কুরআনের পয়গাম
অন্যায়ের পক্ষাবলম্বন নয়
নবীযুগের একটি ঘটনা। বিশর নামে বনু উবায়রিকের এক মুনাফিক ছিল। সে একবার হযরত রিফাআ রা.-এর ঘর থেকে খাদ্যশস্য ও হাতিয়ার চুরি করে। সাহাবী নবীজীর দরবারে গিয়ে তার নামে বিচার দেন। কিন্তু ঐ লোক চুরি করে যাওয়ার সময় একটা চালাকি করে। খাদ্যশস্যের বস্তার মুখ কিছুটা আলগা করে রাখে। যার ফলে রাস্তায় অল্প-অল্প শস্যদানা পড়তে থাকে। এক ইহুদীর বাড়ির দরজায় পৌঁছে সে বস্তার মুখ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, চোরাই হাতিয়ারও সেই ইহুদীর বাড়িতেই রেখে আসে। তারপর নিজ গোত্রের কিছু লোককে বলে- আমি হাতিয়ার অমুকের বাড়িতে রেখে এসেছি। সেখানে গেলেই পাওয়া যাবে। এতে ঐ ইহুদী ফেঁসে যাচ্ছিল। কারণ সরেজমিন যাচাই করে তার বাড়ি পর্যন্ত খাদ্যশস্য পড়ে থাকতে দেখা গেল। আবার চোরাই অস্ত্রও পাওয়া গেল তার বাড়িতেই। তাই প্রথমদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্দেহে পড়ে যান- ইহুদীই বুঝি চুরি করেছে! তাকে জিজ্ঞেস করা হলে সে বলল, হাতিয়ার তো বিশর আমার এখানে রেখে গিয়েছে। কিন্তু এর স্বপক্ষে সে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে পারছিল না। নবীজী তো আর গায়েবের খবর জানেন না, আল্লাহর পক্ষ থেকে যা জানানো হয় তিনি কেবল তা-ই জানেন। এজন্য ধারণা করা হয়েছিল, এই লোক নিজেকে বাঁচানোর জন্যই বিশরের নাম নিচ্ছে। অপরদিকে বিশরের খান্দান বনু উবায়রিকের কিছু লোকজনও জেনেশুনে তার পক্ষ নিল। তারা জোর দিয়ে বলল, বিশরের নয়; ওই ইহুদীরই শাস্তি হওয়া উচিত।
আল্লাহ যখন নবীজীকে প্রকৃত ঘটনা জানিয়ে দেন তখন বিশরের মুখোশ খুলে যায়। ইহুদীকে সম্পূর্ণ নিরপরাধ ঘোষণা করা হয়। (দ্র. তাফসীরে তবারী ৯/১৮৩; তাফসীরে ইবনে কাসীর ২/৪০৫; তাফসীরে কুরতুবী ৫/৩৭৫; তাফসীরে বাগাভী ১/৬৯৮) মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৮১৬৪; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩০৩৬১
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَ لَا تَكُنْ لِّلْخَآىِٕنِیْنَ خَصِیْمًا.
আপনি খেয়ানতকারীদের পক্ষাবলম্বনকারী হবেন না। -সূরা নিসা (৪) : ১০৫
আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন-
وَ لَا تُجَادِلْ عَنِ الَّذِیْنَ یَخْتَانُوْنَ اَنْفُسَهُمْ، اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ مَنْ كَانَ خَوَّانًا اَثِیْمًا.
যারা নিজেদের সঙ্গেই খেয়ানত করে আপনি তাদের পক্ষে বাক-বিতণ্ডা করবেন না। আল্লাহ কোনো খেয়ানতকারী পাপিষ্ঠকে পছন্দ করেন না। -সূরা নিসা (৪) : ১০৭
আয়াত যদিও নাযিল হয়েছে বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, কিন্তু এতে সকল মুমিনের জন্যই রয়েছে শিক্ষা। অপরাধ করে অন্যের ওপর দোষ চাপানো নিকৃষ্ট কাজ; মুমিন এমনটি করতে পারে না। এ বিষয়ে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
وَ مَنْ یَّكْسِبْ خَطِیْٓئَةً اَوْ اِثْمًا ثُمَّ یَرْمِ بِهٖ بَرِیْٓـًٔا فَقَدِ احْتَمَلَ بُهْتَانًا وَّ اِثْمًا مُّبِیْنًا.
যে ব্যক্তি কোনো দোষ বা পাপকর্মে লিপ্ত হয়, তারপর কোনো নির্দোষ ব্যক্তির ওপর তার দায় চাপায়, সে (আসলে) নিজের ওপর গুরুতর অপবাদ ও প্রকাশ্য গোনাহর ভার চাপিয়ে দিল। -সূরা নিসা (৪) : ১১২
আয়াতের আরেক অমূল্য শিক্ষা হল, মামলা-মোকদ্দমায় যার সম্পর্কেই জানা যাবে, সে ন্যায়ের উপরে নেই, মুমিন কীভাবে তার পক্ষে অবস্থান নিবে বা তার উকিল হবে? অন্যায়ের পক্ষে তো নয়ই; বাদী-বিবাদী দুয়ের কারো ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিত না হবে, সে হক ও সততার মধ্যে আছে, তার পক্ষে সাক্ষ্য তো দূরের কথা; মুমিন কোনোভাবেই তার পক্ষাবলম্বন বা সহায়তা করতে পারে না। তাই ইমাম কুরতুবী রাহ. বলেন-
وَفِي هَذَا دَلِيلٌ عَلَى أَنّ النِّيَابَةَ عَنِ الْمُبْطِلِ وَالْمُتّهَمِ فِي الْخُصُومَةِ لَا تَجُوزُ، فَلَا يَجُوزُ لِأَحَدٍ أَنْ يُخَاصِمَ عَنْ أَحَدٍ إِلّا بَعْدَ أَنْ يَعْلَمَ أَنّهُ مُحِقّ.
এতে প্রমাণিত হয়, অপরাধী ও অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব বৈধ নয় (যতক্ষণ না নিশ্চিত হওয়া যায়, সে হকের ওপর আছে।) সুতরাং কারো ন্যয়নিষ্ঠতা প্রমাণিত হওয়া ব্যতীত তার পক্ষে ওকালতি করা জায়েয নয়। -তাফসীরে কুরতুবী ৫/৩৭৭
সূরা নিসার ১০৭ নম্বর আয়াত থেকে আরেকটি শিক্ষাও গ্রহণ করতে পারি। কোনো ব্যক্তি বা দলের অন্যায় প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পর তার পক্ষাবলম্বন বা লেখালেখি ও বক্তৃতা প্রদান মুমিনের কাজ নয়। ইমাম কুরতুবী রাহ. বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন-
قَالَ الْعُلَمَاءُ: وَلَا يَنْبَغِي إِذَا ظَهَرَ لِلْمُسْلِمِينَ نِفَاقُ قَوْمٍ أَنْ يُجَادِلَ فَرِيقٌ مِنْهُمْ فَرِيقًا عَنْهُمْ لِيَحْمُوهُمْ وَيَدْفَعُوا عَنْهُمْ.
কোনো গোত্রের অন্যায় স্পষ্ট হওয়ার পরও তাদেরকে বাঁচানোর জন্য অপর পক্ষের সাথে তর্কে জড়ানো, ওকালতি করা কিংবা বিবাদ-বিসংবাদ ও পক্ষপাতিত্ব করা জায়েয নেই। -তাফসীরে কুরতুবী ৫/৩৭৮
মোটকথা কুরআনের পয়গাম আমাদের প্রতি- সর্বদা ন্যায় ও সততাকে সঙ্গ দেওয়া। মিথ্যা ও অন্যায়ের পক্ষপাতিত্ব থেকে বিরত থাকা। অন্য আয়াতে আরো স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُوْنُوْا قَوّٰمِیْنَ بِالْقِسْطِ شُهَدَآءَ لِلّهِ وَ لَوْ عَلٰۤی اَنْفُسِكُمْ اَوِ الْوَالِدَیْنِ وَ الْاَقْرَبِیْنَ.
হে মুমিনগণ! তোমরা ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী হয়ে যাও আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতারূপে, যদিও তা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে কিংবা পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়। -সূরা নিসা (৪) : ১৩৫
অতএব ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক জীবন, সবক্ষেত্রে আমাদের সঠিকটাই গ্রহণ করতে হবে। অবিচল থাকতে হবে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে। তা আপনজন এমনকি নিজের বিরুদ্ধেই হোক না কেন।
অন্যায়ের পক্ষপাতিত্ব যেমন হতে পারে জাগতিক বিষয়ে, তেমনি হতে পারে দ্বীনী বিষয়েও। যেমন হতে পারে ব্যক্তির ক্ষেত্রে, হতে পারে নির্দিষ্ট গোত্র বা দলের ক্ষেত্রেও। কখনো কোনোভাবেই অন্যায়ের পক্ষে যাওয়া মুমিনের জন্য সমীচীন নয়। আর কি-ইবা লাভ অন্যায়ের পক্ষে গিয়ে? আজ হয়তো মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে অন্যায়ের পক্ষে গেলাম বা জোর-জবরদস্তি করে সমাজে অন্যায়টিই প্রতিষ্ঠিত করা হল, কিন্তু হাশরের মাঠে আল্লাহর সামনে কী করব? তখনও কি পারব অন্যায়ের পক্ষে লড়তে? তখনও কি পারব অন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে? আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
هٰۤاَنْتُمْ هٰۤؤُلَآءِ جٰدَلْتُمْ عَنْهُمْ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا فَمَنْ یُّجَادِلُ اللهَ عَنْهُمْ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ اَمْ مَّنْ یَّكُوْنُ عَلَیْهِمْ وَكِیْلًا.
তোমাদের ক্ষমতা তো এতটুকুই যে, পার্থিব জীবনে তাদের (অর্থাৎ অন্যায় ও খেয়ানতকারীদের) অনুকূলে (মানুষের সাথে) বাক-বিতণ্ডা করলে। কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহর সঙ্গে কে তাদের অনুকূলে বাক-বিতণ্ডা করবে বা কে তাদের উকিল হবে? -সূরা নিসা (৪) ১০৯
কাজেই অন্যায় ও অপরাধের সহায়তা থেকে দূরে থাকা আয়াতের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। দ্বীনী বিষয়েও সতর্ক থাকা জরুরি। কেউ কোনো ভুল মাসআলা বা ভ্রান্ত চিন্তা পেশ করলে তাকে সঙ্গ দেয়া যাবে না। কারণ ভুল নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর তাকে আর সঙ্গ দেওয়া মুমিনের কাজ নয়। জাগতিক ক্ষেত্রেও কোনো ব্যক্তি বা দলের ভুল সিদ্ধান্তের সাথে সহমত পোষণ করব না। কারণ আমি মুমিন। এটি মুমিনের সঙ্গে যায় না।