জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৪   ||   জানুয়ারি ২০২৩

যেদিন নমনীয় হবে সমস্ত কণ্ঠস্বর!

মাওলানা মাসউদুযযামান

یَوْمَىِٕذٍ یَّتَّبِعُوْنَ الدَّاعِیَ لَا عِوَجَ لَهٗ، وَ خَشَعَتِ الْاَصْوَاتُ لِلرَّحْمٰنِ فَلَا تَسْمَعُ اِلَّا هَمْسًا.

সেদিন সকলে আহ্বানকারীর অনুসরণ করবে এমনভাবে যে, তার কাছে কোনো বক্রতা পরিদৃষ্ট হবে না এবং দয়াময় আল্লাহর ভয়ে ক্ষীণ হয়ে যাবে সকল আওয়াজ। ফলে তুমি মৃদু পদধ্বনি ছাড়া কিছুই শুনতে পাবে না।  -সূরা ত্বহা (২০) : ১০৮

পৃথিবীটা দু-দিনের। জীবনটা ক্ষণিকের। আখেরাতের অনন্তকালীন জীবনের তুলনায় দুনিয়ার এ যিন্দেগী মাত্র এক দিন বা দিনের সামান্য সময়। তবু এ জীবন নিয়ে মানুষের কত আশা! এ জীবনকে সাজাতে কত দৌড়ঝাঁপ! সকাল থেকে সন্ধ্যা; দিন ও রাতের সমস্ত সময়জুড়ে একই ফিকির- কী করে জীবনকে আরো উপভোগ্য করা যায়। অর্থ-বিত্তে এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া যায়। বৈধ-অবৈধ যে কোনো উপায়ে সবার সেরা হওয়া যায়, সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা যায়...

অর্থ-বিত্তে সেরা হওয়া এটাই যেন জীবনের চূড়ান্ত সফলতা। খ্যাতি ও প্রতিপত্তির শীর্ষস্থানটি দখল করতে পারা এটাই যেন স্বর্গারোহণ! তাই এ লক্ষ্য যাদের কিছুমাত্র অর্জিত হয় তাদের বক্ষ থাকে স্ফীত। কণ্ঠস্বর থাকে চড়া। তাদের পদবিক্ষেপ হয়ে ওঠে ভারি। বিনয়, নম্রতা, আনুগত্য ও নমনীয়তা শব্দগুলো যেন তাদের অভিধান থেকে হারিয়ে যায়। তারা হয়ে পড়ে দারুণ স্বেচ্ছাচারী। সত্যের ডাক শুনেও তারা শোনে না। ন্যায়ের অনুরোধ তারা রক্ষা করে না। বিবেকের কোনো শাসন ও বারণ তারা আমলে নেয় নানেয়ার প্রয়োজনও বোধ করে না। দরদী হৃদয়ের কোনো আহ্বান-উপদেশ-অনুনয়-আবদার... কোনো কিছুই তাদের স্পর্শ করে না। কর্তব্য-পালনে তাদের সক্রিয় করে তুলতে পারে না। অন্যায়-কর্ম থেকেও ফেরাতে পারে না। অর্থ-বিত্ত ও প্রভাব-প্রতিপত্তি তাদের এমনই অন্ধ করে রাখে! পার্থিব প্রাপ্তি তাদের করে রাখে এমনই আত্মভোলা, এমনই আত্মকেন্দ্রিক ও বেপরোয়া...!

পৃথিবীর মায়ায় আচ্ছন্ন এসব মানুষ ভুলে যায়, পৃথিবীটাই শেষ কথা নয়। শীঘ্রই আসবে এমন এক দিন, যেদিন নমনীয় হবে সমস্ত কণ্ঠস্বর, লঘু হবে পদভার। যেদিন আর কেউ আহ্বানকারীর আহ্বান উপেক্ষা করবে না। পাপ-পুণ্য ও ন্যায়-অন্যায়ের চূড়ান্ত ফয়সালার জন্য সমবেত হবার ডাক শোনামাত্র সবাই ছুটবে সেই ডাক অনুসরণ করে। সেদিন সবাই ঠিকই ডাকে সাড়া দেবে। সবাই সোজা পথে চলবে। কেউ এদিক সেদিক করবে না। কেউ যাব না বলে গোঁ ধরবে না। ধনী-গরীব, ছোট-বড়, শাসক ও শাসিত, জালিম ও মাজলুম- সবাই দ্রুতবেগে ছুটবে সমবেত হবার ময়দানে...। কুরআনের ভাষায়-

یَوْمَىِٕذٍ یَّتَّبِعُوْنَ الدَّاعِیَ لَا عِوَجَ لَهٗ وَ خَشَعَتِ الْاَصْوَاتُ لِلرَّحْمٰنِ فَلَا تَسْمَعُ اِلَّا هَمْسًا.

সেদিন সকলে আহ্বানকারীর অনুসরণ করবে এমনভাবে যে, তার কাছে কোনো বক্রতা পরিদৃষ্ট হবে না এবং দয়াময় আল্লাহর ভয়ে ক্ষীণ হয়ে যাবে সকল আওয়াজ। ফলে তুমি মৃদু পদধ্বনি ছাড়া কিছুই শুনতে পাবে না। -সূরা ত্বহা (২০) : ১০৮

হাঁ, সেদিন সবাই সোজা পথে চলবে। রহমান খোদা তাআলার ভয়ে সবাই একেবারে চুপ হয়ে যাবে। নতশীরে, বিনীতভাবে সবাই এগিয়ে যেতে থাকবে তাঁর ফয়সালা শোনার জন্যে...।

আজ কেন এত বিনয়? কেন এমন আনুগত্য? আজ কেন রহমানের ভয়ে সবাই এমন ভীত? পৃথিবীজুড়ে ছিল যাদের দাপট, তারাও কেন আজ কুণ্ঠিত...?

কারণ আজকে সেইদিন, যেদিন ক্ষমতা শুধুই এক আল্লাহরতাঁর কথা ছাড়া কারো কথা আজ চলবে না। কারো সাহস নেই কিছু বলার। যাদের তিনি অনুমতি দেবেন তারাই কেবল কথা বলবে তাঁর সামনে।

اَلْمُلْكُ یَوْمَىِٕذِنِ الْحَقُّ لِلرَّحْمٰنِ، وَ كَانَ یَوْمًا عَلَی الْكٰفِرِیْنَ عَسِیْرًا.

সেদিন সত্যিকারের রাজত্ব হবে রহমানের (দয়াময় আল্লাহর)আর সে দিনটি কাফেরদের জন্য হবে অতি কঠিন। -সূরা ফুরকান (২৫) : ২৬

یَوْمَ یَاْتِ لَا تَكَلَّمُ نَفْسٌ اِلَّا بِاِذْنِهٖ، فَمِنْهُمْ شَقِیٌّ وَّ سَعِیْدٌ.

যখন সে দিন আসবে তখন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কথা বলতে পারবে না। অতঃপর তাদের মধ্যে কেউ হবে দুর্ভাগা আর  কেউ হবে ভাগ্যবান। -সূরা হূদ (১১) : ১০৫

সন্তান, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, সম্পদ, ক্ষমতা ও দাপট কিছুই সেদিন কাজে আসবে না-

یَوَدُّ الْمُجْرِمُ لَوْ یَفْتَدِیْ مِنْ عَذَابِ یَوْمِىِٕذٍۭ بِبَنِیْهِ،وَ صَاحِبَتِهٖ وَ اَخِیْهِ،وَ فَصِیْلَتِهِ الَّتِیْ تُـْٔوِیْهِ،وَ مَنْ فِی الْاَرْضِ جَمِیْعًا ثُمَّ یُنْجِیْهِ.

অপরাধী সেদিন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য তার পুত্রকে মুক্তিপণ হিসেবে দিতে চাইবে, তার স্ত্রী ও ভাইকে, তার সেই খান্দানকে, যারা ছিল তার আশ্রয় এবং পৃথিবীর সমস্ত অধিবাসীকে, যাতে (এসব মুক্তিপণ দিয়ে) সে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। -সূরা মাআরিজ (৭০) : ১১-১৪

সেদিন বন্ধুরাও শত্রু হয়ে যাবে, শুধু ঈমানদার-মুত্তাকী-পরহেযগার লোকেরা ছাড়া-

اَلْاَخِلَّآءُ یَوْمَىِٕذٍۭ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ اِلَّا الْمُتَّقِیْنَ.

সেদিন বন্ধুরা সবাই একে-অন্যের শত্রু হয়ে যাবে, কেবল মুত্তাকীরা ছাড়া। -সূরা যুখরুফ (৪৩) : ৬৭

ঈমানদার, পরহেযগার লোকদের সেদিন কোনো ভয় নেই। তারা থাকবে নিশ্চিন্ত। কারণ আল্লাহর প্রতি তাঁদের ঈমান ছিল অটল। তাঁর প্রতি তারা ছিল পুরোপুরি সমর্পিত। জীবনটাকে তারা কাটিয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে, তাঁর নির্দেশ মেনে। তাঁর বিধান মোতাবেক চলে। আল্লাহ নিজেই যেমন বলেছেন-

یٰعِبَادِ لَا خَوْفٌ عَلَیْكُمُ الْیَوْمَ وَ لَاۤ اَنْتُمْ تَحْزَنُوْنَ، اَلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا بِاٰیٰتِنَا وَ كَانُوْا مُسْلِمِیْنَ.

(সেদিন মুত্তাকীদের বলা হবে) হে আমার বান্দাগণ! আজ তোমাদের কোনো ভয় নেই এবং তোমরা হবে না দুঃখিতও। (এরা আমার সেই বান্দাগণ,) যারা আমার আয়াতসমূহে ঈমান এনেছিল এবং ছিল অনুগত! -সূরা যুখরুফ (৪৩) : ৬৮-৬৯

অতএব আখেরাতের সেই কঠিন দিনে আল্লাহর গযব ও ক্রোধ থেকে বাঁচতে আসুন নিজেদেরকে আল্লাহর সামনে সঁপে দেই। তাঁর প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান এনে মেনে চলি তাঁর প্রতিটি হকুম। সময় থাকতেই তাঁর কাছে ফিরে এসে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে শুরু করি নতুন জীবন । যেমন ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ یٰعِبَادِیَ الَّذِیْنَ اَسْرَفُوْا عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللهِ اِنَّ اللهَ یَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِیْعًا  اِنَّهٗ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِیْمُ،
وَ اَنِیْبُوْۤا اِلٰی رَبِّكُمْ وَ اَسْلِمُوْا لَهٗ مِنْ قَبْلِ اَنْ یَّاْتِیَكُمُ الْعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنْصَرُوْنَ،وَ اتَّبِعُوْۤا اَحْسَنَ مَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْكُمْ مِّنْ رَّبِّكُمْ مِّنْ قَبْلِ اَنْ یَّاْتِیَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَّ اَنْتُمْ لَا تَشْعُرُوْنَ،اَنْ تَقُوْلَ نَفْسٌ یّٰحَسْرَتٰی عَلٰی مَا فَرَّطْتُ فِیْ جَنْۢبِ اللهِ وَ اِنْ كُنْتُ لَمِنَ السّٰخِرِیْنَ،اَوْ تَقُوْلَ لَوْ اَنَّ اللهَ هَدٰىنِیْ لَكُنْتُ مِنَ الْمُتَّقِیْنَ،اَوْ تَقُوْلَ حِیْنَ تَرَی الْعَذَابَ لَوْ اَنَّ لِیْ كَرَّةً فَاَكُوْنَ مِنَ الْمُحْسِنِیْنَ
.

বলে দাও, হে আমার বান্দাগণ! যারা (পাপাচারে নিমজ্জিত হয়ে) নিজেদের উপর জুলুম করেছ, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয়ই তিনি অতিক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হও এবং তাঁর (পূর্ণ) অনুগত হয়ে যাও- তোমাদের নিকট শাস্তি আসার আগে, যার পর আর তোমাদেরকে সাহায্য করা হবে না।

এবং তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি উত্তম যা-কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে তার অনুসরণ করো- তোমাদের উপর অতর্কিতভাবে শাস্তি আসার আগে, এমনভাবে যে, তোমরা টেরও পাবে না।

যাতে কাউকে বলতে না হয়, আল্লাহর প্রতি আমার কর্তব্যে আমি যে অবহেলা করেছি তার জন্য আফসোস! আসলে আমি (আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধান নিয়ে) ঠাট্টাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।

অথবা কাউকে বলতে না হয়, আল্লাহ যদি আমাকে হেদায়েত দিতেন তবে আমিও মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত  হয়ে যেতাম।

অথবা শাস্তি চোখে দেখার পর যেন কাউকে বলতে না হয়, আহা! আমার যদি একটিবার ফিরে যাওয়ার সুযোগ হত, তবে আমি সৎকর্মশীলদের একজন হয়ে যেতাম! -সূরা যুমার (৩৯) : ৫৩-৫৭

আসুন অতর্কিত সেই শাস্তি আসার আগেই আল্লাহর অভিমুখী হই। সেদিনের সেই ভয়াবহ দৃশ্যে নির্বাক হবার আগেই আজ দুনিয়াতে ভাষাকে করি সংযত, চলাফেরায় হই বিনীত। সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির দাপটে দুর্বিনীত না হয়ে আল্লাহর ভয়ে হই ভীত। তাঁর বিধানের অনুগত।

কন্ঠ তোমার আজকে বড়/বিশ্ব কাঁপাও তুমি।

তোমার পদভারে আজি/থরথর কাঁপে ভূমি।

কিন্তু জেনো, আছে একদিন/হবে নমনীয় হবে নীরব।

নতশির সবে যাবে সম্মুখে/শুধু ক্ষীণস্বরে ইয়া নাফসী রব।

আজকে তোমার খেয়ালিপনা/দেখায় স্বেচ্ছাচার।

সত্য-ন্যায়ের ডাক শুনেও/অন্যায় পথে দুর্বার।

ইসরাফিলের শিঙ্গা যেদিন/বাজবে ভীষণ সুরে,

ছুটবে সোজা সেই আওয়াজেই/এ-দিক ও-দিক ছেড়ে।

থাকতে সময় হও হুঁশিয়ার/শোনো সত্যের ডাক।

হও অনুগত, সিজদাবনত/যিন্দেগী গড় পাক।

 

 

advertisement