সহীহ-শুদ্ধ তিলাওয়াত
শেখা ও শেখানোর ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম
কুরআনের সহীহ-শুদ্ধ তিলাওয়াত শেখা প্রত্যেক মুমিনের জন্য আবশ্যক। সীরাতে রাসূল ও হায়াতুস সাহাবায় এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। যখনই কোনো ব্যক্তি বা গোত্র কিংবা কোনো অঞ্চলের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করত নবীজী তাদেরকে দ্বীনের তালীম ও কুরআন শিক্ষা দেয়ার জন্য এক বা একাধিক মুআল্লিম নির্ধারণ করে দিতেন। আকাইদ ও মাসায়েলের তালীম দেয়ার পাশাপাশি সহীহ-শুদ্ধ তিলাওয়াতও শেখানো হত। এভাবে ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত শেখা ও শেখানোর ধারা শুরু হয়েছে এবং অব্যাহত ছিল। স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের কুরআন তিলাওয়াত শেখাতেন এবং তিলাওয়াত করে শোনাতেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
لَقَدْ مَنَّ اللّٰهُ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اِذْ بَعَثَ فِیْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْ اَنْفُسِهِمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَكِّیْهِمْ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ ۚ وَ اِنْ كَانُوْا مِنْ قَبْلُ لَفِیْ ضَلٰلٍ مُّبِیْنٍ.
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মুমিনদের প্রতি (অতি বড়) অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের কাছে তাদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের সামনে আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়, যদিও এর আগে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে ছিল। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৬৪
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ত্বাবারী রাহ. বলেন-
يقرأ عليهم آي كتابه وتنزيله.
অর্থাৎ কুরআনের আয়াত পড়ে শোনাতেন। (তাফসীরে তবারী ৭/৩৭৯)
ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন-
يجب أن يعلم أن النبي صلى الله عليه وسلم بين لأصحابه معاني القرآن كما بين لهم ألفاظه فقوله تعالى: لِتُبَیِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ اِلَیْهِمْ يتناول هذا وهذا.
জানা থাকা দরকার, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুমকে কুরআনের মর্মও বর্ণনা করেছেন, যেভাবে কুরআনের শব্দ বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তাআলার বাণী-
لِتُبَیِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ اِلَیْهِمْ .
(হে নবী! আমি তোমার প্রতি এই কিতাব নাযিল করেছি,) ‘যাতে তুমি মানুষের সামনে সেইসব বিষয়ের ব্যাখ্যা করে দাও, যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে...’- এই আয়াত উভয় বিষয়কে (মর্ম ও শব্দ) শামিল করে। (মাজমূউল ফাতাওয়া ১৩/৩৩১)
কুরআনের এজাতীয় আয়াত থেকে স্পষ্ট, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের হুকুম-আহকামও শেখাতেন এবং তিলাওয়াতও শেখাতেন।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত-
عَلّمَنِي رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، وَكَفِّي بَيْنَ كَفّيْهِ، التّشَهّدَ، كَمَا يُعَلِّمُنِي السّورَةَ مِنَ القُرْآنِ.
অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে কুরআনের সূরা শেখানোর মত তাশাহহুদের পাঠ শিখিয়েছেন। তখন আমার হাত তাঁর দুই হাতের মাঝে ছিল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬২৬৫
এই হাদীসে একথা স্পষ্ট যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে কুরআন মাজীদ শব্দে শব্দে শেখাতেন।
সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম নবীজী থেকে শুধু সঠিক উচ্চারণই শেখেননি; বরং কোথায় মাদ্, কোথায় গুন্নাহ করতে হয় সেগুলোও শিখেছেন। হাদীস ও আসারে এমন বর্ণনা প্রচুর রয়েছে।
একটি হাদীসে এসেছে-
سئل أنس كيف كانت قراءة النبي صلى الله عليه وسلم؟ فقال: كانت مدا، ثم قرأ: {بسم الله الرحمن الرحيم} يمد ببسم الله، ويمد بالرحمن، ويمد بالرحيم.
হযরত আনাস রা.-কে জিজ্ঞাসা করা হল, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে তিলাওয়াত করতেন? তিনি বললেন, নবীজী মাদ্সহ তিলাওয়াত করতেন। তারপর তিনি ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ পাঠ করে শোনালেন। ‘বিসমিল্লাহ -এর ‘আল্লাহ’ শব্দ টেনে পড়লেন। ‘আর রাহমান’-এর ‘মীম’ টেনে পড়লেন। ‘আর রাহীম’-এর ‘হা’ টেনে পড়লেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৪৬
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. বলেন-
قال القراء: ...ولا شك أن الأمة كما هم متعبدون بفهم معاني القرآن وإقامة حدوده، هم متعبدون بتصحيح ألفاظه وإقامة حروفه على الصفة المتلقاة من أئمة القراء، المتصلة بالحضرة النبوية.
ইলমে কিরাতের ইমাগণ বলেন, ...একথা অনস্বীকার্য, উম্মতের জন্য যেভাবে কুরআন বোঝা এবং এর আদেশ-নিষেধ মানা আবশ্যক, ঠিক সেভাবে কুরআনের শব্দ ও অক্ষরগুলো সহীহ-শুদ্ধভাবে পড়া ও উচ্চারণ করাও আবশ্যক; যেভাবে ইলমে কেরাতের ইমামগণের মাধ্যমে যুগ পরম্পরায় নবীজী থেকে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। -আলইতকান ফী উলূমিল কুরআন ১/৩৪৬
রাসূলের সীরাত ও সাহাবীদের জীবনী থেকে সহীহ-শুদ্ধ তিলাওয়াত শেখার কিছু নমুনা :
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর তিলাওয়াত শেখা
তিনি বলেন-
أَخَذْتُ مِنْ فِي رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ سَبْعِينَ سُورَةً، وَلَا يُنَازِعُنِي فِيهَا أَحَدٌ.
আমি এককভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবান থেকে সত্তরটি সূরা শিখেছি। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৩৩০
আলী রা.-এর কাছে আবু আব্দুর রহমান সুলামী রা.-এর তিলাওয়াত শেখা
عن عاصم قال ما أقرأني أحد حرفا إلا أبو عبد الرحمن السلمي وكان قد قرأ على علي رضي الله عنه.
আসেম রহ. বলেন, আমাকে আবু আব্দুর রহমান সুলামী রা. তিলাওয়াত শিখিয়েছেন আর তিনি পড়েছেন আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর কাছে। -মারিফাতুল কুররা, যাহাবী ১/২৭
উবাই ইবনে কা‘ব রা.-এর কাছে যারা পড়েছেন
أخذ عنه القراءة ابن عباس وأبو هريرة وعبد الله بن السائب.
তাঁর (উবাই ইবনে কা‘ব) থেকে তিলাওয়াত শিখেছেন ইবনে আব্বাস রা. ও আবু হুরাইরা রা. ও আব্দুল্লাহ ইবনে সায়িব রা.। -মারিফাতুল কুররা, যাহাবী ১/২৯
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর কাছে মুআয ইবনে জাবাল রা.-এর তিলাওয়াত শেখা
عن عبد الله، قال: جاء معاذ إلى النبي صلى الله عليه وسلم فقال: يا رسول الله أقرئني، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: يا عبد الله أقرئه، فأقرأته ما كان معي، ثم اختلفت أنا وهو إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقرأه معاذ، وكان معلما من المعلمين على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم.
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, মুআয ইবনে জাবাল রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে কুরআন শিখিয়ে দিন! নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আব্দুল্লাহ! তাকে পড়িয়ে দাও।
আমার যা মুখস্থ ছিল তা আমি তাকে পড়িয়ে দিলাম। অতঃপর আমি ও তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলে মুআয রা. পড়ে শোনালেন। তিনি নববী যুগে একজন মুআল্লিম ছিলেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩০৬৮৫
নবীজীর কাছে কোনো গোত্রের পক্ষ থেকে ওয়াফ্দ বা প্রতিনিধিদল এলেও তিনি তাদের জন্য কুরআন ও দ্বীন শেখার ব্যবস্থা করতেন।
ড. মোহাম্মদ মোস্তফা আ‘জমী রাহ. বলেন-
أما القبائل والأشخاص الذين كانوا يفدون على رسول الله صلى الله عليه وسلم فقد كانوا يوزعون على دور الأنصار، ليقوموا بضيافتهم وتعليمهم.
ولقد سأل رسول الله صلى الله عليه وسلم وفد عبد القيس، “كيف رأيتم كرامة إخوانكم لكم وضيافتهم إياكم؟ قالوا : خير إخوانكم، ألانوا فراشنا، وأطابوا مطعمنا، وباتوا وأصبحوا يعلموننا كتاب ربنا وسنة نبينا صلى الله عليه وسلم، فأعجب النبي صلى الله عليه وسلم وفرح بنا.”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন গোত্র ও ব্যক্তি এলে তাদেরকে বিভিন্ন আনসারী সাহাবীদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হত, যাতে তাঁরা তাদের মেহমানদারী করেন এবং তাদেরকে দ্বীনের তালীম দেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা তোমাদের ভাইদেরকে কেমন পেলে? কেমন আদর আপ্যায়ন পেলে?
তাঁরা বললেন, অনেক ভালো। তাঁরা আমাদের জন্য নরম বিছানার ব্যবস্থা করেছেন, ভালো খাবারের ইন্তেজাম করেছেন। রাতে ও দিনে তাঁরা আমাদেরকে মহান রবের কিতাব শিখিয়েছেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত শিখিয়েছেন। একথা শুনে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব খুশী হলেন।’ -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৫৫৫৯; দিরাসাত ফিল হাদীসিন নাবাবী ১/৫২-৫৩
ওয়াফ্দে আমের
(وقدم عليه) وفد عامر عشرة نفر، فأسلموا وتعلموا شرائع الإسلام، وأقرأهم أبي القرآن وانصرفوا.
ওয়াফ্দে আমেরের দশজন ব্যক্তি নবীজীর কাছে আসে। তারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং ইসলামের বিধানাবলি শেখে। উবাই ইবনে কা‘ব রা. তাদেরকে কুরআন তিলাওয়াত শিখিয়ে দেন, তারপর তারা ফিরে যায়। -তারীখে ইবনে খালদূন ২/৫৫
উসমান ইবনে আবিল আস রা.-এর কুরআন শেখা
قدم عثمان بن أبي العاص على رسول الله مع وفد ثقيف وكان أصغر الوفد سنا، فكانوا يخلفونه على رحالهم يتعاهدها لهم، فإذا رجعوا من عند رسول الله وناموا، وكانت الهاجرة، أتى عثمان رسول الله فأسلم قبلهم سرا منهم، وكتمهم ذلك، وجعل يسأل رسول الله عن الدين ويستقرئه القرآن، فقرأ سورا من في رسول الله، وكان إذا وجد رسول الله نائما عمد إلى أبي بكر فسأله واستقرأه. وإلى أبي بن كعب فسأله واستقرأه. فأعجب به رسول الله وأحبه.
উসমান ইবনে আবিল আস রা. ওয়াফ্দে সাকীফের সাথে নবীজীর দরবারে এলেন। তখন তিনি বয়সে সবার ছোট ছিলেন। গোত্রের লোকেরা তাঁকে সামানা দেখাশোনার জন্য তাবুঁতে রেখে আসত। তাঁরা যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবার থেকে ফিরে এসে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ত, তখন তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসতেন। তিনি তাঁদের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং বিষয়টি তাঁেদর কাছে গোপন রেখেছিলেন। (ওই সময়ে এসে) তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দ্বীন সম্পর্কে জানতে চাইতেন। তাঁকে কুরআন পড়ানোর জন্য বলতেন। এভাবে তিনি নবীজীর যবান থেকে কিছু সূরা শিখে নিয়েছিলেন। যদি নবীজীকে ঘুমে পেতেন তাহলে আবু বকর রা.-এর কাছে গিয়ে দ্বীন শিখতেন এবং তাঁকে কুরআন পড়াতে বলতেন। আবার উবাই ইবনে কা‘ব রা.-এর কাছে গিয়ে দ্বীন শিখতেন এবং তাঁেক কুরআন পড়াতে বলতেন। তাঁর এমন আগ্রহ দেখে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশি হন। -আততবাকাতুল কুবরা, ইবনে সা‘দ ৬/৪৭
কোনো শহর বা অঞ্চল বিজিত হলে বা সেখানকার লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করলে তাদেরকে দ্বীনের তালীম ও কুরআনের সহীহ-শুদ্ধ তিলাওয়াত শেখানোর জন্য এক বা একাধিক মুয়াল্লিম প্রেরণ করা হত। যেমন :
কুরআন শেখাতে মুসআব ইবনে উমায়ের রা.-কে মদীনায় পাঠানো হয়েছিল
এক বছর হজে¦র মৌসুমে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতে মদীনার কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করে ফিরে যায়। পরবর্তী বছরে বারোজন লোক আসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাতে।
এ প্রসঙ্গে আল্লামা যাহাবী রাহ. বলেন-
فلما كان العام المقبل خرج منهم اثنا عشر رجلا، فهي العقبة الأولى، فانصرفوا معهم.
وبعث النبي مصعب بن عمير يقرئهم ويفقههم.
পরবর্তী বছর (হজে¦র মৌসুমে) বারোজন লোক আসে (নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাতে)। এটিই আকাবায়ে উলা হিসেবে প্রসিদ্ধ। সবার সাথে তাঁরাও ফিরে যায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে কুরআনের তিলাওয়াত শেখানো এবং দ্বীনের তালীমের জন্য মুসআব ইবনে উমায়ের রা.-কে প্রেরণ করেন। -সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১/৩০০
ইয়ামানে পাঠানো হয় মুআয ইবনে জাবাল রা.-কে
আবু তামীম জায়শানী রাহ. বলেন-
أقرأني معاذ القرآن حين بعثه النبي -صلى الله عليه وسلم- إلى اليمن.
মুআয রা. আমাকে কুরআন তিলাওয়াত শিখিয়েছেন, যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁেক ইয়ামানে প্রেরণ করেন। -সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী ৪/৭৪
কূফায় প্রেরণ করা হয় আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে
হারেছা রাহ. বলেন-
قرئ علينا كتاب عمر: إني قد بعثت إليكم عمار بن ياسر أميرا وعبد الله بن مسعود معلما ووزيرا، وإنهما من النجباء من أصحاب رسول الله من أصحاب بدر، وقد جعلت عبد الله بن مسعود على بيت مالكم، فتعلموا منهما واقتدوا بهما، وقد آثرتكم بعبد الله بن مسعود على نفسي.
উমর রা.-এর পত্র আমাদেরকে পাঠ করে শোনানো হল- ‘আমি তোমাদের কাছে আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে আমীর হিসেবে এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদকে মুয়াল্লিম ও গভর্নর হিসেবে পাঠালাম। তাঁরা দুজন সম্ভ্রান্ত সাহাবী এবং আসহাবে বদরের অন্তর্ভুক্ত। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদকে তোমাদের বাইতুল মালের দায়িত্বে নিয়োজিত করলাম। তোমরা তাদের থেকে দ্বীন শিখে নাও এবং তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ কর। আমি আমার প্রয়োজনের ওপর তোমাদের প্রাধান্য দিয়ে আব্দুল্লাহ (ইবনে মাসউদ)-কে তোমাদের নিকট পাঠালাম। -আততবাকাতুল কুবরা, ইবনে সা‘দ ৬/৮৮
হযরত আলকামা রাহ. বলেন-
كنا جلوسا عند عبد الله ومعنا زيد بن حدير، فدخل علينا خبّاب فقال: يا أبا عبد الرحمن أكلّ هؤلاء يقرأ كما تقرأ؟ فقال: إن شئت أمرت بعضهم فقرأ عليك، قال: أجل، فقال لي: اقرأ، ... قال: فقرأت خمسين آية من مريم، فقال خبّاب: أحسنت.
আমরা আব্দুল্লাহ (ইবনে মাসউদ) রা.-এর কাছে বসা ছিলাম। যায়েদ ইবনে হুদায়র আমাদের সাথে ছিলেন। খাব্বাব রা. আমাদের মজলিসে এসে (ইবনে মাসউদ রা.-কে) বললেন, হে আবু আব্দুর রহমান! এরা সবাই কি আপনার মত পড়তে পারে? তিনি বললেন, আপনি যে কাউকে বলতে পারেন, সে আপনাকে পড়ে শোনাবে। তিনি (খাব্বাব রা.) বললেন, ঠিক আছে!
পরে আমাকে বললেন, তুমি পড়ো!... আলকামা রাহ. বলেন, আমি ‘সূরা মারইয়ামের’ পঞ্চাশ আয়াত পড়লাম। (পড়া শুনে) খাব্বাব রা. বললেন, মাশাআল্লাহ! অনেক ভালো পড়েছ। -তারীখে দিমাশক, ইবনে আসাকির ৪১/১৭৫
শামে পাঠানো হয়েছিল উবাদা ইবনে সামেত রা., মুআয ইবনে জাবাল রা. ও আবুদ্ দারদা রা.-কে
قال مُحَمّد بْن كعب القرظي: ... وكان عبادة يعلم أهل الصفة القرآن، ولما فتح المسلمون الشام أرسله عمر بْن الخطاب، وأرسل معه معاذ بْن جبل، وأبا الدرداء، ليعلموا الناس القرآن بالشام ويفقهوهم في الدين، وأقام عبادة بحمص، وأقام أَبُو الدرداء بدمشق، ومضى معاذ إِلَى فلسطين، ثم صار عبادة بعد إِلَى فلسطين.
মুহাম্মাদ ইবনে কা‘ব আলকুরাযী রাহ. বলেন, ...উবাদা রা. আহলে সুফ্ফাকে কুরআন শেখাতেন। যখন মুসলমানরা ‘শাম’ জয় করলেন, উমর রা. তাঁকে, মুআয ইবনে জাবাল রা. ও আবুদ্ দারদা রা.-কে তাঁর সাথে ‘শামের’ লোকদের কুরআন এবং দ্বীন শেখানোর জন্য পাঠিয়ে দিলেন। উবাদা রা. ‘হিমসে’ অবস্থান নিলেন। আবুদ্ দারদা রা. ‘দিমাশকে’ এবং মুআয রা. ‘ফিলিস্তিনে’। পরবর্তীতে উবাদা রা.-ও ফিলিস্তিন চলে আসেন। -উসদুল গাবাহ ৩/১৫৮
দিমাশকের মসজিদে আবুদ্ দারদা রা.
قال سويد بن عبد العزيز: كان أبو الدرداء إذا صلّى الغداة في جامع دمشق، اجتمع الناس للقراءة عليه، فكان يجعلهم عشرة عشرة، وعلى كل عشرة عريفا، ويقف هو في المحراب يرمقهم ببصره، فإذا غلط أحدهم رجع إلى عريفهم، فإذا غلط عريفهم رجع إلى أبي الدرداء فيسأله عن ذلك.
সুয়াইদ ইবনে আব্দুল আযীয রাহ. বলেন, আবুদ্ দারদা রা. ‘দিমাশ্কের’ মসজিদে ফজরের নামাযের পর লোকেরা তাঁর চারপাশে জড়ো হয়ে বসতো কুরআন পড়ার জন্য। তিনি দশজন দশজন করে কয়েকটি জামাতে ভাগ করে দিতেন। প্রত্যেক দশজনে তিলাওয়াতে অভিজ্ঞ একজন প্রশিক্ষক থাকতেন। আবুদ্ দারদা রা. মেহরাবে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। কেউ না পারলে নিজ প্রশিক্ষকের কাছে যেত। প্রশিক্ষকও না পরলে আবুদ্ দারদা রা.-এর কাছ থেকে জেনে নিত। -মা‘রিফাতুল কুররা, যাহাবী, পৃ. ২০
আবুদ্ দারদা রা.-এর মজলিসে লোকও হত অনেক। মুসলিম ইবনে মিশকাম রাহ. বলেন-
قال لي أبو الدرداء: اعدد من يقرأ عندي القرآن، فعددتهم ألفا وستمائة ونيفا.
আবুদ্ দারদা রা. আমাকে বললেন, গুনে দেখ তো, আমার কাছে কতজন কুরআন পড়ে? আমি গুনে দেখলাম এক হাজার ছয় শ’রও বেশি। -গায়াতুন নিহায়াহ ১/৬০৬-৬০৭
বসরায় প্রেরণ করা হয় আবু মূসা আশআরী রা.-কে
এই মহান সাহাবী সম্পর্কে ইমাম যাহাবী রাহ. বলেন-
هاجر إلى النبي صلى الله عليه وآله وسلم، فقدم مع جعفر زمن فتح خيبر، واستعمله النبي صلى الله عليه وسلم مع معاذ على اليمن، ثم ولي لعمر الكوفة والبصرة، وكان عالما عاملا صالحا تاليا لكتاب الله، إليه المنتهى في حسن الصوت بالقرآن. روى علما طيبا مباركا وأقرأ القرآن. حدث عنه طارق بن شهاب، وابن المسيب، والأسود، وأبو وائل، وأبو عبد الرحمن السلمي، وربعي بن حراش، وأبو عثمان النهدي وخلق، أقرأ أهل البصرة وأفقههم.
(আবু মূসা আশআরী রা.) খায়বার বিজয়ের সময় হযরত জাফর রা.-এর সাথে মদীনায় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হিজরত করে আসেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুআয রা.-এর সাথে তাঁেক ইয়ামানে প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে উমর রা.-এর পক্ষ থেকে ‘কূফা ও বসরা’র গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি একজন নিষ্ঠাবান, পুণ্যবান, বিদগ্ধ আলেম ছিলেন। অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। সুমধুর কণ্ঠে তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে তার জুড়ি নেই। (বসরায়) বরকতপূর্ণ ও কল্যাণকর ইলম প্রচার করেছেন এবং কুরআন পড়িয়েছেন। তারেক ইবনে শিহাব, ইবনুল মুসায়্যিব, আসওয়াদ, আবু ওয়ায়েল, আবু আব্দুর রহমান সুলামী, রিবয়ী ইবনে হিরাশ এবং আবু উসমান নাহদী ও আরো অনেকে তাঁর থেকে রেওয়ায়েত করেন। তিনিই ছিলেন ‘বসরা’য় কুরআনের সবচেয়ে বড় আলেম ও সবচেয়ে বড় ফকীহ। -তাযকিরাতুল হুফফায ১/২২
সহীহভাবে কুরআন শেখার সাথে সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্দরভাবে তিলাওয়াত করতেও উৎসাহ প্রদান করেছেন।
শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে এমন কিছু বিষয় লক্ষণীয়, যা শুধু কুরআনের সাথেই নির্দিষ্ট। আরবী ভাষার অন্য কোথাও এর ব্যবহার নেই। মাদ্, ইমালাহ, গুন্নাহ, গুন্নাহের প্রকারভেদে উচ্চারণের ভিন্নতা এবং আরো যে বিষয়গুলো শুধু কুরআন তিলাওয়াতের সাথেই সম্পৃক্ত, এই বিষয়গুলো নিজে নিজে অর্জন করা যায় না। উস্তাযের তিলাওয়াত শুনে মশক করে শিখতে হয়। সহীহ-শুদ্ধ তিলাওয়াত না শিখলে তিলাওয়াতে এমন ভুল হয়ে যায়, যার কারণে নামাযই নষ্ট হয়ে যায়। তাই সহীহ-শুদ্ধ তিলাওয়াত শেখা আবশ্যক।
উদ্ধৃত ঘটনাগুলো থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার যে, ইসলাম গ্রহণের পর থেকেই সাহাবায়ে কেরাম কুরআন শেখা ও শেখানোর প্রতি অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
আমাদেরকেও সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন শেখার ও শেখানোর প্রতি মনোযোগী ও আগ্রহী হতে হবে। সাহাবায়ে কেরামের মতো আমাদেরকেও এর প্রতি যত্নবান হতে হবে। কুরআন যথাযথভাবে শিখলে এবং কুরআনের বিধান অনুযায়ী জীবন গড়লে আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই হাদীসের শামিল হব, যে হাদীসে নবীজী বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সে-ই সর্বোত্তম, যে কুরআন শেখে এবং শেখায়।