জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৪   ||   জানুয়ারি ২০২৩

কুরআনের আলোকে
মানবজীবনের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত

মাওলানা মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত এই তিনটি শিরোনাম মানব জীবনের অত্যন্ত জরুরি তিনটি অধ্যায়। জীবন যাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মিশে থাকে এই তিন অধ্যায়ের ভাব, মর্ম ও রহস্য। অতীত থেকে মানুষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুকে লালন করে। এরপর সেই অভিজ্ঞতা ও স্বপ্নের সমন্বয়ে যাপন করে বর্তমান। জীবন যতদিন আছে, ততদিনই থাকবে এই অর্জন ও সমন্বয়ের শুভ মিলন।

অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের একটা অর্থ সমাজে প্রচলিত এবং সবার কাছে পরিচিত। সেই অর্থের স্পষ্টতা ও প্রকাশ্যতা এতটাই দিব্য যে, তার কারণে অন্য কোনো অর্থ খুব সহজে মনে আসে না। সুদূর অতীত ও সুদূর ভবিষ্যত এবং প্রকৃত অতীত ও প্রকৃত ভবিষ্যত স্মৃতিতে জাগরূক থাকে না। অথচ সফল বর্তমান যাপনের জন্য সেই অতীত ও ভবিষ্যত সম্পর্কে সচেতনতা খুব জরুরি।

প্রত্যেক মানুষের সুদূর অতীত হল তার জন্মপূর্ব অবস্থা। সুদূর ভবিষ্যত হল তার মৃত্যু-পরবর্তী জীবন। এই দূর অতীত ও দূর ভবিষ্যত সম্পর্কে জানা ও না জানায় অনেক পার্থক্য হয় দুনিয়ার জীবন যাপনে।

কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য থেকে জানা যায়- প্রতিটি মানুষ প্রথমে ছিল রূহের জগতে। এরপর মায়ের উদরে। তারপর দুনিয়াতে। এরপর দুনিয়ার এই জীবন পার করে সবাইকে যেতে হবে আখেরাতে। কবর জগৎ বা আলমে বরযখে এবং হাশর-নশরের পর জান্নাত কিংবা জাহান্নামে।

রূহের জগৎ ও মায়ের উদর হল মানব জীবনের অতীত। দুনিয়ার জীবন বর্তমান। আর আখেরাতের জীবন ভবিষ্যত।

স্বীকৃত কথা যে, সফল বর্তমান যাপনের ক্ষেত্রে জীবনের প্রতিটি অতীত থেকে যথাযথ শিক্ষাগ্রহণ এবং আগত প্রতিটি ভবিষ্যত নিয়ে সঠিক ও সুন্দর স্বপ্ন দেখা সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করে। তাই দূরদর্শী ও পরিণাম-সচেতন সকলেই অতীত জীবনকে খুব গুরুত্ব দেন। ভবিষ্যত জীবন নিয়ে যথেষ্ট ভাবেন।

কুরআন মাজীদে মানব জীবনের অতীত

মানব জীবনের অতীত সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اِذْ اَخَذَ رَبُّكَ مِنْۢ بَنِیْۤ اٰدَمَ مِنْ ظُهُوْرِهِمْ ذُرِّیَّتَهُمْ وَ اَشْهَدَهُمْ عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ اَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوْا بَلٰی شَهِدْنَا اَنْ تَقُوْلُوْا یَوْمَ الْقِیٰمَةِ اِنَّا كُنَّا عَنْ هٰذَا غٰفِلِیْنَ.

(হে রাসূল! মানুষকে সেই সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিন।) যখন আপনার প্রতিপালক আদম সন্তানদের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের সন্তানদেরকে বের করলেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের সম্পর্কে সাক্ষী বানালেন। (তিনি বললেন,) আমি কি তোমাদের রব নই?

সকলে উত্তর দিল, হাঁ অবশ্যই, আমরা (এ বিষয়ে) সাক্ষ্য দিচ্ছি।

(এ স্বীকারোক্তি আমি এজন্য নিয়েছি,) যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা বলতে না পার যে, আমরা তো এ বিষয়ে অনবহিত ছিলাম। -সূরা আরাফ (৭) : ১৭২

এটা ছিল মানব জীবনের দূর অতীতের প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপ হল মায়ের উদর। এসম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

وَ لَقَدْ خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ مِنْ سُلٰلَةٍ مِّنْ طِیْنٍ، ثُمَّ جَعَلْنٰهُ نُطْفَةً فِیْ قَرَارٍ مَّكِیْنٍ، ثُمَّ خَلَقْنَا النُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا الْعَلَقَةَ مُضْغَةً فَخَلَقْنَا الْمُضْغَةَ عِظٰمًا فَكَسَوْنَا الْعِظٰمَ لَحْمًا ثُمَّ اَنْشَاْنٰهُ خَلْقًا اٰخَرَ فَتَبٰرَكَ اللهُ اَحْسَنُ الْخٰلِقِیْنَ.

নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির নির্যাস থেকে। এরপর তাকে শুক্রবিন্দুরূপে রাখি একটি সংরক্ষিত স্থানে (মায়ের গর্ভে)। তারপর সেই বিন্দুকে জমাট রক্তে পরিণত করি। তারপর সেই জমাট রক্তকে গোশতপিণ্ড বানিয়ে দেই। তারপর সেই গোশতপিণ্ডকে অস্থিতে রূপান্তর করি। এরপর অস্থিসমূহকে গোশতের আচ্ছাদন লাগিয়ে দেই। তারপর তাকে অন্য এক সৃষ্টিরূপে গড়ে তুলি।

বস্তুত সকল কারিগরের শ্রেষ্ঠ কারিগর আল্লাহ কত মহান। -সূরা মুমিনূন (২৩) : ১২-১৪

অন্যত্র বলেন-

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنْ كُنْتُمْ فِیْ رَیْبٍ مِّنَ الْبَعْثِ فَاِنَّا خَلَقْنٰكُمْ مِّنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُّطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِنْ مُّضْغَةٍ مُّخَلَّقَةٍ وَّ غَیْرِ مُخَلَّقَةٍ لِّنُبَیِّنَ لَكُمْ وَ نُقِرُّ فِی الْاَرْحَامِ مَا نَشَآءُ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی ثُمَّ نُخْرِجُكُمْ طِفْلًا ثُمَّ لِتَبْلُغُوْۤا اَشُدَّكُمْ  وَ مِنْكُمْ مَّنْ یُّتَوَفّٰی وَ مِنْكُمْ مَّنْ یُّرَدُّ اِلٰۤی اَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَیْلَا یَعْلَمَ مِنْۢ بَعْدِ عِلْمٍ شَیْـًٔا .

হে মানুষ! যদি পুনর্জীবিত হওয়া সম্পর্কে তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকে, তবে (একটু চিন্তা কর) আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে, তারপর শুক্রবিন্দু থেকে, তারপর জমাট রক্ত থেকে, তারপর এমন এক মাংসপিণ্ড থেকে, যা (কখনো) পূর্ণাকৃতি হয় এবং (কখনো) পূর্ণাকৃতি হয় না। তোমাদের কাছে (তোমাদের) প্রকৃত অবস্থা সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত করার জন্য [যে, তোমাদের মূল কী ছিল? এবং কতদিন অতিবাহিত হওয়ার পর তোমরা মানুষরূপে অস্তিত্ব লাভ করেছ।]

আর আমি যাকে ইচ্ছা এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাতৃগর্ভে স্থিত রাখি। তারপর তোমাদেরকে শিশুরূপে বের করি। অনন্তর (তোমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখি) যাতে তোমরা পরিণত বয়সে উপনীত হও।

তোমাদের কতককে (আগে আগেই) মৃত্যু দেওয়া হয় আর কতককে ফিরিয়ে দেওয়া হয় হীনতম বয়সে। এমনকি তখন সে সব কিছু জানার পরও কিছুই জানে না।

(অর্থাৎ, অতিরিক্ত বৃদ্ধ অবস্থায় মানুষ শৈশবকালের মতোই বোধ-বুদ্ধিহীনতার দিকে ফিরে যায়যৌবনকালে সে যা-কিছু জ্ঞান-বিদ্যা অর্জন করে বৃদ্ধকালে তার সব অথবা বেশির ভাগই ভুলে যায়।)। -সূরা হাজ্ব (২২) : ৫

এই আয়াতে মানুষের অতীত এবং অতীত থেকে বর্তমানে আসার প্রসঙ্গকে একীভূত করে তুলে ধরা হয়েছে। সেইসাথে ইঙ্গিত করা হয়েছে প্রকৃত ভবিষ্যতের দিকে। বরং প্রকৃত ভবিষ্যতকে স্পষ্ট করার জন্যই অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন অবস্থার বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রাহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন-

বস্তুত এটাই সেই বিষয়, যা বুঝতে পারলে (জীবন ও জগতের) অনেক সত্য ও রহস্য স্পষ্ট হয়ে যাবে। এবং মৃত্যুর পর যে পুনরুত্থান সম্ভব সেটা (খুব সহজেই) বুঝে আসবে। -তাফসীরে উসমানী, পৃষ্ঠা ৪৪২

চারপাশের বাস্তবতা

পৃথিবীর বড় থেকে বড় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ব্যাপকভাবে তারা মানুষের বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত। বর্তমান মানে পৃথিবী। বর্তমান জীবন মানে পৃথিবীর জীবন। বলা হয়, এই জীবনে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন ও অধিকার পাঁচটি। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। তাই শ্রেণি জাতি নির্বিশেষে প্রায় সকল মানুষ এ বিষয়গুলো নিয়েই ব্যস্তবড় বড় দার্শনিক বুদ্ধিজীবী, বড় বড় দল ও নেতৃবৃন্দ এবং বড় বড় মিল ও কারখানা এই পাঁচটি বিষয় নিয়েই হাজারো রকমের আয়োজন করে। তারা পুরো দুনিয়াকে কেবল এই পাঁচটি বিষয়ের আশ্বাস ও নিশ্চয়তা দিতে চায়। সবাইকে এ বিষয়গুলোতেই সচেতন রাখার চেষ্টা করে।

চারপাশে একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়- কেবলমাত্র খাদ্য আর বস্ত্র উৎপাদন কিংবা প্রক্রিয়াজাতকরণের উদ্দেশ্যে কত অসংখ্য মিল কারখানা তৈরি হয়েছে। বাসস্থান তৈরির কত হাজার পদ্ধতি ও প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতি ও উৎকর্ষ প্রতি যুগেই আগের যুগকে ছাড়িয়ে গেছে। বাকি রইল শিক্ষা। এই শিক্ষার মূল বিষয়গুলো কী? কয়টি বিষয় দুনিয়ার আয় উপার্জন এবং খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসাকেন্দ্রিক আর কয়টি বিষয় নৈতিক, মানবিক, সভ্যতা, শিষ্টতা ও আত্মিক উন্নতিকেন্দ্রিক? অন্তত আমাদের দেশের শিক্ষা কার্যক্রম ও শিক্ষাব্যবস্থা থেকে কী বোঝা যায়?

জীবন ও জগতের মূল চেতনা ও প্রেরণা কি শুধুই দুনিয়া তথা বর্তমান কেন্দ্রিক! তাহলে অতীত ও ভবিষ্যতের ফিকির কোথায়? অতীত থেকে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার বিষয় কোথায়? ভবিষ্যতের স্বপ্ন ও প্রস্তুতি কোথায়?

নিশ্চিত আগত ভবিষ্যত থেকে আত্মগোপনের সুযোগ তো কারোই নেই!

কুরআন মাজীদে মানব জীবনের বর্তমান

আমাদের সারাজীবনের ব্যস্ততা যেই বর্তমানকে নিয়ে সে সম্পর্কে কুরআন মাজীদে কী ইরশাদ হয়েছে একটু পড়ে দেখুন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

اِعْلَمُوْۤا اَنَّمَا الْحَیٰوةُ الدُّنْیَا لَعِبٌ وَّ لَهْوٌ وَّ زِیْنَةٌ وَّ تَفَاخُرٌۢ بَیْنَكُمْ وَ تَكَاثُرٌ فِی الْاَمْوَالِ وَ الْاَوْلَادِ  كَمَثَلِ غَیْثٍ اَعْجَبَ الْكُفَّارَ نَبَاتُهٗ ثُمَّ یَهِیْجُ فَتَرٰىهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ یَكُوْنُ حُطَامًا  وَ فِی الْاٰخِرَةِ عَذَابٌ شَدِیْدٌ  وَّ مَغْفِرَةٌ مِّنَ اللهِ وَ رِضْوَانٌ وَ مَا الْحَیٰوةُ الدُّنْیَاۤ اِلَّا مَتَاعُ الْغُرُوْرِ.

জেনে রেখ, পার্থিব জীবন তো কেবল খেলাধুলা, সাজসজ্জা, পারস্পরিক অহংকার প্রদর্শন এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে একে-অন্যের চেয়ে এগিয়ে থাকার প্রতিযোগিতা।

(দুনিয়ার জীবনের) উপমা হল বৃষ্টি, যা দ্বারা উদ্গত ফসল কৃষকদেরকে মুগ্ধ করে দেয়, এরপর তা তেজস্বী হয়ে ওঠে। তারপরে তুমি দেখতে পাও তা হলুদ বর্ণ হয়ে গেছে। অবশেষে তা (দলিত) খড়কুটা হয়ে যায়। আর আখেরাতে আছে (একদিকে) কঠিন শাস্তি এবং (অপরদিকে) আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। দুনিয়ার জীবন তো প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছু নয়। -সূরা হাদীদ (৫৭) : ২০

এই আয়াতে খুব সংক্ষেপে দুনিয়াবী জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। দুনিয়ার প্রতি মানুষের মোহ ও আকর্ষণের বিষয়গুলো স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। 

লক্ষ করলে দেখা যায়, জীবনের একেক পর্যায়ে মানুষ একেক বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে। শৈশবে আকর্ষণ থাকে খেলাধুলার প্রতি। যৌবনে সাজসজ্জা ও সুন্দর বেশভূষার প্রতি। আর তখনই সাজসামগ্রী ও অন্যান্য বিষয়ে একে-অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়এমনকি তা নিয়ে অহমিকা দেখানোর আগ্রহও জন্মে হৃদয়ে। তারপর আসে বার্ধক্য। তখন মানুষের যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা আবর্তিত হয় সম্পদ ও সন্তানকে কেন্দ্র করে। তখনকার চেষ্টা একটাই- কীভাবে সম্পদে অন্যকে ছাড়িয়ে যাবে এবং সন্তানের দিক থেকেও অন্যের উপরে থাকবে।

কিন্তু প্রতিটি স্তরে মানুষ যে জিনিসকে আগ্রহ-আকর্ষণ ও কামনা-চাহিদার সর্বোচ্চ শিখর মনে করে, পরবর্তী স্তরে সেটাই তার কাছে মূল্যহীন হয়ে যায়। ফলে অনেক সময় মানুষ এই ভেবে হাসতে থাকে যে, আমি এ কোন্ জিনিসকে জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিলাম!

অবশেষে যখন আখেরাত আসবে, তখন মানুষ উপলব্ধি করবে, আসলে দুনিয়ার আকর্ষণীয় সবকিছুই ছিল মূল্যহীন। প্রকৃত অর্জনীয় জিনিস তো ছিল এই আখেরাতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই।

আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন-

اِنَّمَا مَثَلُ الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا كَمَآءٍ اَنْزَلْنٰهُ مِنَ السَّمَآءِ فَاخْتَلَطَ بِهٖ نَبَاتُ الْاَرْضِ مِمَّا یَاْكُلُ النَّاسُ وَ الْاَنْعَامُ  حَتّٰۤی اِذَاۤ اَخَذَتِ الْاَرْضُ زُخْرُفَهَا وَ ازَّیَّنَتْ وَ ظَنَّ اَهْلُهَاۤ اَنَّهُمْ قٰدِرُوْنَ عَلَیْهَاۤ  اَتٰىهَاۤ اَمْرُنَا لَیْلًا اَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنٰهَا حَصِیْدًا كَاَنْ لَّمْ تَغْنَ بِالْاَمْسِ  كَذٰلِكَ نُفَصِّلُ الْاٰیٰتِ لِقَوْمٍ یَّتَفَكَّرُوْنَ.

পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত কিছুটা এ রকম, যেমন আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করলাম, যার মাধ্যমে জমিনের সেই সব উদ্ভিদ নিবিড় ঘন হয়ে জন্মাল, যা মানুষ ও গবাদি পশু খেয়ে থাকে। অবশেষে যখন ভূমি নিজ শোভা ধারণ করে ও নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে এবং তার মালিকগণ মনে করে এখন তা সম্পূর্ণরূপে তাদের আয়ত্তাধীন, তখন কোনো এক দিনে বা রাতে তাতে আমার নির্দেশ এসে পড়ে এবং আমি তাকে কর্তিত ফসলের এমন শূন্য ভূমিতে পরিণত করি, যেন গতকাল তার অস্তিত্বই ছিল না।

এভাবেই আমি নিদর্শনসমূহ সবিস্তারে বর্ণনা করি সেই লোকদের জন্য, যারা গভীরভাবে চিন্তা করে। -সূরা ইউনুস (১০) : ২৪

দুনিয়া সম্পর্কে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করার জন্য এই একটি আয়াতই কি যথেষ্ট নয়!

আর যারা কেবলই দুনিয়া কামনা করে এবং দুনিয়াবী জীবনের সুখ সফলতাকেই বড় করে দেখে, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-

مَنْ كَانَ یُرِیْدُ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَا وَ زِیْنَتَهَا نُوَفِّ اِلَیْهِمْ اَعْمَالَهُمْ فِیْهَا وَ هُمْ فِیْهَا لَا یُبْخَسُوْنَ، اُولٰٓىِٕكَ الَّذِیْنَ لَیْسَ لَهُمْ فِی الْاٰخِرَةِ اِلَّا النَّارُ  وَ حَبِطَ مَا صَنَعُوْا فِیْهَا وَ بٰطِلٌ مَّا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ.

যারা (কেবল) দুনিয়ার জীবন ও তার সৌন্দর্য কামনা করে, আমি তাদেরকে দুনিয়াতেই তাদের আমলের পূর্ণ ফল দিয়ে দেব এবং এখানে তাদের প্রাপ্য কম দেওয়া হবে না। এরাই তারা, যাদের জন্য আখেরাতে জাহান্নাম ছাড়া কিছুই নেই এবং যে কাজকর্ম তারা করেছিল, আখেরাতে তা নিষ্ফল হয়ে যাবে আর তারা যে আমল করছে (আখেরাতের হিসেবে) তা না করারই মতো। -সূরা হূদ (১১) : ১৫-১৬

আরও বলেছেন-

اِنَّ الَّذِیْنَ لَا یَرْجُوْنَ لِقَآءَنَا وَ رَضُوْا بِالْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ اطْمَاَنُّوْا بِهَا وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَنْ اٰیٰتِنَا غٰفِلُوْنَ، اُولٰٓىِٕكَ مَاْوٰىهُمُ النَّارُ بِمَا كَانُوْا یَكْسِبُوْنَ.

নিশ্চয়ই যারা (আখেরাতে) আমার সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখে না, পার্থিব জীবন নিয়েই সন্তুষ্ট এবং তাতেই নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে এবং যারা আমার নিদর্শনাবলি সম্পর্কে উদাসীন, তাদের ঠিকানা জাহান্নাম- তাদেরই কৃতকর্মের কারণে। -সূরা ইউনুস (১০) : ৭-৮

ভবিষ্যত ও ভবিষ্যত সচেতনতা

সচেতন মানুষমাত্রই ভবিষ্যত সম্পর্কে সজাগ। ভবিষ্যতের চিন্তা ও পরিকল্পনায় দূরদর্শী। ফলে ভবিষ্যতের সুখ ও স্বাচ্ছন্দের জন্য বর্তমানের যে কোনো কষ্ট তারা আগ্রহভরে মেনে নেয়। ভাবে- বর্তমানে একটু কষ্ট হলে হোক, ভবিষ্যতের সুখ নিশ্চিত করতে হবে।

কিন্তু ভবিষ্যতের সংজ্ঞা কী? আজ সকালের কাছে সন্ধ্যা যেমন ভবিষ্যত, সন্ধ্যার কাছে তেমনি সকাল। চলমান মাসের কাছে আরেক মাস যেমন ভবিষ্যত, আগামী মাসের কাছে তেমনি তার পরের মাস। চলমান বছরের কাছে আগামী বছর যেমন ভবিষ্যত, আগামী বছরের কাছে তেমনি তার পরের বছর। এমনিভাবে শৈশবের কাছে কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য সবই নিকট কিংবা দূরের ভবিষ্যত। এভাবেই জীবনের কাছে মৃত্যু ও মৃত্যুপরবর্তী সময়ের প্রতিটি ধাপ হল ভবিষ্যত।

কেউ যদি সকালবেলা কেবলই সন্ধ্যা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, পরবর্তী ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছুই না ভাবে, একমাসে না ভাবে আরেক মাসের কথা, এমনকি বর্তমান সময়ে না ভাবে আগত বছর ও আগত জীবন সম্পর্কে- সবাই তাকে নির্বোধ বলে ধারণা করে। অসচেতন, অবিবেচক ও অপরিণামদর্শী মনে করে। তাহলে যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে আখেরাত নিয়ে ভাবে না- সে কি বোকা নয়? আখেরাত কি তার ভবিষ্যত বরং প্রকৃত ভবিষ্যত নয়!

কুরআন মাজীদে মানব জীবনের ভবিষ্যত

মানব জীবনের ভবিষ্যত সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-

يٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمْ وَ اخْشَوْا یَوْمًا لَّا یَجْزِیْ وَالِدٌ عَنْ وَّلَدِهٖ وَ لَا مَوْلُوْدٌ هُوَ جَازٍ عَنْ وَّالِدِهٖ شَیْـًٔا  اِنَّ وَعْدَ اللهِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَیٰوةُ الدُّنْیَا وَ لَا یَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الْغَرُوْرُ.

হে মানুষ! নিজ প্রতিপালক (এর অসন্তুষ্টি) থেকে বেঁচে থাক এবং সেই দিনকে ভয় কর, যখন কোনো পিতা তার সন্তানের উপকারে আসবে না এবং কোনো সন্তানও তার পিতার কিছুমাত্র উপকারে আসবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় ফেলতে না পারে এবং সর্বাপেক্ষা বড় প্রতারক (শয়তান)-ও যেন আল্লাহর ব্যাপারে তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকা দিতে না পারে। -সূরা লুকমান (৩১) : ৩৩

বর্তমানের সুখ ও সুবিধা দেখে অসচেতন লোকেরা ধোঁকায় পড়ে। অদূরদর্শী লোকেরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়। তাই আল্লাহ তাআলা পরিষ্কার ভাষায় সতর্ক করে দিয়েছেন যে, দুনিয়া ও দুনিয়ার চাকচিক্য সব ধোঁকার সামগ্রী।

এমনিভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। শয়তান মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যেতে চায়। তাই তার ধোঁকা-প্রতারণা থেকেও সচেতনভাবে বেঁচে থাকতে হবে।

পাশাপাশি তিনি মানুষকে আদেশ করেছেন চিরস্থায়ী সফলতা তথা জান্নাতের দিকে অগ্রসর হতে। আদেশ করেছেন ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ঘটে যাওয়া যাবতীয় ভুলভ্রান্তি থেকে ক্ষমার দিকে ধাবিত হতে। ইরশাদ করেছেন-

سَابِقُوْۤا اِلٰی مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ جَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَآءِ وَ الْاَرْضِ اُعِدَّتْ لِلَّذِیْنَ ا ٰمَنُوْا بِاللهِ وَ رُسُلِهٖ  ذٰلِكَ فَضْلُ اللهِ یُؤْتِیْهِ مَنْ یَّشَآءُ  وَ اللهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِیْمِ.

তোমরা অগ্রগামী হও আপন রবের ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে, যার প্রশস্ততা আকাশ ও পৃথিবীর প্রশস্ততা তুল্য। যা প্রস্তুত করা হয়েছে এমন লোকদের জন্য, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান এনেছে। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যা তিনি যাকে চান দান করেন। আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। -সূরা হাদীদ (৫৭) : ২১

দুনিয়া ও আখেরাতকে একসঙ্গে তুলনা করে বলেছেন-

وَ مَاۤ اُوْتِیْتُمْ مِّنْ شَیْءٍ فَمَتَاعُ الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ زِیْنَتُهَا  وَ مَا عِنْدَ اللهِ خَیْرٌ وَّ اَبْقٰی  اَفَلَا تَعْقِلُوْنَ.

তোমাদেরকে যা-কিছুই দেওয়া হয়েছে, তা পার্থিব জীবনের ভোগ ও তার শোভা মাত্র। আর যা আল্লাহর কাছে আছে তা উত্তম ও স্থায়ী। তবুও কি তোমরা বুঝবে না? -সূরা কাসাস (২৮) : ৬০

সেইসাথে পরম আশ্বাস ও সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন-

مَنْ كَانَ یُرِیْدُ حَرْثَ الْاٰخِرَةِ نَزِدْ لَهٗ فِیْ حَرْثِهٖ  وَ مَنْ كَانَ یُرِیْدُ حَرْثَ الدُّنْیَا نُؤْتِهٖ مِنْهَا وَ مَا لَهٗ فِی الْاٰخِرَةِ مِنْ نَّصِیْبٍ.

যে ব্যক্তি আখেরাতের ফসল কামনা করে, তার জন্য আমি তার ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ব্যক্তি (কেবল) দুনিয়ার ফসল কামনা করে, তাকে আমি তা থেকেই খানিকটা দান করি। আর আখেরাতে তার কোনো অংশ নেই। -সূরা শূরা (৪২) : ২০

হাশরের মাঠের এক বিবরণ প্রসঙ্গে আরও কঠিনভাবে বলেছেন-

فَاِذَا جَآءَتِ الطَّآمَّةُ الْكُبْرٰی، یَوْمَ یَتَذَكَّرُ الْاِنْسَانُ مَا سَعٰی، وَ بُرِّزَتِ الْجَحِیْمُ لِمَنْ یَّرٰی، فَاَمَّا مَنْ طَغٰی، وَ اٰثَرَ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَا، فَاِنَّ الْجَحِیْمَ هِیَ الْمَاْوٰی، وَ اَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهٖ وَ نَهَی النَّفْسَ عَنِ الْهَوٰی، فَاِنَّ الْجَنَّةَ هِیَ الْمَاْوٰی.

অতঃপর যখন মহা বিপর্যয় সংঘটিত হবে। যেদিন মানুষ তার যাবতীয় কৃতকর্ম স্মরণ করবে এবং প্রত্যেক দর্শকের সামনে জাহান্নামকে প্রকাশ করা হবে। তখন যে ব্যক্তি অবাধ্যতা করেছিল এবং পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দিয়েছিল, জাহান্নামই হবে তার ঠিকানা। আর যে ব্যক্তি নিজ প্রতিপালকের সামনে দাঁড়ানোর ভয় পোষণ করত এবং নিজেকে মন্দ চাহিদা থেকে বিরত রাখত, জান্নাতই হবে তার ঠিকানা। -সূরা নাযিয়াত (৭৯) : ৩৪-৪১

এত পরিষ্কারভাবে জীবনের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত ও প্রত্যেকটির প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে যে, কোথাও কোনো দ্ব্যর্থবোধকতা নেই। সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। পাশাপাশি প্রত্যেকটির পরিণাম ও প্রকৃত পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। যার পরে কোনোভাবেই এগুলোকে অবজ্ঞা অবহেলা করার সুযোগ নেই।

না। দুনিয়ার জীবনকেও অবহেলা করতে বলা হয়নি। দুনিয়ার জীবনকে অগুরুত্বপূর্ণও বলা হয়নি। বলা হয়েছে- কেবলই দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত না হতে এবং দুনিয়াকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য না দিতে। কারণ দুনিয়াতে মানুষকে পাঠানোই হয়েছে আখেরাতের জন্য। আখেরাতের সফলতা অভিমুখে জীবনকে পরিচালিত করার জন্য। সুতরাং প্রাধান্য দিতে হলে আখেরাতকেই দিতে হবে। তুলনা করতে হলে ভবিষ্যতকেই গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। সেটাই হবে সচেতনতা ও দূরদর্শিতা।

কুরআন মাজীদের ইরশাদ-

بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَا، وَ الْاٰخِرَةُ خَیْرٌ وَّ اَبْقٰی، اِنَّ هٰذَا لَفِی الصُّحُفِ الْاُوْلٰی،صُحُفِ اِبْرٰهِیْمَ وَ مُوْسٰی.

কিন্তু তোমরা দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দাও। অথচ আখেরাত বেশি উৎকৃষ্ট ও বেশি স্থায়ী। নিশ্চয়ই এ কথা পূর্ববর্তী (আসমানী) গ্রন্থসমূহেও লিপিবদ্ধ আছে। ইবরাহীম ও মূসার গ্রন্থসমূহে। -সূরা আলা (৮৭) : ১৬-১৯

আমাদের উচিত নিয়মিত এই বিষয়গুলো হৃদয়ে জাগরূক রাখা। সচেতনভাবে ভবিষ্যতের পূর্ণ প্রস্তুতি নেওয়া। সৎকর্মশীল হওয়া। উত্তম আমল ও উন্নত আখলাকের অধিকারী হওয়া। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার হুকুম মানা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতকে যতেœর সাথে পালন করা। এভাবে জীবন নির্মাণ করলে দুনিয়ার জীবন যেমন সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের হবে। আখেরাতের জীবনও হবে স্থায়ী সফলতায় চির সুখময়। জীবনের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রকৃত অর্থেই সাফল্যমণ্ডিত হবে। সার্থক হবে অতীত ও অতীতের শিক্ষা।

 

 

advertisement