সফর ১৪৪৪   ||   সেপ্টেম্বর ২০২২

কুরআন তিলাওয়াত : মহান একটি আমল

মাওলানা মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

কুরআন মাজীদ হল হেদায়েতগ্রন্থ। হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল যুগের, সকল দেশের, সকল ভাষা, বর্ণ, গোত্র, পরিবেশ ও স্বভাবের মানুষের জন্য কুরআন হেদায়েত ও পথপ্রদর্শক। সেজন্য কুরআন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শ্রেষ্ঠ মুজেযা।

এই কুরআনে শুধু যে বিধি-বিধান বর্ণিত হয়েছে এমন নয়। পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর কর্ম ও কর্মফলের বিবরণ এসেছে। ভবিষ্যৎ ও পরকাল জীবনের নানা অবস্থা বিবৃত হয়েছে। বিশ্লেষিত হয়েছে পাপ-পুণ্যের ও ভালো-মন্দের প্রকৃত পরিণাম। ফলে যে কোন মানুষ চাইলেই কুরআনের আয়নায় নিজেকে দেখতে পারে। নিজের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে কুরআন পড়লে খুঁজে পায় জীবনের আসল রূপ ও ভবিষ্যত পরিণতির আভাস।

কুরআন মাজীদের পরিচয় এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। মূলত কুরআন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কালাম। আসমানী কিতাব। এমন এক কিতাব, যা ছাড়া দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা লাভ করা সম্ভব নয়।

কুরআন শেখা ও শেখানো

এই কুরআনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করার বিভিন্ন দিক রয়েছে। কুরআন তিলাওয়াত করা। অন্যের তিলাওয়াত শোনা। তিলাওয়াত ও তাফসীর শেখা। অন্যকে শিক্ষা দেওয়া। কুরআনের আয়াত, ভাব ও মর্ম নিয়ে চিন্তা-ফিকির করা ইত্যাদি। তন্মধ্যে সবচে সহজ ও গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল তিলাওয়াত।

কুরআন নাযিল হওয়ার পর সর্বপ্রথম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  তিলাওয়াত করেছেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে তিলাওয়াত  করে শুনিয়েছেন এবং শিখিয়েছেন। তাই কুরআন মাজীদের প্রথম শিক্ষক তিনিই। তখন থেকে আজ পর্যন্ত যত মনীষী এই কুরআন শিক্ষাদানে নিয়োজিত হয়েছেন তারা মূলত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই ওয়ারিস ও উত্তরাধিকারী। তাদের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلّمَ القُرْآنَ وَعَلّمَهُ.

তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সে, যে কুরআন মাজীদ শেখে এবং শেখায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০২৭

কুরআন তিলাওয়াত

কুরআন নাযিল হওয়ার পর থেকে সর্বযুগে সকল মুমিনের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল ছিল কুরআন তিলাওয়াত। নামাযে এবং নামাযের বাইরে। তাতে স্বাভাবিক ও নিয়মিত তিলাওয়াতের পাশাপাশি বিস্ময়কর তিলাওয়াতেরও অনেক ঘটনা পাওয়া যায়। আমাদের নিকট অতীতেও পাওয়া যায় নামাযের এক রাকাতে পুরো কুরআন মাজীদ খতম করার ঘটনা। এক রাতে দুই খতম, তিন খতম তিলাওয়াতের ঘটনাও আছে বুযুর্গদের জীবনীতে। তবে সেটা তাঁদের কারামতই বটে। অন্যথা বছরের দীর্ঘ রাতগুলোতেও আর কয় ঘণ্টা সময়? এই সময়ে দুই তিন খতম তিলাওয়াত করা- বলা যায় অসম্ভব। উপরন্তু ধীরে ধীরে, স্পষ্ট উচ্চারণে ও সুমধুর স্বরে তিলাওয়াতের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে হাদীসে। সেজন্য সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই তিন দিনে এক খতম তিলাওয়াত করতেন। অনেকে সাত দিনে। অনেকে একমাসে। বুযুর্গদের অনেকে তিলাওয়াত করতেন চাঁদের তারিখ হিসাব করে। মাসের প্রথম দিন প্রথম পারা, শেষদিন শেষ পারা।

আসলে কুরআন তিলাওয়াতের স্বাদ যাঁরা পেয়ে যান তাঁদের তিলাওয়াত চলতে থাকে সবসময়। তিলাওয়াত ছাড়া একটি দিন পার করা তাঁদের জন্য পানাহার বিহীন দিন পার করার চেয়েও কঠিন।

 দৈনন্দিন তিলাওয়াতের অংশ

সাধারণ নিয়মে কুরআন তিলাওয়াতের সাথে সাথে বিশেষ কিছু সূরা ও আয়াত দৈনিক বা বিশেষ সময়ে তিলাওয়াতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে হাদীসে। সেজন্য ঐ সময়ে ঐ সূরা বা আয়াত তিলাওয়াতে বিশেষ ফযীলতের কথাও বর্ণিত হয়েছে। এমন দুয়েকটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হল।

সাহাবী আবু মাসউদ  আনসারী রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ قَرَأَ بِالْآيَتَيْنِ مِنْ آخِرِ سُورَةِ الْبَقَرَةِ فِي لَيْلَةٍ كَفَتَاهُ.

যে ব্যক্তি রাতে সূরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত পড়বে তার জন্য তা (রাতের আমল হিসেবে এবং সকল অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে) যথেষ্ট হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০০৯

আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বললেন-

أَيَعْجِزُ أَحَدُكُمْ أَنْ يَقْرَأَ ثُلُثَ الْقُرْآنِ فِي لَيْلَةٍ.

তোমাদের কেউ কি রাতের বেলা কুরআন মাজীদের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করতে পারবে?

বিষয়টি তাঁদের কাছে কঠিন মনে হল। তাঁরা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের কে তা পারবে? তখন তিনি বললেন-

اَللهُ الْوَاحِدُ الصّمَدُ ثُلُثُ الْقُرْآنِ.

সূরা ইখলাস (তিলাওয়াত) কুরআন মাজীদের এক তৃতীয়াংশ (তিলাওয়াতের সমান)। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০১৫

রাতের বেলা সূরা ইখলাসের সাথে সূরা ফালাক ও সূরা নাস তিলাওয়াতের কথাও এসেছে হাদীসে। আম্মাজান আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত-

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ إِذَا أَوَى إِلَى فِرَاشِهِ، نَفَثَ فِي كَفّيْهِ بِقُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ وَبِالْمُعَوِّذَتَيْنِ جَمِيعًا، ثُمّ يَمْسَحُ بِهِمَا وَجْهَهُ، وَمَا بَلَغَتْ يَدَاهُ مِنْ جَسَدِهِ.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে যখন বিছানায় আসতেন, (ঘুমানোর আগে) সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়ে দুই হাতের তালুতে (একত্র করে) ফুঁ দিতেন। এরপর সেই দুই হাতে চেহারা ও পুরো শরীর যতদূর সম্ভব মুছে নিতেন। আয়েশা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হয়ে গেলে আমাকে আদেশ করতেন, আমি তা (সূরাগুলো পড়ে হাতের তালুতে ফুঁ দিয়ে শরীর মোছার কাজ) করে দিতাম। -সহীহ বুখারী, হাদীস  ৫৭৪৮

অন্য রেওয়ায়েতে আছে-

يَمْسَحُ بِهِمَا مَا اسْتَطَاعَ مِنْ جَسَدِهِ يَبْدَأُ بِهِمَا عَلَى رَأْسِهِ وَوَجْهِهِ وَمَا أَقْبَلَ مِنْ جَسَدِهِ يَفْعَلُ ذَلِكَ ثَلَاثَ مَرّاتٍ.

দুই হাতে পুরো শরীর যতদূর সম্ভব মুছে নিতেন। মোছা শুরু করতেন মাথাচেহারা ও শরীরের সম্মুখভাগ থেকে। তিনবার এমন করতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০১৭

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত এসব আমলের ফায়েদা বহুমূখী। কোনো কোনো হাদীসে নির্দিষ্ট কিছু ফায়েদার কথা উল্লেখিতও হয়েছে। মূলত উম্মতের নানা প্রয়োজন ও ফায়েদা লক্ষ্য করেই তিনি এসব আমল শিক্ষা দিয়েছেন এবং বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছেন। আমাদের উচিত হাদীসে বর্ণিত এইসব আমলকে অত্যন্ত যত্ন ও গুরুত্বের সঙ্গে আদায় করা।

কুরআন তিলাওয়াতের প্রাসঙ্গিক ফায়েদা

কুরআন মাজীদের কিছু সূরা ও আয়াতের প্রাসঙ্গিক ফায়েদাও বর্ণিত হয়েছে হাদীসে। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়াত হল আয়াতুল কুরসী। এই আয়াতের ফায়েদা বর্ণিত হয়েছে আবু হুরায়রা রা.-এর ঘটনায়। ঘটনাটি সহীহ বুখারীসহ হাদীসের অন্য অনেক কিতাবে এসেছে। সহীহ বুখারীতে এসেছে কয়েকবার। বিস্তারিতভাবে এবং সংক্ষেপে। আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার আমাকে রমযানে উসূলকৃত যাকাতের সম্পদ হেফাযতের দায়িত্ব দিলেন। এক রাতে এক আগন্তুক খাদ্যের স্তূপ থেকে দু হাত ভরে নিয়ে যেতে লাগল। আমি তাকে ধরে ফেললাম। বললাম, অবশ্যই আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে নিয়ে যাব।... আবু হুরায়রা রা. পুরো ঘটনা বর্ণনা শেষে বলেন, তখন আগন্তুক আমাকে বলল-

إِذَا أَوَيْتَ إِلَى فِرَاشِكَ فَاقْرَأْ آيَةَ الْكُرْسِيِّ لَنْ يَزَالَ مَعَكَ مِنْ اللهِ حَافِظٌ وَلَا يَقْرَبُكَ شَيْطَانٌ حَتّى تُصْبِحَ.

আপনি রাতে যখন ঘুমাতে যাবেন আয়াতুল কুরসী পড়বেন। তাহলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একজন হেফাযতকারী ফেরেশতা সকাল পর্যন্ত আপনার সঙ্গে থাকবে। ফলে শয়তান আপনার কাছেও ভিড়তে পারবে না। ঘটনা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

صَدَقَكَ وَهُوَ كَذُوبٌ، ذَاكَ شَيْطَانٌ.

সে ছিল (ইবলিস) শয়তান। সে মিথ্যুক হলেও কথা সত্য বলেছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০১০

আরেকটি বর্ণনায় উবাই ইবনে কাব রা.-এর ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা পাওয়া যায়। তাঁর খেজুরের স্তূপ ছিল। তিনি দেখতে পেলেন সেখান থেকে খেজুর কেবলই কমছে। এক রাতে পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। দেখলেন, কিছুটা সাবালক ছেলের মতো একটা প্রাণী। তিনি তাকে সালাম দিলেন। সে উত্তর দিল।

জিজ্ঞেস করলেন, তুমি জীন না ইনসান? বলল, জীন। ...একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী?

সে বলল, তুমি সূরা বাকারার আয়াতুল কুরসী পড়তে জানো?

বললেন, হাঁ।

সে বলল-

إِذَا قَرَأْتَهَا غُدْوَةً أُجِرْتَ مِنّا حَتّى تُمْسِيَ، وَإِذَا قَرَأْتَهَا حِينَ تُمْسِي أُجِرْتَ مِنّا حَتّى تُصْبِحَ.

এই আয়াত তুমি সকালে পড়লে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের থেকে রক্ষা পাবে। সন্ধ্যায় পড়লে সকাল পর্যন্ত রক্ষা পাবে।

উবাই রা. বলেন, সকালে আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হয়ে ঘটনাটি শোনালাম। তিনি বললেন-

صَدَقَ الْخَبِيثُ.

খবীসটি সত্য বলেছে। -নাসায়ী, সুনানে কুবরা, হাদীস ১০৭৩০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৭৮৪; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২০৬৪।

বিশেষ কয়েকটি আয়াত ও সূরা

পুরো কুরআন মাজীদই ওহী এবং আল্লাহ তাআলার কালাম। পুরো কুরআন মাজীদই নূর ও হেদায়েতে পূর্ণ। কুরআন মাজীদের যে কোনো জায়গা থেকে তিলাওয়াত করলেই প্রতি হরফে কমপক্ষে দশ নেকী। তদুপরি বিশেষ কিছু আয়াত ও সূরা সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্বের কথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন একটি হাদীসে সূরা ফাতিহা ও সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের মহিমা উল্লেখিত হয়েছে। সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম বসা ছিলেন। এমন সময় ওপরের দিক থেকে দরজা খোলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা উঠালেন। তখন জিবরাঈল আ. বললেন, এটি আসমানের একটি দরজা। আজই প্রথম খোলা হল। আগে কখনো এ দরজা খোলা হয়নি।

সেখান থেকে একজন ফেরেশতা নেমে এলেন।

তিনি বললেন, এই ফেরেশতা আজকের আগে আর কখনো পৃথিবীতে আসেননি।

ফেরেশতা সালাম দিয়ে বললেন-

أَبْشِرْ بِنُورَيْنِ أُوتِيتَهُمَا لَمْ يُؤْتَهُمَا نَبِيّ قَبْلَكَ: فَاتِحَةُ الْكِتَابِ، وَخَوَاتِيمُ سُورَةِ الْبَقَرَةِ، لَنْ تَقْرَأَ بِحَرْفٍ مِنْهُمَا إِلّا أُعْطِيتَهُ.

আপনি এমন দুটি নূরেরসুসংবাদ গ্রহণ করুন, যা শুধু আপনাকে দেওয়া হয়েছে। আপনার পূর্বে আর কোনো নবীকে দেওয়া হয়নি। সূরা ফাতিহা এবং সূরা বাকারার শেষাংশ। আপনি এর যে কোনো হরফ পড়বেন তার মধ্যকার প্রার্থিত বিষয় আপনাকে দেওয়া হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮০৬ 

সূরা ফাতিহার গুরুত্ব ও বিশেষত্বের কথা আরও কয়েকটি হাদীসে এসেছে। তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো একটি বর্ণনায় এসেছে মানবজাতির বিরাট প্রাপ্তি ও সৌভাগ্যের কথা।

আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আমি ও আমার বান্দার মাঝে নামাযকে অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করেছি। আর আমার বান্দার জন্য রয়েছে সে যা চায়।

বান্দা যখন বলে-

اَلْحَمْدُ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ.

আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে।

সে যখন বলে-

الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ.

আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার বান্দা আমার গুণগান করেছে।

সে যখন বলে-

مٰلِكِ یَوْمِ الدِّیْنِ.

আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছে।

বর্ণনাকারী কখনো বলেন, আল্লাহ বলেন, বান্দা তার সকল বিষয় আমার কাছে সোপর্দ করেছে।

বান্দা যখন বলে-

اِیَّاكَ نَعْبُدُ وَ اِیَّاكَ نَسْتَعِیْنُ.

আল্লাহ বলেন, এটা আমার ও আমার বান্দা উভয়ের মাঝে। আমার বান্দা যা চায় তা-ই তাকে দেওয়া হবে।

বান্দা যখন বলে-

اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَ، صِرَاطَ الَّذِیْنَ اَنْعَمْتَ عَلَیْهِمْ غَیْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ وَ لَا الضَّآلِّیْنَ.

তখন আল্লাহ বলেন, এ সবই আমার বান্দার জন্য। বান্দা যা চায় তা-ই তাকে দেওয়া হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৯৫

এভাবে কিছু সূরা ও কিছু আয়াতকে তার বিষয়বস্তু বা অন্য কোনো কারণে বিশেষ ফযীলত ও মর্যাদা দান করা হয়েছে। বাহ্যত মনে হয়, এ আয়াত ও সূরা যেন বান্দা বেশি বেশি তিলাওয়াত করে এবং তার মধ্যকার ফায়েদা সহজেই লাভ করতে পারে সেজন্যই তা করা হয়েছে।

একটি হাদীসে সূরা ইখলাসে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলির আলোচনা আছে বলে তার ফযীলত বেশি হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। হাদীসটি আম্মাজান আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত। সেখানে এক সাহাবীকে নামাযে বারবার সূরা ইখলাস পড়ার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন-

 لِأَنّهَا صِفَةُ الرَّحْمنِ وَأَنَا أُحِبّ أَنْ أَقْرَأَ بِهَا.

কেননা তা (এই সূরা) কেবলই আল্লাহ তাআলার গুণাবলি। তাই আমি এটি পড়তে ভালবাসি। একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে জানিয়ে দাও, আল্লাহও তাকে ভালবাসেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৩৭৫

একই কথা আয়াতুল কুরসীর ক্ষেত্রে। সেখানেও আল্লাহ তাআলার গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলির আলোচনা এসেছে।

বিখ্যাত সাহাবী উবাই ইবনে কাব রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আবুল মুনযিরকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আবুল মুনযির, তুমি কি জানো আল্লাহর কিতাবের যে আয়াতগুলো তুমি মুখস্থ করেছ তার মধ্যে কোন্ আয়াত শ্রেষ্ঠ?

আবুল মুনযির বলেন, আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন।

তিনি আবার বললেন, হে আবুল মুনযির, তুমি কি জানো, আল্লাহর কিতাবের যে আয়াতগুলো তুমি মুখস্থ করেছ তার মধ্যে কোন্ আয়াত শ্রেষ্ঠ?

তখন আমি বললাম-

اَللهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ.

(এ আয়াতটি)।

তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার বুকে চাপড় দিয়ে বললেন, ইলম তোমার জন্য সহজ হোক হে আবুল মুনযির। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮১০

নির্দিষ্ট সূরার প্রতি আগ্রহ

কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করতে গিয়ে নির্দিষ্ট কোনো সূরা ভালো লাগা বা সেই সূরার প্রতি বিশেষ টান ও মহব্বত সৃষ্টি হওয়ার প্রসঙ্গও এসেছে হাদীসে। এ ধরনের একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে আনাস রা. থেকে। সেখানেও আছে, এক সাহাবী নামায পড়াতেন এবং নামাযে খুব বেশি সূরা ইখলাস তিলাওয়াত করতেন। মুসল্লিরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তার এ অবস্থা জানালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডেকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন।

উত্তরে সাহাবী বললেন, আমি এই সূরাটিকে খুব ভালবাসি।

তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

حُبّكَ إِيَّاهَا أَدْخَلَكَ الجَنّةَ.

এই সূরার ভালবাসা তোমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৭৪

সূরা ইখলাসের গুরুত্বের কথা অনেক হাদীস থেকেই বুঝা যায়। ছোট্ট এই সূরাটি সহীহ-শুদ্ধভাবে আয়ত্ব ও মুখস্থ করে নিয়মিত তিলাওয়াত করা আমাদের যে কারও জন্যই সহজ।

এক হাদীসে সকাল-সন্ধ্যা সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস তিনবার করে তিলাওয়াত করার আদেশ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সাহাবীকে বলেন-

قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ، وَالمُعَوّذَتَيْنِ حِينَ تُمْسِي وَتُصْبِحُ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ تَكْفِيكَ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ.

এগুলো সকল সমস্যা ও অনিষ্ট থেকে  তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৭৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫০৮২

কুরআনকে বানিয়ে দিন হৃদয়ের বসন্ত

উল্লেখিত ফায়েদা ও ফযীলত ছাড়াও কুরআন তিলাওয়াতের অনেক ফায়েদা-ফযীলতের কথা হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু একজন মুমিনের তিলাওয়াতপ্রিয় জীবন লাভের আকাক্সক্ষার জন্য কি এটুকুই যথেষ্ট নয় যে, কুরআন আল্লাহর কালাম। মহান রাব্বুল আলামীনের বাণী। কুরআন আসমানী কিতাবগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং লওহে মাহফুযে সংরক্ষিত। কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর। যিনি বলেছেন, দুই ব্যক্তির বেলায় কেবল ঈর্ষা হতে পারে-

এক. আল্লাহ যাকে কুরআন শেখার তাওফীক দিয়েছেন, ফলে সে দিনরাত তিলাওয়াত করে। তার প্রতিবেশী শুনে বলে, হায় যদি আমাকেও তার মতো তাওফীক দেওয়া হত; আমিও এমন আমল করতাম যেমন সে করে!

দুই. আল্লাহ যাকে সম্পদ দিয়েছেন। ফলে সে তা উত্তম কাজে ব্যয় করে। তখন কেউ বলে, হায় যদি আমিও তার মতো প্রাপ্ত হতাম, তার মতো আমল করতাম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০২৬

পাশাপাশি তিনি এভাবে দুআ করেছেন এবং আমাদেরকে এভাবে দুআ করতে শিখিয়েছেন-

اللّهُمّ إِنِّي عَبْدُكَ ابْنُ عَبْدِكَ ابْنُ أَمَتِكَ، نَاصِيَتِي بِيَدِكَ، مَاضٍ فِيّ حُكْمُكَ، عَدْلٌ فِيّ قَضَاؤُكَ، أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ، سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ، أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ، أَوْ عَلّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ، أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ، أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيعَ قَلْبِي، وَنُورَ بَصَرِي، وَجِلَاءَ حُزْنِي، وَذَهَابَ هَمِّي.

হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার একজন দাস। আপনার এক দাসের পুত্র। আপনার এক দাসীর সন্তান। আমার ঝুঁটি (পূর্ণ সত্তা) আপনার হাতে। আমার উপর আপনার বিধানই কার্যকর। আমার সম্পর্কে আপনার ফায়সালা সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত। আমি আপনার সকল নামের উসিলায় প্রার্থনা করছি -যে নাম দিয়ে আপনি নিজেকে গুণান্বিত করেছেন কিংবা আপন কিতাবে নাযিল করেছেন কিংবা নিজের কোন সৃষ্টিকে শিক্ষা দিয়েছেন কিংবা আপনার কাছেই গোপন রেখেছেন-  কুরআনকে বানিয়ে দিন আমার হৃদয়ের বসন্ত, চোখের জ্যোতি, চিন্তা বিদূরক ও দুশ্চিন্তার উপশম। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩২৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯৭২ হ

 

 

advertisement