জুমাদাল উলা ১৪৪৪   ||   ডিসেম্বর ২০২২

অপ্রাপ্তির আক্ষেপও নয় প্রাপ্তির উল্লাসও নয়

মাওলানা হুজ্জাতুল্লাহ

মানবচরিত্রের একটি নেতিবাচক দিক হল প্রান্তিকতা। আকাক্সক্ষা পূরণে উল্লাস আর আশাভঙ্গে অতিরিক্ত বেদনাবোধ মানুষের স্বভাবজাত দুর্বলতা। পছন্দের কিছু ঘটলে মানুষ আনন্দের সীমা অতিক্রম করে উল্লসিত হয়ে ওঠে। কখনো তা গর্ব ও অহংকারেও পর্যবসিত হয়। পক্ষান্তরে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় মানুষ অতিরিক্ত দুঃখবোধের শিকার হয়। এই উভয় প্রান্তিক প্রবণতা দূর করে ভারসাম্যের পথ অবলম্বন করার শিক্ষা দেয় কুরআন কারীম। আল্লাহ তাআলা বলেন-

مَاۤ اَصَابَ مِنْ مُّصِیْبَةٍ فِی الْاَرْضِ وَ لَا فِیْۤ اَنْفُسِكُمْ اِلَّا فِیْ كِتٰبٍ مِّنْ قَبْلِ اَنْ نَّبْرَاَهَا اِنَّ ذٰلِكَ عَلَی اللهِ یَسِیْرٌ، لِّكَیْلَا تَاْسَوْا عَلٰی مَا فَاتَكُمْ وَ لَا تَفْرَحُوْا بِمَاۤ اٰتٰىكُمْ  وَ اللهُ لَا یُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرِ.

পৃথিবীতে এবং তোমাদের প্রাণের উপর যে মসিবতই আসে, তা একটি কিতাবে (লওহে মাহফুযে) লিপিবদ্ধ আছে, আমি তা সৃষ্টির বহু পূর্বেই। এটি আল্লাহর পক্ষে অতি সহজ। (তোমাদের এ বিষয়ে জানিয়ে দেওয়া হল) যেন তোমরা যা হারাও বা না পাও তার জন্য মুষড়ে না পড়ো। এবং যা আল্লাহ তোমাদের দান করেন তার জন্য উল্লসিত না হও। আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। -সূরা হাদীদ (৫৭) : ২৩-২৪

এ আয়াত বলছে, পৃথিবীতে এবং মানুষের জীবনে ভালো-মন্দ যা কিছু ঘটে সবকিছু লওহে মাহফুযে লিখিত তাকদীর অনুযায়ীই ঘটে। কাজেই কোনো অপ্রীতিকর ঘটনায় অতিরিক্ত দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় মানবীয় দুর্বলতাবশত মনে তো কিছুটা কষ্ট জন্মেই থাকে। কিন্তু সেই কষ্টকে জিইয়ে রাখা কিংবা অতিরিক্ত দুঃখবোধের শিকার হওয়া উচিত নয়। বরং সবকিছুই আল্লাহর ফায়সালায় হয় এ বিশ্বাস মনে জাগরূক রেখে ধৈর্য ধারণ করা কর্তব্য। তদ্রূপ কোনো কিছুর অর্জনে স্বাভাবিক আনন্দবোধ মানুষের স্বভাবজাত। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু স্বাভাবিক আনন্দের স্তর পেরিয়ে উল্লসিত হওয়া এবং অর্জিত বিষয়কে কেবলই নিজের প্রচেষ্টার ফল মনে করার অবকাশ নেই। বরং অর্জিত বিষয় আল্লাহর দান ভেবে শোকর করা কর্তব্য। এটিই ভারসাম্যপূর্ণ পথ।

একটি হাদীসেও এ বিষয়টি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, একদিন আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে সওয়ারিতে বসা ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন-

يَا غُلَامُ إِنّي أُعَلِّمُكَ كَلِمَاتٍ، احْفَظِ اللهَ يَحْفَظْكَ، احْفَظِ اللهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ، إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللهَ، وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ، وَاعْلَمْ أَنَّ الأُمَّةَ لَوْ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ لَكَ، وَلَوْ اجْتَمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ عَلَيْكَ، رُفِعَتِ الأَقْلَامُ وَجَفَّتْ الصُّحُفُ.

বৎস! আমি তোমাকে কিছু কথা শিখাচ্ছি। তুমি আল্লাহকে হেফাযত করবে (অর্থাৎ তাঁর হুকুম আহকাম মেনে চলবে), তাহলে আল্লাহও তোমাকে হেফাযত করবেন। তুমি আল্লাহকে হেফাযত করবে, তাহলে তাঁকে তোমার সম্মুখে পাবে। যখন চাইবে তো আল্লাহর কাছে চাইবে। সাহায্য প্রার্থনা করবে তো আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে। জেনে রাখ, যদি গোটা উম্মত (মানব প্রজাতি) একজোট হয় তোমার কোনো উপকার করার জন্য, তারা তোমার কোনোরূপ উপকার সাধনে সমর্থ হবে না; কেবল ততটুকুই তাদের পক্ষে সম্ভব হবে, যা আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর যদি তারা একজোট হয় তোমার কোনো ক্ষতি করার জন্য, তোমার কোনোরূপ ক্ষতিসাধনে সমর্থ হবে না; কেবল ততটুকুই তাদের পক্ষে সম্ভব হবে, যা আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৫১৬

এ হাদীস থেকেও আমরা শিক্ষা পাই, মানুষের জীবনে ভালো-মন্দ যা কিছু ঘটে তা পূর্ব থেকেই তাকদীরে লিখিত আছে। কাজেই কোনো কিছু হারালে বা কাঙিক্ষত কিছু না পেলে অতিরিক্ত কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। কারণ এই অপ্রাপ্তি আল্লাহর ফায়সালায়ই হয়েছে। তদ্রূপ কোনো কিছু অর্জিত হলে উল্লসিত হওয়ারও কিছু নেই। কারণ এই প্রাপ্তি কেবলই আমার প্রচেষ্টার ফল নয়, বরং তা আল্লাহর দান।

এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট থাকা দরকার, আল্লাহ তাআলা কার তাকদীরে কী লিখে রেখেছেন- তা কারও জানা নেই। তাকদীরে কী লেখা আছে- তার পেছনে পড়ার কোনো প্রয়োজনও নেই। মানুষের দায়িত্ব হল, নিষ্ঠার সঙ্গে আপন কর্তব্যকর্ম করে যাওয়া। কারণ ইখলাস ও নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করে গেলে আল্লাহ তার জন্য নেক কর্মের পথ খুলে দেন। কুরআন কারীম বলছে-

اِنَّ سَعْیَكُمْ لَشَتّٰی، فَاَمَّا مَنْ اَعْطٰی وَ اتَّقٰی، وَ صَدَّقَ بِالْحُسْنٰی،  فَسَنُیَسِّرُهٗ لِلْیُسْرٰی، وَ اَمَّا مَنْۢ بَخِلَ وَ اسْتَغْنٰی، وَ كَذَّبَ بِالْحُسْنٰی،  فَسَنُیَسِّرُهٗ لِلْعُسْرٰی.

তোমাদের প্রচেষ্টা বিভিন্ন রকমের। (কাজেই তার ফলাফলও বিভিন্ন)। সুতরাং যে আল্লাহর পথে অর্থসম্পদ দান করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে এবং উত্তম বিষয়কে (ইসলামকে) সত্য বলে স্বীকার করে, আমি অবশ্যই তার জন্য সহজ করব (তাওফীক দেব) সহজতম বিষয়  (নেক আমল এবং নেক আমলের পথ ধরে জান্নাত)। পক্ষান্তরে যে কৃপণতা করে, বেপরোয়া থাকে এবং উত্তম বিষয়কে (ইসলামকে) অস্বীকার করে, আমি অবশ্যই তার জন্য সহজ করব কঠিনতম বিষয় (জাহন্নাম)। -সূরা আললাইল (৯২) : ৪-১০

বোঝা গেল, নিষ্ঠার সঙ্গে নেক কর্মে লেগে থাকলে আল্লাহ তার জন্য পুণ্যের পথ এবং পুণ্যের পথ ধরে জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। পক্ষান্তরে কেউ হঠকারিতা করে বিপরীত পথ অবলম্বন করতে চাইলে তার পথও রোধ করা হয় না। তাকে আপন গতিতে চলতে দেওয়া হয়।

সুতরাং মুমিনের কর্তব্য হবে-

ক. নিষ্ঠার সঙ্গে কর্তব্যকর্মে লেগে থাকা। তাহলে আল্লাহ তার জন্য নেক কাজের পথ সুগম করে দেবেন।

খ. কিছু হারালে কিংবা কোনো অপ্রাপ্তিতে অতিরিক্ত দুঃখবোধের শিকার না হওয়া। বরং তাকদীরের ফায়সালা অনুযায়ী সবকিছু হয়- এ বিশ্বাস মনে জাগরূক রেখে সবর করা।

গ. অর্জিত কোনো বিষয়কে কেবলই আপন চেষ্টার ফল মনে করে উল্লাসের শিকার না হওয়া। বরং তা আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহের ফল, এ বিশ্বাস বুকে ধারণ করে তাঁর শোকর আদায় করা।

 

 

advertisement