মুহাররম ১৪২৮   ||   ফেব্রুয়ারি ২০০৭

সচল দর্পণে পরখ করি আপনার মুখচ্ছবি

মাথার চাঁদিতে জবজবে করে তেল মেখে ঘরের দাওয়ায় বসে পরচর্চা করার বঙ্গ সন্তানের যে পরিচয় কবিগুরু দিয়েছেন তা চারপাশের এত পরিবর্তন সত্ত্বেও একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। পরিবেশ ও পরিপার্শে¦র আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সেই চাঁদি ভেজা তৈল মর্দনের রেওয়াজ এখন আর নেই। এখনকার গ্রামগঞ্জের ললনাদের মাথায়ও শোভা পায় শ্যাম্পুকৃত রেশম কোমল অগাধ কুন্তল-রাশি। গলা-পিঠ ও বাহুমূলের সৌন্দর্য সম্পর্কে আজকের পল্লিগাঁয়ের মেয়েরাও যথেষ্ট সচেতন। সরল পল্লিবালার লাজ-নম্রতার স্থলে এসেছে শানিত বাক্য, শানিত দৃষ্টি এবং শানিত অঙ্গ সঞ্চালন। অতএব কবিগুরুর সেই পরিপার্শ্ব আজ খুঁজে পাওয়া বড় দুষ্কর। কিন্তু বাইরের এত পরিবর্তনের পরও ভিতরের মানুষটির খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। ওটা বলা যায় প্রায় অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। অথচ ওটারই পরিবর্তন বেশি দরকার ছিল। পরচর্চার পরিবর্তে প্রয়োজন ছিল আপনচর্চার। আপনার বাহিরকে নিয়ে যার এত আয়োজন, ভিতরকে নিয়ে তার কিছুমাত্রও উদ্বেগ থাকবে না এটা কেমন কথা। এই উদ্বেগ থাকা দরকার। এটা থাকলেই কল্যাণ। আপনার ভিতরকে সজ্জিত করার চিন্তা যদি থাকে তবে পরকে দিয়েও আপনচর্চা হতে পারে। একটু খোলাসা করে বলি। ধরা যাক এক বাড়িতে একজন নতুন মানুষ এসেছে। দেখা গেল, সবাই তার বিভিন্ন আচার-আচরণের বিশ্লেষণে ব্যস্ত। ফলাফল-কখনো কিছুটা ক্ষোভ, কিছুটা শ্লেষ, কখনো বা নিম্নকন্ঠের উত্তেজিত বাক্যালাপ আর চোখ মুখের তির্যক চাহনি। তার এই আচরণটি মোটেই উচিত হয়নি। বউ ওই কথাটা ওভাবে না বললে কি চলত না? এই সহজ কথাটাও যদি মাথায় না আসে তাহলে কীভাবে চলে ইত্যাদি। বিশ্লেষণের এই ধারাটি কি সামান্যও কল্যাণজনক। এভাবে কি কোনো পক্ষের কোনো উপকার হয়? হয় না। এতে বরং দূরত্বই বৃদ্ধি পায়। আর বৃদ্ধি পায় অন্তর্জ্বালা।

বিশ্লেষণের আরেকটি ধারা রয়েছে। সেটি আয়ত্ত করতে কিছুটা অনুশীলন প্রয়োজন। আর কিছুটা স্থিরতা, ধৈর্য ও সংযম প্রয়োজন। তবে আয়ত্ত করা গেলে এর উপকার অনেক। একটি আরবী বাক্যে ধারাটিকে প্রকাশ করা হয়েছে এভাবে- السعيد من وعظ بغيره অর্থাৎ সৌভাগ্য তার অধিকারে আসে যে অন্যের দ্বারা শিক্ষা গ্রহণ করে, অন্যের আচরণগুলোর দর্পণে নিজের মুখচ্ছবিকে পরখ করে নেয়। সেই অপছন্দের আচরণগুলোকে নিন্দা-সমালোচনার কাজে ব্যবহার না করে আত্ম-সংস্কারের কাজে ব্যবহার করে। অন্যের যে আচরণটি বিরক্তিকর বোধ হল সে আচরণটি আমার থেকে প্রকাশ পেলে তা-ও অন্যের কাছে অনুচিত মনে হবে এবং তার মনে আমার প্রতি বিরক্তি সৃষ্টি হবে। অতএব আমাকে এই আচরণ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। বিশ্লেষণের এই ধারাটিই উপরোক্ত আরবী বাক্যটির মর্মার্থ।

বিশ্লেষণের এই পদ্ধতিটির উপকার কি শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে? না, বরং এটি অপরের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করে। সহনশীলতার একটি নিজস্ব ভাষা আছে। সে ভাষা আবেদন সৃষ্টি করে ধীর গতিতে, তবে খুব গভীরভাবে। অনেক সময় দেখা যায়, হাজার বলেও যে অভ্যাস পরিবর্তন করা যায়নি, দুচারবারের না-বলাতেই তাতে পবিবর্তনের আভাস দেখা দিয়েছে।

আত্মসংস্কারের এই ব্যাপারটি শিল্পীর শিল্প কর্মের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। একটি শিল্পকর্মকে নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে হলে শিল্পীকে বেশ দীর্ঘ একটি সময় অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে কাজ করতে হয়। অধৈর্য হওয়া কিংবা তাড়াহুড়া করার সুযোগ থাকে না। শিল্পকর্মটি চূড়ান্তরূপে সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত নিরীক্ষণ ও সংশোধনের পালা চলতে থাকে। এক সময় তা পূর্ণতা লাভ করে। তদ্রূপ আত্ম-দর্শনের এই অভ্যাস গড়ে তুলতেও প্রয়োজন অটল সংকল্প এবং নিরবচ্ছিন্ন কর্মপ্রয়ণ। ভুল ও সংশোধনের ধারা এখানেও চলমান থাকবে। স্বভাবের স্বাভাবিক প্রেরণায় দৃষ্টি বারবার অন্যের দিকেই উঠতে চাবে কিন্তু যতবার এ অবস্থা সৃষ্টি হবে ততবারই দৃষ্টিকে নিজের দিকে নিবদ্ধ করতে হবে। এক সময় আত্ম-দর্শনই অভ্যাসে পরিণত হবে। বাহ্যিক কোনো রোগ-শোকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দেখলে যেমন অন্তর থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার দুআ বের হয়ে আসে তদ্রূপ কারো কোনো মন্দ স্বভাব বা অনুচিত আচরণ দৃষ্টিগোচর হলেও সে দৃষ্টি তৎক্ষণাৎ নিজের দিকেই ধাবিত হবে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার দুআ মুখে আসবে। যে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত তার অন্যদিকে নজর দেওয়ার ফুরসৎ কোথায়? আর অন্যের ভুল ত্রট্টটিগুলোকে যে ব্যক্তি নিজের সংশোধনের উপকরণ হিসাবে গ্রহণ করতে পারে সেই যে প্রকৃত বুদ্ধিমান তাতে কি সন্দেহের কোনো অবকাশ আছে?

 

 

advertisement