একটি ভয়াবহ ভুল
কুরবানীর ঈদ কি জবাইয়ের উৎসব?
দ্বীনী ইলমের ব্যাপক চর্চা না থাকার কারণে কোনো কোনো বে-দ্বীন মানুষ অজ্ঞতাবশত কিংবা জেনেশুনে এই মারাত্মক ভ্রান্ত কথা বলে থাকে যে, কুরবানীর ঈদ পশু জবাইয়ের উৎসবের নাম। এ জন্য তাদের ধারণামতে সেই দিনের আনন্দ হল পশু জবাই করার আনন্দ এবং মুসলিমদের এই উৎসবও ভিন জাতির নানা উৎসবের মতই একটি উৎসব। যেমন- হিন্দুদের রয়েছে বলিদান উৎসব (নাউযুবিল্লাহ)। অথচ ‘কুরবানীর ঈদ’ শব্দেই এই ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন বিদ্যমান রয়েছে। কেননা কুরবানীর ঈদ শব্দটির অর্থ হল আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের ঈদ। এটি এমন ঈদ, যে ঈদে মানুষ আল্লাহ তাআলার আদেশে আল্লাহ তাআলার দেওয়া রিয্ক (গৃহপালিত পশু) আল্লাহ তাআলার নির্দেশিত পন্থায় আল্লাহর দরবারে নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে পেশ করে থাকে। তাহলে এই উৎসব পশু জবাইয়ের উৎসব নয়; বরং আল্লাহর দরবারে নৈকট্য অর্জনের উপকরণ পেশ করতে পারার সৌভাগ্য অর্জনের আনন্দ। এটি গোশত ভক্ষণের উৎসব নয়; বরং খালেস আল্লাহর ইবাদত।
কুরবানী পেশ করার পদ্ধতি আল্লাহ তাআলা এই উম্মতকে এই শিখিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলার দানকৃত গৃহপালিত বিশেষ প্রকারের বিশেষ বয়সের এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যের হালাল পশু নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত পন্থায় শুধু তাঁর হুকুম পালন করার উদ্দেশ্যে এবং তাঁরই নৈকট্য অর্জনের জন্য তাঁর নামে জবেহ করা। এরপর এই পশুর গোশত-চামড়া তাঁর নির্দেশিত পন্থায় ব্যবহার করা।
কুরবানীর এই হাকীকত সামনে থাকলে ইসলামী ঈদ এবং ভিন জাতির উৎসবের মধ্যে নিুোক্ত মৌলিক পার্থক্যগুলো একদম পরিষ্কার হয়ে সামনে আসে।
১. অন্যান্য জাতির উৎসব কোনো বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে উদযাপিত হয়, কিন্তু ইসলামী ঈদ সম্পৃক্ত হচ্ছে ইবাদতের সঙ্গে। যথা ঈদুল ফিতরের সম্পর্ক রমযানের রোযার সঙ্গে এবং ঈদুল আযহার সম্পর্ক হজ্বের সঙ্গে। হজ্বের বরকতপূর্ণ সময়ে আল্লাহ তাআলা হাজ্বীদের জন্য এবং তাদের অসিলায় অন্যদের জন্যও মাগফিরাতের দরজা উন্মুক্ত করেন। এই মাগফিরাতের মওসুমে নৈকট্য অর্জনের আমল হল কুরবানী।
২. অন্যান্য জাতির উৎসবগুলো তাদের নিজেদের বানানো, কিন্তু ইসলামী ঈদ ওহীর শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত।
৩. অন্যদের উৎসব কর্মসূচী ও কর্মপন্থার দিক থেকে শিরক ও বিদআতের সমষ্টি অথচ ইসলামী ঈদের ভিত্তিই হল নির্ভেজাল তাওহীদ ও ইত্তিবায়ে সুন্নত। কুরবানীর পশু জবেহ করার আগে কুরবানীদাতার অন্তর থেকে উৎসারিত হয়-
اِنِّیْ وَجَّهْتُ وَجْهِیَ لِلَّذِیْ فَطَرَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ حَنِیْفًا وَّ مَاۤ اَنَا مِنَ الْمُشْرِكِیْنَۚ
অর্থাৎ ‘আমি সকল ভ্রান্তি থেকে বিমুখ হয়ে ওই সত্ত্বার অভিমুখী হলাম যিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। আর আমি শিরককারীদের অন্তর্ভুক্ত নই। নিঃসন্দেহে আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের পালনকর্তা।’ -সূরা আলেইমরান
এরপর বলে, اللهم منك ولك بسم الله والله اكبر ইয়া আল্লাহ্ আপনার দেওয়া নিয়ামত থেকে কুরবানী করছি। আল্লাহর নামে কুরবানী করছি এবং আল্লাহ সবচেয়ে বড়। এরপর জবেহ সমাপ্ত হওয়ার পর বলে, اللهم تقبل مني ‘ইয়া আল্লাহ, আমার পক্ষ থেকে এই কুরবানী কবুল করুন।
৪. অন্যদের উৎসবগুলো রীতিসর্বস্ব; অথচ ইসলামী ঈদ হল অনেকগুলো নেক আমলের সমষ্টি। যেমন, ঈদুল আযহাতে কুরবানীর পশু জবেহ করা একটি ইবাদত, এটি কোনো ভিত্তিহীন রেওয়াজ নয়। আবার এর উদ্দেশ্য গোশত খাওয়াও নয়। গোশত তো মানুষ বারো মাসই খেয়ে থাকে। যে কোনো হালাল পশু আল্লাহর নামে জবেহ করা হয় তা আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের জন্য হালাল করেছেন। হাদীস শরীফে এসেছে, যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের আগে পশু জবেহ করে তা গোশত খাওয়ার কাজে আসতে পারে কিন্তু তা نسك কুরবানী হিসেবে গণ্য হবে না। কুরবানী হওয়ার জন্য ঈদের নামাযের পর কুরবানীর নিয়তে জবাই করতে হবে। যদি কুরবানী একটি ইবাদত না হত; বরং গোশত ভক্ষণের উৎসব হত তবে এর জন্য এত মাসাইল এবং এত নিয়ম কানুুন যথা, নির্ধারিত সময়, বিশেষ ধরনের, বিশেষ বৈশিষ্ট্যের পশু এবং অন্যান্য মাসাইল ইত্যাদির প্রয়োজন হত না এবং এর জন্য ইখলাসেরও কোনো প্রয়োজন হত না।
অতএব তাওহীদ ও সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শেখানো ঈদুল আযহা ও কুরবানীকে যারা হিন্দুদের বলিদান উৎসবের মতো একটি শিরক ও কুসংস্কারভিত্তিক উৎসব মনে করে সে প্রকৃতপক্ষেই একজন মুলহিদ ও যিন্দীক ব্যক্তি। এ ধরনের মানুষের খালেস তওবা করে সহীহ ইলম অর্জন করা এবং ঈমান ও আকীদা ঠিক করা ফরয।