আমরা তো ‘নঙ্গে হোসাইন’
দক্ষিণবঙ্গের সুবৃহৎ দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলনা দারুল উলূমের মুহতামিম ও শাইখুল হাদীস মাওলানা মাহমূদুর রহমান সাহেবের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তার দারুল উলূম দেওবন্দের ছাত্র জীবন ও সেখানকার উস্তাদগণ সম্পর্কে। রাতের খাবারের ফাঁকে ফাঁকে তিনি বেশ খোলামেলা ভাবেই তার উস্তাদগণের স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি বলেন, আমি দারুল উলূম দেওবন্দে গিয়েছি ১৯৫১ সনের মাঝামাঝি সময়ে। পাঁচ বছর দারুল উলূমে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। ১৯৫৬ সনের মাঝামাঝিতে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করে দেশে ফিরে আসি। দারুল উলূমে অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. ও আল্লামা ইবরাহীম বলিয়াভী রহ. ছাড়াও মাওলানা ফখরুল হাসান রহ. এবং অন্যান্য আকাবির ছিলেন।
মাওলানা ফখরুল হাসান রহ.-এর কাছে মুসলিম শরীফ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। অত্যন্ত উঁচু পযার্য়ের মুহাদ্দিস ছিলেন। সাধারণত উর্দূতে তাকরীর করতেন তবে কখনো কখনো আরবীতেও করতেন। কেউ প্রশ্ন করলে বলতেন ‘ময়দান মে আ যাও’ ময়দান বলতে উস্তাদের সামনে চারপাশে যে ফাঁকা জায়গা থাকত সেটাকেই বোঝাতেন।
হযরতের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক করব বুঝতে পারছিলাম না। অনেক ভেবেচিন্তে একটা বুদ্ধি করলাম। হযরতের কাছে ছাত্ররা টাকা জমা রাখত। আমিও গিয়ে টাকা জমা রাখলাম। টাকা নেওয়ার সময় নাম জিজ্ঞেস করতেন, আমি নাম বলতাম, এভাবেই হযরত আমাকে চিনলেন।
আল্লামা বলিয়াভী রহ.-এর কাছে ছদরা, শরহে চিগমিনি ও তিরমিযী শরীফ পড়েছি। কিরাআত খালফাল ইমাম-এর বহছে ছয়দিন তাকরীর করেছেন।
আল্লামার একটা আজব ব্যাপার ছিল, কেউ যদি বলত, হযরত তবীয়ত শায়াদ আচ্ছী নেহী। তখন হযরতও বলতেন, হাঁ ভাই তবীয়ত খারাব হ্যায়। মনে হত যেন সত্যিই হজরতের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেছে।
শাইখুল ইসলাম রহ. এর কথা কী বলব। ছাত্র যামানায় নাম শুনে শুনে তাঁর আশেক হয়ে গিয়েছিলাম। ১৯৪৪ সালে আমি তখন হেফজখানায় পড়ি। ২৬ পারা হেফজ হয়েছে। সে বছর হযরত আমাদের এ অঞ্চলে সফরে এসেছিলেন। খাতুনগঞ্জে এক মসজিদে হযরতের প্রোগ্রাম ছিল। আমি সেখানে হযরতের সঙ্গে মুসাফাহা করতে গিয়েছিলাম। এ সফরের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা মনে পড়ে গেল। তখন ফযল কাদের চৌধুরী মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট। তিনিও হযরত রহ.-এর সঙ্গে সাক্ষাত করতে উপস্থিত। পরনে স্যুট কোট ছিল। মুসাফাহার জন্য হাত বাড়ালে শাইখুল ইসলাম রহ. মুসাফাহা করলেন না। বললেন, এই লেবাস পরবেন না। খদ্দরের পাঞ্জাবি, খদ্দরের পাজামা পরবেন। ইংরেজদের কোনো কিছুই হযরত বরদাশত করতে পারতেন না। ফযল কাদের চৌধুরী সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসেন। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। ইশার আগে খদ্দরের নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি বানিয়ে সেই পাজামা-পাঞ্জাবি পরে চৌধুরী সাহেব আন্দরকিল্লা জামে মসজিদে হাজির হলেন। হযরত তার নতুন লেবাস দেখে একটু মুচকি হাসলেন। এই হাসি পেয়ে চৌধুরীর সে কি আনন্দ।
মুসলিম হলে হযরতের বয়ানের প্রোগ্রাম হল। মুসলিম লীগের কিছু তরুণ ছেলেপেলে বলতে লাগল এখানে ওনার প্রোগ্রাম হতে দেব না। ফযল কাদের চৌধুরী তাদেরকে ধমক দিয়ে বলল, আমি জীবিত থাকতে প্রোগ্রাম বন্ধ করা যাবে না। খবরদার তোরা যদি তাঁর সঙ্গে বেআদবি করিস তাহলে শেষ হয়ে যাবি।
যাক আমি খাতুনগঞ্জে সাক্ষাত করতে আসলেও ভিড়ের কারণে মুসাফাহা করতে পারলাম না। মনটা খুব বিষন্ন হয়ে গেল। হযরতের পরবর্তী প্রোগ্রাম ছিল আন্দরকিল্লা জামে মসজিদে। আমার এক সঙ্গী ছিল হাফেজ ইসহাক। ওদের ওখানে খতমে তারাবী পড়াতাম। তাকে সঙ্গে নিয়ে আন্দরকিল্লা জামে মসজিদে পৌঁছুলাম। উদ্দেশ্য হযরতের সঙ্গে মুসাফাহা করা। তখন আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের ইমাম ছিলেন সৈয়দ আবদুল করীম রহ.। ইশার নামাযের সময় দুজনে বুদ্ধি করলাম, সৈয়দ সাহেব ফরয নামায পড়িয়ে সুন্নত-বিতর হুজরায় এসে পড়তেন। তার সঙ্গে শাইখুল ইসলাম রহ.ও চলে আসবেন। আমরা ওই সময় হুজরায় ঢোকার মুহূর্তে হযরতের সঙ্গে মুসাফাহা করব। সেইভাবেই ফরজ নামাযের পর দাঁড়িয়ে আছি। অন্যান্য লোকজনও সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেল। সবার সঙ্গে আমরা দুইজনও মুসাফাহা করলাম। মুসাফাহার পর ওইখানে দাঁড়িয়েই চোখের পানি ফেলে দুআ করেছিলাম, ইয়া আল্লাহ! তোমার এই বান্দার কাছে পড়ারও তাওফীক দিও। আল্লাহ তাআলা সেই দুআ কবুল করেছেন। হযরতের ইন্তেকালের আগের বছর আমরা তাঁর কাছে সহীহ বুখারী পড়েছি। দারুল উলূমে থাকাকালীন একবার খুব ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ঋণের পরিমাণ ছিল ৮০ টাকা। তখন ৮০ টাকা অনেক বড় কথা ছিল। দু’আনায় এক কেজি গোশত পাওয়া যেত। চার পয়সায় পাওয়া যেত একসের দুধ। তাই ৮০ টাকা সহজ কথা ছিল না। এদিকে হয়েছে আরেক বিপদ। আমি এক মসজিদে নামায পড়াতাম। খানার ব্যবস্থা ওখানেই ছিল। মাদরাসা থেকে যে খানা পেতাম তা ছ’টাকায় বিক্রি করতাম। এতে আমার হাত খরচ চলত। চট্টগ্রামেরই কিছু ছাত্র গিয়ে দফতরে জানিয়ে দিল মাহমুদুর রহমান অমুক মসজিদে থাকে। ওখানেই তার খানার ব্যবস্থা আছে। ফলে মাদরাসা থেকে আমার খানা বন্ধ হয়ে গেল। নিরুপায় হয়ে শাইখুল ইসলাম রহ.-এর কাছে দরখাস্ত দিলাম। হযরত ডাকলেন, মাহমুদুর রহমান ইসলামাবাদী কোন হ্যায়? সামনে গিয়ে বসলাম। হযরত দরখাস্ত পড়ে ধমক দিয়ে বললেন, এতনা রুপিয়া করজ কেঁউ হুয়া? আমি ভয়ে ভয়ে সব বলার পর একটি আমল দিলেন এবং মাদরাসার খানা জারি করে দিলেন। আমি আমল জারি রাখলাম। এক মাস যেতে না যেতেই আমার সব ঋণ তো শোধ হলই, বেশ কিছু টাকাও জমা হয়ে গেল। কিছুদিন পর একদিন সহীহ বুখারীর সবকে ছাত্ররা চিরকুট দিল। হযরত, মাহমুদুর রহমানকে আপনি আমল দিয়েছেন। সেই আমলের মাধ্যমে তার ঋণ পরিশোধ হয়ে বেশ টাকা-পয়সা জমা হয়েছে। আমাদেরকেও এই আমলের ইজাযত দিন। হযরত সবাইকে ইজাযত দিলেন। হযরত শায়খের বুখারীর দরসে, বিশেষত শেষ দিকে বড় বড় মুহাদ্দিস ও শাইখুল হাদীসগণ, এসে বসতেন। তাঁর বুখারীর দরস কবে শেষ হবে কেউ বলতে পারত না। এজন্য সম্ভাব্য সময়ের সপ্তাহ, দেড় সপ্তাহ আগে থেকেই বিভিন্ন মাদরাসার বড় বড় মুহাদ্দিসরা এসে পড়তেন। শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ., মাওলানা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী রহ.সহ আরও অনেকে। আমাদের বছর যেদিন হযরতের সবক শেষ হবে সেদিন শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ., মাওলানা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী রহ., আল্লামা ইবরাহীম বলিয়াভী রহ. এবং দারুল উলূমের সকল উস্তাদ উপস্থিত ছিলেন। উক্ত তিনজন দাঁড়িয়ে আমাদেরকে ইজাযত দিলেন।
হযরত ফারেগীনদের প্রত্যেককে এক মুঠ করে আরবী খেজুর দিতেন। আর অন্য ছাত্রদেরকে ছিটিয়ে দিতেন।
সবশেষে দুআ শুরু হল। হযরত রহ. খুব লম্বা দুআ করতেন না। মনে আছে সেই দুআয় হযরত বলেছিলেন “খোদায়া, মেরে ইন আযীযোঁ কো রুসওয়া না কর দুনয়া মে আওর আখিরাত মে।” এই বাক্যটি হযরত তিনবার বলেছিলেন। দ্বিতীয়বার বলার সময়ই এমন কান্নার রোল উঠেছিল যে, মনে হচ্ছিল দারুল হাদীস ধ্বসে পড়ে যাবে। সেদিন বেশ কজন বেহুশও হয়ে গিয়েছিল। উপস্থিত মুহাদ্দিসগণ সবাই জার জার হয়ে কাদঁছিলেন। কিন্তু শাইখুল ইসলাম রহ. শান্ত ছিলেন। হযরতের এই এক গুণ ছিল। বড় কঠিন মুহূর্তেও ধীরস্থির থাকতেন। এরপর খুব তাড়াতাড়ি দুআ শেষ করে দিলেন। শাইখুল ইসলাম রহ.-এর একটি অভ্যাস ছিল তিনি কোথাও সফরে যাওয়ার সময় ঢিলেমি করতেন না। নির্ধারিত সময়ে বেশ আগেই স্টেশনে পৌঁছে যেতেন।
শাইখুল ইসলাম রহ. এর কত কথা, কত স্মৃতি রয়েছে, তার কয়টা বলব। হযরতের নিসবতেই চলছি। উস্তাদগণের দুআ ও নেকনজর ছাড়া আর কিছু নেই। চেহারা-সুরত ভাল নয়, তাকরীর ভাল না, এলেম-কালাম তো নেইই । হযরত শাইখের শাগরিদ পরিচয় দিতেও লজ্জা হয়। শাইখুল ইসলাম রহ. নিজের নামের সঙ্গে লিখতেন নঙ্গে আসলাফ (পূর্বসূরীদের লজ্জা)। সেটা ছিল তাঁর বিনয়। আর আমরা প্রকৃতপক্ষেই নঙ্গে হুসাইন আহমদ (হুসাইন আহমদের লজ্জা)।
সংগ্রহ ও সংকলন : মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ