যিলহজ্ব ১৪৪৩   ||   জুলাই ২০২২

সংসদে জিহাদ নিয়ে বিতর্ক
নতুন প্রজন্মের দাবিদারকে তো আরও আধুনিক হতে হবে

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

এক ভাই একটি ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছেন। তাতে দুজন সংসদ সদস্যের সংসদে প্রদত্ত বক্তব্যের অংশবিশেষ রয়েছে। ভিডিওটি দেখে এতটুকু তো মনে হল, এখনো কিছু মানুষ আছে, যারা সংসদ অধিবেশন শোনে বা সেদিকে নজর রাখে। একসময় তো গণমাধ্যমে সংসদের করিকুলাম ফলাও করে প্রচার হত। এখন তেমনটি চোখে পড়ে না। সংসদ অধিবেশন এখন কখন হচ্ছে না হচ্ছে সেসব বিষয় স্বল্প পরিসরে প্রচারিত হয়।

যাহোক ঐ দুই সদস্য কথা বলেছেন জিহাদ নিয়ে। প্রথম সংসদ সদস্য যে জিহাদের কথা বলেছেন সেটা অবশ্য রূপক অর্থে জিহাদ। ইসলামে জিহাদ বিভিন্ন প্রকারের। প্রথমত : মৌলিক জিহাদ। সেটা হল, ইসলাম ও মুসলিম দেশ রক্ষার জন্য আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করার জন্য মুসলিম বাহিনী কর্তৃক শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। আরেক হচ্ছে, রূপক অর্থে জিহাদ। যেমন, কোনো জালেমের সামনে সত্য কথা বলা, নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে খারাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকা ইত্যাদি। যে সংসদ সদস্য জিহাদ শব্দ উচ্চারণ করেছেন তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন- অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা জিহাদ। যে হাদীসটি তিনি উল্লেখ করেছেন তা হল- এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে জিজ্ঞেস করল, সর্বোত্তম জিহাদ কোনটি? তিনি বললেন, যালেম শাসকের সম্মুখে সত্য কথা বলা। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৮২৭

কিন্তু দেখা গেল, নতুন প্রজন্মের দাবিদার আরেক সংসদ সদস্য স্পিকারকে কঠোর ভাষায় সম্বোধন করে জিহাদের বিরোধিতা করছেন। বক্তব্য শুনে বোঝা যাচ্ছে, সংসদ সদস্য মহোদয় খুব রাগ করেছেন- সংসদে জিহাদশব্দ উচ্চারিত হওয়ার কারণে! তিনি নিজেকে সংসদে নতুন প্রজন্মের বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি ও তাঁর মতো যাঁরা, তারা এগিয়ে যেতে চান। তাই তাঁর জোর দাবি হল, জিহাদ শব্দ যেন সংসদে উচ্চারিত না হয়। ভদ্রলোকের কথা থেকেই দেখা যাক তিনি কী বলতে চেয়েছেন-

(তিনি বলেন,) ‘কিছুক্ষণ আগে একজন সংসদ সদস্য একটা শব্দ ব্যবহার করেছে- জিহাদ। আমার মনে হয় মাননীয় স্পিকার আপনার কাছে আমি অনুরোধ করছি, এই শব্দগুলো আমাদের সংসদে যেন আর কেউ না উচ্চারণ করতে পারে সে ব্যবস্থা আপনারা নিন। আমরা অনেকটুকু এগিয়ে এসেছি। এখনও যদি এখানে সংসদে সামনে দাঁড়িয়ে একজন নেতা জিহাদের কথা বলে, আমরা কোথায় যাব? আমরা তো নতুন প্রজন্ম। আপনারা আছেন। এখানে অনেক নতুন সংসদ সদস্য এসেছেন, যাদের এটা প্রথম বার। আপনারা বলবেন তাদেরকে, এ সমস্ত শব্দ ব্যবহার করার সময় নেই। আজকে পদ্মা সেতু নিয়ে আলাপ হবে সেখানে জিহাদ কোথা থেকে আসল!

খুব স্বাভাবিকভাবেই গণমানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়, যে দেশের সিংহভাগ মানুষ মুসলিম, যেখানে সংসদে বড় করে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম লেখা আছে, যে দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। বলা হয়ে থাকে, সাংসদরা জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ সংসদ একান্ত ব্যক্তিগত মতামত দেওয়ার জায়গা নয়। সংসদের সদস্যগণ যখন সংসদে কথা বলবেন, জাতির হয়ে কথা বলবেন, সেখানে কেন জিহাদ নিষিদ্ধ করতে হবে? একজন সংসদ সদস্য এমন কথা বলার অধিকার রাখেন কি না? তিনি এমন দাবি করতে পারেন কি না?

আসলে মনে হচ্ছে, এ নতুন প্রজন্মের সংসদ সদস্যের ইসলাম সম্পর্কে জানাশোনা, পড়ালেখা এবং জিহাদ সম্পর্কে জানা একেবারেই অপ্রতুল। কোন্ জিনিসকে তিনি জিহাদ ভেবে বসে আছেন সেটা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। ধরা যাক (আল্লাহ মাফ করুন) আজকে বাংলাদেশে যদি কোনো দেশ বা কোনো শত্রু আক্রমণ করে বসে আর মুসলমানরা তাদের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে নেমে যায় সেটা তাহলে কী হবে? সেটা তো জিহাদই। আফগানিস্তানে ৯০ -এর দশকের শুরুতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আগ্রাসন চালায়। আফগানিস্তানের  রাজনৈতিক শক্তিগুলো সম্মিলিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। জনগণ সে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেছে। একপর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত হয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে এবং এরই ধারাবাহিকতায় একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেই ভেঙ্গে খান খান হয়েছে। এটা তালেবান ক্ষমতায় আসারও বেশ আগের কথা। সেটা তো জিহাদই ছিল। আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করার জন্য, মুসলিম ভূমি রক্ষার জন্য শত্রুর আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য লড়াই তো জিহাদ, যা বাস্তবায়ন করা মুসলিম শাসকদেরই দায়িত্বে পড়ে। জিহাদের আরও প্রকার রয়েছে। পৃথিবীর সর্বাধিক পবিত্র গ্রন্থ, আল্লাহর কালাম কুরআন শরীফের দুটি বড় সূরা- সূরা আনফাল ও সূরা তাওবার বড় একটা অংশে, এছাড়া সূরা বাকারা, আলে ইমরান, আহযাবসহ অন্যান্য আরো কিছু সূরায় ব্যাপকভাবে জিহাদের কথা এসেছে। কোনো ব্যক্তি কি কুরআন শরীফের অংশবিশেষ না মেনে মুসলমান হতে পারে? নিশ্চয় নয়। তাহলে আমরা কি জিহাদ অস্বীকার করতে পারি? তা ছাড়া ইসলামী পরিভাষাগুলো সংসদে ব্যবহার হতে পারবে না- একথা তিনি পেলেন কোথায়? বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও তো এ সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনে আমরা ইসলামের বিধান হুদুদ কিসাস নিয়ে আসব, তবুও আমরা বিচার করে ছাড়ব।এই হুদুদ কিসাস কীসের পরিভাষা?

আসলে করুণা হয়। আমরা প্রতিবাদের ভাষায় বলতে চাই না। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদেরই বা কী আছে? তাঁদের কথার জবাব দেওয়ারই বা কী আছে? তাঁদের জন্য করুণা হয়, আফসোস হয়। যে দেশে পনেরো কোটির বেশি মুসলমান বাস করছে সে দেশের সংসদে এমন সদস্যও আছেন, যাঁরা নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানও রাখেন না। তিনি নিজেদেরকে নতুন প্রজন্মবলেছেন। নতুন প্রজন্ম হতে হলে তো আরও আধুনিক হতে হবে। তাঁর নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, নিজের ধর্ম, তাঁর নাম, তাঁর বাবার নাম, নামের আগে তিনি যে বংশীয় খেতাবের মতো লাগান সেগুলো তো ইসলামকেই চিহ্নিত করে। নিজেদের স্বকীয়তা, নিজের পূর্বপুরুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য অস্বীকার করে কেউ আধুনিক হতে পারে না। কারণ, এগুলো ছাড়া একজন লোকের অস্তিত্বই হয়ে ওঠে মাথাবিহীন। আচ্ছা ঐ সংসদসদস্য মহোদয় কি তারই পূর্ব পুরুষ, বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীও পড়েননি। তিনি যে ছাত্র যামানাতেই মুসলিম স্টুডেন্ট ফেডারেশনে যোগ দিয়ে সোহরাওয়ার্দি, শেরেবাংলা, ভাসানী ও জিন্নাহ সাহেবদের পাকিস্তান আন্দোলনকে বেগবান করায় ভূমিকা রেখেছিলেন- সে কথাও কি এ ভদ্রলোক পড়েননি?! এইসকল নেতা এবং তাদের পূর্বসূরিগণ যে এ ভূখণ্ড থেকে ইংরেজ খেদাও আন্দোলন করেছিলেন সেটা কোন্ জযবা ও স্পৃহা থেকে করেছিলেন? এবং ১৯৪৭ সালে তাঁরা অখণ্ড ভারতকে সমর্থন না করে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি চেয়েছিলেন কেন?

এরপর ১৯৭১-এ স্বাধীনতার পর পৃথক দেশ না থেকে আবার ভারতের সাথে যোগ দেওয়া হয়নি কেন? খুবই স্পষ্ট কথা, সেটি ছিল স্বজাতীর তাহযীব-তামাদ্দুন, ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার জন্যই। যে দেশের সঙ্গে এত তিক্ততা ও যুদ্ধ হল। স্বাধীনতার পরপর সে দেশে অনুষ্ঠিত ঙওঈ সম্মেলনে ভারতের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দৃঢ়তার সাথে তিনি যোগ দিয়েছিলেন কেন? ঐ নতুন প্রজন্মের দাবিদার রাজনীতিকগণ যদি কুরআন শরীফ নাও পড়েন, যদি বিশ^ মানবতার মুক্তির দূত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাত অধ্যয়ন নাও করেন, যদি ইসলামের জিহাদের মহত্ব ও বাস্তবতা নাও পড়েন, অন্তত নিজেদের পূর্বপুরুষ রাজনীতিবিদদের ইতিহাস তো পড়া দরকার। তাহলেই তো তাঁরা জিহাদ শব্দ শুনলে এত আতঙ্কিত হতেন না।

আরেকটি কথা এখানে বলা দরকার, এই যে সমাজে কিছু কিছু লোকের বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ডকে তারা জিহাদ বলে আখ্যা দিয়ে থাকে এর পেছনেও সত্যিকারের জিহাদ নিয়ে একশ্রেণির লোকের চুলকানিই দায়ী।

আমরা আগেও একাধিকবার এ পত্রিকায় লিখেছি, কোনো কাজ বা পরিভাষার সঠিক ও শুদ্ধ চর্চার সুযোগ না দেওয়া হলে কিছুদিনের মধ্যেই এর ভুল ব্যাখ্যা তৈরি হয়। সুতরাং সত্যিকারের জিহাদকে জানতে হবে। অন্যদেরকে জানার সুযোগও করে দিতে হবে।

অবশেষে বলতে চাই, সংসদ সদস্যদের থেকে আরও দায়িত্বশীল আচরণ এবং দায়িত্বপূর্ণ বক্তব্য জাতি আশা করে।

 

 

advertisement