বিদআত
কিছু যুক্তি ও পর্যালোচনা
বিদআতপন্থী লোকদের যদি কোনো বিদআতের ব্যাপারে সতর্ক করে বলা হয় যে, এ কাজ বিদআত; অতএব তা পরিহার করুন, তখন তারা সেই বিদআতটি পরিত্যাগ করার পরিবর্তে নানা অর্থহীন প্রশ্নের অবতারণা করে এবং ভাবতে থাকে আমি যেহেতু প্রশ্ন করতে পেরেছি তাই আমার এ কাজটি আর বিদআত থাকল না! এ ধরনের কিছু অবান্তর প্রশ্নের নমুনা নিম্নে উল্লেখ করা হল।
১. বিদআতের বৈধতার জন্য রেল ও বিমানের দৃষ্টান্ত পেশ করা
কোনো বিদআতীকে যদি বলা হয়, ভাই তোমার এ কাজটি বিদআত; অতএব তা পরিহার করা উচিত, তখন সে ঝট করে বলে বসে, রেলগাড়িও তো বিদআত, উড়োজাহাজও তো বিদআত। কেননা এই সব যানবাহন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে ছিল না। তাহলে এসব যানবাহনে আরোহণ করে তোমরাও তো বিদআত করছ। কোনো কোনো মানুষ অজ্ঞতার চূড়ান্ত প্রদর্শনী করে বলতে থাকে, খোদ তোমার অস্তিত্বও তো বিদআত! তুমি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে ছিলে?!
বিদআতী লোকের এইসব প্রশ্ন করে মনে মনে ভাবতে থাকে, আমাদের কর্মের পক্ষে আমরা একটি বড় দলীল দিতে সক্ষম হলাম! অথচ এসব প্রশ্নই প্রমাণ করে যে, বিদআতের সংজ্ঞাটিও তাদের জানা নেই। বিদআতের সম্পর্ক হল দ্বীনী কাজকর্মের সঙ্গে। দুনিয়ার বস্তুসামগ্রী কিংবা জীবনযাত্রার ব্যবস্থাপনাগত পন্থা ও পদ্ধতির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। দুনিয়ার ব্যবহার্য সামগ্রী ও জীবনযাত্রার নব আবিষ্কৃত নানা অনুষঙ্গ কিংবা মানুষের দেহ ও অস্তিত্ব -এগুলোকে ‘বিদআত’ বলা চূড়ান্ত রকমের অজ্ঞতা।
বিদআত কী?
বিদআত কাকে বলে একথাটি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই বলে গেছেন। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ.
কেউ যদি আমাদের এই দ্বীনে কোনো নতুন বিষয় উদ্ভাবন করে তবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।’ -বুখারী, মুসলিম-মিশকাতুল মাসাবিহ ২৭
উপরোক্ত হাদীস থেকে স্পষ্ট জানা গেল যে, বিদআতের সম্পর্ক দ্বীনী বিষয়াদির সঙ্গে। যেসব বিষয় নতুন উদ্ভাবন করে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তা-ই বিদআত। অতএব রেলগাড়ি, উড়োজাহাজ ইত্যাদির দৃষ্টান্ত পেশ করা নিতান্তই মূর্খতা।
বলা বাহুল্য, যে কোনোভাবে তর্ক বিতর্ক করলেই এবং নানা অবান্তর প্রশ্নের অবতারণা করতে সক্ষম হলেই কোনো বিদআত ছওয়াবের কাজে পরিণত হয় না; বরং বিদআত বিদআতই থাকে এবং তা গুনাহের কাজ হিসাবে আখেরাতে শাস্তি ভোগের কারণ হয়।
২. বিদআত, তবে বিদআতে হাসানা!
কেউ কেউ তাদের কর্মকাণ্ডকে বিদআত হিসেবে স্বীকার করলেও এগুলোকে ‘হাসানা’ আখ্যা দিয়ে দায়মুক্ত হতে চায়। অথচ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন ,كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ
‘সকল বিদআত গুমরাহী।’ তাহলে শরীয়তের দৃষ্টিতে যা বিদআত তা কখনো হাসানা বা পুণ্যের কাজ হয় না। সবগুলোই সাইয়িআহ বা গুনাহের কাজ ও পরিত্যাজ্য। কোনো বিদআতকে ‘হাসানা’ নামে আখ্যায়িত করলেই তা যদি পুণ্যের কাজে পরিণত হয় তাহলে তো কোনো বিদআতই বিদআত থাকবে না এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী সকল বিদআত গুমরাহী- এটাও অর্থহীন হয়ে যাবে! নাউযুবিল্লাহ!
সুন্নত ছেড়ে ‘হাসানা’র প্রতি আগ্রহ কেন?
এখানে খুব স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটি আসে তা হল, হাদীসের কিতাবসমূহে অসংখ্য সুন্নত সহীহ সনদে বিদ্যমান রয়েছে। সে সুন্নতগুলোকে পরিত্যাগ করে কিছু মনগড়া জিনিস অবলম্বন করা অতঃপর সেগুলোকে ‘হাসানা’ আখ্যা দিয়ে তা পালন করতে থাকা কি সুস্থ বিচার-বিবেচনা এবং দ্বীনদারী ও খোদাভীতির পরিচায়ক হতে পারে? কুরআন হাদীসের বিজ্ঞ আলেমগণ এইসব কর্মকাণ্ডকে বিদআত হিসেবে চিহ্নিত করার পরও এগুলোকে আঁকড়ে ধরে রাখা মোটেই শুভবুদ্ধির পরিচায়ক নয়। বিদআতীদের কর্মকাণ্ডে আশ্চর্য ধরনের বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। তারা একদিকে বিদআতকে ফরয-ওয়াজিবের মতো অনুসরণ করে থাকে, অন্যদিকে সুন্নতকে, এটা তো সুন্নত; ফরয-ওয়াজিব নয়, বলে পরিত্যাগ করে। বলা বাহুল্য এটা ঈমানী চেতনার পরিপন্থী।
তদ্রƒপ যারা সুন্নতের অনুসরণ করে এবং বিদআত থেকে দূরে থাকে তাদেরকে অবজ্ঞা করে, এরা আহলুস সুন্নাহ বা সুন্নী নয় এমন বলে থাকে। এ জাতীয় কর্মকাণ্ডও যে জাহালাত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ কথা খুব ভালোভাবে চিন্তা করা দরকার যে, সত্যের পথে আহ্বানকারী কোনো ব্যক্তিকে ‘ওহাবী’ নামে আখ্যায়িত করে দিলেই কি কিয়ামতের দিন মুক্তি পাওয়া যাবে নাকি মুক্তির জন্য সকল ধরনের বিদআত পরিত্যাগ করে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক আমল করা অপরিহার্য?
একথাটিও খুব ভালোভাবে বুঝে নেওয়া উচিত যে, যেকেউ সনদ দিয়ে দিলেই যদি কোনো কাজ দ্বীনের অংশ হয়ে যেত এবং যেকোনো মনগড়া কাজেই যদি ছওয়াব পাওয়া যেত তাহলে কুরআন-হাদীস পঠন-পাঠনের কোনো প্রয়োজনই থাকত না। যদি সবার জন্য এই খোলা অনুমতি থাকত যে, যার যেমন ইচ্ছা সে তেমনই করতে পারবে এবং হাসানা নামে আখ্যায়িত করলেই সবকিছু দ্বীনের অংশ হয়ে যাবে তাহলে ইসলামের প্রকৃত রূপটি বহু আগেই বিলুপ্ত হয়ে যেত। দ্বীনের হেফাজত তাঁদের মাধ্যমেই হয়েছে যারা সুন্নত ও বিদআতের পার্থক্য বোঝেন এবং অন্যদের বুঝিয়ে থাকেন।
আমি যে কাজটি ছওয়াবের কাজ মনে করে করছি তা পুণ্যের কাজ হওয়ার কথা যদি কুরআন-সুন্নায় না থাকে এবং আমি নিজেও তা বিদআত হিসাবে স্বীকার করি তা হাসানা নামে হোক কিংবা অন্য কোনো নামে, এবং বিজ্ঞ আলেমগণ একে বিদআতে সাইয়িআহ হিসাবে চিহ্নিত করেন তাহলে সে কাজটি পরিত্যাগ করে হাশরের ময়দানে এমন আমল নিয়ে উপস্থিত হওয়াই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক যা পুণ্যের কাজ হওয়ার ব্যপারে কোনো সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ নেই। যে কাজে কোনো রকম জবাবদিহিতার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তা পরিহার করে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। আখেরাতে কি এই কথা বলে রক্ষা পাওয়া যাবে যে, আলেমগণ এইসব কাজকে যদিও বিদআত বলেছিলেন, কিন্তু আমরা এগুলোকে বিদআতে হাসানা ধরে নিয়ে পালন করেছিলাম? এ বিষয়গুলো আমাদের খুব শান্তমনে এখনই ভাবা দরকার।
৩. মুমিনগণের কাছে যা ভালো... কথাটির ভুল ব্যবহার
অনেক মানুষ তাদের বিদআতী কাজকর্মকে পুণ্যের কাজ সাব্যস্ত করার অভিপ্রায়ে নিম্নোক্ত বাক্যটি পেশ করে থাকেন।
مَا رَءَاهُ المُسْلِمُونَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللهِ حَسَنٌ.
‘যা মুমিনগণ ভালো মনে করেন তা আল্লাহর কাছে ভালো।’ তারা বলে থাকেন, যেহেতু আমরাও মুমিন এবং আমরা এই কাজ ভালো মনে করে উদ্ভাবন করেছি তাই তা আল্লাহর কাছেও ভালো।
যারা উপরোক্ত বাক্যটি দ্বারা নিজেদের বিদআতকে দলীলসিদ্ধ করার প্রয়াস পেয়ে থাকেন তাদের হয়তো জানাও নেই যে, এটি কার বক্তব্য। এ কথাটি সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন। কোনো কোনো বর্ণনাকারী কথাটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীরূপে অর্থাৎ মারফু হাদীসরূপে বর্ণনা করলেও সেই বর্ণনার সনদে সুলাইমান ইবনে আমর নাখায়ী নামক একজন রাবী রয়েছে, যার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের বক্তব্য হল এ ব্যক্তি হাদীস তৈরি করত। অতএব কথাটি মারফু হাদীস বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী হিসেবে প্রমাণিত নয়। আর সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. যা বলেছেন তা শুধু এটুকু নয়। এ কথাটির আগে আরেকটু কথাও আছে, যেখানে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণের প্রশংসা করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর পুরো কথাটি নিম্নরূপ,
إِنَّ اللهَ نَظَرَ فِي قُلُوبِ الْعِبَادِ، فَوَجَدَ قَلْبَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَيْرَ قُلُوبِ الْعِبَادِ، فَاصْطَفَاهُ لِنَفْسِهِ، فَابْتَعَثَهُ بِرِسَالَتِهِ، ثُمَّ نَظَرَ فِي قُلُوبِ الْعِبَادِ بَعْدَ قَلْبِ مُحَمَّدٍ، فَوَجَدَ قُلُوبَ أَصْحَابِهِ خَيْرَ قُلُوبِ الْعِبَادِ، فَجَعَلَهُمْ وُزَرَاءَ نَبِيِّهِ، يُقَاتِلُونَ عَلَى دِينِهِ، فَمَا رَأَى الْمُسْلِمُونَ حَسَنًا، فَهُوَ عِنْدَ اللهِ حَسَنٌ، وَمَا رَأَوْا سَيِّئًا فَهُوَ عِنْدَ اللهِ سَيِّئٌ "
‘আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর অন্যদের ক্বলবের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন এবং দেখলেন যে, সাহাবীগণের ক্বলবই সর্বোত্তম। ফলে তাদেরকে তাঁর নবীর সহযোগী বানালেন এবং তারা দ্বীনের জন্য (কাফেরদের সঙ্গে) লড়াই করলেন। অতএব যা কিছু এই মুমিনগণ ভালো মনে করেন তা আল্লাহর নিকটেও ভালো। আর যা এরা মন্দ মনে করেন তা আল্লাহর নিকটেও মন্দ।’ -মুসনাদে আহমাদ ১/৩৭৯, হাদীস ৩৬০০
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর পূর্ণ কথাটি দেখলে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, তিনি এ কথাটি সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারেই বলেছেন। যে কোনো শ্রেণীর মানুষ এমনকি মূর্খ ও বে-আমল লোকদেরকেও এই মর্যাদা প্রদান করা যে, তারা তাদের ইচ্ছামতো কোনো বিষয় উদ্ভাবন করবে আর তা দ্বীনের অংশ সাব্যস্ত হবে-এ কথা কখনো হযরত ইবনে মাসউদ রা.-এর উদ্দেশ্য নয়। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর মতো বিশিষ্ট সাহাবী তো দূরের কথা, দ্বীনের নীতিমালা সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান রাখেন এমন আলেমের পক্ষেও একথা বলা কখনো সম্ভব নয়।
মোটকথা, ‘যা মুমিনগণ ভালো মনে করেন...।’-এ কথাটিতে মুমিনগণ বলতে সাহাবায়ে কেরামকেই বোঝানো হয়েছে। আরবী বাক্যটির প্রারম্ভে যে فا রয়েছে তা একথাই বোঝাচ্ছে যে, এ বাক্যটি পূর্বের কথার সঙ্গে সংযুক্ত।
মুয়াত্তার ভাষ্যকারের ব্যাখ্যা
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর উপরোক্ত বাক্যটির উপর দীর্ঘ আলোচনা শেষে মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদের ভাষ্যকার লিখেছেন,
فإذا لا يدل الحديث إلا على حسن ما استحسنه الصحابة، أو ما استحسنه الكاملون في الاجتهاد، لا على ما استحسنه غيرهم من العلماء الذين حدثوا بعد القرون الثلاثة، ولا حظ لهم من الاجتهاد ما لم يدخل ذلك في أصل شرعي.
অর্থ : তাহলে উপরের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হল যে, হাদীসটি শুধু ওইসব বিষয় ভালো হওয়া প্রমাণ করে যা সাহাবায়ে কেরাম কিংবা মুজতাহিদগণ ভালো মনে করেন। এঁরা ছাড়া যেসব আলেম ‘কুরূনে ছালাছা’ অর্থাৎ সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের যুগের পরে এসেছে এবং মুজতাহিদদের অন্তর্ভুক্ত নয় তাদের পছন্দের ভিত্তিতে কোনো বিষয় ভালো হিসেবে স্বীকৃত হবে না; যদি না তা শরীয়তের কোনো মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত হয়।
এরপর তিনি তার আলোচনায় লেখেন,
وبالجملة، فهذا الحديث نعم الدليل على حسن ما استحسنه الصحابة وغيرهم من المجتهدين وقبح ما استقبحوه، وأما ما استحسنه غيرهم من العلماء، فالمرجع فيه إلى القرون الثلاثة، أو إلى دخوله في أصل من الأصول الشرعية، فما لم يوجد في القرون الثلاثة، ولم يستحسنه أهل الاجتهاد، ولم يوجد له دليل صريح، أو ما يدخل فيه من الأصول الشرعية، فهو ضلالة بلا ريب، وإن استحسنه مستحسن فافهم.
‘সারকথা হল, উপরোক্ত (মওকুফ) হাদীস দ্বারা ভালোভাবে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কেরাম ও মুজতাহিদ ইমামগণ যে বিষয়কে ভালো মনে করেন তা প্রকৃতপক্ষেই ভালো এবং যে বিষয়কে তারা মন্দ মনে করেন তা মন্দ। এঁরা ছাড়া অন্য আলেমগণ যে বিষয়টিকে ভালো সাব্যস্ত করেন সেক্ষেত্রে দু‘শর্তের কোনো একটি থাকতে হবে। এক. কুরূনে ছালাছা অর্থাৎ সাহাবা, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীনের যুগে বিদ্যমান থাকা। দুই. শরয়ী নীতিমালার আওতাভুক্ত হওয়া। অতএব যে বিষয়টি সাহাবা, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীনের যুগে ছিল না এবং শরীয়তের কোনো নীতির আওতাভুক্তও নয় তা নিঃসন্দেহে গুমরাহী, যদিও কোনো ব্যক্তি তা ভালো মনে করে থাকুক না কেন।’ -আততালীকুল মুমাজ্জাদ ১৪৪
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সাহাবায়ে কেরাম ও মুজতাহিদ ইমামগণের পর আর কোনো আলেম এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নন যে, তারা যা ভালো মনে করবেন তা আল্লাহ তাআলার নিকটেও ভালো- এমন মনে করা যাবে। বিদআতের প্রতি অনুরাগী অনেককে যদিও পীর-মুরীদীতে মগ্ন থাকতে এবং আবা-কাবা পরে বড় আলেমরূপে জাহির হতে দেখা যায় কিন্তু সাধারণত বিদআতানুরাগীরা মজবুত ইলমশূণ্যই হয়ে থাকে। সুন্নত বিদআতের পার্থক্য নিরূপণ করার মতো পর্যাপ্ত ইলম না থাকায় তারা বিদআতের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং এসব বিদআতী কাজকর্মের বৈধতা দানের জন্য নানা ধরনের হিলা-বাহানা খুঁজতে থাকেন।
এদের মধ্যে যদি কোনো আলেম থেকেও থাকে তবুও মুজতাহিদ ইমামগণের তাকলীদ ছেড়ে তার তাকলীদ যে বৈধ হবে না তা উপরের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে।
৪. নিষেধ কোথায় আছে?
কিছু মানুষ আছে যারা দ্বিধাহীন চিত্তে বিদআতে লিপ্ত থাকে। এ ব্যাপারে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তারা প্রশ্ন করে বসে যে, ‘এ কাজটি কোথায় নিষেধ করা হয়েছে বলুন!’ এ প্রশ্নটি একটি অযৌক্তিক প্রশ্ন। কেননা যিনি কোনো কাজ করবেন, কাজটি শরীয়তসম্মত কি না তা জেনে নেওয়া তারই দায়িত্ব। শরীয়তের অনুমোদন আছে কি না একথা না জেনে কাজ শুরু করার পর যদি কোনো ব্যক্তি এর নিষেধাজ্ঞা না দেখায় তবে কি কাজটি বিদআতের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যায়? খুব ভালোভাবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, শুধু তর্ক জুড়ে দিলেই বাস্তবতার পরিবর্তন ঘটে না। বিদআত বিদআতই থাকে। এখানে প্রশ্ন হল, শরয়ী দলীল ব্যতিরেকে আপনি কীভাবে এ কাজটি আরম্ভ করলেন? প্রত্যেককেই তার কর্মের ছওয়াব আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে নিতে হবে এবং বিদআতী কর্মকাণ্ডের কারণে ছওয়াব নয়; বরং শাস্তি ও আযাব পেতে হবে। তাহলে শরীয়তের দলীল-প্রমাণ ছাড়া এ কাজের ব্যাপারে ছওয়াবের আশাবাদী কীভাবে হয়ে গেলেন?
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কাজটি করেননি বিদআতপন্থী মানুষরা সে কাজই খুব আগ্রহের সঙ্গে করে থাকে, অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম কাজটি করেননি-এটিই একাজ অনুমোদিত না হওয়ার দলীল। শরীয়তের বহু মাসআলাতে ফুকাহায়ে কেরাম এই নীতিটি ব্যবহার করেছেন। কয়েকটি দৃষ্টান্ত :
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন সূর্য উদিত হওয়ার পর ঈদের নামাযের আগে কোনো নামায পড়েননি। এটিই এ মাসআলার দলীল যে, ঈদের নামাযের আগে নফল নামায পড়া যাবে না। হিদায়া গ্রন্থকার একথাটিকেই মাসআলার দলীল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার আরবী বাক্য নিম্নরূপ-
لِأَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يَفْعَلْ ذلِكَ مَعَ حِرْصِه عَلى الصَّلَاةِ.
ঈদের নামাযের জন্য নবী-যুগে ও সাহাবা-যুগে কখনো আযান দেওয়া হয়নি। এটিই ঈদের নামাযে আযান নিষিদ্ধ হওয়ার দলীল।
হিন্দুস্তানের এক শহরে একবার ঈদের নামাযে আযান দেওয়া হল। আলেমগণ প্রতিবাদ করলে তারা বলতে লাগল, এই আযান কোথায় নিষেধ করা হয়েছে তা আমাদের দেখিয়ে দিন!
প্রশ্ন হল, স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা বিদ্যমান থাকাই যদি কোনো বিষয় নিষিদ্ধ হওয়ার একমাত্র পথ হয় তবে যেসব কাজ-কর্মের স্পষ্ট নিষেধ কুরআন-হাদীসে নেই তা সবই বিদআতীদের এই নীতিতে বৈধ হয়ে যাবে এবং ছওয়াবের কাজে পরিণত হবে। যেমন, কোনো ব্যক্তি যদি নামাযে ছানা পড়ার স্থানে আত্তাহিয়্যাতু পড়া আরম্ভ করে এবং বলে কোথায় একাজ নিষেধ করা হয়েছে তা আমাকে দেখাও কিংবা রুকু-সিজদার মধ্যে রুকু-সিজদার তাসবীহ স্থলে দরূদ শরীফ পড়া শুরু করে এবং বলে একাজ কোথায় নিষেধ করা হয়েছে দেখাও, অথবা জোহরের নামায পাঁচ রাকাআত পড়তে কোথায় নিষেধ করা হয়েছে দেখাও তাহলে এ ব্যক্তিকে একথাই বলা হবে যে, প্রথমে তোমার মস্তিষ্কের চিকিৎসা কর তারপর তোমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে।
মোটকথা, এভাবে যদি নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করে কুরআন-সুন্নাহর স্পষ্ট নিষেধ জানতে চাওয়া হয় এবং এই বাহানায় তা বৈধ করা হয় তবে অসংখ্য নতুন উদ্ভাবিত বিষয় দ্বীনের মধ্যে প্রবেশ করানো যাবে। আসল কথা হল, কুরআন-হাদীসে অনেক বিষয়ের আদেশ করা হয়েছে এবং অনেক বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে। পাশাপাশি এমন নীতিমালা দেওয়া হয়েছে যার ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ের নতুন কাজকর্মের জায়েয-নাজায়েয নিরূপণ করা সম্ভব। এই নীতিমালা সম্পর্কে কুরআন-হাদীসের পারদর্শী ব্যক্তিবর্গ অবগত আছেন। তাই এঁরা যখন কোনো বিষয়ে বলেন, এটি বিদআত তখন সাধারণ মানুষের পক্ষে তা-ই অনুসরণীয়। কেননা তাঁরা শরীয়তের নীতিমালার আলোকেই এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
এ কাজে অসুবিধা কী?
তাদের সর্বশেষ ‘দলীল’ হল, ‘এ কাজ করলে এমন কী অসুবিধা যে, এটা পরিহার করতেই হবে?’ এজাতীয় কথা শুনে মনে হয় তারা শুধু শরীরের কোথাও কেটে-ছড়ে যাওয়া, দশ-বিশ হাজার টাকা চুরি হয়ে যাওয়া কিংবা দুনিয়াবী কোনো মুসীবতে পড়ে যাওয়াকেই অসুবিধা মনে করে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নত থেকে বঞ্চিত হয়ে যে বিদআতকে হাদীস শরীফে পরিত্যাজ্য বলা হয়েছে তাতে পতিত হওয়া কি কোনো অসুবিধাই নয়? তদ্রƒপ বিদআত পরিত্যাগ করা পর্যন্ত বিদআতীর তওবা কবুল হয় না-এটাও কি কোনো ক্ষতি নয়? এমনকি কোনো কোনো পর্যায়ে বিদআতীর নামায-রোযা, হজ্ব-ওমরা, জিহাদ এবং সকল ফরয ও নফল আমল প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায় এই ক্ষতিও কি কোনো ক্ষতি নয়?
একটু চিন্তা করুন, বিদআতে লিপ্ত হওয়া কত বড় ক্ষতি ও লোকসানের কারণ। বিদআতের নিন্দা প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে যে ক্ষতির কথাগুলো উল্লেখিত হয়েছে তা পুনরায় স্বরণ করে এই পথ থেকে ফিরে আসাই হল ঈমানের দাবি। এর বিপরীতে বিদআতের পক্ষে হিলা-বাহানা অন্বেষণ করে তাতে অটল-অবিচল থাকা নিঃসন্দেহে নির্বুদ্ধিতা এবং তাকওয়া ও ঈমান পরিপন্থী বিষয়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক পথে চলার তাওফীক দান করুন।
(‘বেরেলভী উলামা ও মাশায়েখ কে লিয়ে লামহায়ে ফিকরিয়া’ পুস্তিকা থেকে অনূদিত)