তাফসীরের অন্যতম উৎস আছার
ইসরাঈলিয়্যাত নয়
পবিত্র কুরআন কারীমে অবতীর্ণ সুস্পষ্ট আকীদা-বিশ্বাস, অকাট্য বিধি-বিধান, কুরআনের মুহকাম আয়াতসমূহে সরাসরি উল্লেখিত হিদায়াত ও বার্তাসমূহ দ্বীন ইসলামের মুতাওয়াতির ও মুতাওয়ারাছ অংশ। এ অংশের নাম ‘উম্মুল কিতাব’। উম্মুল কিতাবে বর্ণিত পথই হল কুরআন কারীমের ভাষায় ‘সাবীলুল মুমিনীন’।
কুরআন কারীমের তালীমাতের এ অংশ, যার উপর ঈমান ও ইসলামের বুনিয়াদ, তা মূলত কোনো তাফসীরের মুহতাজ নয়। কেননা তা কুরআন কারীমের তিলাওয়াত ও পাঠ থেকেই সুস্পষ্ট। এমনিভাবে এ বিষয়গুলো খাতামুন্নাবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যাঁর মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তাআলার আখেরী হেদায়েতনামা আলকুরআনুল কারীম পেয়েছি, তাঁর থেকে তাওয়াতুর ও ইজমায়ে মুতাওয়ারাস-এর মাধ্যমে অকাট্য ও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। এসকল কারণে কুরআন কারীমের এ মুহকাম অংশ, যার পরিধি অনেক বিস্তৃত, নিজেই তাফসীরের এক বড় মৌলিক উৎস। কুরআন কারীমের এ অংশের ব্যাপারেই উসূলুদ দ্বীন শাস্ত্রে বলা হয়েছে-
تأويله تنزيله.
এ অংশের বাইরে কুরআন কারীমের অর্থ ও মর্মের একটা অংশ এমন রয়েছে, আমাদের বুঝ বুদ্ধির সীমাবদ্ধতার কারণে যা বোঝার জন্য তাফসীরের প্রয়োজন হয়। এ তাফসীরের কয়েকটি উৎস রয়েছে। এর মধ্যে তৃতীয় উৎস হল আছার। এ তালিকায় ইসরাঈলিয়্যাত-এর নাম নেই। ইসরাঈলিয়্যাত-এর নাম আসে তাফসীরে কুরআনের অনির্ভরযোগ্য উৎসের তালিকায়। যে তালেবে ইলম কমপক্ষে উলূমুল কুরআন (কৃত : মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকতুহুম) মুতালাআ করেছে তারও এ বিষয়টি জানা থাকবে।
আছার বলতে উদ্দেশ্য হল, সাহাবায়ে কেরামের বক্তব্য (আছারে সাহাবা), তাবেয়ীন ও আইম্মায়ে দ্বীনের বক্তব্য (مقاطيع)। পারস্পরিক স্তরভেদ থাকলেও এর সবগুলোই কুরআন কারীমের তাফসীরেরর উৎসের মাঝে শামিল।
এগুলোর কোন্টা থেকে কীভাবে এবং কতটুকু পর্যন্ত তাফসীর গ্রহণ করা হবে, গৃহীত তাফসীরের মাঝে কোন্টার কী অবস্থান- এটা উলূমুল হাদীস, উসূলে তাফসীর, উসূলে ফিকহ এবং উসূলুদ দ্বীন-এর বিশেষজ্ঞগণই ভালো বোঝেন। তারাই এগুলো সঠিকভাবে নিরূপণ করতে পারেন।
কিছুদিন আগে দিরাসাতে উলইয়ার এক তালেবে ইলম অধমকে বললেন-
‘আমি জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ.-এর দুররে মানছুর দুয়েক জায়গায় মুরাজাআত করেছি। তাতে কিছু কিছু আছার দেখে খুব পেরেশান হয়েছি। আমাদের উপমহাদেশে বড় সাইজের তাফসীরে জালালাইনের সাথে যে হাশিয়া ছাপা আছে, তা মুতালাআ করলেও মাঝে মাঝে খুব পেরেশানিতে পড়ে যাই। সাহাবী তাবেয়ীর বরাতে কী আজব আজব কথা উল্লেখ করা হয়েছে কোথাও কোথাও। বুঝেই আসে না- এ ধরনের কথা কোনো সাহাবী বা তাবেয়ী বলতে পারেন!’
তাকে আরয করা হল, আপনি প্রথম যে বিষয়টি মনে রাখবেন, আমার আপনার বুঝে আসা বা না আসা এটা কোনো বর্ণনা বা কথার সহীহ-গলদ হওয়ার মানদ- নয়। সহীহ-গায়রে সহীহ হওয়ার শরীয়ত নির্ধারিত মানদ- মোতাবেক আহলে ফন যেটাকে সহীহ বলবেন সেটা সহীহ আর যেটাকে গলদ বলবেন সেটা গলদ।
দ্বিতীয় বিষয় হল, আপনি হয়ত ভেবেছেন, তাফসীরের যে কোনো কিতাবে বা টীকায় সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে যা কিছুই বর্ণিত হয়েছে তার সবই তাদের থেকে প্রমাণিত- এ ধারণা কিন্তু ঠিক নয়। এর কারণ হল, প্রথমে তো দেখতে হবে, সাহাবী বা তাবেয়ীর দিকে নিসবতকৃত এ কথার সনদ কেমন? জালালাইনের সাথে যে হাশিয়া, তাতে সাধারণত রেওয়ায়েতের হাওয়ালাও থাকে না, সনদও থাকে না। দুররে মানছুরে সাধারণত হাওয়ালা থাকে তবে অধিকাংশ জায়গায় সনদ উল্লেখ থাকে না।
হাওয়ালায় উল্লেখিত কিতাব বা অন্য কোনো বা-সনদ কিতাব থেকে এ বর্ণনাটির সনদের মান যাচাই করা জরুরি। স্পষ্টত এ কাজ উলূমুল হাদীসের বিশেষজ্ঞগণই করতে পারেন। আমাদের কর্তব্য হল- তাদের কাছ থেকে জেনে নেয়া এবং তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
এ পন্থায় আপনি যদি রেওয়ায়েতগুলোর মান যাচাই করে নেন, তাহলে দেখবেন আপনার অধিকাংশ ইশকাল আপনাআপনিই শেষ হয়ে যাবে। এরপর আপনার একটি কাজ বাকি থাকবে- সনদের বিচারে মানোত্তীর্ণ বর্ণনাগুলোর সঠিক মর্ম ও মিসদাক জেনে নেয়া। এটা উসূলে তাফসীর ও উসূলে ফিকহের মাহিরীনের কাজ। শুধু আরবী ভাষার জ্ঞান থাকলেই এ কাজ করা যায় না। সঠিক মর্ম ও মিসদাক জানার জন্য যেমনিভাবে আরবী ভাষার পর্যাপ্ত ইলম থাকতে হয় তেমনিভাবে এ পরিমাণ ইলমী মাহারাতও থাকা জরুরি, যার দ্বারা সে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে যে, সংশ্লিষ্ট আছারের সম্পর্ক আয়াতের কোন্ শব্দ বা বাক্যের সাথে। বা তাফসীরের কোন্ দিকটির সাথে উক্ত আছারের সম্পর্ক। এরপর সবশেষে হল, এ আছারের সূত্র (مأخذ) কী- তাও উপলব্ধি করতে সক্ষম হওয়া।
কথাগুলো তো দুই লাইনে বলে ফেললাম। কিন্তু আহলে ইলম জানেন, এ কাজের জন্য কত দক্ষতা, কত যোগ্যতা আর কত মেহনতের দরকার হয়।
এ মারহালাতেও আমাদের কাজ হল, আহলে ইলম থেকে সঠিক বিষয়টি জেনে তা অনুসরণ করা।
এ কাজটি করলে আপনার কোনো এশকাল বাকি থেকে থাকলে তাও দূর হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।
এজন্যই এ বিষয়ে বারবার তাম্বীহ করা হয় যে, ইলমে তাফসীরের জন্য শুধু আরবী ভাষাজ্ঞানই যথেষ্ট নয়। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ নীতি যার বিষয়ে আরো বেশি তাম্বীহ করা হয়- ‘অনুবাদ নির্ভর ইলম ঝুঁকিপূর্ণ।’ আহলে ইলমের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধান ছাড়া এটিকে আস্থাযোগ্য বলা যায় না।
এখানে একটি নাযুক বিষয় এটাও, যার প্রতি হযরাতুল উসতায উলূমুল কুরআনে ইশারা করেছেন। তিনি তাফসীরের অনির্ভরযোগ্য উৎসের তালিকায় ‘ইসরাঈলী বর্ণনা’কে উল্লেখ করেছেন। এরপর ইসরাঈলী বর্ণনার প্রকারভেদ ও প্রত্যেক প্রকারের হাইসিয়্যাত বিস্তারিত আলোচনা করার পর বলেন-
بعض روایات میں تو صراحت ہوتی ہے کہ یہ اسرائیلی روایت ہے، اور بعض روایات میں ایسی صراحت نہیں ہوتی، لیکن دوسرے دلائل کی روشنی میں معلوم ہو جاتا ہے کہ یہ اسرائیلیات میں سے ہے، تفسیر کی کتابوں میں جو روایات کعب الاحبار اور وھب بن منبہ سے مروی ہیں وہ زیادہ تر اسی قسم سے تعلق رکھتی ہیں۔
‘কোনো কোনো ইসরাঈলী বর্ণনায় সুষ্পষ্ট উল্লেখ থাকে যে, এটি ইসরাঈলী বর্ণনা। আর কোনো কোনো বর্ণনায় তা সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকে না। কিন্তু অন্যান্য দলীলের আলোকে জানা যায় যে, এটা ইসরাঈলিয়্যাতের অন্তর্ভুক্ত। তাফসীরের কিতাবাদিতে কা‘ব আলআহবার ও ওয়াহ্ব বিন মুনাব্বিহ থেকে যেসকল রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে তার অধিকাংশই এ প্রকারের।’
قال عبد المالك: فمن لم يتنبه لذلك من الطلاب يقول في هذه الإسرائيليات أنها من أقوال التابعين، فإن كعبا ووهبا كلاهما من التابعين، ثم يدعي أن أقوال التابعين من مآخذ التفسير، وهو لا يدري أن هذه الأقوال ليست أقوال التابعين، وإنما هي حكاية منهما من أهل الكتاب، فهي من الإسرائيليات، والإسرائيليات ليست مأخذا للتفسير أبدا.
قال عبد المالك: وأدق من ذلك أن بعض الصحابة رضي الله تعالى عنهم قد يحكي عن أهل الكتاب بعض الأشياء إما استغرابا وإما استنكارا (وإما لأخذ العبرة إذا كانت قصة غير منكرة فيها عظة) فيظنه البعض بمجرد رؤية اسم الصحابي أنه قول الصحابي، وهو مأخذ للتفسير، مع أن المأخذ هو قول الصحابي، لا ما حكاه عن أهل الكتاب والإسرائيليات.
والتمييز بين أقوال الصحابة وبين حكاياتهم عن الإسرائيليات إذا لم يكن التصريح بالحكاية مذكورا في الرواية أمر غامض ومشكل لا يستطيع أن يقوم به إلا النقاد الفحول من أمثال ابن كثير والآلوسي وغيرهما.
لكن لا يأتي في أقوالهم في أمور الدين من العقائد والأحكام شيء من الإسرائيليات،فإنهم كانوا لا يأخذون ولا ينقلون شيئا عن اهل الكتاب في أمور الدين في قليل او جليل، وإنما يأتي النقل عنهم في القصص وأخبار الأنبياء والأمم السابقة،اعتمادا على الترخيص النبوي، فهناك ينبغي الانتباه حتى لا يعد النقل عن الإسرائيليات عين أقوال الصحابة والتابعين. ومن أراد المزيد من الشرح والتفصيل في هذه المسألة الشائكة يمكنه أن يراجع الوجيز في شيء من مصطلح الحديث ص৩৯-৪০১ ومحاضرات علوم الحديث ص১৭২-৩৭২، كلاهما للعبد الضعيف عفا الله تعالى عنه وعن والديه وشيوخه.
এসব বিষয় সামনে রাখা হলে ইমাম মালেক রাহ.-এর মুক্তাতুল্য সেই কথাটির স্মরণ তাজা হয়, যাতে তিনি বলেছেন-
ليس في العلم شيء خفيف.
আশা করি, আমাদের তালাবায়ে কেরাম ইলমের গুরুত্ব সর্বদা হৃদয়ে জাগরূক রাখবেন। ইলম, তাফাক্কুহ, তাফাত্তুন ও সচেতনতা- এই তিন মারহালায়ই দক্ষতা অর্জনে সচেষ্ট থাকবেন।
هذا، وصلى الله تعالى وبارك وسلم على سيدنا ومولانا محمد خاتم النبيين لا نبي بعده، وعلى آله وصحبه أجمعين، وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
-বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
০৬-০৪-১৪৪৪ হিজরী