জুমাদাল উলা ১৪৪৪   ||   ডিসেম্বর ২০২২

ইনাবাত ইলাল্লাহ : যে গুণ অর্জন করতেই হবে

উসামা বিন আব্দুর রশীদ

আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে বিভিন্ন জায়গায় বান্দাকে উদ্দেশ্য করে ইনাবাত ইলাল্লাহ-এর কথা বলেছেন। ইনাবাত শব্দের অর্থ অভিমুখী হওয়া। ইনাবাত ইলাল্লাহ মানে আল্লাহর অভিমুখী হওয়া। শিরক ও সকল গুনাহ এবং মাখলূকের মুখাপেক্ষিতা ইত্যাদি পরিহার করে আল্লাহ্-অভিমুখী হওয়া। আল্লাহ তাআলাকেই সকল ক্ষেত্রে নিজের আশ্রয়স্থল মনে করা। কোনো ইবাদতই যেমন আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে করা যায় না, তেমনি আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কারো দিকেও ইনাবাত হয় না।

আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন এবং আখেরাতের মুক্তি লাভে ইনাবাত ইলাল্লাহ-এর বিকল্প নেই। তাই ইনাবাতের কথা কুরআনুল কারীমে বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে। কোথাও সরাসরি ইনাবাত ইলাল্লাহর আদেশ করা হয়েছে। আবার কোথাও ইনাবাতের তারগীব দেওয়া হয়েছে। কোনো আয়াতে ইনাবাত অর্জনকারীদের প্রশংসা করা হয়েছে, তো অন্য জায়গায় ইনাবাতের সুফল ও সুসংবাদ ঘোষণা করা হয়েছে। কোথাও নবীগণের ইনাবাত ইলাল্লাহর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আবার কোনো আয়াতে ইনাবাত অর্জনকারীদের পথ অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলার মারেফাত বান্দার মধ্যে ইনাবাতের গুণ তৈরি করে। আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালামের মাঝে যেহেতু আল্লাহ তাআলার মারেফাত পূর্ণরূপে বিদ্যমান ছিল তাই সমস্ত নবী-রাসূলই ইনাবাতের চূড়ান্ত স্তরে উন্নীত ছিলেন। ইনাবাত অবলম্বন ও ইনাবাতের গুণে গুণান্বিত হওয়ায় কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে নবীগণের প্রশংসা করা হয়েছে। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-

اِنَّ اِبْرٰهِیْمَ لَحَلِیْمٌ اَوَّاهٌ مُّنِیْبٌ.

নিশ্চয়ই ইবরাহীম (ছিলেন) সহনশীল, অতি কোমলহৃদয়, (আল্লাহ)-অভিমুখী। -সূরা হূদ (১১) : ৭৫

অর্থাৎ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার দিকে অনেক বেশি রুজুকারী ছিলেন।

হযরত দাউদ ও হযরত সুলাইমান আলাইহিমাস সালামের ব্যাপারে কুরআনে কারীমে বলা হয়েছে, তাঁরা উভয়ই নির্দিষ্ট ঘটনার পর আল্লাহ তাআলার দিকে ইনাবাত অবলম্বন করেছেন। তাঁদের ইনাবাত অর্জনের বিষয়টিকে আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। [দ্রষ্টব্য : সূরা ছদ (৩৮) : ২৪-৩৪]

আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম আল্লাহ তাআলার সমীপে ইনাবাতের নিবেদনও পেশ করতেন। ইনাবাতের বিষয়ে হযরত শুআইব আ.-এর অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে কুরআনে কারীমে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি নিজ কওমকে আল্লাহ তাআলার পায়গাম পৌঁছানোর পর আল্লাহ তাআলার কাছে নিবেদন করতেন-

وَ مَا تَوْفِیْقِیْۤ اِلَّا بِاللهِ  عَلَیْهِ تَوَكَّلْتُ وَ اِلَیْهِ اُنِیْبُ.

আমার দ্বারা যা কিছু হয় তা কেবল আল্লাহরই সাহায্যে হয়। আমি তাঁরই উপর নির্ভর করেছি এবং আমি (সকল বিষয়ে) তাঁরই অভিমুখী হই। -সূরা হূদ (১১) : ৮৮

আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকেও ইনাবাত অবলম্বন করার আদেশ করেছেন। কুরআন কারীমে আল্লাহ তাআলার দিকে ইনাবাত ও তাঁর একনিষ্ঠ আনুগত্যকে আখেরাতে নাজাতের উপায় বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ اَنِیْبُوْۤا اِلٰی رَبِّكُمْ وَ اَسْلِمُوْا لَهٗ مِنْ قَبْلِ اَنْ یَّاْتِیَكُمُ الْعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنْصَرُوْنَ.

আর তোমরা তোমাদের রবের অভিমুখী হও এবং তাঁর অনুগত হয়ে যাও- তোমাদের উপর আযাব আসার আগেই; অতঃপর তোমাদের সাহায্য করা হবে না। -সূরা যুমার (৩৯) : ৫৪

অর্থাৎ, তোমরা তাওহীদ ও ইখলাসের সাথে আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও তওবার মাধ্যমে ইনাবাত ইলাল্লাহ অবলম্বন করো এবং দ্বীনের পূর্ণ অনুসরণের পথে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তাআলার আনুগত হও।

হেদায়েত পেতে হলে ইনাবাত অবলম্বন করতে হবে

হেদায়েত মানুষের প্রতি আল্লাহ তাআলার অন্যতম বড় নিআমত। এ হেদায়েত পাওয়ার জন্যও ইনাবাত অবলম্বন করা আবশ্যক। কুরআনে আল্লাহ তাআলা এ বিষয়টি একাধিকবার উল্লেখ করেছেন যে, হেদায়েত পেতে হলে আল্লাহ তাআলার অভিমুখী হতে হবে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকেই হেদায়েতের নিআমত দান করেন, যারা তাঁর অভিমুখী হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

قُلْ اِنَّ اللهَ یُضِلُّ مَنْ یَّشَآءُ وَ یَهْدِیْۤ اِلَیْهِ مَنْ اَنَابَ.

আপনি বলে দিন, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিপথগামী করেন আর তিনি নিজের দিকে তাদেরকেই পথ দেখান যারা (তাঁর) অভিমুখী হয়। -সূরা রাদ (১৩) : ২৭

আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

اَللٰهُ یَجْتَبِیْۤ اِلَیْهِ مَنْ یَّشَآءُ وَ یَهْدِیْۤ اِلَیْهِ مَنْ یُّنِیْبُ.

আল্লাহ যাকে ইচ্ছা নিজের দিকে টেনে নেন এবং যে তাঁর অভিমুখী হয়, তাকে নিজের দিকে পথ দেখান। -সূরা শূরা (৪২) : ১৩

এটা আল্লাহ তাআলার নেযাম ও নিয়ম যে, আল্লাহ তাআলা বক্রহৃদয় ও অবাধ্য একগুঁয়ে স্বভাবের লোকদের হেদায়েতের নিআমত দান করেন না। এই নিআমতে তাদেরকেই ধন্য করেন, যারা হেদায়েতের অনুসন্ধানী হয় এবং তা লাভ করে তাদের হৃদয় ও মানস আরও বেশি আল্লাহ-অভিমুখী হয়।

মুফাক্কিরে ইসলাম মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. এ আয়াতের আলোচনায় বলেন-

এ আয়াতে দুইটি জিনিস বলা হয়েছে। এক হল, ইজতেবা-এর মাকাম। দ্বিতীয় হল, হেদায়েত। ইজতেবা-এর ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা সাফ সাফ বলে দিয়েছেন, এ বিষয়ক সকল মুআমালা আল্লাহ তাআলার হাতে। তিনি যাকে চান তাকে ইজতেবা-এর মর্যাদায় ভূষিত করেন। আমরা এই স্তর অর্জনে চেষ্টা-কোশেশ করার প্রতি আদিষ্ট নয়। কিন্তু হেদায়েত তো আমাদের সকলেরই দরকার। আর আল্লাহ তাআলা তাকেই হেদায়েত দান করেন, যে তার দিকে রুজু করে। হেদায়েত-প্রত্যাশী হয়। আল্লাহ তাআলা তাকে সঠিক পথের উপর উঠিয়ে দেন এবং গন্তব্যে পৌঁছে দেন। তবে শর্ত হল, তার মাঝে ইনাবাতের গুণ থাকতে হবে। নিজের মাঝে হেদায়েতের তলব, আল্লাহ তাআলার প্রতি মুখাপেক্ষিতার অনুভূতি ও নিজের অসহায়ত্বের প্রকাশ থাকতে হবে। এসব কিছুর সমষ্টিকেই ইনাবাত বলে। -কুরআনী ইফাদাত, পৃ. ৩৫-৪১

কুরআন কারীম আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য আলোকবর্তিকা। যে ব্যক্তি কুরআন কারীমকে যথাযথভাবে অনুধাবন করবে, তার জন্য হেদায়েতের পথ সুগম হয়ে যাবে। আর কুরআনের আলো ও হেদায়েত লাভের জন্য ইনাবাত ইলাল্লাহ অপরিহার্য। কুরআন তাদের জন্য যিকর ও নাসীহার মাধ্যম, যারা ইনাবাত অবলম্বন করে। আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে বিষয়টি একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَاٰیَةً لِّكُلِّ عَبْدٍ مُّنِیْبٍ.

নিশ্চয় এতে (আসমান-যমীনের নিদর্শনাবলির মাঝে) প্রত্যেক (আল্লাহ)-অভিমুখী বান্দার জন্য রয়েছে নিদর্শন। -সূরা সাবা (৩৪) : ৯

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-

تَبْصِرَةً وَّ ذِكْرٰی لِكُلِّ عَبْدٍ مُّنِیْبٍ.

(আল্লাহ তাআলা আসমান-যমীন ও পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি সৃষ্টি করেছেন) প্রত্যেক (আল্লাহ)-অভিমুখী বান্দার উপলব্ধি সৃষ্টি ও তাকে স্মরণ করানোর উদ্দেশ্যে। -সূরা কাফ (৫০) : ৮

আরেক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَ مَا یَتَذَكَّرُ اِلَّا مَنْ یُّنِیْبُ.

উপদেশ সে-ই গ্রহণ করে, যে (সত্যের প্রতি) রুজু হয়। -সূরা মুমিন (৪০) : ১৩

অর্থাৎ, আসমান-যমিনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আল্লাহ তাআলার নিদর্শনাবলি তাদের জন্যই হেদায়েতের মাধ্যম হবে, যাদের মাঝে ইনাবাত ইলাল্লাহ রয়েছে। যারা তাওহীদ, ইবাদত ও তওবার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির দিকে ধাবিত হয় এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহ-অভিমুখী থাকে।

ইনাবাত অবলম্বনকারীগণ অনুসরণীয়

দুনিয়াতে নিজেকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য এবং হেদায়েতের উপর অবিচল থাকার জন্য সঠিক পথপ্রাপ্ত লোকদের সঙ্গলাভ ও তাদেরকে অনুসরণ করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে তাদের পথ ও পদাঙ্ক অনুসরণ করতে বলেছেন, যারা আল্লাহ তাআলার প্রতি ইনাবাত অবলম্বন করে। সর্বাবস্থায় আল্লাহ-অভিমুখী থাকে। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

وَّ اتَّبِعْ سَبِیْلَ مَنْ اَنَابَ اِلَیَّ.

আর ওই ব্যক্তির পথ অনুসরণ করবে, যে আমার অভিমুখী হয়েছে। -সূরা লুকমান (৩১) : ১৫

অর্থাৎ, এমন লোকদের পথ ও পদাঙ্ক অনুসরণ করো, যারা তাওহীদ, ইখলাস, ও আমলে সালেহের মাধ্যমে আমার অভিমুখী থাকে।

যারা ইনাবাত অবলম্বন করবে এবং ইনাবাতের গুণে গুণান্বিত হবে, তাদের জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সুসংবাদ রয়েছে। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

وَ الَّذِیْنَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوْتَ اَنْ یَّعْبُدُوْهَا وَ اَنَابُوْۤا اِلَی اللهِ لَهُمُ الْبُشْرٰی .

আর যারা তাগুতের উপাসনা করা থেকে বেঁচে রইল এবং আল্লাহর অভিমুখী হল, তাদেরই জন্য রয়েছে সুসংবাদ। -সূরা যুমার (৩৯) : ১৭

অর্থাৎ, যারা তাগুতের ইবাদত পরিহার করে তাওহীদ ও আল্লাহ তাআলার ইবাদতের মাধ্যমে ইনাবাত ইলাল্লাহ অবলম্বন করে তার জন্য রয়েছে আখেরাতের নাজাত ও জান্নাতের সুসংবাদ।

আখেরাতের নাজাতের জন্য ইনাবাত

আল্লাহ তাআলার প্রতি ইনাবাত আখেরাতের সফলতার জন্য অপরিহার্য। আখেরাতে নাজাত পেতে হলে আল্লাহ তাআলার কাছে কলবে মুনীব তথা অল্লাহ-অভিমুখী হৃদয় নিয়ে যেতে হবে। যারা অন্যান্য আমলের পাশাপাশি কলবে মুনীব নিয়ে আল্লাহ তাআলার দরবারে উপস্থিত হবে, তাদেরকে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করা হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ اُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِیْنَ غَیْرَ بَعِیْدٍ،هٰذَا مَا تُوْعَدُوْنَ لِكُلِّ اَوَّابٍ حَفِیْظٍ،مَنْ خَشِیَ الرَّحْمٰنَ بِالْغَیْبِ وَ جَآءَ بِقَلْبٍ مُّنِیْبِ.

আর জান্নাতকে খোদাভীরুদের নিকটবর্তী করা হবে, তা দূরে রবে না। এ-ই তা, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেওয়া হত- প্রত্যেক (আল্লাহ)-অভিমুখী, সদাসতর্ক ব্যক্তির জন্য, যে রহমানকে না দেখে ভয় করেছিল এবং এসেছে বিনীত অন্তর নিয়ে। -সূরা কাফ (৫০) : ৩১-৩৩

অর্থাৎ, যারা হাশরের ময়দানে তওবা এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির পথে অগ্রসর ও ইনাবাত ইলাল্লাহ-এর আলোয় আলোকিত হৃদয় নিয়ে উপস্থিত হবে, তাদের জন্যই জান্নাত ও রহমানের সন্তুষ্টি।

আল্লাহ তাআলার প্রতি বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুল যেমন সর্বদা জাগ্রত রাখতে হয় তেমনি ইনাবাতের ফায়েদা হাসিল করতে হলে ইনাবাতের উপলব্ধি সর্বদা অন্তরে জাগরুক রাখতে হবে। অন্তরকে কখনোই ইনাবাত-শূন্য হতে দেওয়া যাবে না।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কলবে মুনীবতথা সর্বদা আল্লাহ-অভিমুখী হৃদয় দান করুন- আমীন। হ

 

 

advertisement