জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৪   ||   জানুয়ারি ২০২৩

মুমিনের সফলতা প্রার্থনা ও কৃতজ্ঞতা

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

মুমিন তো সে-ই, যে আল্লাহ তাআলাকে বিশ্বাস করে। তাঁকে বিশ্বাস করে একক মাবুদ হিসেবে, একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসেবে। মুমিন মাত্রই বিশ্বাস করে, নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দ্বীন ও শরীয়ত আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন, তা যথার্থভাবে মেনে চলার মধ্যেই নিহিত আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের পরিপূর্ণ সফলতা। প্রকৃত মুমিন তো সে-ই, নিম্নোক্ত স্বীকারোক্তি যার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, আর কথায়-কাজে প্রতিফলিত হয়-

رَضِيتُ بِاللهِ رَبًّا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، وَبِمُحَمَّدٍ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَبِيًّا.

আল্লাহকে রব ও প্রতিপালক, ইসলামকে দ্বীন আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে পেয়ে আমি খুশি।

মুমিনের আরেক স্বীকারোক্তি-

اِیَّاكَ نَعْبُدُ وَ اِیَّاكَ نَسْتَعِیْنُ.

আমরা কেবল আপনারই ইবাদত করি আর আপনার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি। -সূরা ফাতেহা (১) : ৪

ইবাদত-বন্দেগীর এ স্বীকারোক্তি, আপদে-বিপদে সাহায্য প্রার্থনার এ স্বীকারোক্তি মুমিন প্রদান করে প্রতিনিয়ত। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযের পাশাপাশি সকল ওয়াজিব-সুন্নত-নফল নামাযের প্রতি রাকাতেই আমাদেরকে এ স্বীকারোক্তি প্রদান করতে হয়। আমরা স্বীকার করি- আমাদের ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যেই নিবেদিত, আমাদের সুখে-দুঃখে সকল চাওয়াও আমরা তাঁর দরবারেই নিবেদন করি। বিপদ থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা তাঁকে ছাড়া আর কার আছে? তিনি যদি না চান, তবে বিপদে ফেলার শক্তিও-বা আছে কার? সকল ক্ষমতার তিনিই উৎস, তিনিই মালিক। তাই সাহায্য চাইতে হলে তাঁর কাছেই চাইতে হয়। মুমিন-মাত্রই তাঁর কাছেই সাহায্যের জন্য হাত পাতে। দুনিয়ার যত ব্যবস্থাপনা, সবকিছু অবলম্বনের পরও মুমিন ব্যক্তির মনে থাকে একটিই আকুতি- আল্লাহ! একমাত্র আপনিই তো আমাকে সাহায্য করতে পারেন, এ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন, আপনি আমাকে সাহায্য করুন, আমার চেষ্টা সফল করুন, আমার দুআ কবুল করুন!

যে শক্তির সামনে আমাদের এমন নিঃশর্ত সমর্পণ, সংকটে-সংগ্রামে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখেন বলে একমাত্র যাঁকে আমাদের বিশ্বাস, ইবাদত তো আমরা তাঁরই করব, তাঁর সামনেই তো আমরা সিজদায় লুটিয়ে পড়ব। মুমিনের উপলব্ধি তো এমন-

اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ.

নিশ্চয় আমার নামায, আমার ইবাদত, আমার জীবন, আমার মরণ-সবই বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।

জীবন-মরণের মালিক যিনি, মুমিন তার কাছেই জীবনের সকল ক্ষেত্রে সফলতা প্রার্থনা করে। সফলতার পর তাঁর দরবারেই কৃতজ্ঞতার সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। যে কোনো ব্যর্থতায় তাঁর রহমতের আশ্বাসবাণীতেই সান্ত¡না খুঁজে বেড়ায়। যার বিশ্বাস- আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার বাইরে গিয়ে জগতের সকলে মিলেও কেউ কারও কোনো বিন্দুমাত্র উপকার করতে পারে না, কাটতে পারে না তার গায়ে একটি কাঁটার আঁচরও, আল্লাহকে ছেড়ে সে কোথায় যাবে! কার কাছে যাবে! আল্লাহ তাআলাই তার একমাত্র ভরসা। প্রার্থনাও তাঁরই প্রাপ্য, কৃতজ্ঞতার অধিকারীও তিনিই।

কথা হল, জীবনে সফলতা লাভের জন্যে আমরা যে আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন হই, সফল হলে তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করি, সে সফলতার মানদণ্ড কী? মুমিনের সফলতা কোথায় নিহিত? সফল মুমিনের পরিচয় কী? একজন মুমিন হিসেবে এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের প্রত্যেকের জানতেই হবে।

আমরা বিশ্বাস করি- পরকালের সফলতা-ই একজন মুমিনের আসল সফলতা। দুদিনের এ দুনিয়ার জীবন সুখে-সাচ্ছন্দ্যে হোক, কষ্টে-দুঃখে হোক, কেটে তো যাবেই। এ দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। দুনিয়ার জীবনও ক্ষণস্থায়ী। ক্ষণস্থায়ী এখানকার সবকিছু। কিন্তু পরকাল যে অসীম, চিরস্থায়ী! সেখানকার সুখই আসল সুখ। সেখানেই পাওয়া যাবে অফুরন্ত নিআমত। আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী সচেতন মুমিন তাই নিজের পরকালটাকেই প্রথমে সাজাতে চায় সফলতার রঙে। সেখানে সফলতায় যারা ধন্য হবে, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের শত কষ্ট নিয়েও তাদের কোনো ভাবনা থাকবে না। দুনিয়ার যত অপ্রাপ্তি, যত ব্যর্থতা, পরকালের সফলতার পর এসব নিয়ে কারও মনেই কোনো আক্ষেপ থাকবে না, থাকবে না দুঃখের ছিটেফোঁটাও

আমরা আরও বিশ্বাস করি- এ জীবনে আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা। যে কেউ যে কোনো পথ ধরেই চলতে পারে। দুদিক থেকেই আসে আহ্বান। একটি ঈমান ও বিশ্বাসের পথ, মহান মালিকের সামনে নিজেকে সঁপে দেয়ার পথ এবং জীবন-জীবিকার সকল চাহিদা তাঁর বিধানের অনুগত করে দেয়ার পথ। আরেকটি কুফর ও অবিশ্বাসের পথ, গোলাম হয়েও মনিবের সঙ্গে অবাধ্যতার পথ এবং আল্লাহর বিধানকে অগ্রাহ্য করে নিজের ইচ্ছেমতো জীবনযাপনের পথ। সংক্ষেপে বললে- একটি আল্লাহর পথ, আরেকটি শয়তানের পথ। এ তো বলাবাহুল্য, আল্লাহকে খুশি করতে চাইলে এবং পরকালের সুখ-সফলতা অর্জন করতে চাইলে আল্লাহর পথ ধরেই চলতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

শয়তান ওঁৎ পেতে আছেই- বনি আদমকে কীভাবে আল্লাহবিমুখ করবে। তার একমাত্র সাধনা- আল্লাহর বান্দাদেরকে আল্লাহর অবাধ্য করে দেয়া। এ অবাধ্যতার আবার নানা ধরন। সবচেয়ে বড় অবাধ্যতা-আল্লাহ তাআলাকে অস্বীকার করা কিংবা তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করা। এ শরীক করা হতে পারে তাঁর একক সত্তা ও সৃষ্টিকর্তা হওয়ার ক্ষেত্রে, হতে পারে ইবাদতের উপযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও। এ কুফর-শিরকের অবাধ্যতায় যারা জড়িত, তাদের আমরা কাফের-মুশরিক বলি। তারা মুমিন নয়। কুফর ও শিরক ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

যারা কুফর-শিরকে জড়িত নয়, আল্লাহবিশ্বাসী মুমিন, শয়তানের প্ররোচনায় তারাও নানাভাবে আল্লাহ তাআলার বিধান লঙ্ঘন করে। নামায পড়া ফরজ জেনেও কেউ কেউ তা কাজা করে বসে। হজ¦ করার মতো শারীরিক আর্থিক সকল সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর বিধান পালনে গড়িমসি করে। কোনো ওজর ছাড়াই রোযা ছেড়ে দেয়। জাকাত আদায় না করার নানা কায়দা-কৌশল খোঁজে। এভাবে ফরয ইবাদত আদায় না করা অন্যায়, পাপ। যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, যারা নিজেদেরকে আল্লাহ তাআলার অনুগত মুমিন বান্দা হিসেবে পরিচয় দেয়, শয়তান এসব অন্যায়ে জড়িয়ে তাদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।

নামায-রোযা-হজ¦-যাকাত-তিলাওয়াত-কুরবানী ইত্যাদি কিছু বিষয়কেই আমরা সাধারণত ইবাদত বলে বুঝে থাকি। কিন্তু একজন মুমিন বান্দার কর্তব্য এতটুকুতেই সীমিত নয়। তার স্বাভাবিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র- আচার-আচরণ, লেনদেন, কথাবার্তা, সামাজিকতা, পরিবার-ব্যবস্থাপনা- সবকিছুতেই মানতে হবে আল্লাহ তাআলার বিধান। ব্যক্তিগত জীবনেও নিজের ইচ্ছেমতো যে কোনো কিছু করার অধিকার তার নেই। আল্লাহর বিধানকে সামনে রেখেই তাকে নির্ণয় করতে হবে- এ জীবনে চলার পথের প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে কী করতে হবে, কী থেকে বিরত থাকতে হবে, নিজের ইচ্ছেগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবে আর কোন্ কোন্ ইচ্ছা থেকে সরে আসতে হবে। এ নির্ণয় যে যতটা বেশি করতে পারবে এবং সে অনুসারে পথ চলতে পারবে, সে ততটাই যথার্থ মুমিন, সফল মুমিন। মুমিন হিসেবে এ সফলতাই আমাদের পরম কাঙ্ক্ষিত

এ এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা- নামায-রোযা আমরা যে যা-ই করি না কেন, লেনদেন-আচরণ ইত্যাদি নানা বিষয়ে দ্বীনী বিধান পালনের ক্ষেত্রে আমরা চরম উদাসীনতার শিকার। বাহ্যত অনেক দ্বীনদার ব্যক্তিকেও দেখা যায় সুদের মতো গুরুতর পাপে জড়াতে। সুদভিত্তিক লেনদেন যে হারাম- এ তো কারও কাছেই অজানা নয়। অথচ পাঁচ ওয়াক্ত নামায যথারীতি আদায় করেন এমন ব্যবসায়ীদের অনেকেই ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি করার জন্যে সুদি লোন গ্রহণ করেন। সুদি ব্যাংক-বীমার প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত অনেকেই নিয়মিত নামায আদায় করেন। সেখানকার নারীদের অনেকে হিজাবও পরেন। তাদের অনেকেই নিজের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে হজ¦ও পালন করেন। যাকাতও দিয়ে থাকেন। অথচ মূল উপার্জনই যাদের হারাম, সে হারাম টাকা দিয়ে পালিত হজ¦-যাকাতের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু- তা কি আমরা ভেবে দেখেছি?

প্রশ্ন হল, তাদের জীবনে এমন সংঘাত কেন? ফরয বিধানও তারা পালন করে যাচ্ছেন নিয়মিত, আবার হারাম লেনদেনেও জড়িয়ে যাচ্ছেন অহরহ। এর কারণ হয়তো তাদের জানাই নেই, নামায-রোযার মতো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই একজন মুমিনকে পরিপূর্ণ অনুসরণ করতে হয় শরীয়তের বিধান। ফরয ইবাদতগুলো তো পালন করতেই হবে। এর পাশাপাশি জীবনে চলার জন্য যে জীবিকা আমরা উপার্জন করি, সেখানেও অনুসরণ করতে হবে শরীয়তের নির্দেশনা। ব্যক্তিগত পারিবারিক সামাজিক- জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানতে হবে ইসলামের বিধান। জীবনধারণের প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহ তাআলার হুকুম আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ্ই হতে হবে আমাদের শেষ কথা। সফলতার কোনো উপলক্ষ যখন আসে, শরীয়তের আলোকেই তা উদ্যাপন করতে হবে। যে কোনো প্রকার দুঃখ-কষ্ট আমাদের জীবনে আসুক, শোকের প্রকাশটাও হতে হবে শরীয়তের বিধান মেনে। এ বিধান মানতে হবে আনন্দ-বিনোদন-উৎসবজাতীয় ক্ষেত্রগুলোতেও। ইসলামের মতো একটি পরিপূর্ণ দ্বীন ও শরীয়তের অনুসারী হয়ে একজন মুমিন-মুসলমানের পক্ষে জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

সন্দেহ নেই, এ বিধান মানার মধ্যেই নিহিত আমাদের প্রকৃত সফলতা। এটাই আমাদের সফলতার মানদণ্ডজীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামের বিধান পালনে যে যতটা অগ্রগামী, বাস্তবে সে ততটাই সফল। সঙ্গতকারণেই আমরা যখন আল্লাহ তাআলার কাছে আমাদের সফলতা প্রার্থনা করি, কোনো প্রয়োজনে আমরা তাঁর দরবারে দুই হাত তুলে মুনাজাত করি কিংবা সিজদায় লুটিয়ে পড়ি, তখন সফলতার এ মানদ-কেই সামনে রাখতে হবে। এ সফলতাই চাইতে হবে। একজন মুমিনের জন্যে যা প্রকৃতপক্ষে কোনো সফলতাই নয়, যে কাজে তাকে জড়িয়ে দিতে পারলে শয়তান মেতে ওঠে উচ্ছ্বাসে, যেখানে লিপ্ত হয়ে পড়লে আল্লাহ তাআলার সামনে তাকে আসামী হিসেবে দাঁড়াতে হবে, সেসব কাজে সফল হওয়ার জন্যও কি মুমিন দুআ করতে পারে আল্লাহ তাআলার দরবারে? পারে না। দুআ যদি সঠিকভাবে সঠিক স্থানে করা হয়, তবে তা-ও একটি ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। দুআর মাধ্যমে মানুষের আসল দাসত্ব ফুটে ওঠে। কিন্তু এ দুআ যদি হয় আল্লাহ তাআলার নাফরমানীতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য? শরীয়তের কোনো বিধান লঙ্ঘনে সফল হওয়ার জন্য? বোঝাই যায়, এটা কেবল একটি পাপ নয়, অনেক পাপের সমষ্টিএক তো আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন, এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আল্লাহর কাছেই তাঁর অবাধ্যতায় সাহায্য প্রার্থনা! আবার এ প্রার্থনাকে মনে করা হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা ও মুমিনের শান! তাই একবার দুআ করার আগে শতবার ভেবে নিতে হবে- আমার এ দুআ শরীয়তের কোনো বিধানকে অমান্য করে নয় তো?

দুআ যদি যথাস্থানে করা না হয়, তবে তা কতটা ভয়াবহ শাস্তি বয়ে আনতে পারে- এর একটি দৃষ্টান্ত পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। সূরা আরাফে বলা হয়েছে-

وَ اتْلُ عَلَیْهِمْ نَبَاَ الَّذِیْۤ اٰتَیْنٰهُ اٰیٰتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَاَتْبَعَهُ الشَّیْطٰنُ فَكَانَ مِنَ الْغٰوِیْنَ .

(হে রাসূল!) তাদেরকে সেই ব্যক্তির ঘটনা পড়ে শোনাও, যাকে আমি আমার নিদর্শনাবলি দিয়েছিলাম, কিন্তু সে তা সম্পূর্ণ বর্জন করে। ফলে শয়তান তার পিছু নেয়। পরিণামে সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। -সূরা আরাফ (০৭) : ১৭৫

এ আয়াতের তাফসীরে শাইখুল ইসলাম মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দা. বা. লিখেছেন- আল্লাহ তাআলা যাকে ইলম ও ইবাদতের মহা সৌভাগ্য দান করেন, তার উচিত অন্যদের তুলনায় বেশি সাবধানতা ও তাকওয়া অবলম্বন করা। এরূপ ব্যক্তি যদি আল্লাহ তাআলার আয়াতের বিপরীতে নিজের অবৈধ কামনা-বাসনা পূরণের পেছনে পড়ে, তবে দুনিয়া ও আখেরাতে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। [তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, সূরা আরাফ, টীকা ৯৮]

তাই দুআ করতে হবে খুবই ভেবেচিন্তে। মুমিন তো তার জীবনের সকল ক্ষেত্রেই আল্লাহর দরবারে দুআ করবে। সে আর যাবে কোথায়? দ্বীন পালনে, দুনিয়ার জীবনযাপনে যা কিছু তার প্রয়োজন, সবই আল্লাহর কাছে চাইবে। এ চাওয়াটাও ইবাদত। যে যত বেশি চায় আল্লাহ তার প্রতি ততই খুশি হন। কিন্তু চাইতে হবে আল্লাহর বিধান মেনে, আল্লাহর বিধানের অধীনে থেকে। আল্লাহ তাআলার বিধান লঙ্ঘনে সফল হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছেই দুআ করা- এ হঠকারিতা ছাড়া আর কী!

একই কথা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ক্ষেত্রেও। যে কোনো নিআমত পেলে কৃতজ্ঞতা আদায় করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। শোকর ও কৃতজ্ঞতা মুমিন কখনো আদায় করে মৌখিক কথায়, কখনো কৃতজ্ঞতা আদায় করতে গিয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে, কখনো নফল নামায আদায় করে। আবার বড় কোনো নিআমতে, আনন্দের কোনো উপলক্ষে অন্যদের জন্যে খাবারের আয়োজন করাও শোকর আদায়েরই ভিন্ন পদ্ধতি। মুমিন তো আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যই অন্যদের আহার করায়। তা বড় ফযীলতপূর্ণ একটি আমলতাই প্রভুর দরবারে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ অন্যদের খাওয়ানোও যেতে পারে। সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এ রীতি ছিল। এমনকি বিয়ে-পরবর্তী যে ওলিমা আর সন্তান জন্মপরবর্তী আকীকার আয়োজন, সে-ও তো শোকর ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশই। তবে কথা হল, যে সফলতায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হবে, তা হতে হবে মুমিনের প্রকৃত সফলতা। এ সফলতা দুনিয়া কেন্দ্রিকও হতে পারে, হতে পারে দ্বীনবিষয়ক। কারও যদি শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ কোনো চাকরির ব্যবস্থা হয়, তবে সে খুশি হয়ে আপনজনদের মিষ্টি খাওয়াতেই পারে। এটাও এক প্রকার কৃতজ্ঞতা। কিন্তু যদি চাকরিটাই হারাম হয়, শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ হয়, এমন চাকরি পেয়ে তো মুমিন খুশি হতে পারে না। এটা তো প্রকৃতপক্ষে তার কোনো সফলতা নয়। এটা এক বড় ধরনের বিচ্যুতি, শরীয়তের বিধান থেকে বিচ্যুতিএমন বিচ্যুতিতে সফলতা পেয়ে মুমিন খুশি হতে পারে না। ইসলাম যে গান-বাদ্য হারাম করেছে, সেগুলোতে খ্যাতি কুড়িয়ে কোনো মুমিন খুশি হতে পারে না। হারাম পদ্ধতির কোনো বিনোদনে এগিয়ে গিয়ে মুমিন খুশি হতে পারে না। এসব তো আসলে সফলতা নয়, মুমিন হিসেবে এসব ব্যর্থতা। একেকটি হারাম কাজে জড়ানো মানেই আল্লাহর বান্দা হিসেবে এক ধাপ অবনমন, আর শয়তানকে খুশি করার পথে এক ধাপ অগ্রসরতা। সহজ কথা, শয়তান যেখানে খুশি হয়, মুমিন তা কামনা করতে পারে না, তা নিয়ে নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে পারে না।

শরীয়তে যা নিষিদ্ধ, এমন কোনো হারাম কাজে নিজে জড়িয়ে পড়লে ইস্তেগফার করতে হবে আল্লাহ তাআলার কাছে। ক্ষমা চাইতে হবে। আন্তরিকতার সঙ্গে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করার কথা দিয়েছেন। আর অন্য কাউকে হারাম কাজে জড়িত দেখলে তার জন্যে দুআ করতে হবে, যেন সে শরীয়তের বিধান মেনে চলতে পারে, হারাম কাজ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, সুযোগ পেলে তাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন হারাম পথ ছেড়ে শরীয়তের আলোঝলমল রাজপথে উঠে আসার দাওয়াতও দিতে হবে। কোনো হারাম কাজে সফল হয়ে খুশি হওয়া, সফলতা প্রার্থনা করা, অন্য কারও হারাম কাজে সহযোগিতা করা, সমর্থন করা- এগুলো মুমিনের কাজ নয়।

মোটকথা, মুমিন পদে পদে সফলতা চাইবেই। সফলতার জন্য প্রয়োজন আল্লাহর কাছে বিনীত প্রার্থনা। আর সফলতার পর অনিবার্য শোকর ও কৃতজ্ঞতা। তবে এ সফলতার কামনা, এজন্য প্রার্থনা আর এর পরে কৃতজ্ঞতা- এসবই আল্লাহ তাআলার বান্দা হিসেবে আল্লাহর বিধান মেনে যথাস্থানেই করতে হবে। তাহলেই আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পথ প্রশস্ত করবে ভবিষ্যত সফলতার। আমার শোকর আদায় বাড়িয়ে দেবে আল্লাহ-প্রদত্ত নিআমত।

 

 

advertisement