ শুধু এই দুটি কিতাবেই পাওয়া যায় এমন নয়; বরং আরও প্রচুর কিতাব রয়েছে, সিদ্ধান্ত দেওয়ার ব্যাপারে যেগুলোর সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা অপরিহার্য।
আমি অন্য জায়গায় উল্লেখ করেছি যে, হাদীসগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে একজন আলেমের হাদীসের উসূল জানা থাকা দরকার। কেননা কিছু কিছু হাদীসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া অন্য হাদীসের উপর নির্ভরশীল অথবা নির্দিষ্ট কোনো কুরআনের আয়াতের উপর নির্ভরশীল, যে জ্ঞান ব্যতীত এবং যে জ্ঞান শেখার জন্য একজন সংশ্লিষ্ট ওস্তাদ ব্যতীত যে কেউ হোঁচট খেতে বাধ্য। এটি আমি খুব ভালো করে জানি। কারণ এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি যখন ১৯৮০ সালে জর্ডানে আসি, তখন একজন এই বলে আমার মনে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় যে, একজন মুসলমানের কুরআন ও সহীহ হাদীস ব্যতীত অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। আরবী কুরআন পড়ার পর A.J. ARBERRY কৃত ইংরেজী কুরআন অনুবাদ পড়ি তারপর MUHSIN KHAN অনূদিত সহীহ বুখারী প্রতিটি খন্ড পড়ে যা একজন মুসলমানকে করতে বলা হয়েছে তা আমি একটি খাতায় টুকে রাখা শুরু করি। এটা ছিল শতাব্দীব্যাপী ইসলাম যে জ্ঞানের মাধ্যমে পুষ্টি লাভ করেছিল তাকে কেটে ছেঁটে সংক্ষিপ্ত করার প্রয়াস, যা ওরিয়েন্টালিস্ট বা পাশ্চাত্যের ইসলাম গবেষকেরা আমাকে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিখিয়েছিল এবং এটা ছিল তথাকথিত খাঁটি ইসলামে ফিরে যাবার প্রচেষ্টা। এখানে এসে সালাফীবাদ বা আহলে হাদীস মতাদর্শ এবং ওরিয়েন্টালিজম বা পাশ্চাত্যের ইসলাম গবেষণাপ্রীতি এক বিন্দুতে মিলিত হয় ।
আমি একটি পাণ্ডুলিপি তৈরী করি বুখারী শরীফের চয়নকৃত হাদীস দ্বারা। একে এক ধরনের নিজের তৈরি শরীয়াহ্ পুস্তিকা বলা যায়। আমি এখনও এটা বুখারী শরীফের বিষয়সূচি হিসেবে ব্যবহার করি, যদিও এর মধ্যে লিখিত ফিকহী সিদ্ধান্তগুলো দেখে আমি এখন অত্যন্ত লজ্জাবোধ করি আমার আনাড়ি ইজতিহাদের নমুনার কারণে। যখন আমি হাদীসগুলো পড়তাম তখন আমার কাছে হাদীসগুলো পরস্পর সাংঘর্ষিক মনে হত, এর সমাধানের জন্য আমি সাংঘর্ষিক হাদীসগুলোর মধ্যে সেই হাদীসটিই গ্রহণ করতাম যেটি আমার ইচ্ছা হত, অথবা যে হাদীসটি আমার পাশ্চাত্য অভ্যাসের নিকটতম ছিল। আমার এই নীতির স্বপক্ষে দলীল হিসাবে আমি মনকে বোঝাতাম যে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময় কোনো সমস্যার দুটো সমাধানের মধ্যে অধিকতর সহজ সমাধানটাই বেছে নিতেন।” -সহীহ বুখারী ৮/২২০ হাদীস ৩৫৫০
আমাকে বলা হয়েছিল যে, দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করাটা সুন্নাহ নয় এবং একটি হাদীসও বলা হয়েছিল যে, আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, যে বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতেন তার কথা বিশ্বাস করো না। -মুসনাদে আহমাদ ৬/১৩৬ পরে আমি বুখারীর হাদীস পড়লাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করেছিলেন। -সহীহ বুখারী ১/৬৬ হাদীস ২২৪ অতঃপর আমি এ ব্যাপারে এই সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমাকে প্রথমে যা বলা হয়েছিল তা হয়তো ভুল অথবা দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা খুব একটা গর্হিত কাজ নয়। আমি এই ব্যাপারে ভুলমুক্ত হই যখন আমি শাফেয়ী ফিকহের আরবী পুস্তক “উমদাতুস সালিক” এর ইংরেজি অনুবাদ করতে যাই। আমি তখন জানতে পারি, আলেমগণ কীভাবে এই দু‘টি হাদীসের সমন্বয় সাধন করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করাটা ছিল উম্মতকে শেখানোর জন্য যে, এটা একেবারে হারাম না অথবা এটা দেখানোর জন্য যে, যেখানে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার ক্ষেত্রে শরয়ী ওজর আছে যেমন, কাপড়কে প্রসাবের ছিটা থেকে হেফাজত করা সেখানে তা জায়েযের পর্যায়ে পড়ে।
আমার অতীতের একা একা হাদীস অধ্যয়নের বিপজ্জনক প্রচেষ্টা যা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল, পরবর্তীতে ফিকহ অধ্যয়নের মাধ্যমে সেই হাদীসগুলোর সমন্বয় সাধনে সমর্থ হই। যেটা আমি আমার ব্যক্তিগত জ্ঞানের মাধ্যমে করতে অপারগ ছিলাম। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে, শীর্ষস্থানীয় হাদীসের ইমামগণ যেমন ইমাম বুখারী কেন ইমাম শাফেয়ীর ছাত্র আব্দুল্লাহ ইবনুয যুবায়ের আলহুমাইদির কাছ থেকে শাফেয়ী ফিকহ গ্রহণ করেছেন। (তাবাকাতুশ শাফিইয়্যা আলকুবরা) কেন ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিযী, ইমাম আবু দাউদ ও ইমাম নাসায়ী শাফেয়ী মাযহাব অনুসরণ করেছেন। -আলজামি লিলউসূল ফী আহাদীসির রাসূল, যেমনিভাবে ইমাম বায়হাকী, ইমাম হাকিম, আবু নুআইম, ইবনে হিব্বান, দারাকুতনী, বাগাবী, ইবনে খুযাইমা, সুয়ুতি, যাহাবী, ইবনে কাছীর, নূরুদ্দীন, হাইছামী, মুনযিরী, নববী, ইবনে হাজার আসকালানী, তাকীউদ্দীন আসসুবকী এবং আরও অনেকে শাফেয়ী মাযহাব অনুসরণ করেছেন। তদ্রƒপ আব্দুর রহমান ইবনুল জাওঝী আহম্মদ ইবনে হাম্বল এর মাযহাব এবং আবু জাফর আতত্বহাবী, আলী আলকারী, জামাল উদ্দীন আযযাইলায়ী (অনেকে তাঁকে ইবনে হাজার আসকালানীর থেকেও বড় আলেম মনে করেন) বদরুদ্দীন আইনী প্রমুখ হানাফী মাযহাব অনুসরণ করেছেন। হাদীসের ইমামদের এই বাস্তব অবস্থা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে তাদের চোখে শরীয়তে হাদীসের কী মাকাম ছিল। তাঁদের জন্য ব্যাপারটা এমন ছিল না যে, তারা ফিকহ মানবেন না হাদীস মানবেন? যেটা আজকের মুসলমানদের মধ্যে অনেকে খুব জোর দিয়ে ইঙ্গিত করেন। বরং তারা অনুসরণ করেছেন হাদীসের সেই ফিকহ বা সিদ্ধান্ত যেটা অঙ্গীভূত ছিল ঐতিহ্যগত মাযহাবের মধ্যে। অনেকের জন্য সুযোগ রয়েছে সেই সমস্ত ইমামদের কর্মনীতি থেকে উপকৃত হবার।
লেখক পরিচিতি
শায়খ নূহ হা মীম কেলার একজন আমেরিকান মুসলমান। তিনি একজন ইসলামী আইনশাস্ত্র বিশারদ ও অনুবাদক। ১৯৫৪ সালে উত্তর-পশ্চিম আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে দর্শন ও আরবী ভাষায় আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সমাপন করেন। তারপর কায়রো গিয়ে আলআযহারে ১৯৭৭ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং পরে ইলমে হাদীস, ফিকহে শাফেয়ী, ফিকহে হানাফী, উসূলে ফিকহ ও আকীদা বিষয়ে সিরিয়া ও জর্ডানে অধ্যয়ন করেন। সেখানে তিনি ১৯৮০ সাল থেকে বসবাস করছিলেন। তার ইংরেজি অনুবাদকর্ম “উমদাতুস সালিক” (পথিকের নির্ভর) [১২৫০ P.P. SUNNA BOOKS, ১৯৯৯] হল কোনো ইউরোপীয় ভাষায় অনুদিত প্রথম ইসলামী আইনগ্রন্থ, যেটা আলআযহারের মতো মুসলমানদের প্রাচীনতম উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি সিরিয়া ও জর্ডানের কয়েকজন ওস্তাদের কাছ থেকে “ইজাযত” প্রাপ্ত। তাঁর অন্য অনুবাদকর্মের মধ্যে রয়েছে ইমাম নববী রহ.-এর “মাকাসিদ” সুন্নীদের আকীদার উপর একটি পুস্তিকা, এবং তাসাওউফ সংক্রান্ত শাধিলি তরিকার একটি পুস্তিকা। তিনি বর্তমানে ইমাম নববী রহ. এর ১২২৭ টি হাদীস সম্বলিত দুআ ও জিকিরের গ্রন্থ “কিতাবুল আযকার”-এর একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ অনুবাদ করছেন।
অনুবাদে (সংক্ষিপ্ত) : মহসীনুল কবির