রব্বিরহামহুমা কামা রব্বায়ানী সগীরা
‘আমি আলাদা বাসায় থাকি, সন্তানদের বিরক্ত করতে চাই না’। কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে শিরোনামটি দেখে মনে হল, ভেতরে পড়ে দেখি। ভেতরে ঠিক যে ধরনের বিবরণ পাওয়া যাবে চিন্তা করেছিলাম তেমনই পাওয়া গেছে। পত্রিকাটির জীবনযাপন পাতায় একজন ব্যারিস্টার মানুষের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়ে থাকেন। সেখানে ৭২ বছরের এক ভদ্রলোক প্রশ্ন করেছেন, দশ বছর আগে তার স্ত্রীর ইন্তেকাল হয়েছে। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে আছে। একসময় ব্যবসা করতেন। এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। তার সন্তানরা ও তিনি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বি। পেশাগত জীবনে সন্তানেরা খুব সফল। তারা খুব ব্যস্ত। মাসে একবার বাবার সঙ্গে দেখা করতে তাদের সময় হয় না। একা থাকেন। নাতি-নাতনিদের দেখতে ইচ্ছে করে। যেহেতু সন্তানরা ব্যস্ত, তাই তিনি বিরক্ত করতে চান না। বর্ষিয়ান ভদ্রলোক বলেছেন, ‘আমি আলাদা বাসায় থাকি। আমার দেখাশোনার জন্য ছেলেরা লোক রেখে দিয়েছে। কিন্তু এখন বার্ধক্যে এসে সন্তানদের অনুপস্থিতি একটু বেশি বোধ করি। তাদের সঙ্গ কামনা করি।’
তিনি বলেছেন, ‘আমি সন্তানদের ওপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল নই। তাদের প্রতি কোনো অভিযোগও নেই। কিন্তু আমাদের দেশে বৃদ্ধ বয়সে অনেক হতভাগ্য মা-বাবা সন্তানদের নিদারুণ অবহেলার শিকার হয়ে অনেক কষ্টে জীবন যাপন করেন। এর কোনো প্রতিকার আছে কি?’
অনেক কষ্টে ভদ্রলোকের কথাগুলো পড়লাম। এরপর দেখলাম, ব্যারিস্টার সাহেবা এসবের কী জবাব দিচ্ছেন। তাঁর জবাবগুলোও পড়লাম। এরপর মনে হল, এ বিষয়ে দু-চারটি কথা আলকাউসারের পাঠকদের সাথে বলি। ওই বিভাগের উত্তরদাতা ভদ্র মহিলা প্রশ্নকর্তা মুরব্বীকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছেন এবং ‘পিতামাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩’ নামে প্রণীত একটি আইনের বরাত দিয়ে প্রশ্নকারীকে বলেছেন, আপনি এ আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। উক্ত আইনে বলা আছে, ‘কোনো পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে, সন্তানদের সঙ্গে বসবাস না করে আলাদাভাবে বসবাস করলে, উক্ত পিতা বা মাতার প্রত্যেক সন্তান তার প্রতিদিনের আয়-রোজগার, মাসিক আয় বা বার্ষিক আয় থেকে যুক্তিসংগত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা, বা ক্ষেত্রমতে উভয়কে নিয়মিত প্রদান করবে। অথবা মাসিক আয়ের কমপক্ষে দশ ভাগ পিতা-মাতার ভরণপোষণের জন্য ব্যয় করবে।’
আইনে আরও বলা আছে, ‘কোনো সন্তান তার মা-বাবাকে অথবা উভয়কে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধাশ্রম কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। সন্তানেরা তাদের মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করবে। শুধু তা-ই নয়, মা-বাবাকে নিয়মিত সঙ্গ প্রদান করার কথাও আইনে বলা আছে। কোনো সন্তানের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে বা অন্য কোনো নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়, তাহলে তারাও একই অপরাধে অপরাধী হবে। তাদেরও এই আইনের অধীনে শাস্তির আওতায় আনা যাবে।’
লোকটির প্রশ্ন এবং উত্তরদাতার জবাবে আরেকবার চোখ বুলালাম। কারণ, তার কথার জবাব এখানে এসেছে বলে মনে হয়নি। ভদ্রলোক তো আইন জানতে চাননি। তিনি বলেছেন, সন্তানদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ নেই। শুধু তার মনের কষ্টের কথা সেখানে জানিয়েছেন। তাহলে তাকে আইন দেখিয়ে লাভ কী?
ভাবনার বিষয় হল, রাষ্ট্র তো আইন করল, তার পরও এমন হচ্ছে কেন? আমাদের মতো মুসলিম এবং মা-বাবা কেন্দ্রিক পরিবার প্রথানির্ভর দেশেও আজকে বহু বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে? কেনইবা অনেক মা-বাবাকে শুধু সন্তানদের সুখের (!) জন্য একাকী জীবন যাপন করতে হচ্ছে। এরকম অনেক বাবা-মায়ের কথা জানা আছে, যাদের সন্তান দেশের বাইরে থাকে। তারা একা একা এখানে ফ্ল্যাটে বাস করেন। নিজের বা সন্তানের অসুস্থতা বা যেকোনো কষ্টের খবরে একে-অন্যের দুঃখে দুঃখিত হন বটে তবে কেউ কারও সহজে সাক্ষাৎ পান না। প্রায়ই বড় বড় অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, রাজনীতিক নেতা, বর্ষীয়ান ব্যবসায়ীদের ইন্তেকালের খবর আসে। সাথে এটিও জানানো হয়, তাঁর সন্তানেরা সকলে বিদেশে আছে। তারা দেশে ফিরে আসলে তিন দিন পর জানাযা হবে।
এসব খবর পড়ি আর আঁৎকে উঠি। আসলে আমরা যাচ্ছি কোথায়? কোথায় হারিয়ে ফেলছি আমাদের ঐতিহ্য? কত দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছি আমাদের ইসলামী শিক্ষা থেকে। স্বাভাবিক চর্মচোখে আমরা যাদেরকে জীবনে অনেক বেশি সফল মনে করি অথবা আমরা যারা জনসাধারণের সামনে সন্তানাদি, পরিবার ও নিজের জীবনের সফলতার কথা বলে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার ভান করি, তাদের ক’জন আসলে জীবনে সফল? তাদের ক’জনের আসলে শেষ জীবন মনের শান্তিতে কাটে? যদি এসব ক্ষেত্রে উত্তরগুলো হয় নেতিবাচক এবং সম্ভবত এখন সে সংখ্যা বাড়ছে- তাহলে আমাদেরকে কি এর প্রতিকার খোঁজা উচিত নয়? আমরা কি আর্থিক উন্নয়নের জন্য বিদেশমুখী হওয়ার সাথে সাথে নিজেদের পারিবারিক ঐতিহ্য এবং দ্বীন-ধর্মও বিসর্জন দেওয়ার প্রতিযোগিতায় লেগে যাব? সেক্ষেত্রে এখন তো বলা হয়, সন্তানেরা বিদেশে আছে, কয়েকদিনের মধ্যে তারা আসবে, জানাযা দেবে। ক’দিন পর তো সে আশাও দূরীভূত হবে। তথাকথিত উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে তো তা-ই হচ্ছে। এখন তো মা-বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেওয়ার সময়ও ওসব দেশের সন্তানদের হচ্ছে না। কেউ আবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খরচ থেকে বাঁচার জন্যে দিল-দরদি হয়ে মরদেহ মেডিকেলগুলোতে দান করছে! (এ বিষয়ে যিলকদ ১৪৪৩ হি./জুন ২০২২ ঈ. মাসিক আলকাউসারে প্রকাশিত ‘চলুন, শেকড়ে ফেরত যাই’ শিরোনামের লেখাটি দেখা যেতে পারে।)
আসলে কি আইন করেই এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব? নিশ্চয়ই নয়। সুতরাং হাত দিতে হবে গোড়াতে। প্রজন্মকে গড়তে হবে এমনভাবে, যেন মুরব্বীরা আলাদা থাকতে চাইলেও তারা তাঁদেরকে পরম শ্রদ্ধা ও মমতার সাথে নিজেদের কাছে আটকে রাখে। তাদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকে। ব্যস্ততা যতই থাকুক, একটা সময় মা-বাবা ও মুরব্বীদের জন্য বিশেষভাবে বরাদ্দ রাখবে।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মুরব্বীদের মধ্যে শিশুসুলভ অনেক বিষয়ও চলে আসে। তখন তাদের মন-মেযাজ বুঝে তাদেরকে সমর্থন দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কখনো বা তারা অল্পতেই রাগ করে ফেলেন। কখনো মেযাজ বিগড়ে যায় বারবার। সে সময়ও তাদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রয়োজন দেখা দেয়।
কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা মানুষের সবচেয়ে বড় পাপ শিরকের কথা উল্লেখ করেছেন, তার সাথে কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় মা-বাবার প্রতি সদাচারের কথা বলেছেন। অর্থাৎ মা-বাবার সাথে অসদাচরণ শিরকের পরেই বড় পাপ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَاعْبُدُوا اللهَ وَلَا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَیْئًا وَّ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا.
আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর। -সূরা নিসা (৪) : ২৬
তবে কুরআনে কারীমের সূরা বনী ইসরাইলে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন আজকের সময়ের এ অবহেলিত মা-বাবা ও বর্ষীয়ান মুরব্বীদের কথাই বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَقَضٰی رَبُّکَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ وَ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا اِمَّا یَبْلُغَنَّ عِنْدَکَ الْکِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوْ کِلٰهُمَا فَلَا تَقُلْ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَّهُمَا قَوْلًا کَرِیْمًا، وَ اخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَۃِ وَقُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا کَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا .
তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোনো একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ্’ পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো।
এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সাথে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো এবং দুআ করো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ২৩-২৪
আমি প্রায় বলে থাকি, মা-বাবার সাথে তো সন্তানকে সবসময় সদাচরণ করতেই হবে। কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় সেটা আছেও। কিন্তু এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বৃদ্ধ মা-বাবার কথা আলাদা করে কেন বললেন? কেন এ কথা বললেন যে, তোমরা মা-বাবার কোনো একজন বা উভয়জন যদি বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়, তাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করবে না; তাহলে কি যুবক-যুবতী বয়সী মা-বাবার সাথে দুরাচরণ করা যায়? বিষয়টি আসলে এমন নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ যখন বার্ধক্যে উপনীত হয় তখন অধিকাংশই মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। সে সময়ে তাদের আপনজনের সঙ্গ দরকার হয় অনেক বেশি। শুধু খোরপোশের জন্যই নয়, বরং সুন্দর সময় কাটানোর জন্য তাঁরা পরিবারের কাছাকাছি থাকতে ভালবাসেন তখন। কিন্তু একই সময়ে বয়সের চাপে ধৈর্য-শক্তিও কমে আসে। সে সময় অল্পতে বিরক্ত হয়ে যাওয়া বা ছোটদের কটু কথা বলে ফেলা, মন খারাপ করা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আল্লাহ তাআলা বান্দাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি জানেন, তার বান্দার কোন্ বয়সে কী ধরনের মন মেযাজ হবে। তাই তিনি তাদের সুরক্ষার জন্য সন্তান-সন্ততিকে নির্দেশ করেছেন- যেন বাবা-মা বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হলেও (যখন তাদের মন-মেযাজ অল্পতেই বিগড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় বেশি) তাদের সাথে সদাচরণ অব্যাহত রাখে। সাথে উক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তাআলা অতিরিক্ত নির্দেশও দিয়েছেন। রূঢ় আচরণে বিরক্ত তো হওয়া যাবেই না; বরং সুন্দরভাবে তাদেরকে জবাব দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন-
وَقُلْ لَّهُمَا قَوْلًا کَرِیْمًا.
তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো।
এখানেই কুরআনের নির্দেশ শেষ হয়নি; বরং আল্লাহ তাআলা উক্ত নির্দেশের যৌক্তিকতাও বান্দার সামনে দিয়ে দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে-
وَقُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا کَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا.
এবং বলো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশব স্নেহ ও মমতায় আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।
যে দুআ প্রত্যেক মুসলমানই তার মা-বাবার জন্য করে থাকে। আসলে এ দুআতেই রয়েছে মা-বাবার সাথে সকল বয়সে এবং তাদের সকল আচরণে সদাচার ও ভদ্রোচিত ব্যবহারের যৌক্তিকতা। কারণ দুআয়-
کَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا.
(‘তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন।)- এ অংশ না থাকলেও পারত। আল্লাহ তো জানেনই যে দুআ করছে, তার মা-বাবা তাকে শিশুকালে লালন-পালন করেছেন। দুআয় এ কথা শিখিয়েছেন, যেন শৈশব ও কৈশোরে লালন-পালন করতে গিয়ে মা-বাবা যে কষ্ট করেছেন সে বিষয়গুলো সন্তানের মনে সব সময় গেঁথে থাকে। যে বান্দার অন্তরে এগুলো গেঁথে থাকবে, সে কখনো পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রম বা ভিন্ন কোথাও পাঠাতে পারবে না। তাহলে আমাদের সমাজে কমতিটা কীসের? আজকের আলোচ্য ঘটনায় সমস্যাটা অর্থের নয়; বরং সমস্যাটা সামাজিক ও দ্বীনকেন্দ্রিক। দ্বীনী বোধ, দ্বীনী শিক্ষা থেকে যত আমরা দূরে সরে যাচ্ছি ততই আমরা নিজেদের একাকিত্বের আয়োজন করে ফেলছি। তাই প্রশ্নটি আইনের নয়, প্রশ্নটি শিক্ষাব্যবস্থার এবং পারিবারিক শিক্ষার। শৈশব-কৈশোরে নতুন প্রজন্মকে দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার গুরুত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সে শিক্ষা যতদিন দেওয়া না হবে ততদিন এ সমস্যা বাড়তেই থাকবে।
আর নাতি-নাতনিদের প্রতি টান অনুভব করা তো আল্লাহপ্রদত্ত মহব্বত ও রহমতের বিষয়। কবে যেন পত্রিকায় পড়েছি, ভারতে এক ভদ্রলোক আদালতে মামলা দিয়েছেন নাতি-নাতনি পাওয়ার আকুতি নিয়ে। কেন তার ছেলের ঘরে বিবাহের বহু বছর পার হওয়ার পরও সন্তান আসে না। খবরটি পড়ে অনেকে হয়তো হেসেছেন, কিন্তু আসলে এখানে দুঃখেরও বিষয় আছে। আমাদের প্রিয় নবী রাহমাতুল লিল আলামীন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত আদর করতেন নাতি-নাতনিদের- সেটির জন্য তো এক-দুটি হাদীসের ভাষ্য পেশ করাই যথেষ্ট। মসজিদে নববীতে নামায আদায়ের সময়ও তাঁর কাঁধ মুবারকে চড়ে বসতেন শিশু হাসান ও হুসাইন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদার সময় তাদেরকে হাতে ধরে নামিয়ে দিতেন। আবার তারা পিঠে চড়ে বসত। কিন্তু কখনো তিনি বিরক্ত হয়েছেন, তাদেরকে বকা দিয়েছেন- এমন কথা কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় না। এটি স্বভাবজাত বিষয়। সুতরাং যে কোনো বর্ষীয়ান মানুষের নাতি-নাতনির প্রতি টান অনুভব হওয়া খুবই স্বাভাবিক বিষয়।
প্রশ্ন হল, এটি কি শুধু একতরফাই থাকা উচিত? না তা কেন হবে? যুগ যুগ থেকে তো এটি একতরফা ছিল না। দাদা-দাদি, নানা-নানি যেমনিভাবে নাতি-নাতনিদের ভালবাসেন, তাদেরকে কাছে পেতে চান, তেমনিভাবে নাতি-নাতনিদেরও তো শ্রদ্ধা, আদর-স্নেহের প্রথম কেন্দ্র হল, দাদা-দাদি ও নানা-নানি। কিন্তু এখনকার নাতি-নাতনিরা কেন দাদা-দাদি ও নানা-নানিকে সময় দেওয়ার সুযোগ পায় না। অথবা প্রয়োজন অনুভব করে না। এসব প্রশ্নেরও একই জবাব। বস্তুবাদিতা এবং একতরফা দুনিয়াদারি এবং তথাকথিত আর্থিক উন্নয়ন ও স্ট্যাটাসের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে মুসলিম সমাজকে। ফিরে যেতে হবে আবার নিজেদের সুন্দর ও একান্ত নিজস্ব ঐতিহ্যে। যে ঐতিহ্য হারিয়ে আজকের তথাকথিত সভ্য বিশ্ব পুড়ে পুড়ে মরছে। আমাদেরকে সে পথে হাঁটা ছেড়ে দিতে হবে। আবার আসতে হবে ইসলামের ছায়াতলে। তবেই আর কোনো পিতা-মাতার এমন দুঃখের কথা শুনতে হবে না।
আল্লাহ তাআলা তাঁর ফজল ও করমে এ সমাজকে রক্ষা করুন। আমাদের নিজ সন্তানাদি এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে দ্বীনী শিক্ষা ও সভ্যতা সংস্কৃতির মাধ্যমে এমন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার তাওফীক দিন, যারা নিজেদের পিতা-মাতা ও অন্যান্য মুরব্বীদের বৃদ্ধ বয়সের মনের কথা সহজেই বুঝতে পারবে।
একটি কথা মনে রাখা দরকার, ঘটনাক্রমে আগে মৃত্যু না হয়ে গেলে বার্ধক্যে তো সবাইকেই পৌঁছতে হয়। আজকে যে কৈশোর বা যৌবন অতিক্রম করছে তারও তো একদিন বার্ধক্য আসতে পারে। তখন তার কী হাল হবে? সুতরাং মুরব্বীদের প্রতি অবহেলা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আল্লাহ তাআলাই একমাত্র তাওফীকদাতা।
দ্রষ্টব্য : অনেকেই অনুরোধ করেছিলেন, দেশের চলমান অর্থনৈতিক অবস্থা এবং গণমানুষের অনাগত অর্থনৈতিক আতংক ও এর প্রতিকার নিয়ে এ সংখ্যায় কিছু লিখতে। কিন্তু আলোচ্য ঘটনাটি পড়ার পর আমার কাছে এ বিষয়ে কিছু আরজ করাই আগে প্রয়োজন মনে হয়েছে। আমি মনে করি, পরিবার, সমাজ এগুলো আগে। অর্থ পরে। যদিও সবকিছুর সাথেই অর্থের প্রশ্ন জড়িত থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই অর্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু অর্থই আসলে মুখ্য বিষয় নয়; সেটি একটি উপকরণ মাত্র। বরং এরও আগে হল, সততা, নিজস্ব সভ্যতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবার ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ। এসব ঠিক না করে অর্থ যতই বেড়ে যাক, যতই কথিত উন্নয়নের কথা বলা হোক- সব ধূলিসাৎ হতে বাধ্য। আমাদের উন্নয়নের জারিজুরিও সেটিরই প্রমাণ বহন করছে।