যিলহজ্ব ১৪৪৩   ||   জুলাই ২০২২

বাজেট ২০২২-২৩ : কোথাও কি কোনো পরিবর্তন আছে?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

গত ৯ জুন ২০২২ জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট উত্থাপিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এই বাজেট পেশ করেন। মাসিক আলকাউসারে শুরুর দিকে কয়েক বছর জাতীয় বাজেট নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। পাঠক সেগুলো পড়ে বেশ উৎসাহিত হয়েছেন। অনেকে বিভিন্ন সময় এসব নিয়ে আরও লেখার অনুরোধ করেছেন। আমরা বাজেট নিয়ে পর্যালোচনার ধারাবাহিকতা ছেড়ে দিয়েছি। কয়েক বছর বিরতির পর কয়েকবার পুনরায় এ বিষয়ে লেখা হয়েছিল। তারপর আর লেখা হয়নি। এক কথা বারবার বলতে, লিখতে ভালো লাগে না। এটি কোনো ইবাদত নয়, যিকির বা দুআ নয় যে, সারাদিন জপতে থাকলে সওয়াব হতে থাকবে।

পুঁজিবাদের বেঁধে দেওয়া একটি ছক আছে। সে ছকেই চলে পুরো বিশ্বের অর্থব্যবস্থা। এর জন্য উন্নত দেশগুলো এক পন্থা অবলম্বন করে। দরিদ্র দেশগুলো ভিন্ন পন্থা গ্রহণ করে। আবার স্বল্পোন্নত দেশগুলো আরেক পন্থা অবলম্বন করে। ঘুরে ফিরে সবাই এক ধরনের কথাই বলতে থাকে। বাজেট হল, সরকারের আয় ও ব্যয়ের খতিয়ান। এই বাজেট হতে হবে একটি সুস্পষ্ট ও সত্যিকার খতিয়ান। এতে নাগরিকদের উন্নয়ন এবং রাষ্ট্রের অবকাঠামো উন্নয়নসহ সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। রাষ্ট্রের আয়ের উৎস ও ব্যয়ের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। আমাদের জাতীয় বাজেটে এসব বিষয় খুব কমই স্থান পেয়েছে। এসব বাজেটে কথার ফুলঝুড়ি ও নেতানেত্রীদের বন্দনাই বেশি থাকে।

আমরা শুনতাম, আগের কালে রাজা-বাদশাহদের পাশে একদল মোসাহেব থাকত। তারা রাজা-বাদশার ভালো-মন্দ জেনে না জেনে সব বিষয়ে মোসাহেবি করত। অনেক সময় মোসাহেবির অতিরঞ্জণ দেখে রাজা নিজেও নারাজ হয়ে যেতেন। সে তো ছিল রাজতান্ত্রিক দেশের কথা। এখন আমরা গণতান্ত্রিক দেশে বাস করি। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হলেও সে বন্দনা কিন্তু আগের চেয়ে বেড়েছে। অর্থমন্ত্রী সাহেবরা নিজের পদ ধরে রাখার জন্যই কি না, বাজেট বক্তৃতায় বন্দনা করেই কাটিয়ে দেন দীর্ঘ সময়। অনেক সময় দাঁড়িয়ে বাজেট বক্তব্য দেওয়ারও শক্তি তাঁদের থাকে না। অনুমতি নিয়ে বসে বক্তৃতা দিতে হয়। কখনো মৌখিক বক্তব্য উপস্থাপন না করে তা টেবিলে পেশ করেন। অথবা পাওয়ার পয়েন্টে বক্তৃতা দেন। অপ্রয়োজনীয় কথাগুলো বাদ দিলে বাজেটের পাতা আরও কম হত। বাজেট বক্তব্য উপস্থাপনও তাদের জন্য সহজ হত।

যাইহোক সেটা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। মূলকথা হল, বাজেট নিয়ে প্রতি বছর বলা বা লেখার মতো উপকরণ থাকে খুব কম। বাজেটগুলো হয় গতানুগতিক। পুরোনো কথাই নতুনভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা। তবুও পাঠকের তাগিদের কারণে এবারের বাজেট প্রসঙ্গে কিছু কথা বলার চেষ্টা করেছি।

এবারের বাজেট তথা ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ছয় লক্ষ আটাত্তর হাজার চৌষট্টি কোটি টাকা। রাষ্ট্র আগামী বছর এই অর্থ ব্যয় করবে। আমরা পাঠকদেরকে বলে রাখা প্রাসঙ্গিক মনে করছি, রাষ্ট্রীয় বাজেট নির্ধারণের সময় ব্যয়ের প্রাক্কলন আগে করা হয়। আয়ের প্রাক্কলন পরে করা হয়। এটি আমাদের পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক হিসাবের মতো নয়। আমরা সাধারণত আয়ের সঙ্গে মিল রেখে ব্যয়ের তালিকা প্রস্তুত করি। যেমন, যদি কারো বেতন হয় বিশ হাজার টাকা। তাহলে তাকে সে হিসাবে খরচের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। আঠারো, ঊনিশ বা বিশ হাজারের মধ্যে ব্যয় সীমিত রাখতে হবে। জাতীয় বাজেটের হিসাব তার উল্টো। বাজেটের হিসাব এমন- প্রথমে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করব। ত্রিশ হাজার টাকা ব্যয়ের তালিকা প্রস্তুত করার পর দেখা গেল আমার আয় বিশ হাজার টাকা। আমি তখন দশ হাজার টাকা ধার নিয়ে আমার ব্যয়ের খাত পূরণ করলাম। এভাবে বাজেটে ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়।

আমাদের অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের জন্য ব্যয়ের প্রাক্কলন করেছেন ছয় লক্ষ আটাত্তর হাজার চৌষট্টি কোটি টাকা। অপরদিকে তিনি আয়েরও একটি প্রাক্কলন করেছেন। তার হিসাবে, আগামী অর্থবছরে তিনি চার লক্ষ তেত্রিশ হাজার কোটি টাকা আয় করবেন। অর্থাৎ জনগণ থেকে কর আদায় করবেন। সরকারের আয় কোথা থেকে আসে তা সবার কাছে স্পষ্ট। ব্যয়ের ব্যাপারে সরকার সিদ্ধহস্ত। সরকারি লোকেরা দুহাত খুলে খরচ করলেও টাকা কিন্তু সাধারণ জনগণের। সাধারণ জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারকে কর আদায় করে। সে করের টাকা সরকারের আয়ের প্রধান উৎস। আগামী অর্থবছরে সরকার আয় করবে চার লক্ষ তেত্রিশ হাজার কোটি টাকা। ব্যয়ের প্রাক্কলন হল ছয় লক্ষ আটাত্তর হাজার চৌষট্টি কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রাক্কলিত আয় থেকে দুই লক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার চৌষট্টি কোটি টাকা বেশি খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এটাকে বলা হয় ঘাটতি বাজেট। ব্যয়ের প্রাক্কলন থেকে আয়ের প্রাক্কলন কম। এবারের ঘাটতি বাজেট হল দুই লক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার চৌষট্টি কোটি টাকা। বাজেট প্রসঙ্গে মৌলিক কথাগুলো জানার পর বাজেটের বড় কয়েকটি খাতের প্রতি আমরা একটু দৃষ্টিপাত করব।

প্রসঙ্গ সুদ

এবারের বাজেটে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সুদ পরিশোধে রাষ্ট্রের ব্যয় সর্বোচ্চ। জাতীয় বাজেটে সুদ আদায়ের জন্য বরাদ্দ হল ১৯.২ শতাংশ। বাজেটের বিশাল অংক, অর্থাৎ প্রায় আশি হাজার পাঁচশত কোটি টাকা সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে। এককভাবে এটি বাজেটের সর্বোচ্চ বরাদ্দ। বাজেটে খরচের আরও যেসকল একক সর্বোচ্চ বরাদ্দ রয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হল জনপ্রশাসন খাত। অর্থাৎ সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী, মন্ত্রী, এমপিসহ সরকারি লোকদের বেতন ভাতা ও সুযোগ সুবিধার জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৭.৭ শতাংশ। এটি বাজেটের অন্যতম বড় আরেকটি বরাদ্দ। তাছাড়া ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা প্রদান, বিভিন্ন কাজে ভর্তুকি প্রদানের জন্যও বাজেটে বড় ধরনের বরাদ্দ রয়েছে।

আয়ের প্রাক্কলনের প্রতি সংক্ষিপ্ত দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই, সর্বোচ্চ আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন করকে। এই খাত থেকে সরকার এক লক্ষ একচল্লিশ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করার চিন্তা করছে। আয়কর বা ইনকাম ট্যাক্স থেকে সরকার আয় করবে এক লক্ষ একুশ হাজার কোটি টাকা। সম্পূরক শুল্ক থেকে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা। আমদানী শুল্ক থেকে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা।

বাজেটে যে বিষয়গুলোর প্রতি অনেকে দৃষ্টি রাখেন, তন্মধ্যে একটি হল জিডিপি প্রবৃদ্ধি। আগামী বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭.৫। অর্থাৎ বর্তমানে যা প্রবৃদ্ধি আছে তা থেকে আরও ৭.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। আগামী অর্থবছরে মাথাপিছু গড় আয় ৩০০৭ ডলার অতিক্রম করবে। মূল্যস্ফীতি আগামী বছর ৫.৬ শতাংশে আটকে রাখা হবে। এবারের বাজেটে আরেকটি আলোচিত বিষয় ছিল, বিদেশে পাচারকৃত অর্থ সামান্য কর আদায় করে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ প্রদান।

বাজেট প্রসঙ্গে আমরা সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছি। প্রথমে বলব, সুদ পরিশোধ প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় বা তাদের মধ্যে জরিপ চালানো হয়, শতকরা কতজন লোক সুদী লেনদেন করেন বা সুদকে সমর্থন করেন, তাহলে অধিকাংশই বলবে, আমরা মুসলমান। আমরা সুদ দিই না, সুদ নিই না। প্রত্যক্ষভাবে তারা সুদের সঙ্গে জড়িত নয়। কিন্তু দেশের সিংহভাগ মানুষ হয়ত জানে না, পরোক্ষভাবে তারা সুদ দিয়ে থাকে। কেননা, সরকার সারা বছর যে অর্থ ব্যয় করে, তার বড় অংশ সুদ প্রদানে ব্যয় হয়। সাধারণ জনগণ সরকারকে কর দেয়। সরকার সে অর্থ সুদ আদায়ের জন্য ব্যয় করে। জনগণের করই সরকারের আয়ের বড় উৎস।

প্রশ্ন হতে পারে, সাধারণ জনগণ তো কর দেয় না; কর দেয় বিত্তবানরা। মূল বিষয়টি এমন নয়। কর দুই প্রকার :

এক. রিটার্ন জমা দিয়ে সরাসরি আয়কর দেওয়া।

দুই. পরোক্ষভাবে কর প্রদান করা।

সাধারণ জনগণ সবসময় পরোক্ষভাবে কর দিচ্ছে। মানুষ যখন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করে, এমনকি একটি ট্যাবলেটও যখন ক্রয় করে তখন তারা সরকারকে কর দেয়। একজন ভিখারীকেও ভিক্ষা করে উপার্জিত সামান্য অর্থ থেকে কর দিতে হয়। এই ভিক্ষার টাকা দিয়ে কোনো কিছু ক্রয় করলে তাকে কর দিতে হয়। ভ্যাট নামে সাধারণ জনগণ থেকে এই কর আদায় করা হয়। বিগত কয়েক বছর ধরে এটি সরকারের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস। এই ভ্যাট বা মূল্য সংযোজিত কর সাধারণ জনগণ সবাই আদায় করে। সাধারণ জনগণের করের টাকায় জনগণের প্রতিনিধি সরকার সুদ দিচ্ছে। ইসলামে সুদ জঘন্যতম হারাম। অথচ সরকারের নীতি কৌশলের কারণে মানুষ নিজের অজান্তে সুদে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সুদ কেন দিতে হয়?

আসলে আমাদের অর্থব্যবস্থাটাই সুদভিত্তিক। ব্যবসার উদ্দেশ্যে, লাভবান হওয়ার আশায় বিভিন্ন ব্যাংক, মাঝেমধ্যে সরকারের বিভিন্ন সুকুক (ইসলামিক বন্ড), বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (ইসলামী নামের আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলেও, কার্যত সেগুলো কতটুকু ইসলামী জোরালোভাবেই সে প্রশ্ন থেকে যায়, ইসলামাইজেশন বা ইসলামীকরণে তাদের দুর্বলতা স্পষ্টভাবেই পরিলক্ষিত হয়) ইসলামীকরণের ব্যাপক প্রবণতা থাকলেও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ইসলামীকরণ এবং সুদমুক্ত করার কোনো পরিকল্পনা এখনও পরিলক্ষিত হয় না। এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম। সুদ হারাম হওয়ার বিষয়টি তাদের বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত। ইসলামের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কুরআনুল কারীম। সেখানেও সুদের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্নভাবে সুদের নিন্দা করা হয়েছে। এক আয়াতে তো যুদ্ধের ঘোষণা এসেছে। যারা সুদ বর্জন করে না, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা  করেন। [সূরা বাকারা (০২) : ২৭৯]

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, সুদ কি এড়ানো যেত না? অবশ্যই এড়ানো যেত। কারণ, সুদ দিতে হয় ঋণ করার কারণে। ঋণ না করলে সুদও দিতে হত না। কেউ বলতেও পারে, ঋণ যে আমার প্রয়োজন। এখানে ভাবার বিষয় হল, ঋণ আসলে কতটুকু প্রয়োজন? এবারের বাজেটে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি টাকার মতো ঘাটতি আছে। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী বাজেট প্রস্তুত করলে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হত না। আড়াই লক্ষ কোটি টাকা বাজেটে ঘাটতি। সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা। তার উপর নতুন ঋণ নেওয়া হচ্ছে। সুদ পরিশোধের জন্য এই টাকা না দিতে হলে ব্যয় অনেক কমে যেত। খরচের প্রাক্কলন থেকে এই পরিমাণ বিয়োগ হত। তাছাড়া অন্যান্য খরচের খাতেও যদি ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করা হত, অপ্রয়োজনীয় খরচগুলো বাদ দেওয়া হত তাহলে ঋণের বোঝা ঘাড়ে চাপত না। যদি উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা হত, মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে হয়ে খরচ বৃদ্ধি না পেত তাহলে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হত না। ঋণ না নিলে সুদও দিতে হত না। আমরা মনে করি, সুদ বন্ধ করার জন্য সরকারের সদিচ্ছা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনাই যথেষ্ট। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সদিচ্ছা থাকলে সুদ থেকে বেরিয়ে আসা রাষ্ট্রের জন্য অসম্ভব নয়। বিগত কয়েক বছর ধরে বাজেটের বড় খাত হয়ে যাচ্ছে সুদ পরিশোধ। জনগণের টাকা দিয়ে রাষ্ট্র সুদ পরিশোধ করে। এই সুদের হার দিনদিন বাড়ছে। কারণ রাষ্ট্রের খরচ যেমন বাড়ছে ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। খরচ করতে তাদের গায়ে লাগে না। রাষ্ট্র তো অনেক বড় বড় কথা বলে। এটা দিচ্ছি, সেটা দিচ্ছি, এটা খাওয়াচ্ছি, ওটা খাওয়াচ্ছি। মনে হয় যেন নিজের পকেট থেকে দিচ্ছে। রাষ্ট্র যা দিচ্ছে সব তো জনগণ থেকে নিয়ে দিচ্ছে। এমনকি ঘাটতি বা ভর্তুকির টাকাও জনগণ থেকে নিয়ে দিচ্ছে। ঘাটতির টাকা রাষ্ট্র ব্যাংক থেকে নিয়ে আদায় করে। আর ব্যাংকে জনগণের টাকা জমা থাকে। এই টাকা সাধারণ মানুষের। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের টাকা এগুলো। এগুলো উচ্চবিত্ত লোকের টাকা নয়। তারা ব্যবসায়ী। তারা বরং ব্যাংক থেকে টাকা নেয়। 

মূল বাজেটের টাকাও জনগণের, ঘাটতি বাজেটের টাকাও পূরণ করা হয় জনগণের টাকা দিয়ে। যদিও সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা নিজেদেরকে মালিকের মতো মনে করেন। মালিকের মতো তাঁরা কথা বলেন। তাঁদের দাপটও মালিকের মতো। টাকা সবটুকু জনগণের। আয়ের প্রাক্কলন যা করা হয় তাও জনগণের, ঘাটতি বাজেটের প্রাক্কলনও জনগণের ব্যাংক একাউন্টের টাকা দিয়ে করা হয়। বৈদেশিক ঋণ, দেশীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ সুদসহ জনগণের টাকা দিয়ে আদায় করা হয়। সকল চাপ জনগণকে নিতে হয়। আর নীতি নির্ধারণ করে রাষ্ট্র। এটা ঠিক যে, জনগণের প্রতিনিধিই নীতি ঠিক করবে। সকল জনগণ মিলে নীতি ঠিক করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই নীতি জনগণের অনুকূলে হতে হবে। জনগণের বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। বর্তমানে তা হচ্ছে কোথায়? রাষ্ট্রের নীতি জনগণের অনুকূলে হলে, এ দেশে সুদী অর্থব্যবস্থা চালু হত না। বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের মতো অনেক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ আছে। এসব দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী ধর্মপ্রাণ। ব্যক্তি পর্যায়ে তারা সুদ এড়িয়ে চলে। বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে তারা সুদকে ঘৃণা করে। অথচ রাষ্ট্র তাদেরকে পরোক্ষভাবে সুদের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলছে। তাদের টাকা সুদী খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। অবশ্যই এই ব্যবস্থার অবসান হওয়া উচিত। নিজের জনগণ, তাদের বিশ্বাস, কুরআন ও কুরআনী শিক্ষার মূল্যায়ন করে ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর কর্তব্য হল, সুদী ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা।

জনপ্রশাসন খাত

জাতীয় বাজেটে অন্যতম বড় একটি বরাদ্দ হল, বেতন ভাতা। সরকারি কর্মচারী, কর্মকর্তা, এমপি, মন্ত্রী সকলের বেতন ভাতা। মোটকথা জনপ্রশাসনের বরাদ্দ। জনপ্রশাসন বলতে সচিবালয় ভিত্তিক কাজকর্মকে বোঝানো হয়। এই খাতে রাষ্ট্রের একটি বড় ব্যয় হয়। এবারের বাজেটে তার জন্য বরাদ্দ হল ১৭.৭ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে রাষ্ট্র তাদের পেছনে এই অর্থ ব্যয় করবে। একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য লোকবল প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও পরিবার আছে, তাদের জীবন জীবিকার প্রয়োজন আছে। তাদেরকে সম্মানী দিতে হবে। রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবন জীবিকার বিষয়ও রাষ্ট্রকে দেখতে হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে রাষ্ট্রের খরচগুলো করা হয় সেগুলোর লাগাম টানা অতীব জরুরি। এটি সম্ভবও। ইসলামী শিক্ষাকে কাজে লাগালে সে খরচে লাগাম টানা সহজ হয়ে যেত। কারণ ইসলাম কখনো অতিরিক্ত খরচের সুযোগ দেয় না। আমরা শুধু দু-একটি খবর পাই। মাঝেমধ্যে কোনো বেরসিক সাংবাদিকের মাধ্যমে সেগুলো মিডিয়ায় চলে আসে। বাস্তবতা হিসেবে সেগুলো অতি নগণ্য। অফিস আদালতের খরচের ফিরিস্তি দেখলে, সেখানে খরচের কত রকমের খাত দেখলে অনেকের পিলে চমকে উঠবে। কখনো আমরা বালিশ কাণ্ডের খবর পাই। চাদরের রং নির্বাচন করতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ গমনের খবর পাই। বর্তমান প্রযুক্তির যুগেও একটি ড্রয়িং আনার জন্য একদল লোক সুদূর আমেরিকায় যেতে হয়। এগুলো কিছু নমুনা মাত্র। এমন হাজারো বিষয় আছে, রাষ্ট্র চাইলে সেখানে ব্যয় সংকোচন করতে পারে। গত মাসে দেখলাম, একজন বড় সরকারি কর্মকর্তা ইউরোপ শিক্ষা সফরে গিয়েছিলেন। শিক্ষা সফর থেকে ফিরে এসে পরদিন তিনি অবসর নিয়েছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে তিনি কী শিক্ষা সফরে গেলেন? শিক্ষা কি তিনি তাঁর পরিবারের কাজে লাগাবেন? বেতন ভাতা নিয়ে প্রাসঙ্গিক অনেক কথা আছে। বেতন ভাতার বৈষম্য নিয়েও কথা বলার সুযোগ আছে। আমরা সেদিকে না গেলেও প্রাসঙ্গিক যে অন্যান্য বিশাল খরচ সেগুলোর অবশ্যই লাগাম টানার সুযোগ আছে। এগুলোর লাগাম টানলে বিরাট অংকের খরচ কমে যাবে। প্রশ্ন হল, বিড়ালের গলায় ঘণ্টি বাঁধবে কে?

শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত

জাতীয় বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বড় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ কাঙ্ক্ষিত। শিক্ষা খাতে এর চেয়ে বড় বরাদ্দ রাখা হলেও দূষণীয় বলে মনে হয় না। কিন্তু যাদের জন্য এই বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যে শিক্ষার জন্য এই বিশাল বরাদ্দ, আমাদের এই শিক্ষা কোন্ স্তরে আছে? বিগত কয়েক বছরে আমাদের দেশের কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে নেই। বিদেশের সঙ্গে তুলনা বাদ দিলাম। দেশীয় সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আসল চিত্র দেখতে পাই। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিসি ও নীতি নির্ধারকদের নীতি নৈতিকতা প্রসঙ্গে যখন আপত্তিকর খবর আসে, তখন এই শিক্ষার বাস্তব চিত্র আমাদের সামনে চলে আসে। তাছাড়া এই প্রশ্নটিও স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে, জাগতিক জ্ঞান বিজ্ঞানে, গবেষণায় তারা কী অবদান রাখতে পারছেন?

এত বিশাল বরাদ্দ কি ভালোভাবে কাজে লাগছে? আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম কি যথাযথভাবে শিক্ষিত হয়ে উঠছে? তাদের সবাইকে না হোক অন্তত সংখ্যাগরিষ্ঠদেরকে আমরা কি সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারছি? তাই শিক্ষার মান উন্নয়নে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা উচিত। শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, দলবাজি মুক্ত করা, নির্দলীয় যোগ্য ব্যক্তিদেরকে যথাযোগ্য পদে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে অধিক মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। তাহলেই সঠিক সুফল পাওয়া যাবে। তখন শিক্ষাখাতে আরও বড় বরাদ্দ দিলেও ফলদায়ক হতে পারে।

কখনো কখনো মন্ত্রী-এমপিদের বলতে শোনা যায়, দেশে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। তখন প্রশ্ন ওঠে, দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে না কেন? দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। আসলে কি আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছি, তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করছি, তা দেখার বিষয় আছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরকারি চাকরি বা সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে কি মেধার প্রতিযোগিতা হয়, না অন্য কোনো বিষয় সেখানে কাজ করে- তা খতিয়ে দেখা দরকার। শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার চেয়ে অনাকাক্সিক্ষত অন্য কোনো বিষয় সেখানে কার্যকরী নয় তো? তাহলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীগণ লেখা পড়ায় মনযোগী হওয়ার বদলে সেসব যোগ্যতা অর্জনে ব্যস্ত হয়ে যাবে।

দারিদ্র্য বিমোচন

দারিদ্র্য বিমোচনের একটি বিষয়ও বাজেটে থাকে। বিষয়টিকে তারা সামাজিক নিরাপত্তা নামে অভিহিত করে। সঙ্গে আরও কিছু বিষয় তারা যোগ করে। এই খাতে এবারের বাজেটে বরাদ্দ হল ৫.৫ শতাংশ। আসলে একটি সরকার যদি গণমুখী ও কল্যাণমুখী হয় তার প্রধান কাজ হল, রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধান করা। রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। কেউ যেন অনাহারে বা অর্ধাহারে না থাকে, স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত না থাকে তা নিশ্চিত করা। কিন্তু বর্তমানে আমাদের মতো রাষ্ট্রগুলোর একটি ফ্যাশন হয়ে গেছে, শুধু উন্নয়ন আর উন্নয়ন। দেশে বড় বড় সেতু তৈরি হবে। বড় বড় অট্টালিকা তৈরি হবে। বিশাল বিশাল রাস্তা তৈরি হবে। বলা হচ্ছে, এই উন্নয়নের সুফল সবাই পাবে। আসলে কতজন এই উন্নয়নের সুফল পায়? দেশের প্রান্তিক লোকেরা এই উন্নয়নের সুফল কতটুকু পায়? তাদের বিষয়টা দেখবে কে? রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্ব ছিল তাদের দেখাশোনা করা। সেটা করা হলে এই খাতের বাজেট আরও বড় হত। এর আওতা অনেক বিস্তৃত হত। সুবিধাভোগীর আওতা আরও বৃদ্ধি পেত। এমনিতে দেখা যায়, গ্রাম্য ও প্রান্তিক এলাকার বিধবা ও হতদরিদ্রদের তালিকা করা আছে। তাদেরকে কিছু ভাতা দেওয়া হয়। তাতে কিছু বৃদ্ধিও করা হয়েছে। তবে যা দেওয়া হয়, প্রয়োজনের তুলনায় তা অতি নগণ্য। এখানেও শোনা যায়, তালিকায় চেয়ারম্যানের আত্মীয়-স্বজন, ধনী লোকদের আত্মীয়-স্বজনের নাম থাকে। উপযুক্ত ব্যক্তিরা সেই তালিকায় ঠাঁয় পায় কম। রাষ্ট্রের এই তালিকা আরও দীর্ঘ হওয়া উচিত। বিশেষ করে কোভিড পরবর্তী সময়ে নতুন করে যে দারিদ্র্য তৈরি হয়েছে, বাজেটে পরোক্ষভাবে এর স্বীকৃতিও আছে, এজন্য সামাজিক নিরাপত্তা বা দরিদ্র লোকদের সহায়তার হার আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন ছিল।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কতজন লোককে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া প্রয়োজন, তার সঠিক হিসাবও তাদের কাছে নেই। যা দেওয়া হয় তা তো একেবারে সামান্য। তা-ও এ বছর জিডিপির দিক থেকে কমানো হয়েছে। গত বছর তা জিডিপির ৩.১১ শতাংশ ছিল, এ বছর তা হয়েছে ২.৫৫ শতাংশ।

তুলনা করার সুযোগ নেই, তবু বলে রাখা ভালো যে, একটি কল্যাণমুখী ইসলামী রাষ্ট্র হলে এক্ষেত্রে কী করত? এমন পরিস্থিতিতে খলীফা বা আমীরুল মুমিনীনদের কর্মপন্থা কী ছিল? ইসলাম ও কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা এটি, খলীফাগণও তা-ই করেছেন, রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য-বস্ত্র ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। আমাদের মতো এসব দেশে বিষয়টি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এর জন্য নামমাত্র একটি বরাদ্দ রাখা হয়। এমন রাষ্ট্রকে কল্যাণমুখী বা গণমুখী রাষ্ট্র বলা যায় না।

প্রতিরক্ষা খাত

প্রতিরক্ষা খাতে এবার অনেক বড় বরাদ্দ আছে। ৫.৯ শতাংশ। প্রায় চল্লিশ হাজার কোটি টাকার অধিক এই খাতে বরাদ্দ। নিঃসন্দেহে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। তবে আমাদের দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে কি সেভাবে সাজানো হচ্ছে? একটি বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের সেনাদের ঈমানী বলে বলীয়ান করে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করা হচ্ছে কতটুকু? আমাদের বাহীনির কেউ জাতিসংঘ মিশনে আছে, কেউ বড় বড় ঠিকাদারীর কাজ করছে, রোড-ঘাটের কাজ করছে। সেক্ষেত্রে কেউ কেউ আপত্তি করছেন যে, তাহলে কি আমাদের প্রতিরক্ষা খাতের জন্য এত বিরাট বরাদ্দ দেওয়া, এত টাকা খরচ করা উচিত?

গণপরিবহণ ও যোগাযোগ খাত

গণপরিবহণ ও যোগাযোগে এবারও বিশাল বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সরকারের হাতে চলমান বেশ কয়েকটি মেগা প্রজেক্ট আছে। আরও কিছু প্রজেক্ট নতুন হাতে নেওয়া হয়েছে। এর জন্য বিশাল বরাদ্দ আছে। কিন্তু লোকমুখে যে কথা উচ্চারিত হচ্ছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বলা হচ্ছে, মেগা প্রজেক্ট মেগা দুর্নীতি। সেই দুর্নীতিকে যদি থামানো না যায়, দুর্নীতির লাগাম যদি টেনে ধরা না যায়, তাহলে মেগা প্রজেক্টের ব্যাপারে মানুষের আস্থা কমতে থাকবে। রাষ্ট্রের প্রতিও মানুষের আস্থা কমবে। কারণ সেখানে দুর্নীতির বিষয়টি অনেকটা স্বীকৃত এবং সকলের জানা। তাই মানুষ এখন বলতেই পারে, এত হাজার কোটি বরাদ্দ, সুতরাং এত হাজার কোটি দুর্নীতি। মেগা প্রজেক্ট মেগা দুর্নীতিএই বদনাম ঘুচাতে রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

দুর্নীতি বন্ধ করা, দুর্নীতি কমিয়ে আনার দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। বাজেটেও এ ব্যাপারে কোনো ইঙ্গিত নেই যে, সামনে উন্নতি হবে, কোনো দুর্নীতি হবে না, দুর্নীতির রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জনগণের টাকা দিয়ে প্রকল্পগুলো তৈরি হচ্ছে। ঋণ নিলেও তা জনগণেরই টাকা। জনগণের নামেই ঋণ নেওয়া হচ্ছে। জনগণের কাঁধেই ঋণের বোঝা চাপানো হচ্ছে। এর সুদও জনগণ আদায় করছে। এই টাকার সদ্ব্যবহার এবং বেহাত হওয়া থেকে রক্ষা করা দায়িত্বশীলদের কর্তব্য। কার্যত তাদের তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। বাজেটেও এর কোনো রূপরেখা দেখা যায়নি।

উন্নয়ন প্রকল্পের আলোচনা আসলে অবশ্যই পদ্মা সেতুর কথা চলে আসে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঋণব্যবস্থা থেকে এই সেতু নির্মিত হয়েছে। সেতুর কাজ শেষ হয়েছে। এই লেখা যখন প্রকাশ হবে তখন হয়ত সেতু উদ্বোধনও হয়ে যাবে। ততক্ষণে জনগণ এই সেতুতে চলাচল শুরু করে দেবে। জনগণ চলাচল শুরু করলে সেতু থেকে আয় শুরু হবে। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা সেখান থেকে আয় হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। কিন্তু সেই সেতুর জন্য এবারও আড়াই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অন্যান্য কাজের কথা বলে এই বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অন্যান্য কাজ কী- তার কোনো ব্যাখ্যা বা বিবরণ অর্থমন্ত্রী দেননি। অনেকে জানতে চেয়েছেন, সে টাকাগুলো কোথায় ব্যয় করা হবে? সেতু তো চালু হয়ে গেছে। কোনো ব্যয় থাকলে সেতুর প্রতিদিনের আয় থেকেও এই ব্যয় নির্বাহ করা যেত। তার পরও নতুনভাবে আড়াই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? মনে হয় তাদের কাছে আড়াই হাজার কোটি টাকা তেমন কিছু নয়।

কৃষিখাত

বাজেটে আরও বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন পরিমাণে বরাদ্দ আছে। কৃষিখাতে বরাদ্দ আছে। ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ আছে। আমরা আগেও বলেছি, কৃষিখাতের এই বরাদ্দের সুফল কৃষক ও সাধারণ জনগণ পায় কি না- তা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে চালের দর অনেক বেশি। মোটা চালও বাজারে পঞ্চাশ টাকার কমে পাওয়া যায় না। এই মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, এই দেশের জনগণের বিরাট অংশ ৪৫/৫০ টাকা দরে চাল কেনার ক্ষমতা রাখে না। আমাদের মন্ত্রীগণ যখন চালের হিসাব করেন তখন নিজেদের ঘরের চালের হিসাব করেন। তাঁরা মনে করেন, আমাদের তিন চারজনের সংসারে সারা মাসে দশ/বারো কেজি চালও লাগে না। প্রশ্ন হল, লাগবে কেন? তাঁরা প্রতিদিন দামী রেস্টুরেন্টে খাবার খান। মূল খাবারের সঙ্গে আরও চৌদ্দ রকমের খাবারের ব্যবস্থা থাকে। তাদের ঘরে সামান্য ভাত রান্না করা হয়। অল্প চালে তাদের মাস চলে যায়। খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষের ভাতই হল মূল খাবার। তাদের ৮/১০ জনের সংসারে মাসে কয়েক মন চাল লেগে যায়। অথচ বর্তমানে সে পরিমাণ চাল কেনার সামর্থ্যই নেই অনেকের। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের তুলনা করা যায় না।

বাজেটের প্রতিটি খাত পর্যালোচনা করলে অনেক কথা বলা যায়। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তো অনেক কিছুই বলার আছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেগুলো অরণ্যে রোদনের মতো হবে। তাই এ বিষয়ে আর দীর্ঘ কথা বলতে মন চাচ্ছে না।

আয়ের খাত

এবার আমরা বাজেটের আয়ের খাতগুলো একটু দেখি। বাজেটে প্রায় ২ লক্ষ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা ঘাটতি আছে। এই টাকা আয়ের কোনো উৎস সরকারের কাছে নেই। এই টাকা ঋণ করতে হবে। আয়ের প্রাক্কলনে আছে ৪ লক্ষ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। আমরা আগেই বলেছি, এর বিরাট অংশ মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট নামে জনগণ থেকে নেওয়া হবে। ধনী গরীব নির্বিশেষে যেকোনো আয়ের লোক সাধারণ জীবন যাত্রায় কোনো পণ্য বা সেবা কিনতে গিয়ে এই কর দিতে হবে। এটি সরকারের আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা এভাবে নেওয়া হবে। পুরো টাকাটা প্রত্যক্ষভাবে জনগণ কর্তৃক প্রদত্ত। তাছাড়া আমদানী শুল্ক ৪৩ হাজার নয় শত চুরানব্বই কোটি টাকা। সম্পূরক শুল্ক ৫৮ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। কর ব্যতীত রাজস্ব ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এই টাকাগুলো জনগণের টাকা। আমদানী শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ব্যবসায়ীরা পরিশোধ করলেও ব্যবসায়ীরা সকল শুল্ক যোগ করে তাদের পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে। তার উপর লাভ হিসেব করে তারা সে পণ্য বিক্রি করে। এ বাবত যত টাকা কর হিসাবে সরকার নেয় পুরো টাকা জনগণের। সাধারণ জনগণের টাকা দিয়েই সরকার চলে। শুধু ধনী ও ব্যবসায়ীরা কর দেয়, বিষয়টি এমন নয়। সাধারণ জনগণ পরোক্ষভাবে তো ভ্যাট ইত্যাদি দিচ্ছেই, প্রত্যক্ষভাবে করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর কথাও মন্ত্রী বলেছেন। টিআইএনধারী বাড়াবেন। টিআইএনের সঙ্গে রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক করবেন। করদাতার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করবেন। কিন্তু ইনসাফের দৃষ্টিতে কাদের থেকে কর নেওয়া উচিত? যাদের কারণে রাষ্ট্রকে ধনী বলা হচ্ছে, যাদের কারণে রাষ্ট্র মধ্যবিত্ত আয়ের দেশে পরিণত হয়ে যাচ্ছে তাদের থেকে নেওয়া উচিত। কয়েক লক্ষ কোটিপতি আছে, যাদের হিসেবে রাষ্ট্রের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, করের ঝাল তো সেই ধনাঢ্য গোষ্ঠীর উপর মেটানো উচিত। অতিরিক্ত কর নিতে চাইলে তাদের থেকে নেওয়া উচিত। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তরা তো এমনিতেই চাপে আছে। তাদের কোমর ভেঙ্গে পড়েছে। তাদের উপর আবার করের বোঝা চাপানো সুস্পষ্ট অবিচার। তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করা কোনো গণমুখী ও কল্যাণমুখী সরকারের কাজ নয়।

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ

এবারের বাজেটে আরেকটি বড় শিরোনাম ছিল, বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনা। সামান্য কিছু কর দিয়ে তা দেশে আনার ব্যবস্থা করা। তার মানে হল, মন্ত্রীগণ (অর্থমন্ত্রী, সেতুমন্ত্রী) একথা স্বীকার করে নিয়েছেন, দেশের বহু টাকা বিদেশে চলে গেছে। এগুলো দেশের হক। তা দেশে ফেরত আনতে হবে। অল্প কিছু কর দিয়ে তা ফেরত নিয়ে এলে এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড), দুদকসহ কোনো সংস্থা এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না।

এখানে কয়েকটি কথা থেকে যাচ্ছে। প্রথমত, দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারে নজরদারি করার জন্য বিভিন্ন সংস্থা আছে। তাদেরকে ফাঁকি দিয়ে কীভাবে এত টাকা বিদেশ চলে গেল? আগে বেসরকারিভাবে অনেকে বলেছেন, বড় কর্তাগণ, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদগণ বিদেশে অর্থ পাচার করছে। বিভিন্ন করস্বর্গ খ্যাত দেশের ব্যাংকগুলোতে তারা অর্থ জমা করছে। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে এই বিষয়গুলো স্বীকার করা হত না। এখন প্রকাশ্যে তা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। সুতরাং প্রথম কথা হল, টাকাগুলো পাচার হওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কি কোনো অবহেলা ছিল? বর্তমানে এটা খোলামেলা বিষয় যে, অনেকের পরিবার ও সন্তান বিদেশে থাকে। সেখানে তাদের ঘর-বাড়ি আছে। এমন অনেকের কথা দেশবাসী জানে।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, এই টাকা উপার্জন হয়েছে কীভাবে? বৈধভাবে না অবৈধভাবে? শুধু কর দেওয়া হয়নি, এই পর্যন্তই বিষয়টি সীমাবদ্ধ, নাকি এটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন, এই টাকা কোনো দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত নয় তো? দেশের সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন কর আইন মেনে চলতে হয়। কর্পোরেট কর দিতে হয়। ব্যক্তিগত পর্যায়েও দশ থেকে পঁচিশ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। অপরদিকে পাচারকৃত অর্থের ক্ষেত্রে মাত্র ৭ শতাংশ কর দিয়ে ঐ টাকা দেশে ফেরত আনার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। অনেকের মতে, এভাবে দুর্নীতির প্রতি আরও উৎসাহিত করা হচ্ছে। প্রথমে তারা দুর্নীতি করে টাকা বাইরে নিয়ে গেছে, আবার সামান্য কর দিয়ে তা বৈধভাবে দেশে ফেরত আনার সুযোগ পাচ্ছে। এটা দেশের সাধারণ ব্যবসায়ীদের প্রতি অবিচার। প্রথমত, সাধারণ ব্যবসায়ীগণ আইন মেনে বেশি কর দিচ্ছে, তারা দিচ্ছে কম। দ্বিতীয়ত, তাদের টাকার বিরাট অংশ দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত। সেগুলো এখন সামান্য কর দিয়ে বৈধ হয়ে যাচ্ছে। এই দেশে একজন ব্যক্তি রিটার্নে কোনো আয় লেখাতে হলে তার যথাযথ সূত্র দেখাতে হয়। অপরদিকে যিনি বাইরে থেকে টাকা নিয়ে আসবেন তার আয়ের কোনো সূত্র দেখাতে হবে না। শুধু কর দিয়ে দিলেই হবে। এটি মূলত এই কথা প্রমাণ করে, রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের নয়, বিশেষ একটি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে। তাদেরকে সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে।

সংসদে জাতীয় বাজেট উপস্থাপনের পর মিডিয়াতে বড় বড় মৌলিক দুই-তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা হয় :

এক. জিডিপি প্রবৃদ্ধি।

দুই. মাথাপিছু গড় আয়।

তিন. মূল্যস্ফীতি।

চার. দারিদ্র্যের হার।

এই বিষয়গুলো নিয়ে কিছু আলোকপাত করে আমরা আলোচনা শেষ করব।

মূল্যস্ফীতির হার

প্রথমেই আসে মূল্যস্ফীতির হার। অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বর্তমান থেকে কী পরিমাণ বাড়বে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এটা ৫.৬ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখবেন। যদি আমরা বিগত কয়েক বছরের চিত্র দেখি এবং বর্তমান বছরের অবস্থা দেখি তাহলে যেকোনো সাধারণ ব্যক্তিই এই বক্তব্য যে বাস্তবতা বিবর্জিত খুব সাধারণ জ্ঞান থেকে বলতে পারবেন। কারণ, মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস চাল, আটা, দুধ, গোশত, মাছের মূল্যই বিগত কয়েক মাসে শতকরা ১০/১৫ পার্সেন্ট হারে বেড়েছে। অথচ বলা হচ্ছে, ৫.৬ পার্সেন্টে আটকে রাখবেন। অর্থাৎ যে পণ্যের মূল্য ৫০ টাকা সেটা ৫৩/৫৪ টাকার বেশি দাম হবে না। যে পণ্যের মূল্য ১০০ টাকা সেটা ১০৫/১০৬ টাকার বেশি দাম বাড়বে না। মজার ব্যাপার হল, অর্থমন্ত্রী যেদিন বাজেট বক্তব্যে মূল্যস্ফীতির এ হারের ঘোষণা করছিলেন সেদিনও ভোজ্যতেলের মূল্য লিটারে আট টাকা বেড়েছে। এ সংবাদ গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। গত কয়েক মাসে এ ভোজ্যতেলের দাম কী বাড়াটাই না বেড়েছে। যেখানে বাণিজ্যমন্ত্রী নিজে ঘোষণা দিয়েছিলেন, দাম এবার একটু কমে আসবে। সেখানে ওই দিনই দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভোজ্য তেল কার ঘরে না লাগে। দাম বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! এখন ২০০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে। এই ভোজ্যতেলে কত দাম বেড়েছে? বছর ঘুরে দেখা যাচ্ছে এক শ পার্সেন্টের বেশি দাম বেড়েছে।

দেশের বড় একটি শ্রেণির বাজেটের প্রতি কোনো আগ্রহই নেই। অনেকে শিক্ষা-দীক্ষার অভাবের কারণে এসব পরিসংখ্যান বোঝেনও না। এজন্য এসব শুনে অনেক লোকই হাসি কান্না কিছুই করতে পারেন না। কিন্তু যারা বোঝেন তারা কী মনে করেন? তারা বুঝতে পারেন, এসব বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। এগুলো আরও পরিহাস। সাধারণ জনগণ আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের মিল না করতে পেরে হিমশিম খায় তখন তাদেরকে বলা হয়, পণ্যের দাম খুব সামান্য বেড়েছে। এসব শুনে মানুষ আরও বেশি কষ্ট পায়। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা জনগণের কষ্টের কথা বুঝলে কতই না ভালো হত।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি

প্রতিবারই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব করা হয়। কয়েক বছর ধরে এগুলো শুরু হয়েছে। প্রতি বছর অর্থমন্ত্রী দেখান, চলতি বছর থেকে আগামী বছর জিডিপি কত হারে বাড়বে। জিডিপি মানে হল, দেশজ উন্নয়ন। দেশীয় পণ্য সেবা থেকে আর্থিক উন্নয়ন। এ উন্নয়নকে বর্তমানে যা আছে তার থেকে বাড়িয়ে বলার নিয়ম চলে আসছে। এটা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণও পুঁজিবাদি অর্থনীতির লোকদেরকে করতে  দেখা যায়। বড় বড় প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এগুলোতে হস্তক্ষেপ করে। দেখা গেল, রাষ্ট্র একটা বলে, বিশ্বব্যাংক আরেকটা বলে। জনগণকে ঘন ঘন শোনানো হয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি আমরা এতটুকু করতে পেরেছি। এটা রেওয়াজ হয়ে আসছে। এই জিডিপি দিয়ে আসলে সাধারণ জনগণের কী যায় আসে? জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবটাই কীভাবে করা হয়? এটা লম্বা অধ্যায়। সংক্ষিপ্ত পরিসরে এটা নিয়ে বলা যাবে না। আগে মনে হয় কখনো বলেছি, এটা নিয়ে পৃথকভাবে বিস্তারিত বলব। কিন্তু কখনো বলতেও ইচ্ছে করে না। আসলে এসব নিয়ে বলে কী লাভ?

জিডিপির হিসাব মূলত করা হয় খরচের দিক থেকে। রাষ্ট্রের কোন্ খাতে কোন্ জায়গায় মানুষ ব্যয় করেছে। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল সাহেব ভার গলায় বাজেট বক্তৃতায় বলতেন, ‘ভোগ ব্যয় বেড়েছে।এটা বলে তিনি  দেখাতেন রাষ্ট্রের আয় বেড়েছে। অনেকে শুনে অবাক হবেন, তিনি বলছেন, ভোগ ব্যয় বেড়েছে, আবার এটা দিয়ে দেখাচ্ছেন জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। এই প্রবৃদ্ধি দেখানোর লাইনই এটা। এখানে একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। মনে করা হোক গত বছর কক্সবাজারে হোটেল ও অন্যান্য খাতে মানুষ খরচ করেছে ১০০ কোটি টাকা। এ বছর খরচ করেছে ১১০ কোটি টাকা। ধরে নেওয়া হবে পর্যটন খাতে আয় বেড়েছে দশ পার্সেন্ট। এভাবে দেশজ অন্যান্য খাতের ব্যয় সামনে নিয়ে এসে কত হারে বাড়ে সে হিসেবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়। এটাকে দেশজ উন্নয়ন ধরা হয়।

দেশ যদি ধরা হয় জনগণকে বাদ দিয়ে স্বতন্ত্র কোনো বস্তু তাহলে তো কোনো কথা থাকে না। দেশ মানে যদি হয় জনগণের দেশ, দেশের স্বত্ব যদি হয় ষোলো-সতেরো কোটি জনতার তাহলে প্রশ্নই থেকে যায়, এ প্রবৃদ্ধি কাদের হচ্ছে? এই যে ভোগ ব্যয় দিয়ে উন্নতি দেখানো হচ্ছে, ভোগ ব্যয়টা কারা বেশি করতে পারছে? যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা, যে কৃষক ও রিকশাওয়ালার বাজারে গেলে কলিজা কামড় দিয়ে ওঠে এবং যারা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত তাদের বেশি বেশি ভোগ ব্যয় করার সুযোগ কোথায়? তারা তো নিত্য প্রয়োজনীয় খরচ করেই কুলাতে পারে না। যেসব ভোগ ব্যয় দিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি গোনা হচ্ছে, বছর বছর উন্নয়ন দেখানো হচ্ছে- এটা কাদের ব্যয়? এরা শতকরা কতজন লোক? দেশের মোট জনসংখ্যার কত পার্সেন্ট তারা। তাদের দিয়ে দেখানো হচ্ছে রাষ্ট্রের আয় হচ্ছে। রাষ্ট্রের আয় হচ্ছে, না মুষ্টিমেয় লোকের আয় হচ্ছে? যারা নিজেদের টাকা বাইরে পাচার করছে আবার পাচার করা টাকা বৈধভাবে দেশে নিয়ে আসার সুযোগ পাচ্ছে! তারা দেশে টাকা রাখলেও মাঝে মাঝেই তাদের এই সুযোগ সেই সুযোগ দেওয়া হয়। কখনো কখনো তারা বিশাল বিশাল প্রণোদনাও পেয়ে থাকে। যেখানে একজন দরিদ্র লোক প্রণোদনা পায় ৫০০ টাকা ৭০০ টাকা ১০০০ টাকা সেখানে দেখা যাচ্ছে, একেকটি ব্যবসায়ী শ্রেণিকে রাষ্ট্র হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে দিচ্ছে। সুতরাং এই প্রবৃদ্ধি কাদের ভোগ ব্যয় দিয়ে? এই দেখানো প্রবৃদ্ধি দিয়ে সাধারণ জনগণের কী লাভ হচ্ছে? হিসেবের উন্নয়নে তো আর পেট ভরে না, শরীর সুস্থ হয় না!

মাথাপিছু আয়

আরেকটি বিষয় এখন বাজেটে বলার রেওয়াজ হয়েছে। তা হল, মাথাপিছু গড় আয়। খুব বড় গলায় এসব দাবি করা হয়। রাস্তা-ঘাটে, জনসভায় বলা হয়, বাংলাদেশ অনেক উন্নত হয়ে গেছে। দেশ এখন নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নশীল দেশ থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত দেশে অগ্রসর হয়েছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে মধ্যম সারির দেশে চলে যাবে। আগামী বছর মাথাপিছু গড় আয় দাঁড়াবে, ৩০০৭ ডলার। ডলারের দাম যে হারে বাড়ছে আগামী বছর হয়ত তা ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সে হিসেবে আমরা ডলারের দাম ১০০ টাকাও যদি ধরি আমাদের দেশের মাথাপিছু গড় আয় দাঁড়ায় তিন লক্ষ সাত শ টাকা। এই মাথাপিছু আয় ধরেই দেশকে একটা স্তর থেকে আরেকটা স্তরে নেওয়ার রেওয়াজ আছে। আমাদের দেশের মাথাপিছু আয়ের একটা মজার কাহিনীও আছে। আমরা নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ করেছি সেটা কিন্তু আমরা কেউ জানতাম না। হঠাৎ একদিন বাংলাদেশ ঘুম থেকে উঠে দেখে, বিশ্বব্যাংক ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশ এখন নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এরপর সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের আর কে পায়? দেশব্যাপী শুরু হয় প্রচারণা। আমরা কিন্তু হিসাব করে রাখিনি। জনগণ তো না-ই, আমরা নিজেরাই তো জানি না, আমরা  ধনী না গরীব। বিদেশীরা বলে দিয়েছে, আমরা আর হতদরিদ্র নেই। এই ঘটনা দেখলেই কিন্তু বুঝে আসে- এসব কথার হাকীকত কী? এসব কথার গুরুত্ব কতটুকু? সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে এসবের সম্পর্ক কতটুকু?

এবার আমরা একটু বুঝতে চেষ্টা করি, মাথাপিছু আয়ের অর্থটা কী? মাথাপিছু আয়ের অর্থ হল, দেশে যত মানুষ আছে প্রত্যেক মানুষের মাঝে দেশজ আয়কে ভাগ করে দেওয়া হলে গড়ে এত টাকা করে পড়বে। যেমন, আগামী বছর প্রাক্কলন করা হয়েছে তিন হাজার সাত ডলার। আমাদের পাড়ার সেলিম মিয়া একজন খেটে খাওয়া মানুষ। তার ঘরে পাঁচ সন্তান, স্ত্রী ও বৃদ্ধ মা আছে। তাঁর পরিবার আট সদস্যের। সরকারি হিসেবে এ ঘরের বার্ষিক আয় একুশ লক্ষ চার হাজার নয় শ টাকা। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তার সন্তানেরা ছোট ছোট। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ হল সেলিম মিয়া। তার কোনো জমি-জিরাতও নেই। থাকার একটা ঘর আছে মাত্র। এই একুশ লক্ষ চার হাজার নয় শ টাকা যদি আমরা বারো মাসে ভাগ করি তাহলে দেখতে পাচ্ছি, এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার চারশ আট টাকা এ পরিবার মাসে কামাই করে। আমরা একটি মাঝারি উদাহরণ টানলাম। সাধারণত এদেশের পরিবারগুলো এই সাইজের হয়। আরও বড় পরিবার হলে অংক আরও বেশি দাঁড়াবে। ছোট পরিবার হলে আরেকটু কম হবে।

আমরা যদি গার্মেন্টস শ্রমিকদের দিকে দেখি। সরকার সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণ করে দিয়েছে। সর্বনিম্ন বেতন ১০ হাজার টাকা করেও যদি ধরা হয় তাহলে সারা বছরে দাঁড়ায়, ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। অন্যদিকে বলা হচ্ছে তোমার বার্ষিক আয় ৩ লাখ ৭০০ টাকা। কিন্তু একজন শ্রমিকের উপর কতজনের দায়িত্ব? তার এক লাখ বিশ হাজার টাকায় আরও পাঁচ জন চলে। পাঁচ জনের মধ্যে ভাগ করলে ২০ হাজার টাকা করে একেকজনের ভাগে পড়ে। এমন অসংখ্য মানুষ আছে, যাদের আয় পরিবারের সবার মাঝে ভাগ করে দিলে মাথাপিছু আয় বার্ষিক ১০ হাজার হবে, ৮ হাজার হবে, ৫ হাজার হবে। কিন্তু জনগণকে শোনানো হচ্ছে, তোমার মাথাপিছু আয় ৩০০৭ ডলার। এটা দিয়ে পুরো দেশকে ধনী বানিয়ে ফেলা হচ্ছে।

দেশ ধনী হওয়ার অর্থ কী? দেশ যদি আলাদা কোনো বস্তুর নাম হয়, যেখানে জনগণ নেই তাহলে তো ভিন্ন কথা। যদি দেশ ধনী হওয়ার অর্থ হয়, জনগণ ধনী, তাদের আর্থিক সামর্থ্য বেড়েছে তাহলে এর বাস্তবতা কতটুকু? এখান থেকে আমরা বুঝি, মাথাপিছু আয়ের এসমস্ত হিসাব জিডিপির মতোই। একশ্রেণির লোকের সম্পদ ভাগ করে জনগণের মধ্যে দেখানো হয়।

আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে অল্প প্রাসঙ্গিক একটি ঘটনা মনে পড়ছে। আগে যে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতাম সেখানে শিক্ষকদের এক দস্তরখানে খাবার হত। একদিন তরকারি কম ছিল। একজন সিনিয়র শিক্ষক ছিলেন। বেশ রসিক মানুষ। দস্তরখানে চার-পাঁচজন বসা। সবাইকে তিনি বলছেন, বসেন বসেন ডিম আসছে!

সবাই ডিমের অপেক্ষায় বসে আছে। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল একটি ডিম এসেছে। তিনি ডিমটি নিজের প্লেটে নিয়ে নিলেন। বললেন, এবার খান। ডিম এসে গেছে, ডিম এসে গেছে।

সবাই অবাকও হল। হাসাহাসিও করল। সবাই ডাল দিয়ে খাচ্ছে। তিনি ডিম দিয়ে খাচ্ছেন।

বিষয়টা এমন- ডিম এসেছে বটে, কিন্তু ডিম খাচ্ছেন তিনি একা একজন। ওই ডিমেরই ঘোষণা তিনি সবাইকে দিয়ে দিয়েছেন। মাথাপিছু আয়টা ওই ডিমের মতোই। ডিম তো এসে গেছে। ডলার আছে। এই পরিমাণ টাকা আছে। আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, কোথায় আছে? আপনাকে জবাব দেওয়া হবেআপনার কাছে ৩ হাজার ডলার নেই, দশ ডলার আছে। তাতে কী সমস্যা? আরেকজনের কাছে যে ১ লাখ ডলার আছে! আরেকজন যে ১০ লাখ ডলারের মালিক। আমাদের অমুক নেতা, তমুক ব্যবসায়ী যে এত এত ডলারের মালিক। তারা যে এত এত ডলার বিদেশে নিয়ে গেছেন আবার বৈধ হয়ে দেশে আসবে সেগুলো কি হিসেবে নেই?

এই যে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে দেশে দেশে মাথাপিছু আয়ের মুলা ঝোলানো হয়, যত দিন যাচ্ছে নতুন নতুন কথার ফুলঝুড়ি আবিষ্কার করা হয়, রাত-দিন বলা হয়, মানুষের আয় বেড়েছে। উন্নয়নের উচ্চশিখরে মানুষ পৌঁছে গেছে। কেউ না খেয়ে নেই। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলেও সমস্যা নেই।

একবার বলা হচ্ছে, দাম বাড়েনি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আছে, আবার বলা হচ্ছে, দেশে দাম বেড়ে গেলেও খাদ্য সঙ্কট নেই, সবাই খাবার পেয়ে যাচ্ছে, এসব কথার হাকীকত কিন্তু এক জায়গায়। তা হল, যারা বলে তারা এবং তাদের সমগোত্রীয়দের উন্নয়ন। মাথাপিছু আয়ও তাদের। তাদের টাকাই অন্যদেরকে ভাগ করে দেখানো হয়। ডিম তারা একাই খেয়ে ফেলে। এর ভাগ আর অন্যদেরকে দেয় না। এ হল মাথাপিছু আয়ের রহস্য, যা আমরা সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করেছি।

গণমাধ্যমের চোখে বাজেট

আগেই বলেছি, বাজেট নিয়ে এখন আর বলতে মনে চায় না। বলে কোনো ফায়দা আছে বলেও মনে হয় না। এবারের বাজেট  দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির হার কম দেখানো এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির অতিরঞ্জন করে দেখানো নিয়ে অনেকে মজার মজার শিরোনাম করেছেন। দৈনিক বণিক বার্তা শিরোনাম করেছে, ‘কভিড যুদ্ধ মূল্যস্ফীতি সবই অর্থমন্ত্রীর বশীভূত!রিপোর্টার এ শিরোনাম দিয়ে বুঝিয়েছেন, কভিড যুদ্ধ নিয়ে পুরো বিশ্ব যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, অর্থনীতিকে সমন্বয় করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ছে, মূল্যস্ফীতি যেখানে বড় প্রসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে আমাদের অর্থমন্ত্রীর কাছে এগুলো কোনো বিষয়ই নয়। সবগুলোকে তিনি পানি-ভাতের মতো দেখাচ্ছেন। এগুলো কোনো সমস্যাই না। দৈনিক প্রথম আলোর শিরোনাম, ‘ব্যবসাবান্ধব বেশি, জনবান্ধব কম। যথার্থ শিরোনাম। ব্যবসাও সাধারণ ব্যবসাবান্ধব বলে মনে হয় না। জনবান্ধব কম বলে ভদ্রতা দেখিয়েছে। জনবান্ধব কম নয়, মোটেও জনবান্ধব নয়। অনেকেই এমন মজার মজার শিরোনাম করেছেন। শেয়ার বিজ শিরোনাম করেছে, ‘চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চ্যালেঞ্জে কর্মকৌশলহীন বাজেট। অনেকটা ভদ্রতা রক্ষা করেছে। নয়া দিগন্ত শিরোনাম করেছে, ‘দাম বাড়িয়ে ঘাটতি পূরণ!জনকণ্ঠ অবশ্য শিরোনাম করেছে, ‘করোনা পেরিয়ে উন্নয়নে ফেরা। এমনও শিরোনাম আছে! এ পত্রিকাতেই শুরুর দিকে অর্থমন্ত্রীর আরেকটি কথা কোট করেছে, ‘শেখ হাসিনা : এক ফিনিক্স পাখির গল্পগাথা।

আমদানী নির্ভর দেশে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়

বাজেটের ধারা আগের মতোই। উন্নয়নের নামে এখনো ব্যাপক ঋণ করার প্রবণতা। বিদেশেী ঋণ এখনো অনেক। সে ঋণ বেড়েই চলেছে। ঋণের মূল এবং সুদ শোধ করার একটা ব্যাপার আছে। আমাদের দেশে এখনো সেই আমদানী নির্ভরতা। রপ্তানির তুলনায় আমদানী গড় হারে বাড়তে থাকার প্রবণতা এখনো ব্যাপক। যেখানে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা খুবই সীমিত। গত বছর আমরা দেখেছি, সরকারিভাবে রাত-দিন প্রচারণা চলেছিল, আজকে রিজার্ভ এত ছাড়িয়ে গেছে, কাল এত ছাড়িয়ে যাবে। হাবভাবে মনে হচ্ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের বুঝি ডলার কিনতে বাংলাদেশে আসতে হবে। ডলার সব বাংলাদেশে পুঞ্জিভূত হয়ে যাবে। মনে হচ্ছিল, এটা তো ডলারের দেশ, টাকার দেশ নয়। এখন কী হচ্ছে? বছর যেতে না যেতেই ডলারের জন্য হাহাকার লেগেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হতে হতে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? টাকার পতন ঠেকাতে কত কৌশল নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আজকে এটা করে, কালকে ওটা করে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিল, বাজারের দাম চলবে না। আমরা মূল্য নির্ধারণ করে দেব। এটা করতে গিয়ে তারা চরমভাবে অসফল হয়েছে। ডলারের দাম আবার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। ছেড়ে দেওয়ার পর ডলারের দাম আটকে থাকছে না। দুদিন পর পরই বেড়ে যাচ্ছে। প্রতি ডলারের মূল্য ৯২/৯৩ টাকা ইতিমধ্যেই পার হয়ে গেছে। কী পরিমাণে মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে। ৮৩/৮৪ টাকা থেকে সরকারিভাবেই ১২/১৩ পার্সেন্ট বেড়ে গেছে। কার্ব মার্কেটের মূল্য ধরলে তো আরও বেশি।

ডলারের আয়ব্যয় নিয়ে দুটি কথা বলব। আমরা জানি, বৈদেশিক মুদ্রার আয় আমাদের দেশে দুভাবে হয়, রপ্তানি ও রেমিটেন্সের মাধ্যমে। এছাড়া সরকার মাঝে মাঝে ঋণ নেয়। যে জন্য সরকার সুদও দেয়। সেই বৈদেশিক ঋণ সরকার ডলারের মাধ্যমে নেয়। এ হল, ডলারের আয়ের সোর্স। ডলারের ব্যয়ের খাত হল, আমদানী। এছাড়া বিদেশ ভ্রমণ করতে নাগরিকেরা যে ডলার নিয়ে যায় সেটাও ডলার ব্যয়ের খাত।

এই যে হজ্বের বিষয়টা দেখুন। হজ্ব কাদের জন্য? যার সামর্থ্য আছে তার জন্য। কিন্তু আমরা দেখলাম, ২৫০ জনের বেশি লোককে সরকারি খরচে হজ্বে পাঠানো হচ্ছে! সরকারের বড় বড় দফতরের লোকদেরকে হজ্বে পাঠানো হচ্ছে। এর কী অর্থ? এটা কি সৌদি আরব ভ্রমণ, না ইবাদত? ইবাদত হয়ে থাকলে রাষ্ট্রীয় টাকায় কেন? এর বৈধতা কী? যে জনগণের টাকায় হজ্ব করানো হচ্ছে তারা কি অনুমতি দিয়েছে? একটা ধর্মীয় কাজ আমি করছি এটা কি যথাযথ হচ্ছে? কীভাবে জনগণের টাকা দিয়ে রাষ্ট্রের লোকদেরকে ইবাদত করতে পাঠানো হচ্ছে? এটি একটি সামান্য উদাহরণ। জনপ্রশাসনের খরচের আলোচনায় আমরা বলেছি, অনেক ব্যয় অনাকাক্সিক্ষত এবং খরচ না করেও পারা যায়। বৈদেশিক মুদ্রার খরচের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য।

আমাদের দেশে কিছু প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানী হয়। কিছু বিলাসদ্রব্য আমদানী হয়। একটি সাধারণ ১৫০০ সিসির গাড়ি আমদানীর যে দাম ৫০০০/৬০০০ সিসির গাড়ির দাম এর চেয়ে বহু গুণ বেশি। কেউ বলতে পারে, এজন্যই তো এর উপর কর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কর বাড়িয়ে দিলেই কী হল? কর বাড়িয়ে তো রাষ্ট্রের আয় হল দেশীয় টাকায়। যে পণ্য বিদেশ থেকে মোটা অংকের ডলার দিয়ে কিনতে হয়েছে সেটা তো দিতেই হয়েছে। বিলাসদ্রব্য আমদানীতে যত বেশি কর আরোপই করা হোক রাষ্ট্র দেশীয় টাকা পাচ্ছে। তাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়বেই। এজন্য আমাদের মতো যেসব দেশের তেল আমদানী করতে হয়, জরুরি আমদানী যাদের আছেই তাদের অবশ্যই আমদানী নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে যেসব উন্নয়ন কাজ করতে হয় সেসব উন্নয়নের লাগাম টেনে ধরতে হবে। আমরা উন্নয়ন উন্নয়ন করতে করতে, অযাচিত বিলাসদ্রব্য আমদানী করতে গিয়ে, অযাচিত ভ্রমণ করে রাষ্ট্রকে সমস্যায় ফেলছি না তো?

প্রসঙ্গ : শ্রীলঙ্কা

শ্রীলঙ্কার প্রসঙ্গ কিছুদিন এদেশে আলোচিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় আন্দোলন কিছুটা নিস্তেজ হয়ে এসেছে এখানেও আলোচনা কমে এসেছে। তখন সরকারি লোকেরা রাতদিন এসবের জবাব দিতেই ব্যস্ত ছিলেন, বাংলাদেশ কখনো শ্রীলঙ্কা হবে না। সেটা তো বটে। কিন্তু শ্রীলঙ্কা যে পথে ডুবেছে আমরা সে পথে হাঁটছি না তো? এটা কিন্তু দেখা ও ভাবার বিষয় আছে। এবং কথার ফুলঝুড়ি কমিয়ে অবশ্যই ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ হওয়া উচিত। সকল প্রকার বিলাসদ্রব্য আমদানী নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া উচিত। যারা বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে দামি দামি জিনিস আনায় ব্যস্ত, যারা দেশীয় ফিটিংস ঘরে ব্যবহার করতে পারে না, ঘরে অনেক দামি দামি বৈদেশিক জিনিস ব্যবহার করতে হয়, যাদের অনেক দামি দামি বাহন ব্যবহার করতে হয়, অনেক দামি বৈদেশিক খাবার লাগে তাদের তো বিদেশে এক-দুটি নয় অনেক বাড়ি-ঘরই আছে, তারা কষ্ট করে একটু বিদেশে চলে গেলেই তো পারেন। এদেশে যা আছে তা সাধারণ মানুষের জন্য ছেড়ে গেলেই তো পারেন। তাহলে দেশে তাদের জন্য এত কিছু আমদানী করতে হয় না। দেশকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়তে হয় না। বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনার এখনি উপযুক্ত সময়। না হয় সময় কারো জন্য বসে থাকে না। বিপর্যয় বলেকয়ে আসে না। বিপর্যয় সৃষ্টিকারীরা কখনো থাকে, কখনো থাকে না। কিন্তু যাদের ক্ষতি হওয়ার তাদের ক্ষতি ঠিকই হয়ে যায়। মুখে যতই বলি, আমরা শ্রীলঙ্কা কখনো হব না, শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি এ দেশে হবে না, এত টান পড়বে না। আমাদের পরিস্থিতি কিন্তু সেটা বলছে না। রিজার্ভের অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহতভাবে চলছে। টাকার যত অবমূল্যায়ন হবে তত মূল্যস্ফীতি বাড়বে। আমদানী নির্ভর জিনিসগুলোর দাম তো বাড়বেই। পাশাপাশি অন্যান্য জিনিসের দামও বাড়বে। কারণ টাকার অবমূল্যায়ন হলে তেলের উপরও এর প্রভাব পড়বে। অন্যান্য জিনিসের উপর প্রভাব পড়বে। ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বেতন বৃদ্ধির দাবিতে গার্মেন্টস শ্রমিকরা ব্যাপক ভাংচুর ও আন্দোলন করেছে। তাদের বক্তব্য হল, সবকিছুর দাম বেড়েছে তাদের বেতন বাড়ছে না। ভাংচুর তো কিছুতেই সমর্থনযোগ্য না, কিন্তু দাবি যে যৌক্তিক। এখন এ দাবি পূরণ করতে গিয়ে মালিক পক্ষেরই বা কী অবস্থা হবে? সেটাও দেখার বিষয় আছে।

অর্থনৈতিক অনাচার থেকে মুক্তির উপায়

বাজেটের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে বিভিন্ন কথা বলার ছিল, আছে। সেসব বিষয় আজ থাকুক। শেষে একটা কথা বলতে চাই, মাঝে মাঝেই কথা ওঠে, মেগা প্রজেক্ট মেগা দুর্নীতি, খরচের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। এসব বড় বড় বিষয় কী করে নিয়ন্ত্রণ হবে? আবার অনেকে বলেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে যে বরাদ্দ তা কাজে লাগে না। শিক্ষার মান উন্নয়ন হচ্ছে না। দুর্নীতির দায়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর এপিএসকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এখানে স্বাস্থ্য খাতের কথাও আছে। বিগত সময় আমরা দেখেছি, এ খাতের বিভিন্নজনকে ধরা হয়েছে। দুর্নীতি করতে গিয়ে বড় বড় অফিসারকে বদলিও করা হয়েছে। স্বাস্থ্যের ডিজিও বদলি হয়েছেন। এগুলো নিয়ন্ত্রণের রাস্তা কী? এগুলো হয় কেন?

আসলে টাকা-পয়সা, ক্ষমতার মোহ তো স্বভাবজাত একটা বিষয়। এ স্বভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য আল্লাহ তাআলা বিধি-বিধান দিয়েছেন। কুরআন-সুন্নাহ দিয়েছেন। নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁদের পর তাঁদের ওয়ারিসদেরকে পাঠিয়েছেন। তাঁরা এ মোহ থেকে বাঁচার পদ্ধতি দিয়ে গেছেন। সেটা হল দ্বীনের শিক্ষা। দ্বীনের শিক্ষা, তাকওয়া, নীতি-নৈতিকতা যদি জাতির সন্তানদেরকে দেওয়া না হয়, তাদের মধ্যে জাগরুক না করা হয় তাহলে স্বভাবজাত আকর্ষণের কারণেই এগুলোর সঙ্গে তারা জাড়িয়ে পড়ে। জনগণের টাকার হেফাজত, জনগণের উৎকোচহীন সেবা পাওয়ার সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে জনপ্রশাসনের লোক, শিক্ষকবৃন্দ, বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লোকজনের তাকওয়া ও নীতি-নৈতিকতার পাঠ প্রয়োজন। এর জন্য বাজেটে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আমরা দেখি, দু-তিনটি বিষয় মিলিয়ে ধর্মকে রাখা হয়েছে। লেখার স্টাইলও কী অদ্ভূত-বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম।এই তিনটি খাত মিলে ০.৮০ পার্সেন্ট বাজেটে বরাদ্দ। যেখানে ধর্মের জন্য বরাদ্দ খুবই নগণ্য। অর্থাৎ বাজেটের আধা শতাংশেরও অনেক কম। অথচ ব্যাপকভাবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিতে হয়। প্রথম তো এটাই দরকার, মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত গুরুত্বসহকারে নীতি-নৈতিকতা, ধর্ম শেখানো। দ্বিতীয় কথা হল, শিক্ষক হয়ে যাওয়ার পর মাঝে মাঝেই তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এমনিভাবে অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অগ্রসর হন। সেসব প্রশিক্ষণে আখলাক, নীতি-নৈতিকতার প্রশিক্ষণও যোগ্য, পরহেযগার আলেমদের মাধ্যমে হওয়া জরুরি। এর জন্য বাজেটেও বড় বরাদ্দ থাকা উচিত। তাহলেই ধীরে ধীরে কর্মীদের মানোন্নয়ন হবে। দুর্নীতিও কমে আসবে। উন্নয়নের টাকাও যথাযথ কাজে লাগবে। খরচও কমে আসবে। বাজেট দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেমন হত তেমনই হবে। তখন উন্নয়ন ব্যয় থাকত বেশি, অনুন্নয়ন ব্যয় থাকত কম। এখন পুরো উল্টো হয়ে গেছে। আমরা আগেই বলেছি, সরকারের উন্নয়নের বিষয়গুলো সুদভিত্তিক না হয়ে ইসলামী তরীকায় হওয়ারও সুযোগ আছে। সেগুলো দক্ষ ইসলামী লোকদের থেকে সহযোগিতা নিয়ে সমাধান করার সুযোগ আছে; যদি ভালোভাবে করতে চায়। শুধু নাম ব্যবহার করে কোনো লাভ নেই। যেমন, ‘সুকুকনাম শুধু ব্যবহারই করা হয়েছে, কাজের কাজ কিছুই নেই। এভাবে কোনো লাভ হয় না। সেই পুরোনো কবিতা বলে বাজেট বিষয়ের লেখা শেষ করছি-

خوشبوئوں  کا  اک  نگر  آباد  ہونا  چاہئے + اس  نظامِ زر  کو  اب  برباد  ہونا  چاہئے

সুরভিত এক নগর আবাদ হতে হবে/ এ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা বরবাদ হতে হবে।

 

 

advertisement