হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ রফী উসমানী রাহ.
[জন্ম : ০২-০৫-১৩৫৫ হি. মোতাবেক ২১-০৭-১৯৩৬ ঈ.
মৃত্যু : ২৩-০৪-১৪৪৪ হি. মোতাবেক ১৮-১১-২০২২ ঈ.]
بسم الله الرحمن الرحيم
গত জুমাবার দিবাগত রাতে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বড় ফকীহ এবং পুরো দুনিয়ার অনন্য ব্যক্তিত্ব, দারুল উলূম করাচির ছদর হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ রফী উসমানী আখেরাতের সফরে রওয়ানা হয়ে গেছেন।
তিনি ছিলেন মুফতীয়ে আযম পাকিস্তান হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.-এর চতুর্থ ছাহেবযাদা। এই মহান মনীষী ছিলেন তাঁর পিতা ও তাঁর আকাবির-আসলাফের প্রকৃত উত্তরসূরি। পিতার ইন্তেকালের পর সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর দারুল উলূমের মহা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উলামায়ে কেরামের ইলমী নেতৃত্বদানের অনন্য কীর্তি স্থাপন করেছেন।
তাঁর পুরো জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যগুলো হল- উন্নত রুচি, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, কানূনের অনুসরণ, অন্যের হক আদায়, নিপুণতা, ধৈর্য ও সহনশীলতা, সচেতনতা ও সতর্কতা, অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা, ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা এবং তাড়াহুড়াকে অপছন্দ করা ইত্যাদি।
শিক্ষক হিসেবে তিনি অত্যন্ত গোছানো, পরিচ্ছন্ন, সাবলীল ও মিষ্ট ভাষার অধিকারী ছিলেন । জামেয়ার ছদর ও পরিচালক হিসেবে তাঁর পরিচালনা-দক্ষতা এত চমৎকার ছিল, কখনো মনে হত তিনি হয়ত দেশের সফল রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার যোগ্য ছিলেন। ফকীহ ও মুফতী হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় যোগ্যতা তখন প্রকাশ পেত যখন তিনি বড় বড় মুফতীদের লেখা ফতোয়ার বিভিন্ন বাক্য ও উপস্থাপন সম্পর্কে গভীর পর্যালোচনা করতেন এবং সেগুলোর তা‘বীরের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম তাসামুহের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন।
একজন খতীব হিসেবে তাঁর আলোচনা সাধারণত বাড়তি ও অপ্রয়োজনীয় কথা ও বিষয় থেকে মুক্ত হত। মুনকার রেওয়ায়েত, ভিত্তিহীন কাহিনী ও আপত্তিকর বক্তব্য থেকে বহু দূরে থাকত। তাঁর আলোচনা হত সহজ সাবলীল। একইসঙ্গে তা ছিল হৃদয়-উৎসারিত এবং হৃদয়ে রেখাপাতকারী। একজন মুসলিহ ও মুরশিদ হিসেবে তিনি তাঁর আকাবির ও মুরব্বীগণের মতোই ছিলেন বিনয়ী ও দরদী, বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ, ধৈর্যশীল ও সহনশীল। তিনি সবার আগে নিজের মুহাসাবা করতেন।
ব্যবস্থাপনাগত ও ইলমী উভয় অঙ্গনে তিনি ছিলেন বড়ত্ব ফলানো, বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি এবং সবধরনের প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত। সবক্ষেত্রে মধ্যপন্থা ও ভারসাম্য ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
প্রাতিষ্ঠানিক ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে প্রচ- ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি দরস-তাদরীস, তাসনীফ ও ফতোয়া লেখার কাজও একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে সর্বদা জারি রেখেছেন। তাদরীস ও ইহতিমামের প্রথম যুগে তো ফতোয়া লেখার কাজ আরো অনেক বেশি করতেন। এটা দেখে অবাক হতে হয়, তাঁর লেখা ফতোয়াসমূহের সংকলন ছয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এটা ‘ফতোয়া দারুল উলূম করাচি’ (ইমদাদুস সায়িলীন) নামে ছেপেছে। এর মধ্যে কিছু ফতোয়া আছে, যেগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং বিস্তারিত; সেগুলো ‘নাওয়াদিরুল ফিকহ’ নামে দুই খণ্ডে আলাদাভাবেও প্রকাশিত হয়েছে।
হযরত রাহ.-এর রাসায়েল, মাকালাত ও খুতুবাতের আলোচনা বেরাদারে মুহতারাম মাওলানা ইছমাতুল্লাহ ‘নাওয়াদিরুল ফিকহের’ ভূমিকায় এবং মুহতারাম মাওলানা ইজায ছমদানী ‘ফতোয়া দারুল উলূম করাচি’-এর মুকাদ্দিমায় বিস্তারিত লিখেছেন।
হযরত রাহ.-এর খুতবা ও বয়ান সমগ্র ‘ইসলাহী তাকরীরেঁ’ নামে নয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
মাওলানা ইছমাতুল্লাহ ও মাওলানা ইজায ছমদানী উভয়েই হযরত রাহ.-এর জীবনীর বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করেছেন। তাদের লেখায় হযরতের সেসব দায়িত্ব ও পদের তালিকা দেখলাম, যেগুলোর যিম্মাদারি তিনি সারা জীবন কিংবা জীবনের কোনো অংশে পালন করেছেন। সেই দীর্ঘ তালিকা দেখে একদম হতবাক হয়ে গেলাম।
فَتَبٰرَكَ اللهُ اَحْسَنُ الْخٰلِقِیْنَ.
হযরত রাহ.-এর রচনাবলির মধ্যে ‘ইয়ে তেরে পুর আসরার বান্দে’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দস্তাবেজ। এটা মূলত হযরতের আফগানিস্তান সফরের বৃত্তান্ত; এতে তিনি আফগানিস্তান জিহাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ লিপিবদ্ধ করেছেন। জিহাদ বিষয়ে হযরতের বয়ান-
"دوسرا جہاد افغانستان اور ہمارے فرائض"، "جہاد كشمير اور ہماری ذمہ داری"
তাঁর দিলের জযবা ও দ্বীনী গায়রাতের প্রতিবিম্ব। তাঁর রিসালাসমূহের মধ্যে-
"دو قومى نظريہ"
"اختلاف رحمت ہے فرقہ بندى حرام"
"مسلك ديوبند كسى فرقے كا نام نہیں، اتباع سنت كا نام ہے"
-আমার অত্যন্ত পছন্দের।
আমাদের জন্য বড় সৌভাগ্যের বিষয় যে, মারকাযুদ দাওয়াহ প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকেই ইফতা বিভাগের নেসাব আমরা উভয় হযরতের নিকট পাঠিয়েছিলাম। আলহামদু লিল্লাহ উভয় মুরব্বীই নেসাবটি খুব পছন্দ করেন। হযরত ছদর ছাহেব বিশেষভাবে জানতে চান, এতে দারুল উলূমের নেসাব থেকে কী কী ভিন্নতা রয়েছে। তা চিহ্নিত করে দেওয়ার পর হযরত তাতে একমত পোষণ করেন। এর এক-দুই বছর পর যখন বাংলাদেশে তাঁর সফর হয়েছিল তখন আমাদের অনুরোধে তিনি মারকাযুদ দাওয়াহতেও তাশরীফ এনেছিলেন।
বাংলাদেশের উলামায়ে কেরামের মধ্যে হযরত রাহ. থেকে সবচেয়ে বেশি ইস্তিফাদা করার সুযোগ যাঁর হয়েছে, তিনি হলেন হযরত মাওলানা দিলাওয়ার হুসাইন ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম। মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী জেদ্দার রোকন হিসেবে বিভিন্ন ফিকহী বিষয়ে হযরত রাহ. সেখানে আরবীতে যেসব প্রবন্ধ পেশ করেছেন সেগুলোর মধ্য থেকে দুইটি বা তিনটি হযরত মাওলানা দিলাওয়ার ছাহেবের প্রস্তুতকৃত। সেই প্রবন্ধগুলোর নযরে সানী ও সম্পাদনার সময় প্রতিটি মুহূর্ত (কখনো কখনো সারা রাত) তিনি হযরত রাহ.-এর সঙ্গে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে হযরত রাহ.-এর অনেক অন্তরঙ্গতা ছিল।
ভূপৃষ্ঠে হযরত রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে যিনি সবচেয়ে বেশি জানেন, হযরতের ছোট ভাই শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম। এখানে তাঁরই একটি লেখার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি-
‘উলামায়ে কেরাম তাঁকে হযরত মুফতী ওলী হাসান ছাহেব টোংকী রাহ.-এর পর পাকিস্তানের ‘মুফতী আযম’ উপাধি দিয়েছেন। এ উপাধি যে কত সঠিক ও যথার্থ, তার নির্ভরযোগ্য সাক্ষী হচ্ছে তাঁর উর্দু-আরবী রচনাবলি, তাঁর ফতোয়াসমূহ, তাঁর গোছালো ও আকর্ষণীয় পাঠদানশৈলী এবং তাঁর পরিমিত ও ভারসাম্যপূর্ণ বক্তৃতামালা ও ওয়ায-নসীহত। আজ পাকিস্তানে যখন বিচক্ষণ, পরিণামদর্শী, মু‘তাদিল ও মুখলিস উলামায়ে কেরামের তালিকা তৈরি হয় তখন আলহামদু লিল্লাহ তাঁর মহান নামই থাকে তালিকার সর্বশীর্ষে।
দারুল উলূমের নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের জন্যে তিনি নিজ দৈহিক ও মানসিক শক্তি-সামর্থ্য যেন ওয়াকফ করে দিয়েছেন। দারুল উলূমের প্রতিটি দ্বার ও প্রাচীর এবং একেকটি চড়াই ও উতরাই এর সাক্ষ্য দেবে। আমি যদি বলি, দুয়েকটি বাদ দিয়ে দারুল উলূমের প্রায় সমস্ত ইমারত-স্থাপনা সরাসরি তাঁর তত্ত্বাবধানে নির্মিত এবং এর প্রতিটি ইটে তাঁর প্রত্যক্ষ মেহনতের ছোঁয়া আছে, খুব সম্ভব তাতে কোনো অতিশয়োক্তি হবে না। তিনি কেবল আমার জন্য নয়, গোটা খান্দান এবং সমগ্র দারুল উলূমের জন্য এক মমতাময় পিতার মতো।’ -ইয়াদেঁ, আলবালাগ, রবীউস সানী ১৪৩৯ হি.
অধমের সৌভাগ্য, দারুল উলূম করাচিতে অবস্থানকালে (শাওয়াল ১৪১১ হি.-মুহাররম ১৪১৪ হি.) হযরত রাহ.-এরও শাগরিদ হওয়ার সৌভাগ্য লাভ হয়। পরবর্তীতে একাধিক ইলমী বিষয়ে চিঠিপত্র আদান-প্রদানেরও সুযোগ হয়। প্রতি বারই ছোটদের প্রতি হযরতের যে স্বভাবজাত স্নেহ, উৎসাহ প্রদান ও সাহস যোগানো- তা লাভ করি।
জানাযার নামায হযরত শায়খুল ইসলাম দামাত বারাকাতুহুম পড়ান। দারুল উলূমের পুরনো কবরস্থানে বাবা-মায়ের মাঝে তাঁর দাফন হয়।
أمطر الله تعالى على جدثه شآبيب الرحمة والرضوان، وأسكنه الفردوس في وسط الجنان، وألهم من بعده الصبر والسلوان.
হযরত শায়খুল ইসলাম দামাত বারাকাতুহুম নিজের টুইটারে লেখেন-
‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। আমার মুশফিক বড় ভাই, মুসলিম বিশে^র অন্যতম মহান ব্যক্তিত্ব এবং ইলম ও আমলের মূর্ত প্রতীক মুফতীয়ে আযম হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ রফী উসমানী রাহ. ইন্তেকাল করেছেন। তিনি সবদিক থেকে আমার বড় ছিলেন। তবে তালিবে ইলমীর সময় থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ পঁচাত্তর বছর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা একসঙ্গে ছিলাম; কিন্তু আজ পঁচাত্তর বছরের এই সঙ্গের ইতি ঘটল। হৃদয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশের কোনো ভাষা আমার কাছে নেই। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সুউচ্চ মর্যাদা দান করুন।...’
উভয় হযরতকে কাছ থেকে যারা দেখেছেন তারা জানেন, তাঁদের সম্পর্ক কত সুন্দর এবং কত গভীর ছিল। এই সুদীর্ঘ সময় তাঁরা একই প্রতিষ্ঠানে একইসঙ্গে ছিলেন। দ্বীন ও জাতির সমস্ত খেদমত তাঁরা একসঙ্গে আঞ্জাম দিয়েছেন। এই সুদীর্ঘ সময়ে একতা ও সম্পর্কের মধ্যে ফাটল তো দূরে থাক, উল্লেখযোগ্য কোনো অসন্তোষও প্রকাশ পায়নি। সদাচার ও উত্তম আচরণের এমন দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। আল্লাহ তাআলা হযরত শায়খুল ইসলামের হায়াতে বরকত দান করুন। আফিয়াত ও সালামাতের সঙ্গে উম্মতের উপর তাঁর ছায়া দীর্ঘায়িত করুন- আমীন।
هذا، وصلى الله تعالى وبارك وسلم على سيدنا ومولانا محمد خاتم النبيين لا نبي بعده، وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العالمين.
আরযগুযার
বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
২৪-০৪-১৪৪৪ হি.