মারকাযের দিন-রাত
আলকাউসারের শুরু থেকে দীর্ঘ দিন এ বিভাগটি চালু থাকলেও গত কয়েক মাস কোনো কারণে বিভাগটি বন্ধ ছিল। পাঠক মহল থেকে কেউ কেউ লিখিতভাবে এবং অনেকে মৌখিকভাবে আবেদন করেছেন যে, বিভাগটি তাদের উপকারে আসে, বিভাগটি যেন আবার চালু করা হয়। তাই আল্লাহর উপর ভরসা করে বিভাগটি পুনরায় চালু করা হল। আল্লাহ কবুল করুন আমীন। -সম্পাদক
০১/১১/২৭ হি. মোতাবেক ২৩/১১/০৬ ঈ.
জোহরের পরের নিয়মিত ইজতেমায়ী দুআ ও তালীমের মজলিসে মাঝে মধ্যে খোঁজ নেওয়া হয় যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জামাতে যথাসময়ে উপস্থিতি, মাসনূন আমাল, কিছু নফল নামায এবং আদইয়ায়ে মাসূরার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কি না। আজও এমন একটি জরিপ করা হল। এ ব্যাপারে আসাতিযায়ে কেরামের পক্ষ থেকে যে দিক-নির্দেশনা দেওয়া হল তাতে বলা হয়েছে, এ বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করা প্রত্যেক মুমিন বান্দার, বিশেষ করে উলামা তালাবার জন্য তো এমনিতেই কাম্য, আর ওলামা তালাবার ইলম, মেধা, সময় ইত্যাদিতে বরকত হওয়ার জন্য এগুলো আরও জরুরি বিষয়।
ইজতেমায়ী মজলিসে যে দুআগুলো পড়া হয়, সেগুলোর অর্থের প্রতি খেয়াল করে মনোযোগের সাথে পড়ার তাগিদ করা হয়েছে। কারণ অমনোযোগীর দুআ একে তো কবুল হয় না, দ্বিতীয়ত এ মুবারক দুআগুলো মনোযোগের সাথে পড়লে ঈমান তাজা হয় এবং আমল আখলাক দুরস্ত হয়। একটু দেখুন, “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহি লা মালজাআ ওয়ালা মানজাআ মিনাল্লাহি ইল্লা ইলাইহি” দুআটির অর্থের প্রতি লক্ষ করুন। দুআটিতে তাওহীদ, তাওয়াক্কুল, তাফভীজ, তথা নিজেকে এবং নিজের যাবতীয় কিছু আল্লাহর উপর সোর্পদ করা এবং নিজের অপারগতা, অপূর্ণতার স্বীকারোক্তি, ইস্তেআযা (আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়া) সহ কতগুলো বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে। যদি কেউ বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল করে বারবার দুআটি পড়ে তবে হৃদয়ে এর কোনো প্রভাব পড়বে না এটা কি সম্ভব? এমনিভাবে দুআয়ে ইউনুস, হাসবুনাল্লাহ ইত্যাদির ব্যাপারেও ভেবে দেখুন সবগুলো একই রকম।
আর দুআগুলো অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে শুধু যে দুআ কবুল হওয়ার বিষয়টি সন্দেহযুক্ত হবে এবং দুআর ফল পাওয়া যাবে না তাই নয়; বরং এর পেছনে যে সময়টুকু যাবে তাও আপনাদের ক্ষেত্রে নষ্ট হয়েছে বলে গণ্য হবে। অথচ আপনি নিজেকে এবং আপনার সময়কে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইলমে দ্বীন এবং দ্বীনের খেদমতের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছেন। তো এখন যদি সবার মিলে দৈনিক প্রায় পঞ্চাশ ঘণ্টা সময় এভাবে নষ্ট করা হয় তবে কীভাবে আল্লাহর দরবারে এর হিসাব দেওয়া হবে? তাই এ আমলগুলোকে অধিক থেকে অধিকতর ফলপ্রসু করার চেষ্টা করা দরকার। ইলমের মধ্যে অভিনিবেশ সম্পর্কে জরুরি আলোচনার এক পর্যায়ে বলেছেন, বড়দের নিকট আমরা সর্বদা শুনে থাকি যে, ইলম অতি আত্মাভিমানী। এজন্য যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ নিজেকে তার জন্য উৎসর্গিত না করে সে তার দিকে ভ্রূক্ষেপ করে না। কিন্তু যেমনিভাবে বন্ধু ও প্রিয় মানুষদের ব্যাপারে চরম আত্মাভিমানী মানুষও সহজ হয়ে যায় তেমনি কেউ যদি ইলমের কাছে নিজের প্রকৃত অনুরাগ এবং গভীর অভিনিবেশ ও অনির্বাণ পিপাসার প্রমাণ দিতে পারে তাহলে দেখবেন এই আত্মাভিমানী ইলমও আপনার ব্যাপারে সহজ হয়ে যাবে। প্রকৃত অনুরাগী উলামা ও তালিবে ইলম, যারা ইলমের জন্য উৎসর্গিত তাদের কথা ও কলম থেকে যে তাৎপর্যপূর্ণ কথাবার্তা বের হয় তার রহস্যটিও এখানে লুকায়িত আছে। তাই ইলমের জন্য এমন অনুরাগ প্রমাণ করুন যেন ইলম আপনাকে তার প্রিয়পাত্র হিসাবে গ্রহণ করে।
১২/১২/২৭ হিজরী, মোতাবেক ০৩/০১/০৭ ঈ.
মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেবের রোযনামচা থেকে
জোহরের নামায মিরপুর ১২নং ত ব্লক মসজিদে পড়েছি। হযরত পাহাড়পুরী হুজুর (দামাত বারাকাতুহুম) সাধারণত সেখানে নামায পড়ে থাকেন। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করা। কারণ কয়েক দিন হয়ে গেল তাঁর খেদমতে উপস্থিত হতে পারিনি। তাঁকে মসজিদে না পেয়ে পেরেশান হলাম। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েননি তো? কারণ তিনি পারতপক্ষে মসজিদের জামাত ছাড়েন না। সাথে সাথেই খেয়াল হল হয়তো মুসলিম বাজার মসজিদে গিয়েছেন। কারণ উভয় মসজিদই নিকটে। যদিও ত ব্লকের মসজিদটি তুলনামূলক বেশি নিকটে এবং যাতায়াতও সহজ। আমি হযরতের বাড়ির সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। তিনি মুসলিম বাজার থেকে নামায পড়ে আসলেন। ভেতরে ডেকে নিলেন এবং তাঁর সামনে চকির উপর বসার নির্দেশ দিলেন। চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী হাসিমুখে খোঁজ খবর নিলেন। আমিও জানতে চেয়েছিলাম আলমারকাযুল ইলমী’র কথা (যা প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য হল, দারুল কুরআন তথা কুরআনের ঘরের ভিত্তিস্থাপন এবং ক্বারী, মুআল্লিম ও মক্তবের শিক্ষকদের তালীম তরবিয়ত) তাও শুনালেন। মসজিদের দেওয়াল পড়ে গেছে। এখন আবার তা নতুন করে করা হচ্ছে। শ্রমিক দিয়ে আর কত করা যায়। এখন যে সব তালিবে ইলম অথবা দ্বীনদার ভাইরা স্বেচ্ছায় যৎসামান্য শ্রম ও সময় পেশ করেন তাদের দ্বারাই অধিকাংশ কাজ নেওয়া হয়। এ পর্যন্ত অনেকের খেদমত গ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটি ও মৌসুমী ছুটিগুলোতে তালিবে ইলমরা চাল-ডাল নিয়ে ওখানে চলে যায়। কিছু সময় আশপাশে দাওয়াতী গাস্ত করে এবং চলমান কাজে সহযোগিতা করে। তার পর সময় মত এসে নিজ নিজ জায়গায় লেখা-পড়ায় লেগে যায়।
আরও বলেন, ইখলাস, একাগ্রতা ও উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে যিম্মাদারী আদায় করার মানুষ পাওয়া যায় না। হযরত (হাফেজ্জী হুজুর) রহ. বলতেন যারা অনাগ্রহে কাজ করে আমি তাদের দ্বারা কাজ নেই না।
একবার বললেন, আপনি তো সম্ভবত হযরত রহ. কে দেখেছেন মাত্র, কাছে বসার সুযোগ তো হয়নি? বললাম, জি, হাঁ। বললেন, যদি নিকট থেকে দেখতেন তাহলে বুঝতে পারতেন যে, কুরআনের শিক্ষা, কুরআনের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা এবং কুরআনের দাওয়াত ব্যাপক করার ব্যাপারে তাঁর অন্তরে কী পরিমাণ আগুন জ্বলতে থাকত। মজলিসটি বেশ দীর্ঘ ও ভাবাবেগপূর্ণ ছিল। অভ্যাস অনুযায়ী মাওলানা যফর আহমদ উসমানী, মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী রহ. সহ যেসব আকাবিরকে তিনি দেখেছেন তাঁদের কারো কারো অবস্থা খুব মজা করে শোনালেন। উস্তাযে মুহতারাম শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. ও মাওলানা আব্দুর রশীদ নোমানী রহ. সর্ম্পকে কিছু বিষয় জানতে চাইলেন।
সবশেষে যে কথা বারবার বলছিলেন তা হল, যে কেউই মারকাযুদ দাওয়ায় আসে, সে ফিকহ ও ইফতা পড়ুক বা উলূমুল হাদীস পড়ুক, তার দিল ও রূহের তাযকিয়ার প্রতি যেন দৃষ্টি দেওয়া হয়। বিশেষ করে উজুব কিবিরের মত ধ্বংসাত্মক আত্মিক রোগগুলোর সংশোধনের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা উচিত। দৈনিক অল্প সময়ের জন্য হলেও এ ব্যাপারে কিছু না কিছু কথা অবশ্যই বলবেন। যাতে এখান থেকে বের হলে কিছু নিয়ে বের হতে পারে।
মোহাম্মদপুরের পশ্চিমে নদীর ওপারে (যে নদীর উপর এখন ব্রিজ হচ্ছে) শ্যামলাপুরের যে জায়গা মারকাযের জন্য বায়না করা হয়েছে তার কথা জিজ্ঞেস করলেন। যখন শুনলেন ওই জমির সম্পূর্ণ দামই প্রায় বাকী তখন বললেন, প্রতিদিনই জোহরের পরের তালীম ও দুআর মজলিসে এবং ইশার পরের দুআর মজলিসে অবশ্যই বিশেষভাবে এ উদ্দেশ্য কিছু পড়ে দুআ করবেন।
প্রসঙ্গক্রমে বললেন, যে মসনদে দরসে হাদীসের জন্য আমার উস্তাদ (শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আজিজুল হক দামাত বারাকাতুহুম) বসেন সেখানে আমাকেও বসতে হয়। তাই আমি ছাত্রদেরকে বলে রেখেছি, আর না পারি আমার আসার আগে হুজুর যে চাদরে বসেন অন্তত সেই চাদরটা হলেও উঠিয়ে রেখো। আমি চলে গেলে পরে আবার বিছিয়ে দিও।
একটি কথা খুব গুরুত্ব দিয়ে বললেন যে, নিজের বংশ পরম্পরার পূর্বপুরুষদের পরিচয় যতটুকু জানা আছে সুন্দর করে লিখে বাঁধাই করে সংরক্ষণ করে রাখবেন এবং পরিবারের লোকদেরকেও তা হেফাজত করার অসিয়ত করবেন। এতে অনেক ফায়দা আছে। এমনিভাবে নিজের জন্ম তারিখ যদি পিতামাতা কেউ নোট করে থাকে সেটাও লিখে হেফাজত করে রাখবেন।
বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক স্কুলে পৌঁছার আগেই বইয়ের দোকানে
পর্যাপ্ত পরিমাণে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রিত হলেও বিভিন্ন স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীরা এই বই পাচ্ছে না এধরনের অভিযোগ বরাবরই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এবছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গত ১৪ জানুয়ারি দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক যা বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয় এখনও তা অনেক শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছয়নি। এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেছেন, প্রতিবারের মত এবারও দেশের ৬৪ জেলায় শিক্ষা অফিস থেকে চাহিদা জেনে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ৫ কোটি ১৮ লাখ কপি পাঠ্যপুস্তক ছাপা হয়েছে। এর বাইরে ২৫ লাখ কপি ছাপা হয়েছে বিক্রির জন্য। এরপরেও শিক্ষার্থীদের কাছে বই না পৌঁছার কী কারণ থাকতে পারে? দৈনিক ইনকিলাবের উক্ত রির্পোটে যেসব তথ্য উল্লেখিত হয়েছে তার সারকথা হল, দায়িত্বশীলদের দুর্নীতির কারণেই পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছুচ্ছে না। এনসিটিবি জেলা শিক্ষা অফিস ও উপজেলা শিক্ষা অফিসের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত করে একটি সংঘবদ্ধ দল বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক বাজারজাত করে থাকে। এর চেয়েও উদ্বেগজনক একটি তথ্য হল, বিভিন্ন স্কুলের এক শ্রেণীর শিক্ষকের ব্যাপারে জেলা শিক্ষা অফিস থেকে বলা হয়েছে, ওই সব শিক্ষকরাই নাকি শিক্ষার্থীদেরকে বাজার থেকে এই বইগুলো কিনতে বাধ্য করছে। তদ্রূপ অনেকে শিক্ষার্থীর তুলনায় চাহিদা বেশি দেখিয়ে বই নিচ্ছে এবং তার একটি অংশ বই বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। এই অভিযোগ যদি সত্য হয় তবে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এ ধরনের নৈতিকতাহীন শিক্ষকদের কাছ থেকে শিশুরা কেমন ধরনের নৈতিকতার শিক্ষা লাভ করবে? এসব দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত কঠিন ব্যাপার নয়। তবে তার পূর্বশর্ত দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত হওয়া। আপাতত এই অবস্থা সৃষ্টির শক্তিশালী কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।